#কৌমুদিনী
#তাফসিয়া_মেঘলা
#পর্ব ২০
৩৯
আজ ফের আকাশে মেঘ করেছে ঘন কৃষ্ণ বর্ণের মেঘ যে কোন সময় বর্ষণ হয়ে ঝরবে৷ বর্ষণের পূর্ব মূহুর্তটা একটু অন্যরক হয়৷ অদ্ভুত সৌন্দর্য বিরাজ করে ধরনিতে৷ স্নিগ্ধ বাতাস মন কে আরো স্নিগ্ধ করে দেয়৷
মাটির গন্ধ হীম শীতল পরিবেশ প্রেমপূর্ণ করে তুলে সব কিছু৷ চৈত্রের আজ শেষ তবে কি বৈশাখের আগে কাল বৈশাখী হবে নাকি? নাকি ঘন অম্বুদের আঁধারে ছেয়ে থাকা অম্বর কোনো কিছুর বার্তা দিচ্ছে? কঠিণ বার্তা?
মিফতার কক্ষের বড় অলিন্দের কর্ণার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রিকা মুখ খানায় গম্ভীরর্য বিস্তৃত৷ জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে মহলে দেখে চমকায়নি এ নিয়ে প্রশ্ন করেনি কোন৷ এহেন কান্ডে বেশ অবাক হয়েছিলো শ্রেয়াস অন্য কেউ হলে নিশ্চিত হাজার টা প্রশ্ন করে বসতো? কে নিয়ে এলো? কেন নিয়ে এলো? কিন্তু মেয়েটা যেন জানতো ওকে এখানেই নিয়ে আসা হবে৷
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলো ক্ষানিক্ষণের মাঝেই চন্দ্রিকাও কিছুটা সুস্থ অনুভব করছে শ্রেয়াস ফের ব্যা’ন্ডে’জ করে দিয়েছিলো সন্তপর্ণে৷ কিছু কাজে তাকে বাইরে যেতে হয়েছিলো৷ বেশক্ষানিক্ষণ পর চন্দ্রিকা আর মেহনুবা নিজেদের মাঝে কি নিয়ে যেন কথা বলছিলো তখন শ্রেয়াস ফের আসে এ কক্ষে পর চন্দ্রিকা যখন মেহনুবার সাথে কথা বলছিলো তখন শ্রেয়াস তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তাতে কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই তারা যেন দেখেইনি শ্রেয়াস কে৷ ওর আসায় কারো ব্রুক্ষেপ না দেখায় শ্রেয়াস এতে বেশ বিরক্ত হয়েছে৷ ওদের কথার মাঝেই হঠাৎই শ্রেয়াস শক্ত কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় চন্দ্রিকার দিকে,
” আপনার গর্দানে গু’লি কি করে লেগেছে চন্দ্রাবতী? ”
চন্দ্রিকা উত্তর দেয়নি৷ সে যেন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনই মনে করেনি৷ উহু বলার প্রয়োজন মনে করেনি বললে ভুল হবে সে যেন শ্রেয়াসের কথা শুনেইনি! তার কর্ণপাত হয়নি৷ চন্দ্রিকা এমন এক রুখে তা শ্রেয়াসের জানা তবে গু’লির কথা শুনে মেহনুবা অবাক হয়নি সে ও স্বাভাবিক ভাবেই চন্দ্রিকার সাথে বলছিলো৷ চন্দ্রিকাকে অচেতন নিয়ে আসার পর যতটা উত্তেজিত হয়েছিল গু’লির কথা শুনে ততটা বিস্মিত হয়নি৷
ছেলের কথা যেন তারো কানে যায়নি৷ তার মা কি জানে? না জানলে স্বাভাবিক কি করে আছে? এতোক্ষণে বিস্ময় হয়ে শ খানেক প্রশ্ন করার কথা ছিলো৷
শ্রেয়াসের এতে রাগ বারে! এ দু রত্তির মেয়ে নাকি তাকে উপেক্ষা করছে? অন্য কেউ হলে এতোক্ষণে তাকে নিরুদ্দেশ করে দিতো৷ আর তার মা? সে ও শুনছেই না এতো আস্তে কথাটা বলেনিতো সে?
শ্রেয়াস রাগ নিয়ে উচ্চ কন্ঠে ফের প্রশ্ন ছুড়লেন,
” চন্দ্রিকা আমি কিছু বলছিতো? শুনতে পাননি আপনি? গু’লি লাগলো কি করে?”
শ্রেয়াস আজ প্রথম চন্দ্রিকাকে পূর্ণ নামে ডাকলো তবে রাগ নিয়ে,
চন্দ্রিকা এবার বিরক্ত হলো কিঞ্চিৎ , সাথে মেহনুবাও মুখে সে বিরক্তির ভাব দু’জনেই ফুটিয়ে তুললো৷ মেহনুবা বিরক্ত নিয়ে বললো,
” আহ বাবা চেচাচ্ছিস কেন?”
শ্রেয়াস ধাতস্থ কন্ঠে উত্তর দিলো,
” আমি একটা প্রশ্ন করছি মা উত্তর দিচ্ছে না কেন? হোয়াই?”
মেহনুবা কিছু বললে এর আগেই দাসী এসে তাকে ডেকে নিয়ে যায়৷
শ্রেয়াস চন্দ্রিকাকে ফের প্রশ্ন করবে এর আগেই চন্দ্রিকা বিরক্ত নিয়ে ‘চ’ এর মত শব্দ করে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
” আপনার কি মনে হচ্ছে না আপনি আমায় নিয়ে একটু বেশি কৌতুহলতা দেখাচ্ছেন? আমায় নিয়ে কেউ কৌতুলতা দেখাক আমি তা চাই না৷”
শ্রেয়াস চন্দ্রিকার কথায় রেগে যায়, এইটুকু মেয়ে বেশি বড় বড় কথা বলছে না?
শ্রেয়াস রাগ টা কাটলো না বরং বাড়লো তবুও ধাতস্থ কন্ঠে বললো,
” কৌতুহলতা নয়৷ আমার দায়িত্ব এটা ভুলে যাবেন না এ রাজ্যের শাসক আমি আমার দায়িত্ব এটা৷ মেয়ে আপনার সাহস দিন দিন বাড়ছে আপনার মনে হচ্ছে এটা? বেশি বারবেন না পাখনা কেঁ’টে দিবো৷
আর রইলো আপনার ওই গু’লির কথা? তা আমি নিজেই বের করে নিবো তখন তা মোটেও আপনার জন্য সুখকর হবে না৷”
চন্দ্রিকা উত্তরে বাঁকা হাসলো৷ যা শ্রেয়াসের মোটেও পছন্দ হলো না৷ চন্দ্রিকার হাসি তার পছন্দ না৷ একটুও না৷
শ্রেয়াস যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে এর আগেই চন্দ্রিকা কেমন অদ্ভুত কন্ঠে বললো,
” আমায় ঘাটতে যাবেন না পরে দেখা যাবে আমার মায়ায় ফে’সে গেছেন৷ এ মায়া জাল কিন্তু তীব্র রৌজাফ শ্রেয়াস…….৷ ”
চন্দ্রিকার দিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর মত তাকালো শ্রেয়াস৷ মায়ায় তো সেই কবেই জরিয়েছে বের হতে চাইছে কে? সে তো জরাতে চায় গভীর, নিবিড়, প্রগাঢ় ভাবে৷
তবে রহস্যময়ীর রহস্য সে ভেদ করবেই৷ এর পর আর দাঁড়ায়নি শ্রেয়াস বড় বড় পা ফেলে বেড়িয়ে গিয়েছিলো৷ এর পর অনেকটা সময় কেঁ’টেছে তখন থেকেই চন্দ্রিকা অলিন্দে দাঁড়িয়ে ছিলো৷
প্রাণ আর প্রণয় কে আনেনি শ্রেয়াস, তার এখন ও বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না আর গেলেও ফারহান নিশ্চয়ই ঝা’মেলা করবে? তাই আর গেলো না মিফতার বিছানায় এসে চুপটি করে গা এলিয়ে দিলো৷
কক্ষটা চন্দ্রিকার অনেক প্রিয়, এ কক্ষ জুরে আছে মিফতার স্মৃতি৷ বিছানাটায় কেমন মিফতার শরীরের ঘ্রাণ রয়ে গেছে৷ অজস্র স্মৃতি গুলো ফের তারা করছে বারংবার৷ এ কক্ষের দেয়ালে দেয়ালে ক্যামেরাবন্দি হয়ে আছে ওদের খুনশুটির মূহুর্ত৷
এই বুঝি মিফতা বললো,
“চন্দ্রাবতী আমাকে ছাড়া তুমি থাকছো কি করে?”
এই বুঝি এসে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে বললো,
” চন্দ্রাবতী মিফতা তোমায় ভালোবাসে৷ ”
কঠোর চন্দ্রিকার নেত্রকোণ জুরে দু এক ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো৷ মায়ের পর তার সব চেয়ে কাছের যদি কেউ থেকে থাকে তাহলে তা মিফতা আর মেহনুবা৷ মায়ের থেকে বেশি খেয়াল রাখতো মিফতা তার৷ যে মিফতা বিয়ের কথা শুনে কেঁদে কেঁ’টে ভাসিয়ে বলেছে,
” চন্দ্রাবতী কে আমার সাথে নিয়ে যাবো৷ ”
সে মিফতা ওই অন্ধকার ঘরটায় আছে কি করে? কষ্ট হচ্ছে না? মেয়েটা ওকে পাষাণ বলতে বলতে নিজে পাষাণের প্রমাণ দিলো? পাষাণ মেয়েটা ওকে ছাড়া ওই অন্ধকার ঘরটায় ভালো আছে বুঝি?
৪০
আয়াশ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে কি করবে নিজেই বুঝতে পারছে না৷ নবাব কে এ কথা এখন জানানো উচিত নাকি সে বুঝতে পারছে না৷
আচ্ছা ফারহানের সাথে কথা বলে প্যাথলজি ল্যাবে ঘুরে এসে কি জানাবে?
এখন জানানো উচিত নয় কি? পরে জানালে যদি রেগে যায়? বা সে যদি এমনি কোন ভাবে জেনে যায় তাহলে নিশ্চিত তার চাকরির ইতি ঘটবে?
তাই ভেবেই নিলো কাল যাবে আজ আকাশে মেঘ করেছে তীব্র বাতাস বইছে এ আবহাওয়য় বের হওয়া উচিত না৷
আশরিফ কে পাওয়া যায়নি হসপিটাল থেকে শুরু করে মর্গ কিছুই বাদ রাখেনি তাহলে গেলোটা কোথায় আশরিফ? চেক পোস্ট বসানো হয়েছে শহরে শহরে প্রতিটা বাস স্টেশন এ ও খবর নেওয়া হচ্ছে কিন্তু কোনো খবর মিলেনি৷ আশরিফ গেলো টা কোথায়? আদৌ ঠিক আছে তো? তার চাকরি জীবনে এমন প্রথম হলো যে মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে৷ এ কেসের শেষ অবদি যেতে পারবে তো?
এর মাঝে ভুলেই গিয়েছিলো রায়হানের কথাটা৷ আচ্ছা শাহনেওয়াজ এর কেন মনে হলো রায়হানের খু’ন হয়েছে?
নাকি এটা উছিলা মাত্র? এটা উছিলা করে পালাতে চেয়েছিলো মাঝে আশরিফ তাকেই মেরে দিলো৷ আচ্ছা সত্যি কি উছিলা? কিন্তু রায়হানকে কে আর কেন মারবে?
তবে এটা ভাবনার বিষয় গ্রামের ভিতরের রাস্তা দিয়ে কেন কোনো ট্রাক যাবে?
তাহলে কি শাহনেওয়াজ অন্য কিছু জানতো? কে এসবের মূলে রয়েছে? আশরিফ? নাকি অন্য কেউ?
এতো এতো প্রশ্নের উত্তর কি মিলবে? নাকি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ফের কোন রহস্য বেরিয়ে আসবে?
৪১
তখন গধুলি পেরিয়েছে মেঘ আসবে বলেও আসেনি অবাধ্য অম্বুদ এখনো নিজের রাজত্ব চালাচ্ছে ওই অম্বরে৷ মেঘ তবে আজ বর্ষন হয়ে ঝরবে না? তবে এতো তাল তামাশার মানে কি? মেঘ চন্দ্রিকা নামক রহস্যময়ী নারীর ন্যায়৷ তাকে মন্দ ও লাগে না তার এমন বেখেয়ালিপানা ভালো ও লাগে না৷
মেয়েটাকে তার ভালো লাগে না তবে এই অপছন্দের মেয়েটাই তার সবটা জুরে বিরাজ করছে৷ এ মেয়ে বড়ই অদ্ভুত ওই চাঁদের মতই যাকে ধরাও যায় না আবার ছাড়াও যায় না৷ ‘চন্দ্রিকা’ মানে জ্যোৎস্না মেয়েটাকি জ্যোৎস্না ছড়ায়?
অপছন্দ করলেও এ মেয়েকে শ্রেয়াসের লাগবে৷ এর অবাধ্যপানা থাকলেও একে শ্রেয়াসের লাগবেই লাগবে৷
প্রণয় আর প্রাণের মিষ্টি ডাকে চন্দ্রিকার নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটলো৷ তবে সে বিরক্ত হলো না সে অবস্থায় উষ্ঠ কোণে হাসি ফুটলো৷
যা অলিন্দের গোল কাঠের চেয়ারে বসে থাকা শ্রেয়াসের চোখ এড়ালো না৷ মেয়েটা হাসছে অন্তকরণে অদ্ভুত অনুভূতি গুলো উপচে পরতে শুরু করলো৷ মেয়েটা অল্প হাসলেও সারা মুখ হাসে কিন্তু মেয়েটার এই হাসি সবসময় দেখা যায় না৷ হাসে কেমন রহস্যময় হাসি হাসে সর্বদা৷
চন্দ্রিকা এবার উঠলো প্রাণ প্রণয় কে খুজলো তখনই শ্রেয়াসের সামনে দেখে মুখটা ছোট হয়ে গেলো৷ শ্রেয়াস এখানে কি করছে? লোকটা ফের এই পাখি দুটো কে নিজের কাছে রেখেছে প্রতিবার কোন না কোন ঝামেলা হয়ই৷
না এবার ঝামেলা করার শক্তি নেই৷ কঠোর চন্দ্রিকা নরম হয়েই গুটি গুটি পায়ে শ্রেয়াসের সামনে এগোলো তা দেখে শ্রেয়াস বাঁকা গেসে পাখিদের খাঁচাটা নিজের হাতে উঠালো৷ তাতে পাখি গুলো যেন তেঁতে উঠে আরো চেচানো শুরু করলো৷ চন্দ্রিকা ধাতস্ত হয়েই শ্রেয়াসের সম্মুখে গেলো অতঃপর শান্ত মোলায়েম কন্ঠেই বললো,
” ওদের দিন আমায় রাজকুমার৷ ”
“বিনিময়ে কি দিবেন?”
শ্রেয়াসের এহেন অদ্ভুত প্রশ্নে হকচকালো, ভরকালো চন্দ্রিকা৷ তার পাখি ওর কাছ থেকে নিতে হলে আবার কি চাই? কি অদ্ভুত লোক৷
শ্রেয়াসের প্রতিউত্তরে চন্দ্রিকা ফের ধাতস্থ কন্ঠেই প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে বললো,
“বিনিময়?”
শ্রেয়াসের উষ্ঠ কোণে ফের হাসি ঝুললো৷ বাঁকা হাসি! অতঃপর বললো,
” বিনিময়ে আমার আপনাকে চাই…..”
চলবে,