কৌমুদিনী পর্ব-২১

0
1522

#কৌমুদিনী
#তাফসিয়া_মেঘলা
#পর্ব ২১

৪২
অতঃপর নতুন বছরের সূচনা হলো বিষাদ মাখা এক সংবাদে৷
“মিফতার খু’ন৷ ”
যেটাকে তারা স্ট্রোক ভেবে এসেছে সেটা খু’ন কি করে? খু’নই যদি হতো রিপোর্টে স্ট্রোক আসলো কেন? ফারহান কিছু করেনি তো? না ফারহান কি করে কি করবে? প্যাথলজি ল্যাবে তো ফারহান ছিলো না তাহলে?
আয়াশ মনের দিক দিয়ে বেশ শক্ত হলেও এ কথা আহসান মীর কে জানাতে তার বুক কে’পেছে৷ ভেবেছে সে ঠিক থাকবে তো? আহসান মীর ঠিক না থাকলে এ রাজ্যের মানুষের কি হবে? তার ভরসাতেই সুবিধাবঞ্চিত মানুষ গুলো বেঁচে আছে৷ সে ভে’ঙে পরলে হবে নাকি? কিন্তু আয়াশের ধারনা সম্পূর্ণ ভুল প্রমানিত হয়েছে৷ আয়াশ যখন এসে বললো,
“রাজকুমারী মিফতার সাধারণ মৃ’ত্যু ছিলো না নবাব৷ রাজকুমারী কে খু’ন করা হয়েছিলো৷ ”
আয়াশ তখনো শাহনেওয়াজ এর কথা জানায়নি৷ আহসান মীর এ কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ চাপ বলেছিলো অতঃপর কিছুক্ষণ বাদে গম্ভীর্য নিয়েই শুধু বলেছিলো,
“মেহনুবা যেন না যানে আয়াশ৷”
অতঃপর ফের চুপ ছিলো৷ উপর উপর গম্ভীর থাকলেও পরিশেষে সে বাবা তো? তারো কষ্ট হয়৷ তার গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছিলো না কণ্ঠনালীতে আটকে ছিলো যেন৷ ফের কিছুক্ষণ পর কম্পিত কন্ঠে বলেছিলো,
“কাউকে ছাড়বে না আয়াশ৷ কাউকে না আমার মিফতাকে যারা খু’ন করেছে৷”
এ কন্ঠ আয়াশের মনে বেশ দাগ কাটে৷ মানুষ টা নিজেকে শক্ত রাখার প্রাণ প্রণ চেষ্টা চালাচ্ছে৷ নিসন্দেহে ওনাকে একজন চমৎকার মানুষ বলা যায়৷ ফের সে একজন শক্ত মানুষের পরিচয় দিলো এর সাথে এ বোঝালো সবার মত তার ও একটা কোমল হৃদয় আছে যা সে এই কঠিনতার মাঝে লুকিয়ে রাখে৷
আয়াশের তখনো বুক কা’পছে শাহনেওয়াজ এর কথা বলতে৷ শাহনেওয়াজ কে সে নিজের হাতে বড় করেছে মানতে পারবে তো এ কথা?
আয়াশ আর চুপ থাকলো না৷ শক্ত হলো ধাতস্থ কন্ঠে কথাটা বলেই দিলো,
” রাজকুমারী কে যে খু’ন করেছে সে আর নেই নবাব৷”
আহসান মীর এবার বিস্মিত হলো৷ আয়াশ ফের মুখ খুললো,
” শাহনেওয়াজ খু’ন করেছে রাজকুমারীকে নবাব৷ ”
আয়াশের কথায় বিস্মিত হল, চমকালো৷ সে কি ভুল শুনছে ভাবলো? শাহনেওয়াজ? কিন্তু কেন? না ভুল হচ্ছে কোথাও আয়াশের৷ না কেন শাহনেওয়াজ মিফতাকে খু’ন করতে যাবে?
আহসান মীর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বলে,
” কি বলছো? ভুল হচ্ছে কোথাও তোমার৷ ”
আয়াশ তপ্ত শ্বাস ফেলে মোবাইলের রেকোর্ড টা শোনালো৷ তা শুনে আহসান মীর স্তব্ধ, বিমূঢ় হয়ে বসে রইলো৷ সে যেন আজ নিজের কান কেই বিশ্বাস করতে পারছে না৷নিরবতা, নিরবাচ্ছন্ন, নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেলো চারোপাশ৷ থমথমে হলো সব কিছু৷ আহসান মীরের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না কি চলছে তার মনে৷
এমন একটা কথায় কি আদৌ ঠিক থাকা যায়? শাহনেওয়াজ কেন এমনটা করলো কি এমন ক্ষোভ ছিলো যে তার কলিজাটাই ছিনিয়ে নিলো? কি তার কমতি পরে গেলো? শাহনেওয়াজ, ফারহান, কে তো কখনো মিফতা আর শ্রেয়াস থেকে আলাদা দেখেনি৷ তাহলে? কিসের রাগ ছিলো তার মেয়েটার উপর? রায়হানের খু’নের কথা যখন বললো তখন তো স্বাভাবিক দেখলো৷ শাহনেওয়াজ এর এমন একটা কাজ করতে হাত কাঁ’পেনি? বুক কা’পেনি? আচ্ছা রায়হান কে ও কি শাহনেওয়াজ খু’ন করেছে? না খু’ন করলে নিশ্চই নিজে এসে বলতো না? মিফতাকে যদি শাহনেওয়াজ খু’ন করে থাকে আশরিফ কি সত্যি তবে শাহনেওয়াজ কে খু’ন করেছে?

অদ্ভুত এই দুনিয়া কেউ বিশ্বাস যোগ্য নয়৷ কাউকে বিশ্বাস করা যায় না৷ কেউ কারো বিশ্বাসের মূল্য রাখে না৷ সবাই স্বার্থপর, হয়তো স্বার্থে আ’ঘাত লেগেছে তাই এমন করলো? ‘দুধ কলা দিয়ে কালসাপ’ প্রবাদ বাক্যটা মিলে গেলো না? এই অদ্ভুত দুনিয়ার কারসাজি বোঝা বড়ই দায়৷ এর পরে মানুষকে আর বিশ্বাস করা যাবে? সে তো ভুলেও আর করতে পারবে না৷

বুকের বা দিক টা তার অদ্ভুত ব্যাথা করছে৷ মিফতার হাস্যজ্জল মুখটা বার বার চোখের সামনে ভাসছে৷ মেয়েটাকে কি ভাবে মা’রলো?
তার রাজকন্যা যে খু’ন করা হলো সে আঁচ পর্যন্ত পেলো না? সে এক ব্যার্থ বাবা হিসেবে নিজেকে আখ্যায়িত করলো৷ হ্যাঁ ব্যার্থই তো, বাচাতে পারলো না মেয়েটাকে? কেমন বাবা সে?
না পারলো এ রাজ্য সঠিক ভাবে সামলাতে, না পারলো ভালো বাবা হোতে৷ আজ তার মনে হচ্ছে তার জীবনটা ব্যার্থতা দিয়ে ঘিরে গেলো৷ ব্যার্থ সে৷

আয়াশ ভাবলে একা থাকতে দেওয়া উচিত তাই কিছু বললো না শুধু অনুমতি নেওয়ার জন্য বললো,
“আমি যেতে পারি নবাব?”
আহসান মীর উত্তর দিলো না৷ আয়াশ বুঝলো সে হয়তো নিজের মাঝে নেই৷ এহেন একটা খবর শুনেও যে শক্ত হয়ে বসে আছে লোকটা৷ আয়াশ এবার যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো৷ ঠিক তখনি আহসান মীর বাধ সেধে শক্ত কন্ঠে বলেন,
“শ্রেয়াস যেন না জানে ৷ ”
আয়াশ ফের পিছনে ঘুরে সম্মতি জানালো৷ যাওয়ার অতঃপর জন্য পা বাড়ালো৷ সত্যি শ্রেয়াস কে না জানানোটাই শ্রেয়৷ শাহনেওয়াজ আর মিফতা দু’জনেই প্রাণ ছিলো শ্রেয়াসের৷

মহল থেকে বের হওয়ার আগেই শ্রেয়াসের সাথে দেখা হয়ে গেলো আয়াশের৷ শ্রেয়াস এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো আয়াশের পানে,
” আরে এস আই যে৷ খবর আছে কোন? আশরিফ কে পাওয়া গেছে?”
আয়াশ কিছুটা হাসার চেষ্টা করলো অতঃপর বললো,
” না রাজকুমার খোঁজ চলছে৷ ”
বলে থামলো অতঃপর হাসফাস করতে করতে বললো,
“আসছি আমি৷ ”
বলে পা বারাবে এর আগেই শ্রেয়াস বাধ সেধে কিছু জিগ্যেস করবে এর আগেই আয়াশের ফোন বেজে উঠলো৷
আয়াশ ফোন তুললো অতঃপর কিছু একটা শুনে বিস্মিত হলো৷ কিছুক্ষণ থমথমে হয়ে রইলো৷ ফোন রাখতেই শ্রেয়াস ফের প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“কিছু হয়েছে কি?”
আয়াশ তাড়াহুড়ো করে বললো শুধু,
” আশরিফের খোঁজ পাওয়া গেছে৷ ”
বলেই এক প্রকার দৌড়ে বেরিয়ে গেলো৷ শ্রেয়াস ভাবুক হয়ে এখানেই দাঁড়িয়ে রইলো৷ তখনই চন্দ্রিকা কোথ্যেকে যেন এলো এ মেয়ে আবার কোথায় গিয়েছিলো? শ্রেয়াস কিছু জিগ্যেস করার আগেই এ মেয়ে শ্রেয়াস কে এক প্রকার উপেক্ষা করেই চলে গেলো৷

৪৩

আজো অন্তরিক্ষে মেঘ করে আছে৷ উহু আজ নয় কাল থেকেই এমন হয়ে আছে৷ তার কি সময় হয় নি বর্ষণ হয়ে ঝড়ার? নাকি এমন ক্ষুন্ন মনেই থাকবে বলে পন করেছে? কিসের এতো মন খারাপ তার?
হীম শীতল বাতাস শরীর মন জুড়িয়ে দিচ্ছে৷ প্রকৃতির ক্ষুন্ন মন আজ মুগ্ধকর লাগছে, প্রাণবন্ত লাগছে চন্দ্রিকার কাছে৷ আকাশের মন ক্ষুণ্ণ হলেও চন্দ্রিকা আজ বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে৷ রহস্যময় কন্যার প্রশান্ত মনে দেখে অন্তরিক্ষেরো যেন হিংসে হলো৷ আজ প্রকৃতি শুধু ক্ষুণ্ণ নয় মেঘ গুলো শুধু জটলা পাকিয়ে নেই আজ বাতাসের পরিমাণ ও তীব্র৷ বৃষ্টির আগ মূহুর্তটা সর্বদাই সুন্দর হয় যদিও জানা নেই তার বৃষ্টি আজ ঝরবে কি না?
বাতাসে অদ্ভুত এক ঘ্রানে মম করছে চারোদিক কিছুক্ষণ পরপর তীব্র বাতাসের সাথে কয়েক ফোটা পানির ঝাপটা এসে অলিঙ্গন করছে চন্দ্রিকাকে৷ প্রকৃতির এই ধ্বংসাত্মক রুপ প্রিয় চন্দ্রিকার৷ মিফতার মত আজকাল তার ও প্রিয় হয়ে গেছে এসব৷ প্রেমময় মূহুর্ত কেমন৷

মহলের বড় ছাদটার মধ্যখানে বকুল ফুল আর আলতা নিয়ে বসেছে৷ পাশেই প্রাণ আর প্রণয় ফুল মুখে নিয়ে আছে৷ হাতে তার সুচ আর সুতা আর ছাদটা জুরে আছে বকুল ফুল তীব্র বাতাসে কুড়িয়ে আনা বকুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে৷ বকুলের মালা চন্দ্রিকার প্রিয় না৷ তবুও আজ তা নিয়েই বসেছিলো কিন্তু তা আর হলো কই? লাল পাড় সাদা শাড়ি টা জড়িয়ে আছে শরীরে৷ আজ অবাধ্য চুল ও বাধেনি মুক্ত করে দিয়েছে৷ মুখে কৃত্রিম সাজের ছিটে ফোটাও নেই৷ তার সাজ পছন্দের নয় শাড়িও তার বড্ড অপ্রিয় কিন্তু সে মাঝে মাঝেই পড়তো মিফতা থাকা কালীন৷মিফতা জোর করে পড়িয়ে দিতো৷ আজ অনেক দিন পর মন প্রাণ জুরে প্রসান্তি বিরাজ করছে৷ তাই নতুন বছরে নিজেকে নতুন করে সাজাতে ভুললো না৷ অপ্রিয় জিনিস গুলো নিজের সাথে অলিঙ্গন করলো৷ কাঁচের লাল চুড়ি গুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিলো আলতো হেসে৷ রহস্যময়ীকে আজ এ রুপে দেখে যে কেউ হয়তো চমকাবে? রহস্য কি এ সাজের হয়তো ভাববে?
কি চলছে আজ রহস্যময়ীর অন্তকরণে? রহস্যময় কিছু?

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here