কৌমুদিনী পর্ব-২২

0
1508

#কৌমুদিনী
#তাফসিয়া_মেঘলা
#পর্ব ২২

বাতাসের ধ্বনির সাথে চুড়ির ‘রুনঝুন’ শব্দ মিলিয়ে মধুর এক ধ্বনি তৈরি হলো৷ চুড়ির এই শব্দটা কি সুন্দর৷ কই আগে তো বিরক্ত লাগতো এখন ভালো লাগছে কেন? কোন কালেই তার চুড়ি প্রিয় ছিলো না,

চুড়ি তার বড্ড অপ্রিয়৷ মিফতা শ’ খানেক বার এ চুড়ি গুচ্ছ নিয়ে ওর পিছন পিছন বেপরোয়া হয়ে ঘুরেছে কিন্তু তবুও পরাতে পারেনি৷ প্রতিবারই চন্দ্রিকা নাকোচ করতো৷ প্রতিবার জোর করে শাড়ি পরাতে পারলেও চুরি পরাতে পারতো না৷ আর মিফতা প্রতিবারই মুখ ফুলিয়ে বলতো,
“চুরি না পরলে মেয়েদের সুন্দর লাগে নাকি? টিপ চুরিতো মেয়েদের দূর্বলতা তুমি কেন পরতে চাও না চন্দ্রাবতী? ”
আর প্রতি বারই চন্দ্রিকা উত্তর দিতো,
” যে জিনিস মানুষের দূর্বলতা তা আমি পরতে চাই না৷ যে দিন প্রমাণ করতে পারবো মেয়েরা কোন কিছুতেই দূর্বল নয় সে দিন না হয় তোমার ওই চুড়ি গুলো পরবো আমি?”
মিফতা তখন ভাবুক হয়ে অবুঝ এর মত বসে থাকতো৷ তখন নিশ্চয়ই সে ভাবতো এ মেয়ে কি বলছে? কবে আবার সে কি দিয়ে প্রমাণ করবে মেয়েরা দূর্বল নয়? সত্যিকি মেয়েরা কিছুতেই দূর্বল নয়? দূর্বলতা ছাড়া মানুষ হয়? তাহলে তো তারা পুরুষের মতই হতো৷ কিন্তু চন্দ্রিকার ধারণা শুধু পুরুষই কেন শক্ত হবে? মেয়েরা কেন দূর্বলতা নিয়ে থাকবে? দূর্বলতা থাকলে মানুষ সেই মানুষ কে আঘাত করতে পারে বেশি৷ আর সে তাই কোন দূর্বলতা চায় না৷ শাড়ি চুরি মেয়েদের যে দূর্বলতা নয় বরং অহংকার৷ নারীর অহংকার৷
মিফতার সাথে কাটানো এক একটা দিন এক একটা মূহুর্ত এক একটা কথাও ভুলতে পারে না চন্দ্রিকা৷
তবে আজ সে খুশি৷ কেন খুশি তার নিজেরো জানা নেই হয়তো?

তীব্র বাতাসে এলো মেলো হয়ে যাওয়া শাড়ির আচলটা ঠিক করলো ফের৷ এই নির্লজ্জ বাতাস এসে বারংবার শাড়ির আচলটা নষ্ট করে দিচ্ছে চন্দ্রিকার৷ তাতে যেন সে কিঞ্চিৎ বিরক্ত৷ বিরক্ত নিয়ে লম্বা চুল গুলো এক পাশে আনলো চন্দ্রিকা, অতঃপর এক পা ভাজ করে আরেক পা উচু করে আলতার কৌটোটা খুললো৷ টকটকে লাল আলতায় আজ রাঙাবে তার পা৷ তখনি আলতা টা কেউ ছিনিয়ে নিলো৷

এহেন ঘটনায় ভরকালো চন্দ্রিকা৷ কাজে ব্যাঘাত ঘটায় ভ্রু কুঁচকে এলো৷ কে নিলো তা দেখার জন্য কৌতুহল নিয়ে তাকালো সামনের দিকে চন্দ্রিকা৷ তার অতি নিকট, অতি সম্মুখে শ্রেয়াস কে দেখতে পেলো৷ ভরকালো না, চমকালো না স্বাভাবিকই রইলো৷ সে যেন জানতো শ্রেয়াস এখানে আসবেই ব শ্রেয়াস আলতার কৌট থেকে তুলায় আলতা মাখিয়ে আলতা পরাতে পরেতে একবার পরখ করে নিলো চন্দ্রিকা কে৷ অতঃপর শান্ত কন্ঠেই প্রশ্ন ছুড়লেন চন্দ্রিকার দিকে,
“পেত্নীর মত সঙ সেজেছেন কেন?”
অবাক হলো চন্দ্রিকা, তাকে বুঝি পেতনি লাগছে? আর পেতনিরা বুঝি এমন সাজে?
চন্দ্রিকা বিরক্ত নিয়েই উত্তর দিলো,
” আপনার বুঝি পেতনিদের সাথে সাক্ষাৎ আছে? তারা বুঝি সঙ সাজে?”
শ্রেয়াস এবার ঠোঁট এলিয়ে হাসলো৷ ফের শান্ত কন্ঠে বললো,
” আজ হঠাৎ সাজার কারণ?”
“মন চাইলো৷ ”
চন্দ্রিকার স্পষ্ট উত্তর৷ শ্রেয়াস পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো চন্দ্রিকার পানে৷ মেয়ে এবার নিজের ফর্মে এসেছে ঘাড় বাঁকা কথা না বললে তার হয়ই না৷ স্পষ্ট উত্তর যেন সে দেওয়া সেখেই নি৷ এ অদ্ভুত নারীতেই সে নিজেকে হাড়িয়েছে৷ এ মেয়ে যে শাড়িও পরে জানা ছিলো না তো সব সময় কেমন রঙহীন জামা কাপড় পরে থাকে মাথায় বড় ঘোমটা৷ চন্দ্রিকাকে প্রথম দেখায় ভেবেছিলো শান্ত স্বভাবের মেয়ে৷ পরে আস্তে আস্তে পরিচিত হওয়ার পর বুঝলো এ মেয়ে শুধু শান্ত নয় লেজ বিশিষ্ট ও বটে৷ বাকা বাকা কথা বলা, অস্পষ্ট উত্তর, হেয়ালিপানা, রহস্য রেখে কথা বলা তার প্রধাণ বেতন ভুক্ত কাজ বলেই মনে হয়৷ তার মাঝে কত কত রহস্য লুকিয়ে আছে কে জানে? এ এক রুখে মেয়ে নাকি আবার সাজতেও জানে৷ আর আজ নিজের কান্ডে অবাক না হয়ে পারলো না এ মেয়েতে নিজেকে খুইয়ে কত কত কিছুই না করতে হচ্ছে?
” এ শাড়ি পরে ভুলেও মহলের বাইরে জাবেন না মেয়ে৷ বলা তো জায়না এই ঝর তুফানের মাঝে পেতনি দেখে কে আবার হৃদপিন্ডে প্রাণঘাতী আক্রমণ হয়ে জীবন টাই খোয়ালো?”
চন্দ্রিকা হাসলো শুধু উত্তর দিলো না শ্রেয়াসের কথার৷ ততক্ষণে এক পায়ে আলতা পরানো শেষ৷ এবার চন্দ্রিকা দু পাই উচু করে বসলো শ্রেয়াশ আরেক পায়ে আলতা পরানো শুরু করলো৷
শ্রেয়াস ও হাসলো, তীব্র বাতাসের সাথে এবার ফের এক ঝাপটা পানি এসে চোখ মুখে পরলো চন্দ্রিকার৷ সাথে সাথেই নেত্র যুগোল বন্ধ করে নিলো চন্দ্রিকা৷ এখন সে বিরক্ত না হলেও শ্রেয়াস বিরক্ত হলো৷ বাতাস তার প্রেয়সীকে উত্যক্ত করছে, অলিঙ্গন করছে, কি স্ফর্ধা তার৷ চন্দ্রিকার চোখে মুখে উপচে পরা চুল গুলোর উপর বিরক্ত হলো৷ থমথমে কন্ঠে বললো,
” আপনার চুল গুলো আর এভাবে খুলে রাখবেন না চন্দ্রাবতী৷ আমি ব্যাতিত আপনাকে আর কিছু অলিঙ্গন করুক তা আমি চাই না৷ ”
চন্দ্রিকা দুর্বোধ্য হাসলো৷ তার কাছে এ কথাটা নেকামি ছাড়া কিছুই মনে হলো না মিনমিনিয়ে বললো শুধু,
” আপনি পাগল শ্রেয়াস৷ ”
চন্দ্রিকা তৃতীয় বারের মত শ্রেয়াসের নাম ধরে ডাকলো৷ শ্রেয়াস এবার হাসলো ফের বললো,
“আপনারি তো৷ ”
শ্রেয়াসের এহেন উত্তরে চমকালো চন্দ্রিকা৷ কথাটা কেমন জানি সুন্দর শুনালো “আপনারি তো৷ ” চন্দ্রিকা কছু বললো না আর চুপই রইলো৷ আদৌ তার কিছু? না সে কাউকে চায় না৷ কাউকে না৷

হঠাৎই শ্রেয়াসের কি হলো কে জানে অদ্ভুত কন্ঠে বললো,
” আমি প্রথম কোন নারীতে আকৃষ্ট হয়েছি৷ এমন এক নারী যার মাঝে লুকিয়ে আছে রহস্য আর রহস্য৷ ”
শ্রেয়াসের কথার অর্থ বুঝলোনা চন্দ্রিকা, এটা বলার মানে কি? হঠাৎ কিছু ভাবলো চন্দ্রিকা৷ চন্দ্রিকা এবার উঠলো আলতা রাঙা পা নিয়ে৷ শুকায়নি এখনো যার দরুন মেঝেতে পায়ের ছাপ বসলো৷ গুটি গুটি পায়ে ছাদের এক কোণে এসে দাঁড়ালো৷ চন্দ্রিকার সাথে পাখি দুটো ও চন্দ্রিকার সাথে এসে রেলিং এর উপর বসলো৷ শ্রেয়াস ও দাঁড়ালো চন্দ্রিকার পিছন ঘেঁষে দাড়ালো মাঝে কিঞ্চিৎ দুরত্ব একটু এগোলেই চন্দ্রিকার পিঠ ঠেকবে শ্রেয়াসে বক্ষে৷

শ্রেয়াস এবার ক্ষানিকটা গম্ভীর কন্ঠেই বললো,
” আশরিফ কে পাওয়া গেছে চন্দ্রাবতী৷ ”
“জানি৷ ”
চন্দ্রিকার ছোট, স্পষ্ট উত্তর৷ শ্রেয়াস ফের খানিকটা নিচু কন্ঠে বললো,
” আশরিফ কে জীবিত পাওয়া যায়নি৷ মৃত পেয়েছে৷ ”
শ্রেয়াসের কথায় ফের দুর্বোধ্য হাসলো শুধু চন্দ্রিকা৷ শ্রেয়াস ক্ষানিকটা সরে চন্দ্রিকার দিকে তাকিয়ে ছিলো৷ হাসিটা চোখ এড়ালো না শেয়াসের৷

অদ্ভুত এই হাসির মানে কি? হঠাৎ শ্রেয়াস এক অদ্ভুত প্রশ্ন ছুড়লেন,
“খু’ন সম্পর্কে আপনি কি কিছু জানেন চন্দ্রাবতী?”
চন্দ্রিকা চুপ রইলো উত্তর দিলো না এবারো৷
চন্দ্রিকা যে উত্তর দিবে না জানা ছিলো৷
শ্রেয়াস ফের বললো,
” পুলিশের ধারণা খু’ন টা আরো তিন চার দিন আগে করা হয়েছে তারপর পুকুরে ফেলা হয়েছে৷ আশরিফের খু’ন আর আপনার গর্দানের এই গুলির দাগ কোন সম্পর্ক নেই তো চন্দ্রাবতী? ”
চন্দ্রিকা উষ্ঠ কোণে হাসির রেশ রেখেই শ্রেয়াসের দিকে ফিরলো৷ এক হাত শ্রেয়াসের কাধে রাখলো আরেক হাত বা বক্ষে তবুও মাঝে কথা দূরত্ব ঘুচলো না রয়েই গেলো এক হাত দুরত্ব৷ শ্রেয়াস প্রশ্ন বোধক চাওনি দিয়ে তাকালো৷ চন্দ্রিকা শ্রেয়াসের নেত্র যুগোলে দৃষ্টি মিলালো অতঃপর হাসলো কিছুটা যার শ্রেয়াসের ওষ্ঠ কোণেও হঠাৎ হাসি ফুটলো কিছুটা৷
চন্দ্রিকা ফিসফিসিয়ে বললো,
“জানি না আমি, কিচ্ছু জানি না৷ ”

চলবে,

[আমি লেখায় সচারাচর রোমান্স দেই না৷ কেমন জানি আজকের পার্টে মনে হচ্ছে রোমান্স দিয়ে দিলাম৷ ছোট বলে লজ্জা দিবেন না, ঈদ মানেই ব্যাস্ততা আশাকরি বুঝবেন? বাই দ্যা রাস্তা জানাতে ভুলবে না কেমন হয়েছে৷🖤]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here