কৌমুদিনী সূচনা পর্ব

0
6719

এক
বিয়ের আগ মুহূর্তে মৃত্যু ঘটলো জমিদার কন্যা মিফতার৷ র’ক্তা’ক্ত নিথর দেহ পরে আছে কৃত্রিম মাটিতে৷ লাল জামদানিটা র’ক্তে চুপচুপে হয়ে আছে৷ আলতা আর র’ক্তে’র সংমিশ্রণ হয়ে হাত পা মাখো-মাখো হয়ে আছে৷ বিয়ের লাল শাড়ি পরিহিত কনেকে এখন সাদা কাফনে মোরানো হবে৷
মিফতার এমন হওয়ার দশ মিনিট পূর্বে জানা যায় তাঁর হবু স্বামী রাফসান বরযাত্রী আসার সময় সরক দূর্ঘটনায় ক্ষ’তি’গ্রস্ত হয়েছে৷
গ্রামের স্বাস্থকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে রাফসানকে তাঁর অবস্থাও দুর্দশাগ্রস্ত৷ এমনটা নয় যে মিফতা তাঁর হবু স্বামীর এমন করুন সংবাদ শুনে আ’ত্ম’হ’ত্যা করেছে৷
সে সংবাদ শোনার আগেই মৃত্যু কোলে ঢলে পরে রাজকন্যা মিফতা ওয়াসিমা

রাজ বাড়ির কোনো কন্যাকে বাহিরে সাজানো হয়না৷ উহু শুধু রাজ বাড়ির কন্যাদের কথাটা হয়তো অসত্য? গ্রামের কোনো বিবাহের পাত্রীকেই ঘটা করে বাইরে সাজতে পাঠানো হয়না৷ ঘরোয়া ভাবে সাজানো হয় বিয়ের কনেকে৷ ওইতো অপরাহ্নের শেষ বেলা হলুদ দিয়ে স্নান করালো মেয়েটাকে কি খুশি ছিলো মেয়েটা৷ অতঃপর দেশের সনামধন্য রূপবিশারদ মিফতাকে লাল ঢাকাই জামদানিটা পরিয়ে কনে ভেসে সাজিয়ে দিলো৷ সবাই মিলে বসালো মেয়েটিকে শয়নকক্ষে৷
মিফতাকে একা রেখেই সবাই সাজগোজ সারতে যায়৷ সাজগোজ শেষে ফিরে এসে মিফতার সই যখন মিফতার কক্ষে ঢুকবে চৌকাঠের সামনে র’ক্ত দেখে থমকায় সে৷ শরীর সহ অন্তর আত্মা ঝংকার তুলে কেঁ’পে উঠে তাঁর
কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই দেখতে পায় মিফতার নি’থ’র দেহটা পরে আছে কৃত্রিম মেঝেতে৷ মেঝেটাও র’ক্তে তলিয়ে গেছে৷ নাক মুখ ভর্তি র’ক্ত শির থেকেও গলগল করে রক্ত ঝরছে এখনো৷

র’ক্ত দেখে হাত পা অবসান হয়ে আসে সে মেয়েটির৷ রক্তে ফোবিয়া থাকায় বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলো না আর৷ দৃঢ় হয় নেত্র পল্লব ঝাপসা হয় আশপাশ অতঃপর সেও চিৎকার করে সেখানেই নিজের জ্ঞান হারায়৷ মেয়েটির চিৎকারে মেয়ে দেহরক্ষী গুলো এগিয়ে আসে কক্ষের ভেতর৷ রসুই ঘর থেকে গরম দুধ আর মিষ্টি নিয়ে মিফতার মা মেহনুবা সে ও এদিকেই আসছিলো চিৎকারটা তাঁর কর্ণ এড়ায় না৷ পা চালিয়ে দাসি কে নিয়ে মিফতার মা মেহনুবা মেয়ের কক্ষের দিকে এগিয়ে আসে৷ এখানে এসে থমকে যায় সে ও৷ মিফতা আর সেই মেয়েটিকে এভাবে পরে থাকতে দেখে চমকে উঠে৷ সেও চেচিয়ে মেয়ের কাছে এগিয়ে যায়৷

মিফতার হবু স্বামী রাফসানের করুন সংবাদ শুনে রাজবাড়ির সকল পুরুষ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গেছে মাত্রই৷ দেহরক্ষী গুলো আছে শুধু বাড়িতে৷
ধরাধরি করে উঠানো হয় মিফতাকে৷ কিন্তু উঠাতে গিয়ে নজর পরে মাথায়৷ সেখানে পেরেক গেঁথে গেছে অর্ধেক৷ পেরেকটা বিছানার পায়াতে ছিলো সেখানে মাথাটা পরার কারণে পেরেকটা মাথায় ঢুকে গেছে৷
কিন্তু এখানে পরলো কি করে আর নাক মুখ থেকেই বা র’ক্ত আসছে কি করে?
বিপদে কি আর এসব চিন্তা মাথায় আসে? মেয়ে দেহরক্ষী গুলো ধরাধরি করে মিফতাকে গাড়িতে নিয়ে বসালো সে মেয়েটির জ্ঞান ফিরেনি এখনো তাঁর মাথা চৌকাঠে পরার কারণে ফেটে গেছে ক্ষানিকটা৷
অতঃপর দু’জনকেই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে আসা হলো৷ মেয়েটিকে ভর্তি করানো হলো৷

স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে আসার পর জানায় মিফতা আরো ঘন্টাক্ষানেক আগেই নিজের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে৷
মিফতার মৃ’ত্যু সংবাদে রাজবাড়িতে নেমে আসে শোকের ছায়া৷ বিয়ে আমেজি পরিবেশটা পরিনত হয় কান্নায়, ক্লেশে৷
কি করে মৃ’ত্যু ঘটলো তা নিয়েও মানুষের কৌতুহলতার শেষ নেই৷ গ্রামের মানুষ না জেনেই সাত পাঁচ কত কিছু বানিয়েও ফেলছে মনে মনে৷ কিন্তু রাজ বাড়ির কন্যা বলে মুখে টু শব্দ করতে পারছে না৷
এটা সত্যি ভাবনার বিষয় নয়কি? হঠাৎ মৃত্যু ঘটলো কি করে?
অনেক সময় মাথায় আঘাত লাগলে ব্রেইনে র’ক্ত জমাট বেধে নাক মুখ দিয়ে র’ক্ত বেরিয়ে আসে৷ কিন্তু চিকিৎসক এর ধারণা স্ট্রোক করেছে হেমোরেজিক স্ট্রোক যাকে বলা হয়৷ র’ক্তনালি ফেটে র’ক্তক্ষরণ হলে হেমোরেজিক স্ট্রোক হয়ে থাকে৷
ডাক্তার সেই ধারনাই করছে৷ নাক মুখ দিয়ে যেহেতু র’ক্ত র’ক্ত আসছে তাহলে হেমোরেজিক স্ট্রোকই৷ ডাক্তার মিফতার নাক মুখে র’ক্ত দেখে পরিক্ষা নিরিক্ষাও করানো হলো৷ হঠাৎ কেন স্ট্রোক করবে? সবার থেকে জিগ্যেস করে কোন রকম তথ্য পেলো না৷ অসুস্থ ছিলো না আগে রাজকন্যা মিফতা তাহলে হঠাৎ স্ট্রোক? এটা কি সাধারন বলেই গন্য করে নিবে?

সময় পেরোলো আঁধার মাখা রাত পেরিয়ে ভোর হলো ঝলমলে আলোয় বিস্তৃত ভোর৷
আঁধার কেটে আলো ফুটলেও মন প্রসন্ন হলো না কারো হসপিটালের সব নিয়ম কানুন শেষ হলো৷ সে মেয়েটির জ্ঞান ফিরেছে মাত্র৷ চুপচাপ হয়ে শুয়ে আছে মেয়েটা কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে যেন৷ মিফতা তাঁর বড্ড প্রিয় ছিলো যে৷
মেয়ের মৃ’ত্যুর শোকে কয়েকবার জ্ঞান হারিয়েছে মিফতার মা মেহনুবা৷ মিফতার বাবা আহসান মীর দাম্ভিক মানুষ শক্ত হয়ে বসে আছে এক কোণে৷ চেহারায় বিস্তৃত আছে ক্লেশ৷ তবুও শক্ত হয়ে ঠায় বসে আছে৷ জমিদার মানুষ অল্পতেই ভেঙে পরলে চলে নাকি? কিন্তু তবুও বাবাতো ভেতরটা তাঁর পুরছে মেয়ে হারানোর যন্ত্রণায়৷
মিফতার ভাই ‘ রৌজাফ শ্রেয়াস ‘ বোনের মৃত্যুতে বাবার মতই পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তাঁর মুখ দেখে ভাব ভঙ্গি বুঝার উপায় নেই৷ এ ছেলে সবসময় বাবার থেকে বেশি কঠোর৷ সময় পেরোচ্ছে এভাবে থাকলে হবে না মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে যে৷ হঠাৎ ডাক্তার ফারহান কি মনে করে এগিয়ে এলো আহসান মীরের কাছে৷ সবাই স্ট্রোক এর ব্যাপারটি সবাই সাধারন ভাবে নিলেও ডাক্তার ফারহান পারলো না৷ সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের হঠাৎ স্ট্রোক হয় নাকি? কিছু সিমটম তো দেখা দেয়ই আগে থেকে কিন্তু আগে মিফতা পুরো সুস্থ ছিলো৷ কেউ না জানলেও রাজকন্যা অসুস্থ হলে সর্বপ্রথম তাকেই ডাকা হতো৷ রাজ বাড়ির পারিবারিক ডাক্তার সে৷ ডাক্তার ফারহান আহসান মীরের সামনে এসে আমতা আমতা করে বলেই ফেললো,
” জনাব আমার মনে হচ্ছে একটু অন্য ভাবে দেখলে ভালো হতো৷ রাজ কন্যা হঠাৎ কেন স্ট্রোক করলো? আগে তো অসুস্থ ছিলো না৷ আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে৷ ”
আহসান মীর বলেন,
“অন্যভাবে বলতে? কি বলতে চাইছো ফারহান?”
ফারহান ফের আমতা আমতা করে বললেন,
“ময়না তদন্ত৷”
ফারহানের কথা শুনে নেত্র যুগোল রক্তিম হয়ে এলো তাঁর৷ বাঁকা চোখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন ফারহানের পানে৷ শুকনো ঢোক গিললো ফারহান যা বোঝার বুঝে গেছে সে৷ আহসান মীর ফারহানের পানে তাকিয়ে ছেলেকে বললেন,
“চলো শ্রেয়াস৷ দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার মেয়ের নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটছে এখানে৷ ওর স্থায়ী ঠিকানায় শান্তির স্থানে রেখে আসি ৷”
বলেই উঠলেন তিনি৷ অতঃপর সাদা লাশ বাহী গাড়িটায় উঠানো হলো মিফতাকে৷
তখনই পিছন থেকে কেউ মেয়েলি কন্ঠে ঢুকরে কেদে উঠলো৷ শ্রেয়াস গাড়িতে উঠতে গিয়েও উঠলো না দাঁড়ালো খানিক্ষণ কিন্তু কন্ঠটা কার পিছন ফিরে দেখলো না৷ উঠে পরলো কালো চার চাকা ওয়ালা গাড়িটায়৷ মিফতাকে লাশ বাহী গাড়িটায় উঠানোর পর আরেকজন ও আড়ালে আবডালে ভারাক্রান্ত মনে সে গাড়ির দিকে তাকালো৷ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো মিনমিনিয়ে বললো,
“সর্বকালের জন্য পথ আলাদা হলো৷ তুমি আমার হলে না কারো হলে না৷ এ কি হওয়ার ছিলো?”

মিফতা মারা যাওয়ার অনেক পর রাফসানো তাঁর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন৷ মধ্য রাতের দিকে রাফসান আশংকামুক্ত ছিলো৷ কিন্তু শেষ রাতের দিকে অদ্ভুত ভাবে মৃ’ত্যু হয় রাফসানের৷ অদ্ভুত বলা চলে না কি? যে মানুষটাকে মধ্যরাতে আশংকামুক্ত ঘোষণা করলো শেষ রাতে তাকে গিয়ে ডাক্তার মৃত পেলো৷
শেষ রাতে তো জ্ঞান ফেরার কথা বলেছিলো ডাক্তার৷ তাঁর ডাক্তার জীবনে প্রথম নিজের উপর নিজেই সন্দেহ করলো ডাক্তার ফারহান৷

অতঃপর বিয়ের কনেকে লাল শাড়ি থেকে সাদা কাফনে মোরানো হলো৷ রেখে আসা হলো তাঁর স্থায়ী বাস গৃহে৷ চার-দিন পার হলো আজ কাল রাজ বাড়িটা আর হাসিতে মাতে না থমথমে হয়ে গেছে৷

অন্তরিক্ষ ঘন অন্ধকার আচ্ছন্ন রজনী গভীর হয়নি তবে গ্রামাঞ্চল তাই গভীর মনে হচ্ছে৷ তখন সময়নিরূপক যন্ত্রটিতে সারে দশটা বাজে৷ শ্রেয়াস বৈঠকখানায় সাহেবি ভঙ্গিতে বসে ব্লাক কফি নামক বিদঘুটে স্বাদ বিষ্টি জিনিসটা পান করছে৷ সাহেবি কায়দা সব তাঁর৷ বোনের বিয়ের উপলক্ষে লন্ডনের বাস গৃহ থেকে এখানে এসেছে৷ কিন্তু বিয়েটাই হলো না বোনেরো অকাল মৃত্যু হয়ে গেলো দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো শ্রেয়াস নামক পুরুষটি৷
মুঠোফোনে দৃষ্টি দিয়ে কফিটা ফের চুমুক বসাতেই দৃঢ় পায়ে কেউ সামমে দিয়ে হেটে গেলো৷ দেহরক্ষীদের ওত সাহস নেই ওর মুখের সামনে দিয়ে যাবে৷ কৌতুহল জাগলো জানার কার এত সাহস৷ কৌতুহল নিয়ে চোখ তুলে তাকালো সে দিকে তখনি দেখলো একটা মেয়ে মেয়েটির পেছন ফেরানো তাই মুখশ্রী দেখতে পেলো না৷
বাড়িতে আসার পর মেয়েটিকে মিফতার সাথেই একবার দেখেছিলো তখনো মুখখানা দেখা হয়নি কন্ঠ শুনেছিলো মাত্র৷ কাল যে অজ্ঞান হয়ে পরে ছিলো সে মেয়েটি৷ মেয়েটির মুখশ্রী এখনো দেখেনি শ্রেয়াস৷ মেয়েটি কে জানার জন্য কৌতুহল জাগলো তাঁর৷ সদর দরজা দিয়ে মেয়েটি বের হবে ঠিক সে সময়ই শ্রেয়াস উচ্চ কন্ঠে বাধ সেধে বলেন,
” থামুন৷ কে আপনি?”
থামলো মেয়েটি কিন্তু ফিরলো না পিছনে উরনাটা মাথার ভালো করে টেনে ক্ষানিকটা ঘাড় ঘুরালো দেখতে পেলো না এবারো শ্রেয়াস৷ মেয়েটির স্পর্ধা দেখে বিস্মিত শ্রেয়াস৷ সে ফের প্রশ্ন ছুড়বে এর আগে মেয়েটি মিষ্টি কন্ঠে উত্তর দিলো,
” রাজকুমারি মিফতার খাস সঙ্গিনী, সই আমি৷ চন্দ্রিকা৷ চন্দ্রিকা আমার নাম জনাব৷ ”

চলবে,

#কৌমুদিনী
#তাফসিয়া মেঘলা
#জনরাঃথ্রিলার
#সূচনা পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here