ক্যামেলিয়া পর্ব-২

0
6033

#ক্যামেলিয়া
#পর্ব-২
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)

(৪)

গতকাল যে মেয়ের বাবা মারা গেছেন, বরযাত্রী এসে ফেরত গিয়েছে, ভোর হতেই যদি জানতে পারে ফেরত যাওয়া বরযাত্রী পুনরায় এই বাড়িতে আসবে। অথচ তার জন্য নয়, তার চাচাতো বোনের জন্য। তখন সেই মেয়ের কেমন প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিৎ তা সে জানে না।
নিজেদের উঠানের কদবেল গাছটার নিচে বসে সে এই খবর টাই জানতে পেরেছে। আজ তার প্রাক্তন আসবে তার চাচাতো বোনকে বিয়ে করতে।গতকাল চলে যাওয়ার পর সে একটা বারের জন্যও কল দেয়নি তাকে। হয়তো দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। যদি করতো তবে এমন সময় তাকে ফেলে চলে যেতো না।ছয় মাসের প্রণয়ের সম্পর্ক এরপর বিয়ে অবধি।

পানির গ্লাসটা মাটিতে রেখে স্মিত হাসলো জাফরিন।সম্মতি জানালো তার চাচাকে। অবশ্যই তারা বিয়েতে যাবে। কারণ সকল বোনদের মধ্যে আশা হচ্ছে তার প্রিয় বোন। বোন নয় বান্ধুবীও বলা যায়। তার বিয়েতে অবশ্যই তারা যাবে।

জাফরিনের এমন কথায় জান পরাণ অবাক হলো তার বড় আপা। সে কিছুটা কাঁদতে কাঁদতে বলল,

“তোর মাথা কি ঠিক আছে জাফরিন?তুই বিয়েতে যাবি?”

“কেন যাবো না?”

“না কেন যাবি না। দোষ তো তোর না, দোষ আমাদের কপালের। না হইলে কালকেই ক্যান আব্বা মারা যাবে?বরযাত্রী ফেরত যাবে?”

“আপা কান্না থামান।কথায় কথায় আপনারা দুই বোন কাঁদা বাদ দেন।”

“তুই বুঝবি না।আব্বার কথা ভুলতে পারি না।”

“আব্বার কথা আপনাদের কেউ ভুলতে বলে নাই।আব্বা আজ দুনিয়াতে নাই, এটা আমার বা আপনাদের দোষ না।আল্লাহ্ হায়াত দেয় নাই।এটা মানতেই হবে। আর আমার বিয়ে ভাংছে এতেও আমার দোষ নাই। কারণ যে ব্যক্তি আমার এই সময়, আমার আব্বা মারা যাওয়ার সময় আমাকে ছাড়তে পারে, যখন তাকে আমার সব থেকে বেশি দরকার। সেই ব্যক্তির সাথে আমি জীবন কীভাবে পার করবো?”

“মানুষ এত কিছু দেখবে না।সবাই দেখবে তিন মেয়ে ছিল তার।ছোটো মেয়ের গতি করতে পারলো না।”

“সবাই? কার কথা বলতেছেন আপনি?আপনার চাচা, ফুপুদের কথা?যারা কালকেই চিন্তা ভাবনা করতেছে কে কতটা সম্পত্তি পাবে?কত অংশের মালিকানা পাবে?কারণ আমাদের ভাই নেই বলে।এদের কথা ধরতেছেন আপনি?”

জাফরিনের কথায় এগিয়ে এলো তার মেঝ বোন।সে একজন শিক্ষিকা।এগিয়ে এসে দুই বোনের পাশে বসে বললেন,

“আপা, আব্বা কিন্তু জাফরিনকে এখনি বিয়ে দিতে চায়নি।আমাদের বিয়ে হয়েছিল আরো বয়স হয়ে। লেখাপড়া শেষ করে। আব্বা সব সময় চাইতেন তার মেয়েরা তার পরিচয় হোক।জাফরিনের বয়স মাত্র আঠারো বছর। এই বয়সে বিয়ে দেওয়ার কারণ ছিল কানাডায় গিয়ে যেন জাফরিনের একজন অভিভাবক থাকে। ওর কোনো বিপদ হলে যেন সেখানে তাকে আগলে রাখতে পারে। কিন্তু একবার ভাবুন তো যে ছেলে এই সময় তার হাত ছেড়েছে,চব্বিশ ঘন্টা পার হওয়ার আগেই আশাকে বিয়ে করতে আসতেছে সেই ছেলের কাছে আমাদের বোনটা কতটা নিরাপদ ছিল?”

কথায় কথায় কাঁদবেন না আপা।মেয়ে মানুষ হওয়ার দরকার নেই আগে মানুষ হোন।

(৫)

নিজ রুমে বসে ভিডিও কনফারেন্স এর মাধ্যমে ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিং এ ব্যস্ত মাশহুদ। এই ডিলটা তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজমল সাহেবের মৃত্যুর কারণে সকল ওয়ার্কার কাজ বন্ধ রেখেছে। তাদের সেফটি ইস্যু নিয়ে কথা বলছে টিম লিডার। কিন্তু মাশহুদ কে জানানো হয়েছে সাইডে যথেষ্ট সেফটির ব্যবস্থা করেছে।
নিছক দূর্ঘটনা মাত্র আজমল সাহেবের মৃত্যু। কিন্তু কোনো ভাবেই কাজে ফেরানো যাচ্ছে না শ্রমিকদের। তাদের দাবী, যেখানে কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিরাপদ নেই সেখানে তাদের কাজের কী নিরাপত্তা। এই বিষয়ে ক্লায়েন্টদের অফিশিয়াল মেইলে কেউ অভিযোগ জানিয়েছে।সত্যতা যাচাই করার জন্যই আজকের এই মিটিং।

মাশহুদ একজন ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ।তার অধরে সব সময় লেগে থাকে স্মিত হাসী।এই মানুষটা তীব্র রাগ দেখাতে দেখাতেও হাসি ধরে রাখতে পারে। যে বিনয়ী, ক্ষিপ্র বুদ্ধিমত্তার মানুষ।সামনে থাকা ব্যক্তির মন বুঝতে তার খুবই স্বল্প সময় লাগে। প্রথমে সে তার সামনের পক্ষের কথা শুনবে, ধৈর্য্য ধরে তাদের সকল অভিযোগ মেনে নিবে কিন্তু এরপর তার যুক্তি এবং পরিকল্পনা সম্পর্কে বলবে। শুধু এমনটাই নয় ব্যাক আপ প্ল্যান হিসেবে থাকবে পরিকল্পনা-২।ক্লায়েন্টদের একটা পছন্দ না হলে অন্যটা ঠিক পছন্দ হবে।প্রকৃত ব্যবসায়ী মানুষ আবেগী হয় না।তারা প্রফিট চেনে। ঠিক এমনি কেউ না কেউ থাকে ক্লায়েন্টদের দলে।শিকারীর মুখ থেকে শিকার ধরে আনার এই খেলায় অন্যতম খেলোয়াড় মাশহুদ এখনো জানে না যে তাকে নিয়ে খেলার মানুষ তার কতটা কাছে চলে এসেছে।
শিকারী যেদিন শিকার হবে সেদিনের অপেক্ষা ফুরিয়ে এসেছে।

মিটিং শেষ করে এমিলিকে ডাকলো মাশহুদ।যোগাযোগ করতে বলল। এমিলি কল দিলে দুই বার রিং হওয়ার পর ভেসে এলো এক নারীর কণ্ঠস্বর। যে কণ্ঠস্বর সমুদ্রের মতোন শান্ত অথচ এতটা শান্ত সমুদ্রে যদি গর্জন উঠে তবে?

“ম্যাম ভালো আছেন?”

” জি। বলুন, আমার বাবা এখন কোথায় আছেন?”

“লাশ ফ্রিজিং করে রাখা হয়েছে। আপনাদের সাথে কিছু প্রয়োজন ছিল।”

“বলুন।”

“আপনার বাবার কোম্পানিতে কিছু ইন্সুইরেন্স ছিল।যেটার অংশীদার আপনারা তিন বোন হয়েছেন।”

“এসব বিষয় তো দূতাবাস থেকে করার কথা তাই না?আপনারা হুট করে এতটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন?কিছু লুকাতে চাইছেন?”

“সরি ম্যাম! আমরা কী লুকাতে চাইবো?”

“হতেও পারে আমার বাবার মৃত্যুটা আপনাদের কাছে নিছক কিন্তু আমার কাছে এমন নয়।”

“ম্যাম খুব দ্রুতই সকল কাগজ ইমেইল করা হবে। সকল কিছু চেক করে আমাদের কনফার্ম করার অনুরোধ রইল।”

অপর পাশ থেকে কল কেটে দিয়েছিল।মাশহুদ কিছুটা অবাক হলো।যে মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গেছে, বাবা মারা গেছে সেই মেয়ে এতটা শান্ত কেন?তার উচিৎ ছিল কল রিসিভ করেই কান্নাকাটি করা। কথা বলার সময় আটকে যাওয়া।অথচ সে এমন কেন? কেন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই?

(৬)

জাফরিনদের দুপুরে খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছে তার ফুপুরা। পাশের বাড়িতে বিয়ে সেই ছেলের সাথেই। ফুপুরা কাঁদছিল এসে,তারা বলছিল তাদের কিছুই করার নেই। তারা কী করবে?গতকাল যখন বিয়ের কথা তাদের ভাই বলল তারা নিষেধ করেছিল অথচ তার ভাইয়ের পরিবার শোনেনি। শত হলেও গতকাল তাদের ভাই মারা গেছে, তাদের গলা দিয়ে আজ খাবার নামছে না তবুও তাদের থাকতে হচ্ছে কারণ ওটাও ভাইয়ের বাড়িই।জাফরিনের মা গেলেন না।বড় আপা যেতে না চাইলে জাফরিন বলল,

“ক্যান যাবেন না আপা?আজ না গেলে কাল আপনার চাচারা বলবে আপনাদের পেটে হিংসা। তার মেয়ের সুখ সহ্য হয় নাই। কেন এসব শুনবেন?আমাদের যাওয়া দরকার আমরা যাবো।আমাদের আব্বা নাই, এই দুঃখ আমার আপনার। বাইরের মানুষের না।তাই নিজের দুঃখ নিজের রাখেন।”

বিয়ে বাড়ির জাক জমক দেখে দুচোখ ভরে এলো।জাফরিনের। সামনে বসে থাকা বর বেশে ঈশানকে দেখে তার কান্না পাচ্ছিলো।গতকাল সকালেও তাকে নিয়ে কতই না স্বপ্ন দেখেছিল সে অথচ আজ সব মরীচিকা। জাফরিনকে কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্যেই হয়তো আশার বড় বোন তাকে টেনে নিয়ে গেল ঈশানের সামনে। আবদার করলো হাত ধুইয়ে দেওয়ার। জাফরিনের শক্ত স্বরে না বলা শুনে তার দিকে তাকিয়ে রইল ইশান সমেত বাকী সবাই।

“আমি কেন অন্যের বরকে হাত ধোওয়াবো?আমি যেমন আমার বরের হাত অন্যকে ধরতে দিবো না তেমনি অন্য কারোর হাত আমি কেন ধরবো?”

“এটা নিয়ম।স্বাভাবিক ভাবে বললেই পারিস সত্য মেনে নিতে পারছিস না।এত ভালো ছেলে,কানাডা প্রবাসী, দেখতে ভালো ছেলে হাত ছাড়া হলো তাই? আসলেই আশার কপাল ভালো ও জিতেছে।”

“আমাকে যে ধরে রাখতে পারেনি এটা তার ব্যর্থতা,
আমি যাকে ধরে রাখবো সে হবে ভাগ্যবান।নিশ্চয়ই কোনো কাপুরষ নয় যে এক এতিম মেয়েকে বিয়ের আসরে রেখে চলে যাবে। অথচ যে বর নিয়ে আপনাদের অহংকার, সেই বরের কানাডায় যাওয়ার টিকিট অবধি আমার টাকায় কেনা।এবার বুঝে নিন কে জিতেছে আর কে হেরেছে?”

#চলবে

(যারা গল্প পড়েন তারা রেসপন্স করবেন।আমি কিন্তু নিয়মিত হচ্ছি।এবার আপনাদের পালা।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here