ক্যামেলিয়া পর্ব-২৫

0
8136

#ক্যামেলিয়া
#পর্বঃ২৫
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)

জাফরিনের চুলে আলতো স্পর্শে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মাশহুদ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো,

“ঠিক হতে কত দিন সময় লাগবে?”

“সার্জারী করালে ভালো হতো। অথবা তেলাপিয়া মাছের চামড়া দিয়ে ট্রিটমেন্ট ওটা করিয়ে দেখতে পারেন।”

“প্রতিদিন ড্রেসিংটা স্কিপ করতে চাচ্ছি।ওর কষ্ট হচ্ছে।”

“তবে দ্বিতীয় পদ্ধতি অবলম্বন করাটাই বেটার হবে।”

“কোনো ক্ষতির সম্ভবনা যদি ১% থাকে তবে অন্য উপায় দেখুন।”

“এটাই সবথেকে ভালো হবে।তেলাপিয়া মাছের চামড়ায় কোলাজেন প্রোটিনের টাইপ ১ ও টাইপ ৩ রয়েছে, যা আগুনে পুড়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া অংশকেও খুব সহজে সারিয়ে তুলতে পারে। এটাকে ব্যান্ডেজের মতোন ব্যবহার করে নিলেই হবে।”

“বেশ তবে এটাই করুন।প্রতিদিন ঘুম পাড়িয়ে, অবশ করলে।ওর অন্য ক্ষতির আশংকা থাকবে।আমি সেটা চাই না।”

“জি আমরা দেখছি।”

ড্রেসিং শেষ করে এমিলি চলে গেল তাদের নিয়ে। মাশহুদ উঠে দাঁড়িয়ে দেখলো যাচ্ছে তাই অবস্থা হয়ে আছে জাফরিনের স্টাডি রুমের।সেখানে পা রাখতেই তার মনে হলো,

“ন জাফরিন এমন অগোছালো করেনি।কেউ একজন এসেছিল এখানে। কিছু একটা খুঁজতে। সে নিশ্চয়ই কাঙ্ক্ষিত বস্তু খুঁজে পায়নি।মুহুর্তেই তার মস্তিষ্কে হাজার খানেক চিন্তার আগমন ঘটে গেল।সে নিজের ফোন বের করে এখানে থাকা সকল ক্যামেরা অফ হওয়ার কমান্ড বাটন প্রেস করলো।এরপর ডেকে পাঠালো অন্য এক স্পেশাল টিমকে।তারা এসে পুরো ঘর থেকে অন্য কারোর লাগানো চারটে ক্যামেরা উদ্ধার করলো।মাশহুদ এমিলির দিকে তাকাতেই সে মাথা নিচু করে রইল,
কেননা একমাত্র মাশহুদের অনুপস্থিতিতে এমিলিই এখানে আসার অনুমতি পেয়েছে।স্পেশাল টিমের সাহায্যে তারা সকল ক্যামেরা অফ করে নতুন করে লাগানো হলো এবং সিস্টেম আপডেট করলো এমন ভাবে যাতে উক্ত ক্যামেরা বাদে অন্য কোনো ক্যামেরা এখানে এক্টিভেট না করা যায়।সাথে সকল কিছুর এক্সেস মাশহুদের কাছে থাকবে।সে ব্যতীত এখানে কেউ আসতে বা বের হতে পারবে না।জাফরিব যদি এখান থেকে বের হতে চায় তবে মাশহুদের ডিভাইসে প্রথমে এক্সেস পারমিশন চাইবে, সে পারমিশন দিলে ফ্ল্যাটের মেইন ডোর ওপেন হবে।প্রায় ৩০ মিনিট সময় লেগেছিল সবটা ঠিক করতে৷ জাফরিন তখন ঘুমে মগ্ন।সবাই ফেরত যাওয়ার পর মাশহুদ ক্লান্ত দেহে গা এলিয়ে দিলো পাশের কাউচে।জাফরিনের হাতটা এবার চিন্তা ফেলছে তাকে।

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো সে।রান্নাঘর থেকে এক মগ কফি বানিয়ে দাঁড়ালো বারান্দায়।স্মৃতি পাতায় তখন ভেসে উঠে মাস ছয়েক পূর্বের এমনি এক সন্ধ্যে বেলা।

“স্যার,আপনি মেয়েকে অনেক ভালোবাসেন?”

“জানো তো?ওর মা ছেলে চেয়েছিল কিন্তু যখন ওর জন্ম হয় ও ওর মা কে দেখে ভ্রু কুঁচকে, ঠোঁট উল্টিয়ে তাকিয়ে থাকতো।তার কোলেও যেতে চাইতো না।অথচ সন্তান হয় মা ভক্ত।আমি কোলে নিলেই সে কী হাসি হাসতো।মেয়েটা আমার কাঁদতে জানে না।আমি কেন যেন ওকেই বেশি আদর করি।”

“তবে ওই ছেলের সাথে বিয়েতে মত দিলেন কেন?”

“জাফরিন পছন্দ করেছে ঈশানকে।আমি ওর এই পছন্দকে সম্মান করি বলে।”

দমকা বাতাসে ঘোর কাটে মাশহুদের।কাউকে না দেখে ভালোবাসা যায়?যায়, যেমনটা বেসেছে মাশহুদ। আজমল শিকদারের মুখে মুখে মেয়েটার কথা শুনে তাকে ভালোবেসেছে।যে মুহুর্তে জাফরিনের বিয়ে ঠিক হলো, সে বার বার চেয়েছে বিয়েটা যেন না হয়।ভেঙ্গে যাক এই বিয়েটা।যে কোনো মূল্যেই হোক।কিন্তু মূল্যটা যে আজমল শিকদারের মৃত্যু হতে পারে তা কখনো ভাবতেও পারেনি সে।

জাফরিনের জেগে উঠার আগ মুহুর্তে সে ফিরে এলো।নাস্তার টেবিলে রেখে এসেছিল ছোট্ট একটা নোট সাথে ডিনার।যেখানে লেখা ছিল,

“ফিনিশ ইট,ডিয়ার লেডি।”

(৫৬)

ভিনদেশে থাকা মেয়ের জন্য মায়ের মন সব সময় কু গাইতেই থাকে।আজ সকাল থেকে মেয়ের জন্য অস্থির হয়ে আছে জাফরিনের মা।বড় ভাইয়ের বাড়িতে এসেছিল সে।তার ভাই অস্থিরতা দেখে বলল,
“একটা কথা বললে শুনবি?”
“কি কথা?”

“আমরা সবাই তো দেখি জাফরিন আর ইউভান কতোটা কাছে। ওদের চার হাত এক করে দেওয়া যায় না।”

“কী বলেন এসব ভাই?ওরা নিজেদের ভাই বোন মনে করে। ”

“আপন ভাই বোন তো আর না।তাছাড়া ইউভানের সাথে যার সম্পর্ক ছিল সে তো এখন বাপ মায়ের পছন্দে বিয়ে করেছে।ওদের চার হাত এক হলে আমার আর তোর থেকে শান্তি কেউ বেশি পাবে না।”

জাফরিনের মা নিজের ভাইয়ের কথায় চিন্তায় পড়লেন।সত্যি তো আর এই পৃথিবীতে কেউ নেই যে ইউভানের মতোন জাফরিনের খেয়াল রাখবে।যদি এমন হয় তো ক্ষতি কীসের?

ঘুম থেকে জেগে জাফরিন দেখতে পেল তার লাগানো দুটো ক্যামেরার কোনোটাই কাজ করছে না।সে ভেবেছিল যান্ত্রিক কোনো গোলযোগপূর্ণ কারণে এমন হচ্ছে।ফুটেজ চেক করে দেখতে পেল এমিলি এবং ডাক্তার সমেত দুজন তার ফ্ল্যাটে প্রবেশ করছে, সে ঘুমিয়ে যাচ্ছে।এরপর আর কিছুই নেই, সব সাদা কালো।দীর্ঘ শ্বাস ফেলল সে। তার বার বার মনে হপ্য কেউ একজন তার অনুপস্থিতিতে এখানে আসে। কে সে?এটাই জানার জন্য লাগিয়েছিল দুটো ক্যামেরা।হয়তো কম দামী বলে নষ্ট হয়ে গেল।দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিচে নেমে এলো সে।তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা তার স্বাভাবিক লাগে না।এমিলি মেয়েটা এত কেন করে?কি সুন্দর তার পুরো ফ্ল্যাট গুছিয়ে রেখেছে।অথচ সে এত বড় কোম্পানিতে জব করে। খাবার টেবিলের কাছে এসে জুসের গ্লাস দেখতে পেল সে। হাতে নিয়ে এক চুমুকে সবটা শেষ করে ফেলেছে।টেবিলে ঢাকা দেওয়া নোটটা দেখে তার ভিতরে সব কিছু জমে গেল।এই মুহুর্তে একটা ভয় কাজ করতে লাগলো।কি লিখেছে এমিলি?

“ডিয়ার লেডি?” মানে কী?সে কেন তার প্রিয় নারী হতে যাবে?তবে কি এমিলি সমকামী?

নাউজুবিল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ বলে তিন কদম পিছিয়ে এলো সে। কাউচে বসে নিজের কপালে হাত রেখে বলল,

“এজন্যই বুঝি আমার প্রতি তাহার এত দরদ?এজন্যই কী আমার দিকে এভাবে তাকাতো?তার চোখে আমার জন্য মায়া ছিল না? কী ছিল ওসব?আমি এখন কী করবো?”

জাফরিনের মাথায় তখন শ’খানেক চিন্তা।সে পায়চারি করতে করতে ভাবে,ঘুমানোর পর এমিলি তার সুযোগ নেয়নি তো?”

এমন সময় কলিংবেলের শব্দে তার ঘোর ভাঙ্গে।স্ক্রিনে একজন ডেলিভারি বয় দাঁড়িয়ে আছে।জাফরিন ভাবে এই মুহুর্তে সে কিছু অর্ডার করেছে বলে মনে হয় না।তবে কে এলো?দরজা না খুলে দাঁড়িয়েই স্ক্রীনে দেখতে পায় একজন মুখ ঢাকা লোক দাঁড়িয়ে। সে হেসে বলল,

“মাম ইউর অর্ডার। প্লিজ চেক ইট।”

“কিন্তু আমার কোনো অর্ডার ছিল না।আপনি ভুল ঠিকানায় এসেছেন।”

“জি না ম্যাম, আপনি একটু বেরিয়ে এসে দেখুন।”

“আমি কিছু কিনিনি।আপনি ভুল ঠিকানায় এসেছেন।”

“ম্যাম ঠিকানা এটাই দেওয়া।আপনি দয়া করে রিসিভ করুন। না হলে আমার চাকরিটা চলে যাবে।”

জাফরিনের এবার মায়া হলো।সে দরজা খোলার জন্য কোড চাপতেই কনফার্ম ম্যাসেজ পেলো মাশহুদ। সে তখন ব্যস্ত ছিল মিটিংয়ে। মোবাইল স্ক্রীনে দেখলো বাইরে ডেলিভারি বয় দাঁড়ানো।সে ভেবেছিল হয়তো জাফরিন কিছু আনিয়েছে। তাই ওকে করতেই দরজা খুলে গেল।কিন্তু স্ক্রিনে থেকে চোখ সরানোর পূর্বেই সে বুঝে গেল তার জীবনের সব থেকে বড় ভুলটা সে করে ফেলেছে।যে ভয় পাচ্ছিলো সেটাই হলো।তার চোখের সামনেই কেউ একজন সজোরে আঘাত করে বসলো জাফরিনের মাথায়।চুইয়ে চুইয়ে রক্ত ঝরছে,তিনজন লোক টেনে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।শক্ত করে বেঁধে ফেলে তার চুলের মুঠি ধরে বলছে,

“পেনড্রাইভ কোথায়?তোর বাবা শেষ বার তোকে যে মেইল করেছিল তাতে কী ছিল?”

ক্লান্ত জাফরিনের দুচোখে নেমে এলো রাজ্যের অস্থিরতা। সে ধীরে ধীরে তলিয়ে গেল ব্যথাহীন, যন্ত্রণাহীন কোনো এক রাজ্যে।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here