গল্পঃবসন্ত এসে গেছে লেখাঃনুশরাত জেরিন ১.২

গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
লেখাঃনুশরাত জেরিন
১.২
পর্বঃ১

—এই মেয়ে ওঠ,ওঠ বলছি।ওঠ আমার বেড থেকে।

কথাটা শুনতেই লাফিয়ে খাট থেকে নামলো অপু।
অন্ধকারে সামনে দাড়িয়ে থাকা লোকটার মুখটা ঠিকমতো দৃষ্টিগোচর হলোনা তার।
কিন্তু এটুকু বুঝতে পারলো লোকটা তার স্বামী।একটু আগেই তিনকবুল পড়ে এই লোকটার সাথে অপুর বিয়ে হয়েছে।
সে এমুহূর্তে বসে ছিলো ফুল দিয়ে সাজানো এক খাটের ওপর।
আজ তাদের ফুলসজ্জা।
সেই উপলক্ষেই মুলত খাটটা সাজানো হয়েছে।তাছাড়া রুমটাও বেশ সাজানো গোছানো।দামী দামী আসবাবপত্র ভরা রুমটা।তাকালেই চোখ ঝলসে যায় যেনো।
অপু কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে তার সদ্য বিয়ে করা স্বামীর দিকে তাকালো।কিন্তু কিছুতেই মুখ দেখতে পেলোনা।শুধু দেখলো এক লম্বা চওড়া পুরুষ অবয়ব।

লোকটা তাকে খাট থেকে নামতে কেনো বলছে?তাও এমন রাগী কন্ঠে?

ঘোর কাটলো লোকটার ঝাঁঝালো কণ্ঠে,

,

—ড্যাবড্যাব করে কি দেখছিস হ্যা?ছোটলোক কোথাকার,বড়লোক ছেলে জিবনে দেখিসনি?

অপুর কথাগুলো শুনে খুব রাগ হলো,সাথে অভিমানও হলো।নতুন বউয়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?

মিনমিন করে বললো,

—এভাবে কথা বলছেন কেনো?

—তো কিভাবে কথা বলবো তোর সাথে বল?আপনি আপনি করবো?নাকি মাথায় নিয়ে নাচবো?

—আমি কি তাই বলেছি নাকি?

—আবার কথা বলিস?আবার?বড়লোকের ছেলে দেখে গলায় ঝুলে পরে আবার মুখে এতো বড় বড় কথা?

অপুর এবার বেশ রাগ হলো।সে তেজ দেখিয়ে বললো,

—মুখ সামলে কথা বলুন?নইলে কিন্তু…..

মুখের কথা শেষ করতে পারলোনা অপু।তার আগেই লোকটা আবার বললো,

—-নইলে কি হ্যা?নইলে কি?
ইচ্ছে তো করছে দেই এক চড়।দেবো? দেবো চড়?

শক্ত পোক্ত হাতটা অপুর উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসতেই অপু আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলো।

চোখ মেলে দেখলো চারদিকে অন্ধকার, ঘুটঘুটে অন্ধকার।
অপু আশেপাশে কিচ্ছু খুজে পেলোনা।হাত বাড়িয়ে বালিশের পাশ থেকে ফোনটা উঠিয়ে টর্চ জালালো।একি কোথায় সে?কোথায় তার সেই রাগী বদমেজাজি বর?যে কিনা বাসর রাতেই বউকে তুই তোকারি করে?হাত তুলতে যায়?
কোথায় সে?
কোথায় সেই ফুলে ঘেরা খাট?সেই রুম?
কোথায়?
অপু তো তার নিজের ঘরে শুয়ে আছে?
তাহলে এতোক্ষণ কি সে সপ্ন দেখছিলো?
সপ্ন? না না এটা সপ্ন হতে পারেনা কিছুতেই।এটা তো দুঃসপ্ন,ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন।

,

,

ওড়না নিয়ে কপাল গলা মুছে নিলো অপু।ভয়ে ঘাম ছুটে গেছে তার।
খাট থেকে উঠে লাইটটা জালিয়ে নিলো সে।আর ঘুম হবে না আজ রাতে।
সপ্নের রেশটা তারা করে বেরাবে সারা রাত।
প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। আচ্ছা ভোরের সপ্ন নাকি সত্যি হয়?এটাও কি সত্যি হবে?
না না কিছুতেই না?এমন সপ্ন সত্যি হতেই পারেনা।

আজান দিতেই অজু করে নামাজ পরে নিলো অপু।
তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো।সকালের নাস্তা বানাতে হবে তাকে।

ভাল নাম তার অপরুপা,ডাক নাম অপু।এবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। মফস্বল এলাকার মেয়ে সে।পড়ালেখায় খুব ভাল এবং তারচেয়েও বেশি ভাল সে স্বভাবে।
,

,
🌼🌼

,

—স্যার,বড় স্যার আবার অসুস্থ হয়ে পরেছেন।

—কিহ,কবে?কিভাবে? কখন?

—আসলে স্যার,আরও দুইদিন আগে থেকেই তিনি অসুস্থ।

—দুইদিন ধরে অসুস্থ বাবা,আর আজ আপনি আমায় জানাচ্ছেন?

ঝাঁঝালো গলার কথাগুলো শুনে লোকটা আমতা আমতা করে,মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকে।এই মুহুর্তে কিছু বলা মানেই বাঘের মুখে হাত ঢোকানো।নোমান খানের এমনিতেই মেজাজ চড়া থাকে তারউপর এতোবড় কথা শুনে মেজাজ তো চড়া হবেই।

উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করে নোমান,

—কি হলো কথা বলুন,
কথা বলুন।

চিৎকার শুনে লোকটার হাটু কাপে।মাথা চুলকে বলে,

—ভুল হয়ে গেছে স্যার।

—ভুল হয়ে গেছে?হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ভুল হয়ে গেছে?বাবা আমার জন্য কি সেটা আপনারা জানেন না?
এমন ভুল কিভাবে হয় আপনাদের?

লোকটা আবারও চুপ থাকে।

নোমান রাগে নিজের চুল টেনে ধরে।চোখ লাল থেকে ভয়ংকর লালে পরিনত হয়।চিৎকার করে বলে ওঠে,

—হা করে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?আউট, আউট ফ্রম হেয়ার ইডিয়ট।

লোকটা দৌড়ে পালায়।
নোমান খানের রাগ সম্পর্কে তাদের ধারনা আছে।খুনও করে ফেলতে পারে রাগলে।তারউপর যদি হয় বাবার ব্যাপার তাহলে কথাই নেই।

লোকটা বেরিয়ে যেতেই নোমান তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বের হয়।গটগট করে সিড়ি বেয়ে নামে।আলিসান এই বিলাস বহুল বাড়িতে সে আর কিছু চাকর বাকর ছাড়া আর কেউ নেই।কেউ না।
যদিও তার বাবা আছে,তবে সে আলাদা বাড়িতে থাকে।আলাদা ঘর সংসার নিয়ে।নোমানকে থাকতে বলেছিলো অনেকবার।কিন্তু সে থাকেনি।এমনকি বাবার বিজনেসেও সে বসেনি।নিজের পরিশ্রমে নিজের বিজনেস দাড় করিয়েছে সে।
,
,
পর্ব ২

—এখনো নাস্তা তৈরী হয়নি?আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো আমরা?

তাড়াতাড়ি হাত চালাতে চালাতে বললো অপু,

—এইতো ভাবি,এক্ষুনি হয়ে যাবে।

—এই কথাটা তো ১০বার শোনা হয়ে গেলো আমার।তোমার ভাইটা যে খেয়েদেয়ে অফিসে যাবে সে খেয়াল কি আছে?প্রতিদিন এমন ভাবে দেরি করে অফিসে গেলে যে বস অফিস থেকেই বের করে দেবে,তখন খাবার জুটবে কোথা থেকে?

—এখনো তো ৮টায় বাজেনি ভাবি।

অপুর কথা শুনে তার ভাই অনিক বলে উঠলো,

—৮টা বাজেনি তো কি হয়েছে,তাই বলে কি আরও দেরি করবি?তোর ভাবির মুখে মুখে আবার কথা বলিস?বড়দের সম্মান করতে জানিস না?

অপুর ভাবি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো,

—দেখেছো তো,এভাবেই কথা বলে ওরা মা মেয়ে আমার সাথে।আমার কথার কোন দামই দেয়না।আমাকে একেবারে ফেলনা ভাবে এরা।
আর তোমার মা টার কথা আর কি বলবো সে তো ঘুম থেকেই ওঠে ১০ টায়।উঠে নবাবের মতো খেয়েদেয়ে আবার শুয়ে পরে।

অনিক মাথা দুলিয়ে বলে,

—ঠিকই বলেছো,মা টাও যে কি হয়েছে না?গাধার মতো খাটনি করে কামাই করি আমি আর এরা সব শুয়ে বসে উড়ায়।

—হুমমম, সত্যি তাই।

অপু নাস্তা তৈরী করে টেবিলে নিয়ে আসে।ভাইয়ের সামনে প্লেট এগিয়ে নাস্তা দেয়।আড়চোখে একবার তাকায় ভাইয়ের দিকে।চোখ ছলছল করে।
বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার।
মনে হয় এই কি তার সেই ভাই?সেই আগের ভাই?যে বোনের সাথে সারাদিন খুনসুটি করে বেড়াতো।মাকে মাথায় করে রাখতো?এই কি সে?
যে কিনা বোনের চোখের একফোঁটা পানি সহ্য করতে পারতোনা?
তার ভাইয়ের কি মনে নেই মা অসুস্থ? হার্টের অপারেশন করাতে হবে তাকে?বিছানা থেকে উঠতেও যে পারেনা তাকে কথা শুনাচ্ছে ভাই?মায়ের অপারেশন করা দুরে থাক ডাক্তার দেখাতেও যে ভাই কার্পন্য করে সে অপুর ভাই হতে পারনা।কিছুতেই না।
আচ্ছা হতে পারে এটা অন্য কেউ,শুধু চেহারাটাই অনিকের মতো?তার ভাই হয়তো অন্যকোথাও আছে?অপু আর তার মাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে? হতে পারেনা?হতেও তো পারে।

—খাওয়ার সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে কি খাওয়া যায় নাকি?

অনিকের কথায় অপুর ধ্যান ভাঙে।
আবার রান্নাঘরে গিয়ে দাড়ায়।
চোখের পানি বাধ ভাঙে।
কিছুক্ষণ পর নিজেকে স্বাভাবিক বানায়।একটা প্লেট এ খাবার নিয়ে মায়ের রুমে এগোয়।
মাকে খাইয়ে ভার্সিটি যেতে হবে তাকে।
কিছুদিন পরেই ইয়ার ফাইনাল পরিক্ষা আছে তার কিন্তু পড়াশোনার সময়ই পায়না।বাড়িতে থাকলে অসুস্থ মায়ের সেবা আর বাড়ির সকল কাজকর্ম করতে করতে দিন যায়।তাছাড়া কিছু টিউশনিও করায় অপু।টিউশনির টাকা দিয়েই তো নিজের পড়ার খরচ চালায়।ভাই তো পড়াশোনা করাতে একেবারেই রাজি ছিলোনা।সে তো চায় যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব অপু কে বিয়ে দিয়ে এ বাড়ি থেকে বিদেয় করতে।

,মায়ের পাশে চৌকিতে ধীরে ধীরে বসে অপু।এতো সাবধানতার পরও চৌকি মড়মড় করে ওঠে।ভাঙা চৌকির মলিন বিছানা ওপর শুয়ে চোখ পিটপিট করে তাকান আলেয়া বেগম।বয়স তার খুব বেশি না হলেও অসুখের জন্য বেশি দেখায়।
হাত পায়ের চামড়ার সাথে মুখের চামড়াও কুঁচকাতে শুরু করেছে ইদানীং।
খাট থেকে উঠে চলাফেরা করার মতো শক্তি খুব একটা পাননা তিনি।চোখ পিটপিট করে অপুর দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করেন আলেয়া বেগম।
অপু দেখে তাড়া দিয়ে বলে,

—চোখটা একটু খোলো তো মা,চোখে মুখে জল দিয়ে খাবারটুকু খেয়ে নাও।

আলেয়া বেগম চোখ বুজেই হাসেন।বেদনার হাসি হাসেন।

—খাবার খেয়ে কি আর হবে?

—কি হবে মানে?খাবার না খেলে তো তুমি আরও অসুস্থ হয়ে পরবে।

—এমনিতেও তো অসুস্থই।সুস্থ আর হচ্ছি কোথায়?

—হবে সুস্থ, ঠিক একদিন সুস্থ হবে।আবার হেসেখেলে বেড়াবে তুমি মা,আমি কোন ভুল করলে শাসন করবে,লাঠি নিয়ে মিথ্যা মারার নাটক করবে।

আলেয়া বেগম আবার হাসেন।মেয়ের মন তিনি বুঝতে পারেন।তিনি ছাড়া যে অপুটার কেউ থাকবে না সেটাও বোঝেন।কিন্তু মিথ্যা আশা বেধে কি কোন লাভ আছে?আলেয়া বেগম তো জানেন তিনি বেশি দিন বাঁচবেন না।নিজের শরীরের খবর তো তিনি বোঝেন।

,

🌻🌻

,

,

—বাবার কথা মনে পরলো তোমার নোমান?

আরমান খানের কথায় উত্তর দেয়না নোমান।
সে বাবার পাশে বসে বাবার হাত মুঠো করে বসে আছে।সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে।কিছু চুল কপালে এসে পরেছে।একহাত দিয়ে চুলগুলো পিছে ঠেলে দেয় নোমান।হাতের দামী ঘরিতে একবার চোখ বুলায়।

বাবার উপর তার অনেক রাগ জমানো,অনেক বছরের রাগ।ভালভাবে কখনো কথাও বলা হয়নি তার বাবার সাথে।ওপরে ওপরে গম্ভীর ভাব ধরে কঠোর হওয়ার চেষ্টা করে সে।অথচ ভেতরে তার বাবার জন্য এক আকাশ সম ভালবাসা আছে।পুরো পৃথিবীতে আপন বলতে এই বাবাটাই তো শুধু আছে তার।

ছেলের উত্তর না পেয়ে আরমান খান আবার বলেন,

—কথা বলবা না?

নোমান গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দেয়,

—হুমমম বলছি।

আরমান খান দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
ছেলের এই রাগী বদমেজাজি হয়ে ওঠার পেছনে পুরো অবদানটা তারই।
নোমানের ছোটবয়সে মা মারা যাওয়ার পর মায়ের অভাব পুরন করতে যখন নতুন মা আনা হলো তখন থেকেই তার পরিবর্তনের সূচনা।সৎ মায়ের অত্যাচারে অবহেলায় নোমান বদলে যেতে শুরু করে। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি আরমান খান। কিন্তু যতোদিনে বুঝতে পেরেছে ততোদিনে খুব দেড়ি হয়ে গিয়েছিলো।
নোমানের কঠোরতা,জেদ ফুটে উঠেছিলো তার চরিত্রে।
তারপরেই তো পড়াশোনার জন্য পাড়ি জমালো বিদেশে।
আর ফিরে এলো সম্পুর্ন অচেনা এক নোমান হয়ে।বাবার বিজনেসে না বসে নিজে বিজনেস চালু করে।অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজের কোম্পানীকে নিয়ে যায় দেশের প্রথম সারির কোম্পানীর কাতারে।নোমান খান যাকে দেখলে প্রত্যেকটা কর্মচারীর হাটু কাপে,যার সামনে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে গেলেও গলা শুকিয়ে কাঠ হয়।

,
চলবে…..
১.২
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1268321536882946&id=439669216414853
৩.৪.৫
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1268715680176865&id=439669216414853
৬.৭.৮
https://www.facebook.com/439669216414853/posts/1269409726774127/
৯.১০.১১
https://www.facebook.com/439669216414853/posts/1270192686695831/
১২.১৩.১৪
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1271247989923634&id=439669216414853
১৫.১৬.১৭
https://www.facebook.com/439669216414853/posts/1272624799785953/
১৮.১৯.২০
https://www.facebook.com/439669216414853/posts/1273269699721463/
২১.২২.২৩
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1274265122955254&id=439669216414853
২৪.২৫.২৬
https://www.facebook.com/439669216414853/posts/1275003002881466/
২৭.২৮.২৯
https://www.facebook.com/439669216414853/posts/1275600989488334/
৩০.৩১ ও শেষ পর্ব
https://www.facebook.com/439669216414853/posts/1276297992751967/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here