গল্পঃ প্রেমমোহ
লেখিকাঃ ফারজানা আফরোজ
পর্বঃ ৭
–” শুভ্রতা। তুমি কিন্তু মোটেও ভালো কাজ করছ না। জানো আমি কতটা রেগে গেছি। তোমাকে তো এইজন্য শাস্তি পেতেই হবে।”
ভয় পেয়ে শুভ্রতা আমতা আমতা করে বলল,
–” ম মানে আম আমি কি কি করেছি ভাইয়া?”
–” স্পন্দন তোমাকে বাড়িতে এনেছে বলে তুমি শুধু ওকেই চা দিবে? বাসার অন্যান্য সদস্যদের প্রতি একটু খেয়াল রাখা উচিৎ নয় ?”
–” হুম। কি করবো এখন ভাইয়া?”
সাকিব জোরে জোরে হাসতে লাগলো। হাসি থামিয়ে বলল,
–” কিছুই করতে হবে না এখন শুধু আমার জন্যও এক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে এসো। স্পন্দন যেহেতু তোমার হাতের চা খাচ্ছে তারমানে তোমার হাতের রান্না ভীষণ টেস্টি।”
শুভ্রতা মুচকি হেসে বলল,
–” আচ্ছা ভাইয়া।”
আবারো রান্না ঘরে এসে তিন মগ কফি বানালো। ড্রয়িং রুমের কাছে আসতেই মিসেস সাবিনা বেগমকে দেখে সালাম দিল শুভ্রতা।
–” আন্টি কফি।”
–” তুমি কেন বানাতে গেলে কফি। টুনির মাকে বললে ওই বানিয়ে দিতো।”
–” কাজ করতে আমার ভীষণ ভালো লাগে আন্টি। আমি বরং আঙ্কেল আর বড় ভাইয়াকে দিয়ে আসি কফি।”
মিসেস সাবিনা বেগম কফির মগে চুমুক দিল। শুভ্রতার কথা শোনে কেশে উঠলেন। চিল্লিয়ে বলে উঠলেন,
–” এই এই শুভ্রতা তোমার আঙ্কেলের কফির মগটা আমার হাতে দেও আমি দিয়ে আসি তুমি বরং সাকিবকে দিয়ে আসো।”
–” কেন আন্টি? আঙ্কেল কি আমাকে পছন্দ করেন না?”
হতাশ হয়ে বললেন মিসেস সাবিনা বেগম,
–” কথা তা নয়। উনিও মানুষকে সাহায্য করতে ভীষণ পছন্দ করেন। কিন্তু তোমার চেহারার সাথে…!”
কথাটা বলে থেমে গেলেন মিসেস সাবিনা বেগম। শুভ্রতা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
–” আমার চেহারার সাথে কি আন্টি?”
–” তেমন কিছু না মা। আসলে তোমার আঙ্কেল স্পন্দনের মত বদমেজাজি। উনার সামনে না যাওয়াই ভালো। প্লিজ যেও না।”
শুভ্রতা মাথা এদিক ওদিক করে সায় দিল। সে যাবে না। কিন্তু ওর মনে একটা খটকা লেগেই আছে। যে জানতে চায় সেই অর্ধেক কথার পুরো অর্থ। কিন্তু মুখ ফোটে বলতে পারছে না। এক রাজ্য হতাশ নিয়ে সাকিবের রুমের দিকে পথ বাড়ালো শুভ্রতা।
–” তুমি আমাকে এক মুঠো ভালোবাসা দেও আমি তোমাকে পৃথিবী ভরিয়ে ভালোবাসা দিব। তোমাকে দেখার পর থেকেই আমার মন শুধু তুমি তুমি করে। তোমার প্রেমের মোহে অন্ধ হয়ে গেছি আমি। শুধু বলো ভালোবাসি।”
দরজার কাছে যেতেই সাকিবের এমন অনুনয় করে কণ্ঠস্বর শুনে ঘাবড়ে গেল শুভ্রতা। দরজার কাছে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বলল,
–” আসবো ভাইয়া?”
সাকিব শুভ্রতার কন্ঠ শোনে ঘাবড়ে গেল। মনের ভিতর জেগে উঠলো এক রাজ্য ভয়। শুভ্রতা যদি তার কথা শুনতে পায় তাহলে তাকে কি মনে করবে। লজ্জায় সে শুভ্রতার মুখের দিকে তাকাতে পারবে কি? নিঃশ্বাস ছেড়ে মৃদু হেসে বলল,
–” হুম আসো।”
সাকিবের মুখ দেখে শুভ্রতা কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে। তাই এমন একটা ভাব করলো যেন সে কিছুই জানে না কিংবা শুনে নাই। মুখে হাসির রেখা টেনে হেসে বলল,
–” আমার হাতের চমৎকার কফি খেয়ে নিন ভাইয়া পরে কিন্তু মগ খেয়ে ফেলতে চাইবেন।”
সাকিন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। ঠোঁটের কোণায় হাসি ঝুলিয়ে বলল,
–” হাহাহা। তাই নাকি? তাহলে দেও দেও কফির মগটা।”
শুভ্রতা কফির মগ বাড়িতে দিয়ে রুম থেকে চলে যেতে নিলো। সাকিব পিছু ডেকে হালকা কেশে বলল,
–” তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি? যদি মনে কিছু না করো।”
–” জ্বী ভাইয়া করতে পারেন প্রশ্ন।”
–” তোমার আব্বু আম্মু কিভাবে মারা যায়? তাছাড়া তোমার মামা মামী এমন কেন? আম্মুর কাছ থেকে শুনেছি উনারা তোমাকে লাইক করে না কিন্তু কেন?”
–” আমার বয়স যখন পাঁচ কি ছয় তখন আমার আব্বু আম্মু অ্যাকসিডেন্টে মারা যান। তখন আমি নানুর কাছেই থাকি। আমার এগারো বছর বয়সে উনিও ত্যাগ করেন এই পৃথিবীর মায়া। পরে আমার ঠাঁই হয় আমার মামার বাড়িতে। ছোট থেকেই আমার মামা মামী আমাকে পছন্দ করতেন না। পছন্দ কেন করতেন না তার কারণ আমার অজানা । তবে হ্যাঁ আমার নানু আমার জন্য কিছু টাকা রেখে গিয়েছিল সেই টাকা দিয়েই আমি পড়াশোনা করেছি ইন্টার পর্যন্ত। ভার্সিটিতে ভর্তি হতে চেয়েও পারিনি। মামী দেয়নি। আর কয়েকদিন হল বিয়ে। বিয়ের গন্ধ না যেতেই স্বামীও একা করে দিয়ে চলে গেলো।”
সাকিব মনোযোগ সহকারে শুনলো শুভ্রতার কথা। কফির মগে চুমুক দিয়ে আবারো প্রশ্ন করলো,
–” নতুন করে পড়ালেখা করতে চাও? তাহলে সব দায়িত্ব আমি নিবো।”
–” জ্বী ভাইয়া আমি পড়ালেখা করতে চাই তবে আমার কিছু শর্ত আছে?”
–” বলো?”
–” আমার পিছনে যত টাকা ব্যয় করবেন সব কোনো একটা নোটে লিখে রাখবেন। পড়ালেখা শেষ হলেই আমিও যেকোনো জব যদি খুঁজে পাই তাহলে ফেরত দিয়ে দিবো।”
সাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে হাসলো। শুভ্রতা অভিমানী সুরে বলল,
–” হাসির কিছু বলেছি আমি যে আপনি হাসছেন?”
–” নাহ এমনি হাসলাম। তুমি এখনও বাচ্চা মেয়েই থেকে গেলে। ওকে যাও তোমার সব শর্তে রাজি আমি এখন খুশি তো?”
–” ভীষণ।”😊
–” আরেকটা কথা। জীবনে নতুন করে আর সংসার জীবন শুরু করতে চাও না? ইচ্ছা আছে কি?”
শুভ্রতার মুখটা মলিন হয়ে গেল। মলিন মুখেই বলল,
–” নাহ ভাইয়া। সংসার তো আমার শুরু হবার আগেই শেষ তাই নতুন করে আর কোনো সংসার করতে চাই না। যেমন আছি তেমনই ভালো আছি। চাই না আর কারো মায়ায় জড়িয়ে পড়তে, চাই না আর কাউকে ভালোবাসতে, চাই না নতুন আলোর সন্ধান খুঁজে বারবার অন্ধকার গর্তে হুমড়ি খেয়ে পড়তে। একাকী জীবন আলোর জীবন।”
সাকিবের মুখটা মলিন হয়ে উঠলো। শুভ্রতার চোখের পানি টপ করে গালে বেয়ে পড়লো। সে এক মুহূর্তও ঐখানে দাঁড়িয়ে না থেকে নিজের রুমে চলে গেল। সাকিব মনে মনে বলছে,
–” ইস মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম। আম্মু ঠিকই বলে আমি অতিরিক্ত কথা বলি।”
স্পন্দনের রুমের বারান্দাটা ভীষণ সুন্দর। বিভিন্ন ধরনের ফুলের টব, ইজি চেয়ার, ছোট্ট কৃত্রিম ঝর্ণা। পানিতে মুখ ডুবিয়ে টমিকে ডাকলো সে,
–” টমি টমি।”
দৌঁড়ে এসে স্পন্দের গায়ে মুখ ঘষতে লাগলো। ইজি চেয়ারে বসে পাশে টমিকে বসতে বলল। বাধ্য কুকুরের মত বসলো টমি। স্পন্দন এক নাগাড়ে বলতে লাগলো,
–” টমি তুই কোনোদিন অবহেলিত হয়েছিস? তাও আবার কাছের মানুষের কাছ থেকে?”
–” ঘেউঘেউ।”
–” কিন্তু আমি হয়েছি। যে মানুষটাকে আমি প্রচুর ট্রাস্ট করতাম সেই মানুষটা আমাকে অবহেলা করেছে। তার মায়া আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। আচ্ছা বলতো তাকে ভুলার জন্য কি করতে হবে আমাকে?”
–” ঘেউঘেউ।”
–” তাকেও কষ্ট দিতে হবে? কিন্তু তাকে তো আমি খুঁজে পাচ্ছি না। জানি না সে কোথাও থাকে। তাকে কষ্ট দিলেই কি আমি সুখী হবে তুই বলছিস?”
–” ঘেউঘেউ।”
স্পন্দন টমির কথা শোনে ভাবনায় পড়ে গেলো। সে এখন ওই মানুষটাকে কোথায় খুঁজবে? আদৌ কি খুঁজে পাবে? ভাবতে ভাবতেই তার চোখজোড়া বাগানের দিকে পড়লো। একটি মেয়ে পুকুরের পানিতে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। উল্টোদিক ঘুরে। সাদা জামা কাপড় দেখেই বুঝতে পারলো মেয়েটি শুভ্রতা। টমির দিকে তাকিয়ে অসহায়ের ভঙ্গীতে বলল,
–” এই মেয়েটার কষ্ট কিছুটা আমার মত। তবে ওর কষ্ট ওর আপন মানুষগুলো না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার জন্য কিন্তু আমার কষ্ট আমার প্রিয় মানুষটি পৃথিবীতে থাকা সত্ত্বেও বহু দূরে।”
–” ঘেউঘেউ।”
সাকিব মায়ের কাছে শুভ্রতার পড়া সমন্ধে কথা বলল। মিসেস সাবিনা বেগম এক কথাতেই রাজি হয়ে গেলেন যদিও উনি শর্ত শোনে বেশ হেসেছেন।
পরের দিন সকালে স্পন্দন রুম থেকে বের হতেই শুনলো,
চলবে,..?
বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। টমির ঘেউঘেউ শোনে স্পন্দন নিজের ভিতরের অনুভূতি প্রকাশ করে। একটা কুকুর এইসব কখনোই বলবে না। তাই এই নিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না।