গল্পঃ প্রেমমোহ
লেখিকাঃ ফারজানা আফরোজ
পর্বঃ ৮
–” স্পন্দন বাবা আমার একটা কাজ করে দিবি। প্লিজ না করিস না অনেক আশা নিয়ে এসেছি তোর কাছে।”
–” বলো?”
–” শুভ্রতাকে ভার্সিটি ভর্তি করিয়ে দিতে পারবি? দেখ বাবা মেয়েটা যদি পড়াশোনা করে তাহলে ভবিষ্যতে ওর নিজের বলে একটা আস্থা থাকবে। জানিস তো প্রত্যেক মানুষের নিজের বলে একটা খুঁটি দরকার হয়। চিকন খুঁটি নয়, এমন একটি খুঁটি যার দ্বারা নিজেকে সে রক্ষা করতে পারবে।”
বিরক্তি প্রকাশ করে বলল স্পন্দন,
–” লেকচার শেষ হয়েছে? শুনো আমার হাতে মোটেও সময় নেই। তোমার বড় ছেলেকে বলো সে নিয়ে যাক। সেদিন দেখলাম তোমার ছেলে এই মেয়ের প্রতি অনেক টান তো আজ কি হলো?”
–” ওর নাকি ভার্সিটি গেলে ভয় করে। ছোট থেকে তো পড়া চোর ছিল এখনও মনের ভিতর সেই চোর চোর গন্ধ বের হয়নি। তুই তো আমার ব্রিলিয়ান্ট বাবা প্লিজ নিয়ে চল মায়ের এইটুকু কথা রাখবি না?”
–” শুরু হয়ে গেলো ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল। এখন আমি যে এই বিপদটাকে ভর্তি করাবো মার্কশিট, সার্টিফিকেট, প্রশংসাপত্র, অন্যনো যাবতীয় কাজপত্র আছে ম্যাডামের কাছে?”
স্পন্দন শুভ্রতার দিকে তাকালো। শুভ্রতা মাথা দুইদিক ঘুরিয়ে বুঝালো তার কাছে নেই। আবারো রাগে গজগজ করতে লাগলো স্পন্দন। কঠিন কণ্ঠে বলল,
–” তো? ভর্তি কিভাবে করাবো? আমার কিংবা তোমার পালিত মেয়ের মুখ দেখে তো আর ভার্সিটিতে ভর্তি নিবে না। কাগজপত্র ছাড়া ভার্সিটি গেলে আমাদের রোহিঙ্গা ভেবে মায়ানমারে পাঠিয়ে দিবে। সো, তুমি এখন ভেবো দেখো কি করবে আমি আসছি। আর তোমার পালিত মেয়েকে বলো সৌন্দর্য দেখিয়ে চলচ্চিত্রের হিরোইন হওয়া যায় কিন্তু ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া যায় না।”
স্পন্দনের এই অপমান শুভ্রতার মনে লেগেছে। শেষের কথাটুকু যে কতটা জগন্য ভাবে বলেছে শুভ্রতা ঠিকই বুঝতে পারছে। তার চোখের কোণে পানি এসে টলমল করছে। মিসেস সাবিনা বেগম স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলে উঠলো,
–” তুই দিনদিন খারাপ থেকে খারাপে রূপান্তরিত হচ্ছিস স্পন্দন। আজকাল কি মেয়েদের সম্মান দিতেও ভুলে গেছিস। কই আগে তো এমন ছিলি না। বাদ দে সেসব কথা। সাকিবকে বলে ওর মার্কশিট আমি বের করে আনছি তুই শুধু ভর্তি করিয়ে দিয়ে আয়। পরে ওর স্কুল কলেজ থেকে বাকি কাগজপত্র আনা যাবে।”
–” ভর্তি করাবো মানে? আম্মু তুমি ভুলে গেছো আজকাল ভর্তি মানে অনলাইন। ওকে বলো অনলাইনে দরকাস্ত করতে।”
সাবিনা বেগম এইবার বেশ রেগে গেলেন। স্পন্দনকে ধমকের সুরে বলতে লাগলেন,
–” মিস্টার আফজাল হকের সাথে আমার কথা হয়েছে। উনি শুভ্রতার সব শোনে আমাকে বলেছে শুধু মার্কশিট নিয়ে যাবার জন্য। পরবর্তীতে স্কুল কলেজ থেকে বাকিসব কাগজপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য। তোর মাকে এতটাও বোকা ভাবিস না।”
স্পন্দন মায়ের ধমক খেয়ে চুপসে গেলো। শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে উচ্চ শব্দে বলল,
–” এইখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে বকা না খাইয়ে চলুন। আমার হাতে সময় খুব কম। সবসময় বিপদ সংকেতগুলো আমার আশে পাশেই ঘুরবে। আমাকে মৌচাক পেয়েছে যত্তসব।”
স্পন্দন বের হলো পিছু পিছু শুভ্রতা হাঁটা দিলো। গাড়ির কাছে যেতেই শুভ্রতা ঘাবড়ে গেল। যেহেতু স্পন্দন ড্রাইবার নয় তাহলে পিছনের সিটে বসা ঠিক না কিন্তু সামনের সিটে বসলে স্পন্দন যদি কিছু বলে? দুটানায় পরে গেলো শুভ্রতা। স্পন্দন তার চোখ দুটি ছোট ছোট করে তাকালো। শুভ্রতার চিন্তার ভাঁজ স্পন্দনের চোখে ফাঁকি দিতে পারেনি শান্ত ভঙ্গটিতে বলল,
–” আমার পাশের সিটে বসুন। চিন্তা করে দেখছি কুড়িতেই বুড়ি হয়ে যাবেন। জানেন কি? চিন্তা ভাবনা মানুষকে দ্রুত গতিতে বৃদ্ধ বানাতে সাহায্য করে। তবে হ্যাঁ সুন্দর মেয়েদের বুড়ি হওয়াতে দারুন লাগে। আমার স্কুলের একজন ম্যাম ছিলেন। বয়স তখন উনার আনুমানিক পঞ্চাশ ছিল। আমার চোখে তাকে দারুন লাগতো। ফর্সা মুখটা যখন পান খেয়ে লাল রঙ ধারণ করতো তখন ম্যামের প্রেমে পরে যেতাম। জানেন সেই সুন্দরী অপ্সরী ম্যাম ছিলেন আমার নানু।”
স্পন্দন গাড়ি ড্রাইভ করছে আর নানুর কথা বলছে। শুভ্রতা স্পন্দনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। স্পন্দন হয়তো বুঝতে পারছে না সে তার গম্ভীর মনসত্ব ধীরে ধীরে ত্যাগ করে ফেলছে।
–” জানেন আমার নানু…….!”
চুপ মেরে গেলো স্পন্দন। গাড়ি থামিয়ে দিয়ে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে অর্ধেক পানি শেষ করে শুভ্রতার দিকে না তাকিয়েই বলল,
–” সরি। বুঝতে পারিনি।”😊
–” ঠিক আছে।”
গাড়ি এসে থামলো কলেজের সামনে। আফজাল হকের রুমের দিকে পথ বাড়ালো দুজন। স্পন্দন শুভ্রতার হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে মার্কস দেখতে লাগলো। না ভালোই মার্কস শুভ্রতার। অবহেলায় থাকা সত্ত্বেও সে ভালো মার্কস করেছে ভাবতেই স্পন্দন মনে মনে অবাক হলো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মিষ্টি হেসে বলল স্পন্দন,
–” স্যার আসবো?”
কাজে মগ্ন ছিলেন মিস্টার আফজাল হক। স্পন্দনের কন্ঠ শোনে আনন্দের হাসি দিয়ে ইশারাতে বুঝালো ভিতরে আসার জন্য।
–” আসো স্পন্দন। পড়ালেখা শেষ করেই যে সেই গিয়েছিলে আর তো আসলে না ভার্সিটি। আমাদের ভুলে গেছো নিশ্চয়?”
–” না স্যার। সত্যি বলতে সময় হয়ে উঠেনি। শুনলাম অন্তু নাকি এই ভার্সিটির প্রফেসর?”
–” হ্যাঁ। কিছুদিন হলো জয়েন করেছে সে। তো এই মেয়ের কথাই বলেছে তোমার আম্মু?”
–” জ্বী স্যার।”
ভর্তির যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ করে দুইজন বের হয়ে পড়লো। বিরক্তি নিয়ে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলল স্পন্দন,
–” কোন স্কুল, কোন কলেজে পড়ালেখা করছেন? যাবতীয় ডিটেলস বলুন।”
শুভ্রতা সবকিছু বলল। কিন্তু শুভ্রতার কথা বেশি বুঝলো না স্পন্দন। রাগী গলায় বলল,
–” কাঁপছেন কেন? কি এমন বললাম আমি?”
–” ধমক দিয়ে কথা বললে ভয় করে না? ধমক ছাড়া যেন কথাই জানেন না আপনি।”
স্পন্দন কিছু বলার আগেই অন্তু এসে দাঁড়ালো। অভিমানী সুরে বলল,
–” শালা হারামী, কই ছিলি এতদিন? খোঁজ খবর কিছুই নেই। ফোন করলেও বিজি সবসময়। বাই দা ওয়ে কেমন চলছে দিনকাল।”
বন্ধুকে জড়িয়ে ধরলো স্পন্দন। কিছুক্ষণ তারা কথা বলল। অন্তু শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান নজরে বলল,
–” কে উনি? ভাবি?”
শুভ্রতা কেশে উঠলো। স্পন্দন পরিস্তিতি ঠিক করার জন্য বলল,
–” নাহ। আমার আম্মু পালিত মেয়ে। ভর্তি করাতে আসছিলাম।”
অন্তু জিজ্ঞাসা করলো,
–” পালিত মেয়ে মানে?”
–” রাতে ফোন দিয়ে ডিটেলস বলব। এখন এই মেয়েকে নিয়ে এক জায়গায় যাবো। তোর সাথে পরে কথা হবে।”
তাড়া দেখিয়ে শুভ্রতাকে নিয়ে চলে আসলো স্পন্দন। শুভ্রতা মৃদু স্বরে বলল,
–” কোথায় যাবো আমরা?”
–” আপনার স্কুলে।”
–” ওহহ।”
–” হুম।”
স্কুলে গিয়ে পৌঁছালো দুজন। শুভ্রতার স্কুল, কলেজ পর্যন্ত ছিল বিধায় ইন্টার পর্যন্ত সে এইখানেই পড়াশোনা করেছে। শুভ্রতাকে স্কুলে দেখেই চিনতে পারলেন হেডমাস্টার। ভীষণ খুশি উনি। স্পন্দন শুভ্রতার ব্যাপারে সবকিছু বলার পর অনেক কষ্ট পেয়েছেন উনি। শুভ্রতার ব্যাপারে যাবতীয় কাগজপত্র তিনি জোগাড় করে দিলেন। স্পন্দন সবকিছু দেখছিল হঠাৎ একটা নামে ও আটকে গেলো। নামটা ভালো করে দেখে স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নামটা দেখার পরেই স্পন্দনের চোখ ঝাঁপসা হয়ে উঠলো। টিস্যু দিয়ে চোখ পরিষ্কার করে ভারী কণ্ঠে বলল,
–” এবার যাওয়া যাক মিসেস শুভ্রতা।”
–” হুম।”
আকাশের কোণে মেঘ জমেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে বর্ষণ। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে জানা গিয়েছে পাক্কা তিনদিন থাকবে ভারী বৃষ্টি। বজ্রপাতও হবে খুব। স্পন্দন চাচ্ছে যত দ্রুত বাসায় যাওয়া যাক ততই ভালো। বজ্রপাত নামক ভয়ংকর বিদ্যুতের আলোকে অনেক মেয়ে ভয় পায় এখন সেই অনেক মেয়ের মতো যদি শুভ্রতা হয় তাহলে তো সমস্যা। ভয়ের কারণে যদি তাকে জড়িয়ে ধরে তাহলে সে কি করবে? অবশ্যই সে থাপ্পড় নামক বস্তুটি গালে সুন্দর করে বসিয়ে দিবে। নাহ বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। ঝুমঝুম করে নূপুরের শব্দের মধ্যে বৃষ্টির আওয়াজ। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভিজলে মন্দ হবে না। কিন্তু শুভ্রতা পাশে থাকায় সে পারছে না। হঠাৎই সেই নামটা মনে পড়লো স্পন্দনের। গাড়ি থামিয়ে একটা কাগজ বের করে জিজ্ঞাসা করলো,
–” কে উনি?”
চলবে,..?
বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। রি-চেইক করা হয়নি। আগামীকাল থেকে রেগুলার গল্প দিবো।