(১)
গভীর রাতে নিজের স্বামী নেহালকে চোরের মতো চুপিচুপি উঠে চলে যেতে দেখা যায়। প্রথম দু’দিন ব্যাপারটাকে হালকা ভাবে নিলেও আজ যেন কোনোভাবেই নিজের মনকে কিছু একটা বোঝাতে পারছে না কুসুম। নেহাল বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কুসুমও উঠে বসল। ওদের বাথরুমটা ঘরের বাইরে। এতদিন বাথরুমে যায় ভেবে উল্টো পাশ ফিরে ঘুমিয়েছে কুসুম, কিন্তু আজ কেন যেন মনটা কু গাইছে। মনে হচ্ছে,তার পিঠ পিছনে ভয়ংকর কোনো রহস্য চলছে। যেটা আজ তার মুখোমুখি হবে। কুসুম ফাঁকা ঢোক গিলে ধীর পায়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। এক সেকেন্ড স্ট্যাচুর ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে এগিয়ে চলল দরজার দিকে। দরজা খুব আস্তে করে চাপিয়ে রেখে গেছে নেহাল। কুসুমও হালকা হাতে দরজাটা খুলে নিলো। মাথা বের করে অন্ধকারে উঁকি দিতেই তার চোখে নেহালের চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। ড্রয়িংরুমে একটা স্বল্প পাওয়ারের ডিম লাইট জ্বলতে থাকে সারারাত,যাতে রাতে উঠে বাথরুমে যেতে আসতে সুবিধে হয় সবার। সেই হালকা আলোয় কুসুম দেখল, ছোট দেবরের ঘরে টোকা দিয়ে চলেছে নেহাল। কুসুমের কলিজা আৎকে উঠল। ছোট দেবর কিছুদিন হলো বিয়ে করেছেন। ব্যবসায়িক কাজে তাকে শহরে যেতে হয়েছে গতকাল সন্ধ্যায়। তার স্ত্রী, মানে শিমুল ঘরের ভেতর একাই রয়েছে। তাহলে তার ঘরে কী কাজ নেহালের? কুসুমের মনে হলো, তার সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। কিছু একটা রক্তে রক্তে ছুটে চলে সর্বাঙ্গ গরম করে তুলেছে। এত অস্থিরতা এর আগে কখনো হয়নি কুসুমের। মাত্র তিন বছরের বিবাহিত জীবনের মধ্যে এমন নিচু ঘটনার সাক্ষী হতে হবে, তা কল্পনাও করেনি কুসুম। কুসুম দরজার গোড়ায় বসে পড়ল, যখন দেখল শিমুল দরজা খুলে প্রায় টেনে ভেতরে নিয়ে গেল নেহালকে। তারপর খট করে দরজাটা আঁটকে দেওয়া হলো।
ব্যগ্রতা চেপে ধরল কুসুমকে। মাথা খাটালো সে। এভাবে নেহালকে পার পেয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। কুসুমের মতো নরম মনের মেয়ে পেয়ে যা ইচ্ছে তাই করবে? তা কিছুতেই মেনে নেবে না কুসুম, আর না নেহালকে শান্তিতে এসব রামলীলা চালাতে দেবে… কুসুম হা-মুখ করে বুক ভরে বাতাস টেনে নিলো। কপাল থেকে এলো চুল সরাতে গিয়ে টের পেল,তার দু’চোখে পানির জোয়ার। কুসুম ঝটপট চোখ জোড়া মুছে নিলো। কুসুমের মা বলেছিল, “চোখের পানি সবচাইতে দামী বস্তু। কারণ এতে এক ভাগ পানি থাকলেও, নিরানব্বই ভাগ থাকে অনুভূতির বেহাল দশা.. তাই যার তার জন্য চোখের এত দামী পানি খরচ করার মানেই হয় না।” কুসুম নেহাল নামক ওই জানোয়ারটার জন্য এক ফোঁটাও চোখের পানি ফেলবে না। সে মেয়ে, আর মেয়েরা শুধু সব সহ্যই করে না, এটা নেহালের কর্ণকুহরে ভালোরকমে ঢুকিয়ে দিতে হবে।
কুসুম হাত খোঁপা করে উঠে দাঁড়াল। তার পরনে সুতির শাড়ি। বিয়ের আগে শাড়ি পরা আর যুদ্ধ করা, কুসুমের জন্য সমান ছিল। যেই মেয়ে শাড়ি পরতে হবে শুনলে কোথায় গিয়ে লুকোবে ভাবতো, সেই মেয়ে এখন রাত-দিন চব্বিশটা ঘন্টাই শাড়ি পরে থাকে। এর কারণ, নেহাল… বাসর রাতেই নেহাল বলেছিল, তার অন্যতম ইচ্ছে, স্ত্রী সবসময় শাড়ি পরে থাকবে। তাতে নাকি বউদের বউ বউ ভাবটা সবসময় বজায় থাকে। কথাটি শুনে প্রথমে গলা শুকিয়ে এলেও শেষটায় নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে কুসুম। এবং শেষতক নিজেকে শাড়িতে পুরোপুরি ভাবে অভ্যস্ত করতে পেরেছে।
পুরোনো দিনের বেশ কিছু এলোমেলো কথা,স্মৃতি, সব মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে বারবার। কুসুম সমস্ত ভাবনাকে এক পাশে ফেলে এগিয়ে চললো শ্বাশুড়ি মরিয়ম বেগমের ঘরের দিকে।
এই বাড়িতে পাঁচটি রুম। একটি বড় ভাই-ভাবীর দখলে, দ্বিতীয়টি তার ও নেহালের, তৃতীয়টি কুসুমের দেবর নয়নের জন্য বরাদ্দ ছিল, সেখানে এখন তার বউয়েরও জায়গা হয়েছে। আর দু’টি রুমের একটি শ্বশুর-শ্বাশুড়ির,অন্য রুমটি খালিই পড়ে রয়েছে। ওখানে বড় ভাবীর একমাত্র মেয়ে টুকু খেলে। টুকুর ভালো নাম- আশফিয়া। সবাই ভালোবেসে টুকু বলে ডাকে।
দরজায় কড়াঘাত চালালো কুসুম। বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। রাতের এই প্রহরে এসে এরকম একটি ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে তাকে! তা যেন চিন্তাতেও আসেনি… নিজের স্বামী এখন ওই মেয়েটির সঙ্গে রঙ্গ লীলায় ব্যস্ত, আর কুসুম এখানে শ্বাশুড়িকে ডাকতে চলেছে। কী অদ্ভুত পরিস্থিতি! কুসুমের চোখ জ্বালা করছে। হাত-পা কাঁপছে। কেমন অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে- যার ব্যাখ্যা তার কাছে নেই। মরিয়ম বেগম চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুললেন এবং মেজ বউকে এত রাতে এভাবে দেখে চমকে উঠলেন।
তার ঘুম পুরোপুরি গায়েব হয়ে গেল চোখ থেকে।
“কী হইছে মেজ বউ? তুমি এত রাইতে এমনে দরজা টাকাইতেছো কেন?”
“আম্মা, আম্মা আপনি এদিকে আসেন..” বলে কুসুম কান্না করে ফেলল। দু’জনের হালকা শোরগোলে হাবিব শিকদারের ঘুম ভেঙে গেল। তিনিও উঠে আসলেন।
“ও কাঁদে কেন মরিয়ম? কী হইছে?”
“আমিও তো বুঝবার চেষ্টা করতেছি। মেজ বউমা, ঘটনা কী আমারে খুইলা কও।”
হুট করে শ্বশুরের আগমনে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে উঠল কুসুম। একরাশ লজ্জারা তাকে ঘিরে ধরল আষ্টেপৃষ্টে। কিন্তু এখন লজ্জাদের রাজত্ব করতে দিলে চলবে না ভেবে সমস্ত লাজ-লজ্জা একপাশে ফেলে কিছুক্ষণ আগেই ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ধীর গলায় মিনমিনিয়ে ব্যাখ্যা করল কুসুম। যা শুনে শ্বশুর, শাশুড়ি দু’জনেই যারপরনাই চমকে উঠলেন। কুসুমের চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি গড়াচ্ছে। এই চোখের পানি দেখে কুসুমের কথাগুলোকে কিছুতেই হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে পারলেন না তারা। মরিয়ম বেগম কিছু বলার আগেই হাবিব শিকদার গমগমে কণ্ঠটি নাড়ালেন।
“নেহাল কী এখনো ওই রুমে?”
কুসুম মাথা ঝাঁকিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। স্ত্রী, বউ কে নিয়ে হাবিব শিকদার ছোট ছেলের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। দরজায় গায়ে হাত রেখে বুঝলেন দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। তিনি এবার জোরে থাবা মারলেন দরজার গায়ে। মনে হলো, ভেতরে থাকা লোক দুটো চমকে উঠল এতে। তাদের কে কেউ এভাবে আবিষ্কার করে ফেলবে, তা যেন ভাবতেই পারেনি তারা। হাবিব শিকদার গর্জে ওঠা গলায় নেহালের নাম ধরে উচ্চারণ করলেন। তার হম্বিতম্বিতে পুরো বাড়ি সরগরম হয়ে উঠল মুহূর্তেই। বড় ছেলে তমল আর তার স্ত্রী মিতুও উঠে চলে এলো ঘরের বাইরে। ব্যাপারটা কী ঘটেছে, তা বুঝার জন্যেই মিতু একবার অশ্রুসিক্ত কুসুমের দিকে চাইলো। তারপর শ্বাশুড়ির হতভম্ব মুখটা দেখল। এরপর যেন সব বুঝে গেল, এমন ভঙ্গিতে চুপ করে গেল। তমলের হাত ধরে টানলো। তমল চোখ ইশারায় প্রশ্ন করল,
“কী?”
মিতু তমলকে টেনে আবার ঘরে নিয়ে এলো।
“কী ব্যাপার? ঘরে আনলে কেন?”
“আমি যা সন্দেহ করছিলাম, তাই ঘটলো।”
“কীসের সন্দেহ? আর কী ঘটছে? আমাকে খুলে বলো তো..”
“তোমার ভাই নেহাল, ওই নতুন বউয়ের সাথে ওর যে একটা ফিসফিসানি কিছু চলতেছিল তা আমি আগেই টের পাইছি। বিয়ের দিনই কেমন করে যেন তাকাচ্ছিল বারবার শিমুলের দিকে। আবার শিমুলও দেখি নেহালকে চোখে চোখে হারাচ্ছিল। আমি প্রথমে সবটা মশকরাতে নিলেও এখন মনে হচ্ছে এর পেছনে খুব জটিল কিছু আছে।”
তমল যেন বিশ্বাসই করতে পারল না, এমন ভঙ্গিতে বলল,
“কী বলো এসব!”
“যা বলি, সত্য বলি। আসো বাইরে আসো। আর দেখো, কোন নাটক চলতেছে..”
হাবিব শিকদারের ভয়ে হোক আর যে কারণেই হোক,আত্মসমর্পণ করল নেহাল। দরজা খুলে দিতেই সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। কুসুম কেঁদে উঠল হাউমাউ করে। নিচে বসে পড়ল ধুপ করে। তার বুক ফেটে কান্না আসছে। বাবা মারা যাওয়ার সময়ও এতটা কষ্ট বুঝি তার হয়নি।
নেহাল কাচুমাচু ভঙ্গিতে বাইরে বেরিয়ে এলে হাবিব শিকদার সপাটে তার ফর্সা গাল লাল করে ফেলল। তমল গিয়ে বাবাকে সরিয়ে না আনলে নেহালকে বোধহয় মেরেই ফেলতেন হাবিব শিকদার। এরপর পরাপর ঘটে গেল কয়েকটা ঘটনা। কুসুম সহ্য করতে না পেরে ছুটে গেল ঘরের ভেতর। শিমুল এক কোণায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছিল। কুসুম গিয়েই তার চুলের মুঠি নিজের হাতে পেঁচিয়ে ধরল। আর শুরু করল ধমাধম মাইর… যেভাবে পারল শিমুলের হাত-মুখ ভেঙে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করল। মিতু, মরিয়ম বেগম গিয়ে টেনেহিঁচড়ে কুসুমকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করল। কুসুম চেঁচাচ্ছে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে,
“তুই একটা মেয়ে হয়েও আমার ঘর কীভাবে ভাঙ্গলি? দুনিয়াতে এত পুরুষ থাকতেও আমার স্বামীকেই চোখে পড়ছিল তোর? আমার এই পেটের সন্তান… ও জন্ম নেওয়ার পর বাবা বলে কাকে ডাকবে? কাকে?”
থমকে গেল ঘরের প্রতিটি সদস্য। নেহালের চোখে বিস্ময়। সে বাবা হতে চলেছে অথচ এই কথাটি কুসুম তাকে একটিবারও জানালো না কেন? নেহাল এগিয়ে এসে কুসুমকে ধরতে নিলে কুসুম ছিটকে দূরে সরে গেল। হিসহিসিয়ে বলল,
“খবরদার বলছি.. আমাকে ছোঁবেন না আপনি। একদম ছোঁবেন না… অপবিত্র,নোংরা আপনি। কী করে পারলেন আমার সাথে এরকমটা করতে?”
কুসুম কেঁদেই চলেছে। নেহাল বলল,
“আমার কথাটা একবার শোনো কুসুম। আমি কিচ্ছু করিনি।”
“মাঝ রাতে নিজের স্ত্রী কে ছেড়ে চোরের মতো চুপিচুপি অন্য একটি মেয়ের ঘরে আসেন। আর বলেন আপনি কিছু করেননি?”
“আমি ওকে বোঝাতে এসেছিলাম কুসুম।”
“কী বোঝাতে এসেছিলেন, হ্যাঁ?”
“ও আমার প্রাক্তন কুসুম।”
কুসুম সহ পরিবারের সবাই থমকে গেল। কুসুমের মনে হলো তার মাথা ঘুরছে। চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে। কুসুম পড়ে যেতে নিলে নেহাল তাকে ধরে ফেলল।
(চলবে)
গল্প-শর্বরী
লেখিকা-অলিন্দ্রিয়া রুহি