গাংচিল পর্ব-১১

0
316

#গাংচিল
#১১তম_পর্ব

টগরের প্রশ্নে লেখা থামায় সীমান্ত। হাসিটা বিস্তার পায় তার। চোখে অন্য রকম ভাষার খেলা। ধীর স্বরে বলে,
“জীবনের শেষ দিন, যেদিন টের পাবো জীবনের হিসেবগুলো এবার চুকিয়ে ফেলতে হবে সেদিন খোলশা করে দিবো নাহয়।“
“তোমার এই আল বাল কথা ছাড়া কি কিছুই মুখে আসে না? মৃত্যু মৃত্যু শুনতে ভালো লাগে না আমার।“

টগর ঝাঝিয়ে উঠে কথাটা বললো। তাতে সীমান্তের গায়ে বাধলো কি না তার জানা নেই। সীমান্তের সাথে তার পরিচয়টা এখনের নয়। অনেক পূর্বের, একই সাথে ভার্সিটির সিড়ি পার করেছিলো তারা। সাইন্সে ছেলেটার বেশ দখল ছিলো। সবার ধারণা ছিলো বেশ বড় মাপের চাকরি করবে ছেলেটা। কিন্তু সীমান্তের মন সাহিত্যে ডুবেছিলো। লেখালিখির প্রতি আকর্ষণ তার মস্তিষ্কে ঝেঁকে বসেছিলো। তাই তো পুরোপুরি লেখালিখিতেই মনোনিবেশ করেছিলো সে। ভাগ্য বা তার অপরিসীম মেধা যাই বলা হোক, পাঠক সমাজে নিজের নামটা বেশ ভালো উজ্জ্বল করেছিলো সে। বিগত ছয় বছরের লেখনীর সময় পার করে পর পর বেশ কটা বই বের করেছিলো সে। পাঠকেরা তার বই এর অপেক্ষায় প্রহর গুনতো। কয়েকজন বন্ধু মিলে এই প্রকাশনীটাও স্থাপন করেছিলো। ভালোই চলছিলো সব। তার বিক্রিত বই এর টাকা দিয়ে প্রকাশনী বাকি কাজগুলো বেশ ভালোভাবেই চলছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই যেনো সব এলোমেলো হয়ে গেলো। হঠাৎ করেই লেখা ছেড়ে দিলো সীমান্ত। তার সাথে এ নিয়ে টগরের বেশ কিছুবার ঝামেলাও হয়েছে। কিন্তু তাকে রাজী করানো যেনো অসম্ভব। টগর হাল ছেড়ে দিলো। সন্ধানে নামলো নতুন লেখক-লেখিকা। ফেসবুকে আজকাল অনেক ভালো ভালো লেখক-লেখিকার সন্ধান ই পাওয়া যায়, কেউ কেউ লিখেন শখের বসে তো কেউ কেউ লিখের পেশার হিসেবে। হাজার হাজার ফলোয়ারস তাদের। সামনের বছর তাদের কিছু সংখ্যক মার্জিত লেখক সমাজ নিয়ে তাদের প্রকাশনী কাজ করছে। কিন্তু কোথাও যেনো একটা শূন্যতা থেকেই যাচ্ছে। শূন্যতা সীমান্তের, শুন্যতা তার লেখনীর, শুন্যতা তার শব্দের__________________

ডাইনিং টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে মৌপ্রিয়া এবং ইফতেকার সাহেব। সপ্তাহ গড়িয়ে গেছে মেয়ে তার সাথে ঠিক মতো কথা বলে না। নিজের মাঝেই থাকে, উদাসীনতা তাকে যেনো গিলে খাচ্ছে। কোনো কিছুতে বারণ নেই, কোনো কিছুতেই মুখ খিচিয়ে উঠছে না। ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগছে না ইফতেকার সাহেবের। কিন্তু নিজ থেকে কথা বলতেও খানিকটা বব্রত বোধ হচ্ছে। বলা তো যায় না, এটা ঝড়ের পূর্বে শান্ত থমথমে পরিবেশও হতে পারে। কিন্তু মেয়ের সাথে কথা না বললে শুন্যতা যেনো আরোও গভীর হয়। বয়স বাড়লে মানুষের একাকীত্ব ভালো লাগে না। তখন সঙ্গীর প্রয়োজন হয়। আর ইফতেকার সাহেবের সবথেকে কাছের সঙ্গী এই মেয়েটি। তাই তার সাথে কথা যে তার বলতেই হবে। গলা ঝেঁড়ে একটু ভাব নিয়ে বললেন,
“তো, তোমার পড়াশোনা কতদূর আগাচ্ছে?”

খাওয়ার মাঝেই বাবার প্রশ্নে থেমে যায় মৌপ্রিয়া। ভেবেছিলো বাবা হয়তো জিজ্ঞেস করবে,
“তুই কি আমার উপর রেগে আছিস?”
কিন্তু না, এই পাগলেটে মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক আচারন আশা করাটা নিতান্ত বোকামি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৌপ্রিয়া বললো,
“তোমার মাস্টারমশাই ডুব দিয়েছেন। সপ্তাহ হতে চললো, তার টিকিও দেখা যাচ্ছে না।“
“সীমান্তের কি টিকি আছে না কি? আমি তো দেখলাম না।“

বলেই হো হো করে হাসতে লাগলেন। মৌপ্রিয়া ভ্রু কুচকে হিনহিনে কন্ঠে বললো,
“বোকার মতো হাসবে না তো বাবা। বিরক্ত লাগে।“
“তুই কি আমাকে বোকা বললি?”
“বোকাকে বোকা বলেছি, এতে দোষের কিছু আছে বলে আমি মনে করি না।“
“বেশ, আমি বোকা। আর তুমি তো খুব চালাক। সারাক্ষন কি সব হিজিবিজি লেখো, আর নিজেকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ লেখিকা ভাবো। এহহ লেখিকা, না ছাই।“

মুখ বেকিয়ে কথাটা বললেন ইফতেকার সাহেব। মৌপ্রিয়া কোনো উত্তর দিলো না। চুপচাপ খেতে লাগলো। তার কাছ থেকে সাড়া না পেতে তিনি আরোও হুমড়ি তুমড়ি শুরু করলেন,
“তোমার কি মনে হয়, আমি লিখতে পারি না। আমি চাইলে আজ আমিও লেখক হতাম। হাহ, খুব তো লেখিকা হয়েছো বলো তো জীবনানন্দ দাসের লেখা “বনলতা সেন” কবিতাটি প্রথম কবে প্রকাশিত হয়?”
“জানি না”
“ঠিক আছে ঠিক আছে। এটা তো বলতেই পারবে শরৎচন্দ চট্টোপাধ্যায়ের “পরিনীতা” উপন্যাসে পরিনীতা অর্থ কি?
“আমি জানি না, বাবা”

জড়তাবিহীন স্বরে কথাটা বলে মৌপ্রিয়া। ইফতেকার সাহেব যেনো হার মেনে নিলেন। অন্য সময় হলে মেয়ে চার কথা শুনিয়ে দিতো তাকে। আজ মোতেই তেমন কিছু হচ্ছে না। মৌপ্রিয়া শান্ত নদীর ন্যায় বসে আছে। না তার প্রবাহ আছে না ঢেউ। ফোঁস করে বুক চিরে একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে ইফতেকার সাহেবের। তখন শান্ত গলায় মৌপ্রিয়া বলে,
“সবসময় একই ট্রিক খাটালে কি কাজ হয় বাবা? তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি কেনো চেতে আছি। তবুও তুমি এদিক ওদিক থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছো।“
“তোর মা ফোন করেছিলো। তাই না?”
“যাক তুমি যে ব্যাপারটা বুঝেছো, জেনে খুশি হলাম।“
“কি বললো সে?”
“প্রতিবার যা বলে, তা এই বেহায়াপনা গুলো কনা করলেই কি নয়? কেনো তার শত বারণের পরেও কাজ গুলো করো।“
“………”
“বাবা আমার না ভালো লাগে না, যখন ওই মহিলাটা তোমাকে অপমান করে।“

ইফতেকার সাহেব এবার খানিকটা নড়ে বসলেন। গম্ভীর গলায় বললেন,
“সে তো তোমার মা, এভাবে মহিলা, মহিলা করবে না। ভালো লাগে না“
“হ্যা, মা। সেটা যখন তার মনে ছিলো না আমার মনে রাখার তো কোনো বাধ্যবাধকতা দেখছি না। আর একটা কথা, আমি না তোমার সকল পাগলামী মেনে নিবো, লিখালিখির টিচার, মাঝ রাতে কবিতার আসব, কুষ্টিয়ার লালন ফকিরের শিষ্য হওয়া সব মেনে নিবো। তবে এই রোড সাইড রোমিও হওয়াটা আমার সহ্যের বাহিরে। মনে হচ্ছে কি জানো, আমার ছেলে কোনো মেয়ের পেছনে ছোটাছোটি করছে তার গার্ডিয়ান আমার কাছে এসে কমপ্লেইন করছে। আমার এগুলো সহ্য হয় না।“
“সূবর্ণা তোর সাথে দেখা করতে চাইছিলো। শেষ কবে দেখেছে সেটা মনে নেই তার। একবার পারলে দেখা করিস। ও সত্যি খুব একা।“

ইফতেকার সাহেবের কথাটা শুনে থমকে যায় মৌপ্রিয়া। বুকটা ঝা ঝা করছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। খাবারের প্লেট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। তীব্র কন্ঠে বলে উঠলো,
“কেনো বাবা? কেনো তুমি এমন করো? তোমার ই মান অপমান বোধ বলে কিছুই নেই? যে মানুষটা তোমাকে ফেলে পনেরো বছর পূর্বে চলে গিয়েছে তার একাকীত্ব নিয়ে কেনো এতোটা ভাবো তুমি? অই সে তো তোমাকে নিয়ে ভাবে না? তাহলে কেনো?
“মান, অপমান শব্দগুলো গায়ে লাগালেই তার দাম থাকে, না লাগালে সেগুলো কেবলই অর্থহীন বিষেশন। আর সব কেনোর উত্তর যে নেই মৌপ্রিয়া। একটা মানুষকে ভালোবাসা শুরু করলে তুমি হুট করেই সেটাকে বন্ধ করে দিতে পারো না। আমি শুধু তাকে ভালোবাসি, এটাই হয়তো উত্তর। এক আকাশ সমান ভালোবাসা, তাই হয়তো জানি সে কখন একা বোধ করে। সূবর্নাকে যে আমার অনেক কথা বলার আছে। সেগুলো না বলেই পৃথিবী ছাড়বো? তাহলে যে সে বুঝতেই পারবে না আমি তাকে কতোটা ভালবেসেছিলাম”
“যে বুঝতে চায় না, তাকে বুঝিয়ে কি আদৌ কোনো লাভ আছে বাবা? তার কাছে তুমি কেবল ই একজন নির্বোধ ব্যাক্তি।“

বলেই নিজ রুমে প্রস্থান করলো মৌপ্রিয়া, তার কন্ঠ কাঁপছে। মায়ের প্রতি ঘৃণাটা যেনো প্রবল হচ্ছে। ইফতেকার সাহেব এখনো যেখানেই বসে রইলেন। তার মুখে মলিন হাসি। সূবর্না আর তার সম্পর্কটা সত্যি ই শেষ, চাইলেও তার সূবর্নাকে এখন তার বলা যাবে না। কেউ ঠিক বলেছিলো,
“মনের মানুষ আর মানুষের মন দুটো দূর্লভ বস্তু। একটি পেলে আরেকটি খোয়াতেই হয়।“

বহুদিন পর আবারো এমুখী হলো সীমান্ত। মাস্টার হিসেবে সে খুবই অপারগ একজন ব্যাক্তি। হয়তো সত্যি সত্যি কাউকে পড়ালে খুব তিরস্কারের মুখোমুখী হতে হতো তাকে। কলিংবেল বাজানোর সাথে সাথেই নীলু দরজাটা খুললো, হিনহিনে কন্ঠে বললো,
“আফায় পড়তো না। আপনি যাইতে পারেন।“
“ভালো কথা, কিন্তু ভেতরে ঢোকা বারণ কি?”
“হুদা আইসে কি করবেন?”
“তাও ঠিক, তুমি খুব বুদ্ধিমান। তা তোমার আফার কি শরীর খারাপ?”
“জে না মাথা খারাপ, টপ ফলোরে আগুন জ্বলতাছে। খালুজানের লগে কাইজ্যা লাগছে। খাওন ও খায় নাই। বারান্দায় বইয়ে আছে। আমি আপনের ভালো চাই বললেই কইছি চলে যান। আফায় খেপলে আপনেরে আস্ত রাখবে না।“

সীমান্ত তার ভুবনভুলানো হাসি হাসলো। নীলু মেয়েটাকে তার খুব ভালো লাগে। দেখলেই মনে হয় তার ছোট বোন এমন হলে খুব একটা মন্দ হতো না। সে মিহি কন্ঠে বললো,
“তুমি যে আমাকে নিয়ে ভেবেছো, তাতে আমি আমি খুব খুশি হয়েছি। তবে চিন্তা করো না। তোমার আপার রাগ কমাতে আমি পারি। সে ঔষুধটা আমার কাছে আছে। নাও এবার সরো। ভেতরে যাই।“

নীলুর চোখে বিষ্ময়, লোকটার কথা তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো। তাই সরে দাঁড়ালো। সীমান্ত সিড়ী বেয়ে উপরে উঠে গেলো। মৌপ্রিয়ার ঘরের দরজা ভেজানো। কোনো নারীর ঘরে অনুমতি ছাড়া ঢোকাটা অন্যায়। তাই সীমান্ত দরজায় কড়া নাড়লো। অনুনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলো,
“ভেতরে আসবো?”

কোনো উত্তর এলো না। সীমান্ত কিছুক্ষণ চিন্তা করলো। তারপর দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। সত্যি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে মৌপ্রিয়া। তার শাড়ির আঁচলটা নিচে গড়াচ্ছে, বাতাসে তার কোকড়া চুল উড়ছে। দূর থেকে সীমান্তের মনে হলো শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের কোনো নায়িকা দাঁড়িয়ে আছে। ছিপছিপে গড়ন, এলোমেলো শাড়ি, উদাসীন চাহনী। সীমান্ত এগিয়ে পাশে দাঁড়ালো মৌপ্রিয়ার, তার গাল ভেজা। মেয়েটি কি কাঁদছিলো! কেনো কাঁদছিলো? উৎসুক মন অস্থির হয়ে উঠলো। কিন্তু সাহস হলো না জিজ্ঞেস করার। বরং উৎফুল্ল গলায় বললো,
“আজ ঘুরতে যাবে? নরম আবহাওয়ায় ঘুরতে ভালো লাগে”

মৌপ্রিয়া অবাক চোখে তাকালো সীমান্তের দিকে। তার চোখ এখনো ভেজা। সীমান্ত ধীর স্বরে বললো,
“সুন্দর, খুব সুন্দর।“

মৌপ্রিয়া ভ্রু কুচকে সন্দীহান চোখে তাকায় সীমান্তের দিকে। চিন্তার ঢেউ এ সীমান্তের কথাটা ঠিকমতো শুনতে পারে নি সে। তাই ধরা কন্ঠে বলে,
“কিছু বললেন?”
“নাহ, শুধু বলেছি আজ ঘুরতে যাবো। আমি নিচে অপেক্ষা করছি।“

বলেই হাটা ধরে সীমান্ত। কিন্তু কি মনে করে যেনো দাঁড়িয়ে যায় দরজার কাছে। মুচকি হেসে বলে,
“আজ নীল শাড়ি পরো, নীল শাড়িতে তোমায় খুব মানায়……………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here