গাংচিল পর্ব-১৫

0
486

#গাংচিল
#১৫তম_পর্ব

তিয়াশার কথা শুনে সন্দীহান কন্ঠে মৌপ্রিয়া বলে,
“তবে সেদিন সে কেনো ছেড়ে গিয়েছিলো তোকে? কেনো তোকে একা করে গিয়েছিলো? যখন তোর অন্তুকে সবথেকে বেশী দরকার ছিলো কেনো সে তোর সাথে ছিলো না?”
“অন্তু আমাকে কখনো ছেড়ে যায় নি, আমি অন্তুকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। আবেগের বিয়েটা আমি মানতে চাই নি। সেকারণেই হয়তো সে আমাকে ঘৃণা করে।“

তিয়াশার কথায় হতবাক হয়ে যায় মৌ। এতো বছর পর এই প্রথম তিয়াশা মুখ খুলেছে। তার এবং অন্তুর ব্যাপারে সে কিছু বলেছে। এতো বছরের বন্ধুত্বে কখনোই তাদের বিয়ের ভাঙ্গনটা মৌপ্রিয়ার কাছে খোলাশা করে নি সে। ঘুটে ঘুটে কষ্ট পেয়েছে কিন্তু কখনোই সত্যি কারণটা কাউকে জানতে দেয় নি। মৌপ্রিয়া ভেবেছিলো অন্তু তিয়াশার হাত ছেড়ে দিয়েছে। অবশ্য সেটার ও কিছু কারণ ছিলো। তিয়াশা যখন কলেজে অনিয়ম করা শুরু করেছিলো, সকলের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলো তখন মৌ সবার আগে অন্তুর কাছেই তার খোঁজে যেতো। কিন্তু অন্তুর যেনো সবসময় একটা গা ছাড়া ভাব ছিলো, তিয়াশার প্রতি সে ছিলো উদাসীন। তখন এমন একটা ভাব ছিলো যেন, তার কাছে তার ক্যারিয়ারটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং বান্ধবী হিসেবে মৌপ্রিয়ার ধারণা ছিলো অন্তু তিয়াশাকে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আজ তিয়াশার মুখে এমন ধারা কথা শুনে সে হতবাক হয়ে গিয়েছে। অবাক কন্ঠে বলে,
“অন্তু তোকে ছেড়ে যায় নি?”
“উহু, ওই পাগলের কাছে এই বিয়েটার মূল্য সবথেকে বেশি ছিলো। আমি কি ভীতু ছিলাম। কি করতাম বল, হুট করে আমার জীবনটা ৩৬০ ডিগ্রী এঙ্গেলে ঘুরে গেলো। আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। আমার জন্য অন্তুর পড়াশোনার বেশ ক্ষতি হচ্ছিলো। নিজের স্বার্থপরতার জন্য আমি সেই মানুষটাকে কষ্ট দিতে পারি না তাই না? ওর জীবনের বাধা হবার থেকে এই অনিশ্চিত সম্পর্কটাকে ভেঙ্গে দেওয়াই আমার জন্য সহজ মনে হয়েছে। তাই আমি ওর জীবন থেকে সরে গেলাম। তবে ওকে ভালোবাসাটা বন্ধ করতে পারলাম না। তাইতো আজ ও আমার মনের ব্যালকানিতে ওর নামের সূর্যটাই উঠে। প্রেম মানে নিঃস্ব হওয়া না মৌ। আর তুই তো অলরেডি ওই আবালচন্দ্র মাষ্টারমশাই এর প্রেমে পড়ে গিয়েছিস। এখন চাইলেও তুই নিজেকে বাঁচাতে পারবি না।“
“যদি আমাদের গল্পটা সুখের না হয়? যদি সে আমার প্রেমে না পড়ে?”
“প্রেম মানেই তো বেদনা, এক পাক্ষিক হোক কিংবা উভয়পাক্ষিক। বেদনাহীন প্রেম, প্রেম নয়। এতা কেবল খোলস। আর তোর এই হিসেবগুলো প্রেমের ক্ষেত্রে খাটে না। সব হিসেবকে জ্বালিয়ে দিবে তোর প্রেম। তাই সময়ের উপর ছেড়ে দে। সময় ঠিক বলে দিবে।“

তিয়াশার কথা শুনে মলিন হাসি হাসে মৌপ্রিয়া। সে প্রেমে পড়েছে। অবশেষে পঁচিশ বছরের জীবনে সে প্রেমে পড়েছে। তাও কার! যাকে সবথেকে বেশি অপছন্দ তার, আবালচন্দ্র মাষ্টারমশাই এর প্রেমে পড়েছে সে। কিন্তু এর পরের কাহিনীটা কি হবে? সেটা যে তার অজানা। সে শুধু ঈশ্বর ই জানেন_________________

সিলেটের চা বাগানের কাছেই ভিলা সীমান্তদের। বিগত পঁচিশ বছর ধরে এই ভিলাতেই তাদের বাস। মিজান সাহেবের চাকরিটা শুরু হয় চা বাগানের ম্যানেজার হিসেবে। আজ তাদের নিজস্ব চা বাগান আছে। এই চা বাগানের ভিলার ঝুলন্ত বারান্দা খুব পছন্দ সুমী বেগমের। তার যখনই মন খারাপ থাকে সে বারান্দায় এসে দাঁড়ান। বারান্দা থেকে গুড়ি গুড়ী বৃষ্টি দেখা তার পছন্দের কাজের মধ্যে একটি। আজ তার মন খারাপ। অবশ্য এই মন খারাপ তার প্রতিদিন ই হয়, আজকের মাত্রা বেশি। সীমান্তকে নিয়ে খুব বাজে স্বপ্ন দেখেছে সে। ধরফরিয়ে উঠেছেন সকালে। ইচ্ছে করছিলো একটা ফ্লাইট নিয়ে উড়ে যেতে সীমান্তের কাছে। কিন্তু তার স্বামীর বারণটা তাকে আটকে রেখেছে। মিজান সাহেব মিলিটারীদের থেকেও শক্ত মানুষ। মানুষটার মনটা যেনো পাথর। নয়তো নিজের অসুস্থ ছেলের সাথে কেউ জিদ করে? তিনি আবার সীমান্তকে ত্যজ্য পুত্র করেছেন। তাই সুমী বেগম কে স্বামী এবং ছেলের মধ্যে একজনকে বেঁছে নিতে হচ্ছে। একজন মায়ের কাছে ব্যাপারটা অতি কষ্টের। তবে করার কিছুই নেই। হঠাৎ একটা গরম কফির মগ তার দিকে এগিয়ে এলো। পাশে ফিরতেই দেখেন মিজান সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি জানেন তার স্ত্রীর বৃষ্টির দিনে কফি খাওয়া খুব পছন্দ। কফির মগটা এগিয়ে দিয়ে ধীর স্বরে বললেন,
“খেয়ে বলতো কেমন হয়েছে। নিজ হাতে বানিয়েছি।“

সুমী বেগম মগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, পছন্দের কফিটাও আজ ভালো লাগছে না তার। মিজান সাহেব বাহিরের দিকে দৃষ্টি দিলেন। চা বাগানের এক অংশ বারান্দা থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। বাগান দেখতে দেখতে বললেন,
“রেগে আছো আমার উপর?”
“রাগার অধিকার আছে বুঝি?”
“তুমি ভালো করেই জানো, তোমার অধিকারের সীমা। মুখে বলার দরকার নেই।“
“ওহ, আমি তো ভাবতাম এ বাড়িতে আমি অনুভূতিহীন একটা জড় পদার্থ, যাক জেনে ভালো লাগলো।“

সুমী বেগমের ঠেস মারা কথায় মিজান সাহেব আহত হলেন ঠিক ই। কিন্তু তা প্রকাশ করে নিজের পুরুষ অহংটাকে আঘাত পেতে দিলেন না। ঠান্ডা গলায় বললেন,
“শুরুটা আমি করি নি সুমী, সীমান্ত করেছে।“
“আপনি ভালো করেই জানেন সে আপনার ছেলে। তাই জিদটাও আপনার মতোই। সেদিন তাকে ওভাবে অপমান করাটা কি খুব শোভনীয় ছিলো।“
“তর্কে যেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি ভালো করেই জানো ঝামেলাটা কবে থেকে শূরু হয়েছে। সে লেখক হয়ে চেয়েছে, হয়েছে। আমার মতামত কানে তোলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে নি। বাবা হিসেবে আমিও চেয়েছিলাম আমার ছেলে একটা এমন কাজ করুক যা গর্বের সাথে আমি বলতে পারি। তুমিও জানো তার পোটেনশিয়াল ছিলো। কিন্তু না তার তো লেখার ভুত চেপেছে। এখন শুনছি একটা প্রকাশনীও আছে। খুব ভালো। কিন্তু এতো জেদ কেনো তার? সে ভালো করেই জানে ওই লেখনী দিয়ে কিচ্ছু হয়। পৃথিবীতে চলতে টাকার দরকার। তার বাঁচতেও টাকার দরকার। এতো কিছু জানা স্বত্তেও তোমার ছেলে জেদ ধরে বসে আছে নিজের টাকায় ওপারেশন করাবে। খুব ভালো, আমিও অপেক্ষায় আছি। আমিও দেখতে চাই কতোদিন তার এই জেদটা থাকে।“

মিজান সাহেবের ঠান্ডা গলার কথায় থমকে যান সুমী বেগম। তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়, ধরা গলায় বলেন,
“আপনাদের এই মান অভিমান আর জেদের যুদ্ধে আমার ছেলেটাই না হারিয়ে যায়, দেখবেন পরে যেনো আফসোসটা না হয়।“

কথাটা বলেই ভেতরে চলে গেলেন সুমী বেগম। মিজান সাহেবের উত্তরের অপেক্ষাটুকু। স্ত্রীর অভিমানটা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছেন তিনি। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। শূন্য দৃষ্টি প্রয়োগ করলেন বাহিরের দিকে। এখনো আকাশের ক্রন্দন থামে নি, মুক্তার ন্যায় বারি বর্ষন হচ্ছে সবুজ চা বাগানের উপর। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে প্রকৃতির এই অপরুপ মায়া দেখতে লাগলেন মিজান সাহেব। হয়তো এভাবেই নিজের ভেতরে চলা লড়াই থেকে কিছুটা হলেও নিজেকে বিরতি দিতে পারবেন_________________

৮.
মেসের সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে সজোরে ধাক্কা খেলো টগর। তাড়ার মাঝে যেনো তাড়া আরোও বাড়ে বলে মনে হলো তার। আজ ব্লাড দিয়ে মেসে নিয়ে এসেছে সীমান্তকে। সকাল থেকেই হাসপাতালে ছিলো তারা। ব্লাড ম্যানেজ করতে এবার বেশ ভুক্তে হয়েছে। ব্লাড ব্যাংকে ব্লাড এভ্যেইলেবল ছিলো না। পরে পরিচিত এক বন্ধু ব্লাড দিয়েছে। সীমান্তের শরীরটা বেশ দূর্বল। কেমন যেনো ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। জ্বর, ঠান্ডা একেবারেই কাবু করে ফেলেছে তাকে। রুমে কোনো খাবার নেই। দুপুরের খাবারের ব্যাবস্থাটা তার ই করতে হবে। তাই বেশ তাড়ায় আছে সে। এর মাঝেই এই কান্ড। রেলিং ধরে নিজেকে সামলে নিলো টগর। মাথা তুলে শাসিয়ে উঠলো,
“চোখ কি ব্যাগে নিয়ে হাটেন নাকি? দেখে চলবেন তো।“
“মাফ করবেন, আসলে দোষটা আপনার………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here