#গাংচিল
#১৬তম_পর্ব
সীমান্তের শরীরটা বেশ দূর্বল। কেমন যেনো ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। জ্বর, ঠান্ডা একেবারেই কাবু করে ফেলেছে তাকে। রুমে কোনো খাবার নেই। দুপুরের খাবারের ব্যাবস্থাটা তার ই করতে হবে। তাই বেশ তাড়ায় আছে সে। এর মাঝেই এই কান্ড। রেলিং ধরে নিজেকে সামলে নিলো টগর। মাথা তুলে শাসিয়ে উঠলো,
“চোখ কি ব্যাগে নিয়ে হাটেন নাকি? দেখে চলবেন তো।“
“মাফ করবেন, আসলে দোষটা আপনার। আপনি ই দ্রুত নামছিলেন। শুধু তাই নয়, আপনি দেখেন ও নি আমি উঠছি। যাই হোক। সরি”
টগর মেয়েটির এমনধারা কথা শুনে খানিকটা অবাক হলো। সে একই সাথে তাকে সরি বলছে এবং টগরের ভুলটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। ভুলটা টগরের ই ছিলো। দ্রুত নামার তাড়ায় মেয়েটাকে সে খেয়াল করে নি। টগরের সামান্য লজ্জাবোধ হলো। কিন্তু তা টিকসই হলো না। যখন তার মনে পড়লো এটা ছেলেদের মেস। এখানে কোনো মেয়ের প্রবেশটা অনেকটা মরুভূমিতে বর্ষণ। এবার বেশ মনোযোগ দিয়ে টগর মেয়েটিকে দেখতে লাগলো টগর। কালো একটি শাড়ি পরিহিত মেয়ে, চুলগুলো বেশ সুন্দর করে খোঁপা করা। শ্যাম মুখখানায় এক অন্যরকম মায়ার ছাপ, কাজলকালো স্বচ্ছ চোখগুলো আভিজাত্যের পরিচয় দিচ্ছে। পাতলা ঠোঁটের কোনায় মাখা হাসিটা যে কারোর দিন ভালো করে দিতে পারে। হাতে একটা হটপট। মেয়েটা যদি কোনো নাটক থিয়েটার করতো তবে খুব সহজেই “পারমিতা” এর ললিতা হতে পারতো। টগরকে নিজের দিকে এভাবে খুটিয়ে দেখতে দেখে মেয়েটা ধীর স্বরে প্রশ্ন করে,
“কিছু বলবেন?”
“আপনি কার কাছে এসেছেন?”
স্পষ্ট জড়তাবিহীন কন্ঠেই প্রশ্নটা করে টগর। মেয়েটা হয়তো প্রস্তুত ছিলো না এই প্রশ্নের জন্য। তার চোখে মুখে এক অস্বস্তি কাজ করছে। তবুও ইতস্তত স্বরে বলে,
“সীমান্ত সাহেব কি এই মেসেই থাকেন?”
“আপনি সীমান্তের কাছে এসেছেন?”
“আপনি তাকে চিনেন?”
বেশ উৎফুল্ল হয়ে মেয়েটি প্রশ্ন করে। তার চোখ চকচক করছে। যেনো অনেক খোঁজার পর অবশেষে সে এক দূর্মূল্য জিনিস পেয়েছে। টগর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করে তার দিকে। তারপর প্রশ্ন করে,
“সীমান্তের কাছে আপনার কি কাজ?”
“তার সাথে যে কাজ তা নাহয় আমি তাকেই বলবো, আপনি একটু আমাকে উনার কাছে নিয়ে যেতে পারবেন?”
“সে অসুস্থ, এখন কারোর সাথে দেখা করতে পারবেন না।“
“আমি জানি সে অসুস্থ, কিন্তু আমার সাথে দেখা করতে তিনি মানা করবেন না। আপনি কথা বাড়াচ্ছেন শুধু শুধু। অনুরোধ করছি, প্লিজ আমাকে উনার কাছে নিয়ে যান। উনার সাথে অনেক কথা আছে আমার।“
টগর খানিকটা বিরক্ত হচ্ছে, মেয়েটি রীতিমতো তাকে ওর্ডার করছে। কিন্তু সেটাকে অনুরোধের ভঙ্গিতে করছে। তাই তাকে মানা করার উপায় পাচ্ছে না সে। তাই বিরক্তের সাথেই বললো,
“চলুন”
মেয়েটার ঠোঁটের হাসি বিস্তৃত হলো। সে টগরের পিছু পিছু সীমান্তের ঘর অবধি গেলো। সীমান্ত তখন চোখের উপর হাত ঢেকে শূয়ে আছে। টগর তাকে ধীর গলায় বললো,
“সীমান্ত, একজন মহিলা তোর সাথে দেখা করতে এসেছেন। উঠ।“
সীমান্ত ক্লান্ত কন্ঠে বললো,
“কে এসেছে?”
“পরিচয় দিচ্ছেন না, উঠেই দেখ।“
সীমান্ত কোনোমতে উঠে বসলো। তখনই মেয়েটি টগরের পেছন পেছন ঘরে প্রবেশ করলো। তাকে দেখেই সীমান্তের চোখ বিষ্ময়ের চোটে বড় বড় হয়ে গেলো। মুখ থেকে বেড়িয়ে গেলো,
“মৌপ্রিয়া”
★★★★★★
ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে তিয়াশা, ক্লান্ত চোখ জোড়া মেঘের আনাগোনা দেখতে ব্যাস্ত। তিয়াশার মা অর্থাৎ রহিমা বেগমের শরীরটা কয়েকদিন ধরে ভালো নেই। ডায়াবেটিসটা কন্ট্রোলে থাকছে না, ফলে গতকালে মাছের কাটা ফোটা জায়গাটা পেকে গেছে।থাতের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। ঔষধ দিতে পারছে না বিধায় শুধু নাপা আর হেক্সাসলের ডেসিং করতে হচ্ছে। ডাক্তারটা দেখাতে পারলে উপকার হতো। মাসের শুরু, কিন্তু বেতনটা এখনো পাওয়া হয় নি তিয়াশার। প্রতিদিন এডমিনিস্ট্রেশনের রুমে ধন্না দিতে হচ্ছে। টাকাটা পেলে ডাক্তার দেখাতো মাকে। এই ঢাকা শহরে ডাক্তাররা সোনার ব্যাপারী থেকেও জল্লাদ, একটা ভিজিটে দেড়টা হাজার টাকা চলে যায়, ঔষুধপত্রের কথা নাই বা বলা হোক। মাঝে মাঝে খুব অসহায় লাগে নিজেকে। গতমাসে মাথাটা না ফাঁটালে আজ টাকার চিন্তাটা করতে হতো না। মৌকে বললে, সে চোখ বুঝে ধার দিতো। কিন্তু তার করুনা নিতে ইচ্ছে করছে না তিয়াশার। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। মাঝে মাঝে নিজের অপারগতার উপরে খুব রাগ হয়। আজ আবার এডমিনিস্ট্রেশনকে জানাবে। আশা করছে আজ তাকে শূন্য হাতে যেতে হবে না। মোবাইলে ঘড়ির সময়টা দেখে নিলো সে। লান্স টাইম শেষ। ডেস্কে ফেরার সময় হয়ে এসেছে। ডেস্কে যাবার জন্য ঘুরতেই একজন মানুষের সাথে সজোরে ধাক্কা খেলো সে। তিয়াশার মনে হলো একটা বিশাল পাথর এসে ধাক্কা দিয়েছে। অসতর্কতায় নাকে বেশ লেগেছেও। নাকে হাত দিয়ে মাথা তুলে তাকায় তিয়াশা। মাথা তুলতেই পা জোড়া ঠান্ডা হয়ে গেলো তার। তার সম্মুখের মানুষটি আর কেউ নয় বরং অন্তু। সুগভীর নয়নে সে তাকিয়ে আছে তিয়াশার দিকে। অন্তুকে এখন এখানে মোটেই আশা করে নি সে। ছাদের এই জায়গাটা শুধু তার একান্ত একাকীর সঙ্গী। সেখানে আর যাই হোক অন্তুকে সে আশা করে না। বিগত তিনদিন যেখানেই যায় না কেনো লোকটা তার পিছু নিচ্ছে। যা তিয়াশাকে অসম্ভব অস্বস্তিতে ফেলছে। দু একবার কথা বলার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু তিয়াশা এড়িয়ে গছে। অনুভূতিকাতর মনটাকে পুনরায় দূর্বল করতে চায় না সে। এখনো তাই করবে, এড়িয়ে যাবে অন্তুকে। তিয়াশা মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে যেতে গেলেই হাতটা টেনে ধরে অন্তু। হ্যাচকা টানে তিয়াশাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে সে। অবাক নয়নে অন্তুর দিকে তাকায় তিয়াশা। এর পর অন্তু আরো অবাক করে তার কোমর চেপে ধরে। সুঠান পুরুষালী হাতের স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠে তিয়াশা। জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টি প্রয়োগ করে সে অন্তুর দিকে। কিন্তু অন্তু তো অন্তু। নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে সে। হাতের বাঁধন ছাঁড়াতে অক্ষম হলে তিয়াশা স্বর খাঁদে নামিয়ে মিনমিন করে বলে,
“ছাড়ো”
“যদি না ছাড়ি, কি করবে?”
কথাটা শুনেই চমকে অন্তুর দিকে তাকায় তিয়াশা। অন্তু তখন তার গালে আলতো হাত ছোয়ায়। রক্তিম হয়ে উঠে তুলতুলে গালজোড়া। অন্তুর এমন আচারণ তিয়াশার জন্য একেবারে নতুন। যখন তাদের মাঝে গভীরতম সম্পর্কও ছিলো তখনও অন্তু তাকে এতোটা গভীরভাবে স্পর্শ করে নি। অন্তুর স্পর্শ তিয়াশাকে দিশাহীন করে তুলেছে। তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস যেনো হৃদয়কে পুড়াচ্ছে। তিয়াশার মনে হচ্ছে, মনের মাঝে হাজারো প্রজাপতি ডানা মেলেছে। মস্তিষ্কের নিউরণ কথা হারিয়ে ফেলছে, সব কিছু যেনো নিঃস্ব লাগছে। শুধু একটা মানুষই তার সামনে, সে হলো অন্তু। তিয়াশা অন্তুর চোখে চোখ রাখলো, স্বচ্ছ চোখ জোড়ায় শুধু নিজের প্রতিবিম্বটাই দেখতে পাচ্ছে সে। নিজের অনুভূতিগুলো তার উপর নিজের প্রভাব বিস্তার করছে কথাটা বুঝতে ভুল হচ্ছে না তিয়াশার। অন্তু তাকে টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছে। এতোটা কাছে যে তার হৃদস্পন্দন ও শুনতে পাচ্ছে তিয়াশার।
সময় পার হতে লাগলো, অন্তু তিয়াশাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। এতোক্ষোন বেশ ছটফট করছিলো তিয়াশা। কিন্তু সময়ের সাথে নিজেকে অন্তুর বাহুডোর থেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টাটা ছেড়ে দিলো সে। চুপ করে লেপ্টে থাকলো তার স্বামীর বুকে। তবে মনের অস্থিরতাটা এখনো থামে নি, মন ক্ষণে ক্ষণে উৎসুক হয়ে আছে অন্তুর না বলা কথাগুলো জানতে, কেনো এই আচারণ করছে সেটা জানতে। অন্তুর চুপ করে থাকাটা যেনো অসহনীয় লাগছে তার কাছে। তিয়াশার চাহনী অন্তুর মুখের দিকে, ঠোঁটজোড়া কাঁপছে। হয়তো কিভাবে কথা গুলো বলবে তা সাজাচ্ছে। অন্তু আলতো হাতে তার কপালের চুল গুলো সরিয়ে দিলো, গুজে দিলো তিয়াশার কানে। তিয়াশার চোখের কোনটা চকচক করছে। অবাধ অনুভূতির সাগরটা জড়ো হয়েছে ও কাজল কালো চোখ জোড়ায়। অন্তু এবার মুচকি হাসলো, মিহি কন্ঠে বললো,
“যদি সহ্য ই না করতে পারো তাহলে দূরে যাবার চেষ্টা করছো কেনো!”
অন্তুর এমন কথায় তিয়াশা একটু নড়ে উঠলো। নিজের অনুভূতিগুলো অন্তুর কাছে ধরা পড়ে যাওয়ায় নিজেকে পক্ষের প্রতিরোধ দেওয়াল গড়তে লাগলো সে। অন্যদিকে ফিরে কড়া কন্ঠে বললো,
“আমার ডেস্কে ফিরতে হবে। অহেতুক সময় নষ্ট করার সময়টা আমার নেই। আর একটা কথা ভুল ধারণা কিন্তু ভালো নয়। অহেতুক কোনো আশা করাটা অযৌক্তিক।“
“তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছো আমি ভুল দেখছি? আমার স্পর্শে তোমার শিহরণটা কি ভুল? তোমার চোখে আমার জন্য অস্থিরতা ভুল? তোমার হৃদয়ের প্রতিটা স্পন্দনের সাথে আমার প্রতি তোমার অনুভূতিগুলো ভূল? চোখটা কিন্তু এখনো হান্ড্রেড পার্সেন্ট সঠিক আছে।“
“হ্যা, ভুল। ভুলের অসীম সাগরে আপনার বাস। কোনো অনুভূতি নেই আপনার প্রতি। কোনো অস্থিরতা নেই। অচেনা মানুষের স্পর্শে যে কেউ এভাবেই শিহরিত হবে। এটা সাইন্স।“
তীব্র কন্ঠে প্রতিবাদ করে তিয়াশা। তার অগ্নি দৃষ্টি অন্তুর দৃষ্টিতে স্থির। কিন্তু এই তীব্রতার মাঝে এক রাশ ভয় লুকিয়ে আছে। ভয়টা ধরা পড়ার। তাই তো এই প্রতিরোধ দেওয়াল। অন্তু আবারো হেসে উঠে। তবে সে যে একটা সাংঘাতিক কাজ করবে এটা কল্পনা করতে পারে নি তিয়াশা। আরোও শক্ত করে চেপে ধরে সে তিয়াশাকে। খানিকটা ঝুকে নিজের উত্তপ্ত ঠোঁটজোড়া চেপে ধরে তিয়াশার কম্পনরত ঠোঁটজোড়ায়। অন্তুর এমন আচারণে…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি