#গাংচিল
#১৭তম_পর্ব
অন্তু আবারো হেসে উঠে। তবে সে যে একটা সাংঘাতিক কাজ করবে এটা কল্পনা করতে পারে নি তিয়াশা। আরোও শক্ত করে চেপে ধরে সে তিয়াশাকে। খানিকটা ঝুকে নিজের উত্তপ্ত ঠোঁটজোড়া চেপে ধরে তিয়াশার কম্পনরত ঠোঁটজোড়ায়। অন্তুর এমন আচারণে হতবাক হয়ে যায় তিয়শা। তার সকল অস্থিরতা, রাগ, অভিমান, ভয়কে নিমেশেই শুষে নেই সেই ঠোঁটজোড়া। বুকের মাঝে দামাদল বাজতে লাগে। এ যেনো এক অন্য অনুভূতি। পঁচিশ বছরের নারীর মাঝেও এক অন্যরকম কিশোরত্বের জন্ম দিচ্ছে। দমটা আটকেk আসছে। এই অনুভূতি বহু বছর পূর্বে তিয়াশার একবার ই হয়েছিলো। যখন লাইব্রেরি অই থাকের আড়ালে এই উষ্ণ ঠোঁটজোড়া তার মাঝে বিলীন হয়েছিলো। আবারো সেই অনুভূতিটা জীবন্ত হয়ে উঠলো। জীবন্ত এবং তাঁজা। সময়ের খেয়াল যেনো ভুলেই গেলো তার মস্তিষ্ক। সময়টা থেমে গেলে হয়তো ভালো হতো। তিয়াশার ঠোঁটজোড়া যখন মুক্ত হলো তখন তার দৃষ্টি তোলার শক্তি নেই। মাথা নিচু করে তাকিয়ে রয়েছে মাটির দিকে। লজ্জা রাগে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে তিয়াশার। এর মাঝেও এক ক্ষীন ভালোলাগা কাজ করছে। অন্তু তার কানে ঠোঁট মিশিয়ে বললো,
“ভুলে যাস না, তুই কিন্তু এখনো আমার ছয়শ এক টাকার বউ। কথাটা ফিল্মি হলেও সত্য। অচেনা কেউ তোকে স্পর্শ করতে গেলে হাত ভেঙ্গে গলায় ঝুলায়ে দিবো। সব সহ্য করে নিবো,শুধু এই একটা জিনিস আমার কোনো জন্মে সহ্য হবে না। তা হলো আমার বউ এর উপর অন্য কারোর অনধিকার চর্চা।“
অন্তুর তীক্ষ্ণ কন্ঠে রাগের ছাঁপ রয়েছে। অন্তুকে রাগতে বহুবার দেখেছে, কিন্তু এভাবে রাগান্বিত হয়ে স্পর্শ করার সাক্ষী এই প্রথম হলো তিয়াশা। মাথাটা তুলে তাকালো সে অন্তুর দিকে। চোখজোড়া লাল হয়ে আছে অন্তুর। চোয়াল জোড়া শক্ত। হিংস্রতার এক সুপ্ত ছাপ বুঝতে পারছে সে। তবে তিয়াশাও দমে যাবার পাত্রী নয়। রুদ্র কন্ঠে বললো,
“অনধিকার চর্চা কেনো করতে যাবে, স্বধিকারে স্পর্শ করবে। ভুলে যাবেন না, ওই ছয়শ টাকার বিয়ের কোনো দাম এই সমাজে নেই। আমার পরিবার যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করবে আমি তার অর্ধাঙ্গিনী হতে প্রস্তুত। তখন আমার জীবন, আমার শরীর এবং আমার সবকিছুর উপর শুধু এবং শুধু মাত্র তার অধিকার থাকবে।“
“আমাকে চ্যালেঞ্জ করছিস?”
“যা ভাবার ভাবতে পারেন।“
বলেই অন্তুর বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় তিয়াশা। অন্তুর অগ্নিদৃষ্টিকে ভয় পাচ্ছে না তিয়াশা। অন্তু কিছুক্ষণ চুপ করে শুধু তিয়াশাকে দেখে। এরপর বরফ শীতল কন্ঠে বলে,
“এতোদিন তোকে ছাড় দিয়েছি, এখন তো দেখছি ভুলটা আমার ছিলো। মাথার উপর উঠে নাচানাচি করতে শুরু করেছিস। ব্যাশ, আমিও দেখবো কোন শালায় বিয়ে করে তোকে।“
কথাটা বলেই হনহন করে বেড়িয়ে গেলো অন্তু। অন্তু চলে গেলে মাটিতে ধপ করে বসে পড়ে তিয়াশা। তার পা জোড়া পাথর হয়ে গেছে। নড়ার শক্তিটাও নেই। চোখে জড় হয়ে থাকা প্লাবনকে আর রুখতে পারলো না তিয়াশা। নোনাজলের প্রবাহ বইতে লাগলো। কেনো অন্তু বোঝে না, এই কঠিন, শক্ত মানবীর মাঝে একটা রক্ত মাংসের হৃদয় আছে। যে হৃদয়ে কেবল একজন পুরুষের ই রাজত্ব। যতই কঠোর হবার ভান করুক, যতই প্রতিরোধের দেওয়াল তুলুক; সব গুড়িয়ে যায় তার সামনে। এভাবে চলতে থাকলে পুনরায় হেরে যাবে তিয়াশা। হেরে যাবে নিজের ভালোবাসার কাছে_________
★★★★
সীমান্ত হেলান দিয়ে বসে রয়েছে। তার সামনে বেশ সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে পঞ্চভোগ। কেঁচকি মাছের বড়া, লাউ চিংড়ী, পটলের দোলমা, ইলিশ পাতুরী, গরু মাংস ভুনা, টাকি মাছের ভর্তা, বেগুনের আঁচার। এতোগুলো তরকারি সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে তার সামনে। সবকিছু একা হাতে বানিয়েছে মৌপ্রিয়া। অবাককর ব্যাপার হলো এই প্রতিটা তরকারি মারাত্বক ভাবে ভালোবাসে সীমান্ত। কিন্তু সে খাওয়া ছেড়ে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে মৌপ্রিয়ার দিকে। মৌপ্রিয়া চেয়ার টেনে পাশে বসলো। তারপর অবাক নয়নে জিজ্ঞেস করলো,
“খাচ্ছেন না যে?”
“এগুলো তুমি রেধেছো?”
“হ্যা, ভাবলাম অসুস্থ মানুষটার জন্য কি নেওয়া যায়? হরলিক্স আর আপেল তো সবাই নেয়। ছাত্রী হিসেবে ঠিক কি নিয়ে গেলে আমার মাস্টারমশাই এর ভালো লাগবে। অনেক চিন্তা শেষে ঠিক করলাম রান্না করে নিয়ে যাবো। নিন এবার কথা রেখে খান তো। নয়তো আপনার বুভুক্ষু বন্ধুর পেটেই সব চলে যাবে।“
আড়চোখে টগরকে একটু দেখে নিলো মৌ। কিন্তু তাতে কি সে তো বেশ আয়েশেই খাচ্ছে। তখন সীমান্ত প্রশ্ন ছুড়ে দিলো মৌ এর দিকে,
“তুমি জানলে কি করে আমি অসুস্থ? আমি তো তোমাকে বলি নি। সাথে আমার এড্রেস পেলে কিভাবে?”
“খুজলে ঈশ্বর ও পাওয়া যায় জানেন তো? কি ভেবেছিলেন ফোন নাম্বার দিবেন না তাই আমি আপনার টিকি টুকুও পাবো না? ভুল ভেবেছিলেন। আপনার মতো ফাকিবাজ মাস্টারকে কিভাবে শায়েস্তা করতে হয় জানা আছে। উঠলাম আপনার কলেজে। যাই হয়ে যাক সেখানে তো কিছু লুকাতে পারবেন না। সেখান থেকেই এই ঠিকানা পাওয়া। এবার কি বোমকেশ বক্সী প্রশ্নোত্তর শেষ হয়েছে? হলে কেই তুচ্ছ মানবীর কষ্টের প্রতিদানটা দিন। খান।“
সীমান্ত হেসে উঠলো। তার হাস্যজ্জ্বল চেহারাটা খুব প্রিয় মৌপ্রিয়ার। ঘরে ঢুকে তাকে বিছানায় শায়িত দেখেই কলিজায় কামড় পড়েছিলো। তার ফ্যাকাশে মুখখানা দেখে বুকে হাজারো তীর আঘাত হানছিলো। ভালোবাসা এতোটা বেদনার এই প্রথম টের পেলো মৌপ্রিয়া। সীমান্ত খেতে লাগলে মুগ্ধ নজরে তাকে দেখতে লাগে মৌপ্রিয়া। হঠাৎ ই বলে উঠে,
“আমার আপনাকে কিছু বলার আছে, একান্তে বলতে চাই। তাই খাওয়া শেষে একটু সময় হবে কি?”
সীমান্ত খানিকটা থমকে গেলো। আড়চোখে টগরের দিকে তাকালো। টগর খানিকটা ইতস্ততস্বরে বললো,
“আমি খেয়েই বেড়িয়ে পড়বো।“
টগর খাবারের বেগ বাড়ালো। সীমান্ত কিছুক্ষণ ভাতের প্লেটের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এরপর শান্ত গলায় বললো,
“মৌপ্রিয়া, তুমি তো জানো এটা ছেলেদের মেস। এখানে যদি এভাবে একজন যুবক, যুবতী একই রুমে বেশ কিছুক্ষণ বদ্ধ থাকে তবে তাদের নিয়ে অহেতুক কথাটা রটবে। সেই কথাগুলো খুব একটা শ্রুতিমধুর লাগবে না তোমার।“
“আপনি কবে থেকে লোকের কথায় কান দিচ্ছেন?”
“আমাকে নিয়ে কথা উঠলে হয়তো কান দিতাম না, কিন্তু সেখানে তুমিও থাকবে।“
এবার মৌপ্রিয়া হো হো করে হেসে উঠলো। খিলখিল হাসিতে পুরো ঘর মুখোরিত হয়ে উঠলো। সীমান্ত অবাক ক্লান্ত নজরে মৌপ্রিয়াকে দেখছে। একটা মানুষের সব কিছুই কি সুন্দর হতে পারে? পারে না। কিন্তু এই মেয়েটির সবকিছুই সুন্দর। তার কান্নারত মুখ, তার হাসি, তার চোখ, তার ঠোঁট সব সুন্দর। মৌপ্রিয়া হাসি থামিয়ে বললো,
“মাস্টারমশাই এর চিন্তায় আমি শিহরিত। তবে আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি এখানে আসার আগে বাবাকে বলে এসেছি। কথাটা যদি খুব জরুরি না হতো, তবে এতোটা ব্যাস্ত হতাম না। আর কথাটা খুব ব্যাক্তিগত। চিন্তা করবেন না, বেশি সময় নিবো না। আপনি নিশ্চিন্তে খেয়ে নিন। আমি অপেক্ষা করছি। আপনার খাওয়া শেষে নাহয় চা খেতে কথা বলা যাবে। আমার কাছে অঢেল সময়।“
সীমান্ত আর কথা বললো না। খাওয়াতে মন দিলো। অনেকদিন পর যেনো জিবে স্বাদ এসেছে। পেটের ক্ষুধাটাও যেনো দ্বিগুন হয়ে গেছে। সীমান্তের মনে হলো একটা রাক্ষস তার পেটে ভর করেছে। গোগ্রাসে গিলছে সে। আর মৌপ্রয়া মুগ্ধনয়নে তার মনের মানুষটিকে দেখে যাচ্ছে। পিপাসু চোখজোড়া যেনো শান্ত হয়েছে তাকে দেখে। কি অদ্ভুত এই প্রেম!
টগরের খাওয়া শেষে সে তৈরি হলো বেরিয়ে যাবার জন্য। মৌপ্রিয়া সব প্লেটগুলো গুছিয়ে নিলো। বের হবার আগে টগর সীমান্তের উদ্দেশ্যে বললো,
“বন্ধু, আমি বের হচ্ছি। ফোনটা কাছে রাখিস। কোনো অসুবিধা হলেই ফোন দিস। আমার একটু দেরিও হতে পারে। আসার সময় খাবার নিয়ে আসবোনে। আসলাম।“
“ঠিক আছে।“
টগর বেরিয়ে গেলে সীমান্ত মৌপ্রিয়াকে বলে,
“আমার টেবিলের উপরের ঠোঙ্গাটা দিবে? ঔষধ খেতাম।“
“দিচ্ছি।“
“তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেললাম, তাই না?”
“কষ্টের কি আছে, দু কদমের মধ্যেই তো ছিলো। এমন একটা ভাব নিচ্ছেন যেনো আমি হনুমানের মতো পর্বত উঠিয়ে নিয়ে এসেছি।“
ঔষধের প্যাকেটটা দিতে দিতে মৌপ্রিয়া কথাটা বললো। সীমান্ত হেসে উঠলো। হঠাৎ তার কপালে হাত রাখলো মৌপ্রিয়া। মুচকি হেসে বললো,
“যাক বাবা জ্বরটা নেই। আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম। জ্বরের মানুষটাকে কিভাবে নিয়ে বের হবো।“
মৌপ্রিয়ার এমন কাজে বেশ চমকে উঠে সীমান্ত। মৌপ্রিয়া আজ তাকে বার বার চমকে দিচ্ছে। প্রথমত মেসে এসে একবার চমকে দিয়েছে, তারপর আরেকবার চমকে দিয়েছে তার জন্য রান্না করে নিয়ে এসে, তৃতীয়বার চমকে দিয়েছে তার সাথে একান্তে কথা বলার আবদার করে, এখন আবার জ্বর মাপার বাহানায় কপাল ছুয়ে চমকে দিয়েছে। মেয়েটা কি ভুলে গিয়েছে সে একজন পুরুষের সান্নিধ্যে আছে। বলা তো যায় না, কুমতলব থাকলেও থাকতে পারে। সীমান্ত মুখ ফিরিয়ে নিলো। অস্থির কন্ঠে বললো,
“বের হবে মানে?”
“আপনাকে নিয়ে একটা জায়গায় যেতাম। তাই আর কি!”
“ওহ!”
“জিজ্ঞেস করবেন না কোথায়?”
“নাহ। আমি জানি ক্ষতিকর কোনো জায়গায় তুমি নিয়ে যাবে না। আচ্ছা, কি কথা বলতে চেয়েছিলে, এখন বলো। কেউ তো নেই আমি আর তুমি ছাড়া।“
কথাটা শুনেই মৌপ্রিয়া চুপ হয়ে যায়। মনে মনে কথাগুলো গুছাতে থাকে। কোথা থেকে শুরু করবে বুঝে উঠছে না। মৌপ্রিয়াকে চুপ করে থাকতে দেখে সীমান্ত বলে,
“কি হলো চুপ করে আসো যে!“
“কিছু বলার ছিলো”
“বলো, নির্দ্বিধায়”
মৌপ্রিয়া রুদ্ধশ্বাস ফেলে বললো,
“আমি…আমি”
“হ্যা তুমি?”
“আমি আপনাকে……
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি