গাংচিল পর্ব-২০

0
456

#গাংচিল
#২০তম_পর্ব

হঠাৎ মনের অনুভূতিগুলো একত্রে জড়ো হলো। এক ভয়ংকর কাজ করার উৎসাহ জাগাতে লাগলো। পায়ের পাতার উপর দাঁড়িয়ে আলতো হাতে স্পর্শ করলো সীমান্তের গাল। মৌপ্রিয়ার এমন কাজে হতভম্ব হয়ে গেলো সীমান্ত। তার চোখের দিকে তাকাতেই ভয়ংকর কাজটা ইশারা পেলো সে। ধীর গলায় বললো,
“আমরা রাস্তায় মৌপ্রিয়া, লোকে দেখলে কি ভাববে?”
“লোকে কি ভাববে সেটা আমরা ভাবলে লোকে কি ভাববে।“

বলেই ঠোঁটজোড়ায় নিজের দখল করে নিলো মৌপ্রিয়া। সীমান্ত তখন স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শিরদাঁড়া বেয়ে গরম রক্ত ছলকে উঠে। আবেশে চোখ বুঝে আসে। হাত চলে যায় মৌপ্রিয়ার কোমরে। সময়, সমাজ, মানুষ তাদের যেনো কিছুই খেয়াল নেই। নিজেদের মাঝে বিলীন হয়ে রয়েছে তার। হৃদস্পন্দন বাড়ছে। বৃষ্টির ছিটা ভিজিয়ে দিচ্ছে সীমান্তের পিঠ, কিন্তু নড়ারে ইচ্ছে হচ্ছে না। হঠাৎ করেই বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হলো সীমান্তের। শ্বাস নিতে যেনো খুব কষ্ট হচ্ছে, দম আটকে আসছে। তার শরীর জানান দিচ্ছে, তোমার অন্তিম ক্ষণ সন্নিকটে। অহেতুক কেনো আশা বাড়াচ্ছো? কথাটা মনে হতেই এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো মৌপ্রিয়াকে। সীমান্তের এমন আচারণে হতাবাক হয়ে গেলো মৌপ্রিয়া। তার চোখে হাজারো প্রশ্ন, বিস্ময়। সীমান্তের শীতল দৃষ্টি নজরে পড়তেই থমকে গেলো সে। রক্ত মাংসের হৃদয়টাকে কেউ যেনো খুবলিয়ে খুবলিয়ে চিরে খাচ্ছে। সীমান্ত কোনো কথা বললো না, শুধু বৃষ্টির মাঝে নেমে পড়লো। হনহন করে হাটতে লাগলো বৃষ্টিতে। বুকের ব্যাথাটা বাড়ছে। এটা শরীরের ব্যাথা নয়, হৃদয় ভাঙ্গার ব্যাথা। পিছে থাকাবার ইচ্ছে হলো না, ভয় হলো শ্যামলীর ছলছল নয়নে বিষাদসিন্ধু দেখার। মৌপ্রিয়া ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। নিজের উপর নিজের রাগ হতে লাগলো। এভাবে নিজেকে নিচে না নামালেই পারতো সে_______________

চায়ের ট্রে নিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই থমকে গেলো তিয়াশা। বা পাশের বেতের সোফায় বসা নীল শার্ট পড়া যুবকটি হাসি মুখে কথা বলছে রহিমা বেগমের সাথে। যুবকটি আর কেউ নয় তিয়াশার প্রাক্তন এবং স্বামী অন্তু। ছেলেটা তাকে বলেছিলো, কোন শালায় তাকে বিয়ে করবে দেখে ছাড়বে। কিন্তু নিজেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে উপস্থিত হবে এটা ভাবতে পারে নি। তিয়াশার পা যেনো জমে গেলো ট্রে হাতে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো সে। অন্তু তখন দৃষ্টি তার দিকে প্রয়োগ করলো, বাঁকা হাসি দিয়ে জানিয়ে দিলো সে চ্যালেঞ্জ জিতে গেছে। রহিমা বেগম তিয়াশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলেন, বললেন,
“ভাবি এই যে আমার মেয়ে, আমার মেয়ে কোনো ছেলের চেয়ে কম নয়। একা হাতে আমার সংসার চালায় সে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, ও আমার মা।“

শাহানা বেগম আলতো হেসে বললো,
“মা, আমার কাছে এসে বসো। দেখি তো চাঁদমুখখানা।“

তিয়াশা ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো বসলো শাহানা বেগমের পাশে। অন্তু তখন আয়েশ করে চা খাচ্ছে। শাহানা বেগম তাকে নানা প্রশ্ন করছে। তিয়াশা উত্তর দিচ্ছে। এর মাঝেই রহিমা বেগম বললেন,
“ভাবি, ছেলে মেয়ে দুটোকে আলাদা কথা বলার সুযোগ দিলে হয় না?”
“নিশ্চয়ই ভাবী, এ আবার বলতে।“
“তাহলে তিয়া, তুই অন্তু বাবাকে নিয়ে ছাঁদে যা। ওখানে কথা বলঅলি। বৃষ্টি থেমে গেছে, রোদ ও নেই। যা”

তিয়াশা কথা না বাড়িয়ে মাথা কাত করেই উঠে দাঁড়ালো। অন্তুর অপেক্ষা না করে হাটা শুরু করলো। অন্তু ও পিছু নিলো তার।
ছাঁদের কর্ণিশ ধরে দাঁড়িয়ে আছে তিয়াশা। তার ঠিক পেছনে অন্তু। সে ঝলঝলে আকাশের কুসুম আভা দেখতে ব্যাস্ত। মেঘের ফাঁকে একটা রংধনু ডানা মেলেছে। কি চমৎকার লাগছে। এর মাঝেই তিয়াশা বলে উঠে,
“এসবের মানে কি?”
“কোন সবের?”
“এই যে, বলা নেই কওয়া নেই। চলে এসেছো আমার বাড়ি”
“নিজের বউ কে নিতে এসেছি। তুমি তো বলেছিলে ছয়শ টাকার বিয়ের দাম নেই। তাই এলাম দাম আছে এমন বিয়ে করতে। এতে এতো আপত্তি কেনো তোমার?”

এবার তিয়াশা আর আটকাতে পারলো না নিজেকে। কেদে উঠে বললো,
“কেনো পাগলামী করছো অন্তু? আমাকে ভালোবেসে কি পাবে তুমি? আমার অনেক দায়িত্ব। আমার কাছে আমার দায়িত্বগুলো সবার আগে থাকবে। তোমাকে হয়তো আমি কিছুই দিতে পারবো না।“

তিয়াশার কথা শুনে এগিয়ে আসে অন্তু। আলতো হাতে স্পর্শ করে মায়াবী মুখশ্রী। আবেগজড়ানো কন্ঠে তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
“লাগবে না আমার কিছু,, আমার যে শুধু তোমাকে চাই। আমি জানি তোমার উপর অনেক দায়িত্ব। আমি শুহদু চাই সেই দায়িত্ব, কষ্ট, শ্রমটুকু ভাগ করে দিতে। তিয়াশা সাত বছর আগে আমার যেই যোগ্যতা ছিলো না তোমার পাশে দাঁড়ানোর। ইচ্ছা থাকলেও আমি অপারগ ছিলাম। কিন্তু আজ আমি সটান দাঁড়াতে পারবো, বাঁধা আসুক, ঝড় আসুক আমাকে পাশে পাবে তুমি। ঠিক এই ভাবে আগলে নিবো আমি তোমায়। একটা বার আমায় বিশ্বাস করো। আর কত একা একা এই তুফানের সাথে লড়বে। একবার নাহয় একসাথে লড়লাম।“

তিয়াশার কপালে এখনো কপাল ঠেকিয়ে আছে অন্তু। তার দৃষ্টি তিয়াশার সুগাঢ় ছলছল নয়নে। তিয়াশার শীতল হৃদয় বহুবছর পর অন্তুর উষ্ণতায় গলতে শুরু করলো। মোম যেমন আগুনের স্পর্শে গলে বিলীন হয়ে যায়, আজ তিয়াশার শক্ত খোলস ও ভেঙ্গে চুরে যাচ্ছে অন্তুর আকুল প্রেমে। দুজন মানব মানবী নিজেদের মাঝে সমাকয়িত হয়ে রইলো বহুক্ষণ। রক্তিম সূর্য দাঁড় প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এখনই আধারকে নিমন্ত্রণ জানাবে সে, সেই অপেক্ষায় রয়েছে পৃথিবী।

১০.
অনুপমা প্রকাশনীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে মৌপ্রিয়া। গত তিন দিন আগে এখানের এক প্রকাশকের ফোন এসেছে তার কাছে। তারা তার পান্ডুলিপিটা চাচ্ছিলো। তার পেজ থেকে তার খোজ পেয়েছে। তার লেখা নাকি খুব ভালো লেগেছ প্রকাশনী। তার সাথে কাজ করার বিশাল আগ্রহ প্রকাশনীর। মৌপ্রিয়ার কাছে ব্যাপারটা সোনায় সোহাগা হবার মতো। এমনিতেও পান্ডুলিপিটা শেষ। এখন প্রকাশনী থেকে প্রকাশনী ঘুরতো সে। এর চেয়ে যখন প্রকাশনী নিজ থেকে তাকে ফোন দিয়েছে তখন এই প্রকাশনীর কাছেই প্রথম পান্ডুলিপিটা দেওয়া উচিত। তাই নিজেই স্বশরীরে এসেছে প্রকাশনীর অফিসে। আয়াতুল কুরসী পড়ে প্রবেশ করলো বিল্ডিং। বিশাল বিল্ডিং এ ছোট একটা অফিস। সেখানে একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো,
“প্রকাশক সাহেব আছেন?”
“জ্বী অই রুমে গিয়ে বসুন”

মৌপ্রিয়া মেয়েটির দেখানো রুমে যেয়ে বসলো। সময় পার হতে লাগলো কেউ আসার নাম নেই। সামনেই শেলফের সাজানো বই গুলো দেখে তার মনে লোভ জাগলো। এমনেই বসে রয়েছে, বই পড়লে ক্ষতি কি। তাই এগিয়ে গেলো শেলফের দিকে। সাজানো বই এর একটি নাম দেখে থমকে গেলো সে। তা হলো “সীমান্ত ইসলাম”। নামটি দেখেই মনে পড়ে গেলো সীমান্তের কথা। লোকটি যেনো হাওয়া হয়ে গেলো। সেই বৃষ্টিস্নাত বিকেলের পর থেকে আর তাকে দেখে নি মৌপ্রিয়া। হাসি খুশী মনটা হুট করে বিষাদে ভরে গেলো। কেউ সত্যি বলেছে,
“প্রেম মানে সুখ নয়; বরং বিষাদ, বিষাক্ত নীল বিষাদ”

কাঁপা হাতে একটা বই হাতে নিলো সে। মনোযোগে পড়তে লাগলো। লোকটির লেখনী বড্ড পরিচিত লাগছে। কোথায় যেনো পড়েছে সে। উলটে পালটে লেখক পরিচিতিতে গেলো সে। নাহ কোনো ছবি নেই। তবে একটা লাইনে আটকে গেলো মৌপ্রিয়া। সেখানে লেখা,
“মানুষ তাকে ফেসবুকে “ব্যার্থ মানুষ” হিসেবে চিনে।“

এটা “ব্যার্থ মানুষ” এর লেখা বই। সে যে মৌপ্রিয়ার অনুপ্রেরণা। অবশেষে তাকে পেলো মৌপ্রিয়া। তখন ই দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে টগর। পেছনে ফিরে টগরকে দেখেই থমকে যায় সে। সব কিছু যেনো এলোমেলো লাগছে তার কাছে। টগর এই প্রকাশনীতে কাজ করে, সেই টগর সীমান্তের অন্তরঙ্গ বন্ধু, আবার সেই প্রকাশনীর একজন লেখক “ব্যার্থ মানুষ”। যার আসল নাম সীমান্ত ইসলাম। মৌপ্রিয়াকে হতবাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে টগর বলে,
“অবশেষে সীমান্তের পরিচয় উদ্ভাবন করলে তুমি?”

টগরের কথাটাই যথেষ্ট ছিলো সব সন্দেহের উত্তর পেতে। সব গুলো প্রশ্ন এক বিন্দুতে এসে জড়ো হয়ে তা হলো, সীমান্তই ব্যার্থ মানুষ, আর ব্যার্থ মানুষ ই সীমান্ত। ম্যাজেসের জবাব না দিলেও সেই তাকে উপদেশ দিতে হাজির হয় তার মাস্টার হিসেবে। নিজের পরিচয় গোপন করে ঢুকে পড়ে মৌপ্রিয়ার অগোছালো জীবনে। টগর স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
“পান্ডুলিপিটা এনেছো?”
“আমি মিথ্যুক, ঠকদের সাথে কাজ করি না…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here