গাংচিল পর্ব-২১

0
567

#গাংচিল
#অন্তিম_পর্ব (প্রথম অংশ)

টগরের কথাটাই যথেষ্ট ছিলো সব সন্দেহের উত্তর পেতে। সব গুলো প্রশ্ন এক বিন্দুতে এসে জড়ো হয়ে তা হলো, সীমান্তই ব্যার্থ মানুষ, আর ব্যার্থ মানুষ ই সীমান্ত। ম্যাজেসের জবাব না দিলেও সেই তাকে উপদেশ দিতে হাজির হয় তার মাস্টার হিসেবে। নিজের পরিচয় গোপন করে ঢুকে পড়ে মৌপ্রিয়ার অগোছালো জীবনে। টগর স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
“পান্ডুলিপিটা এনেছো?”
“আমি মিথ্যুক, ঠকদের সাথে কাজ করি না। “

কথাটা বলেই বেরিয়ে যায় মৌপ্রিয়া। সীমান্তের মিথ্যের প্রকাশ যেনো তার হৃদয়কে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। পৃথিবীতে মিথ্যুকদের সে পছন্দ করে না। আর তার জীবনের অতিপ্রিয় মানুষটি ই মিথ্যুক। টগর বাঁধা দিতে চায়। কিন্তু পারে না। মৌপ্রিয়া ছুটে বেড়িয়ে যায়। দম আটকে আসছে তার। কষ্টে বেদনা বুক ঝাজড়া হয়ে যাচ্ছে। কেনো মিথ্যে বলতে হলো সীমান্তকে? কেনো? কেনো?

রাত ৩টা,
হুট করেই ঘুম ভেঙ্গে যায় সীমান্তের। শ্বাস নিতে পারছে না সে। দম আটকে আসছে। বুকে ব্যাথাটা প্রকট হয়ে গিয়েছে। মৃত্যু যেনো তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সময় বুঝি শেষ হতে চললো। নাক দিয়ে শীতল তরল বের হচ্ছে। হাত দিতেই দেখলো রক্ত, টাটকা লাল রক্ত। পাশেই টগর ঘুমাচ্ছে। কিন্তু তাকে জাগাতে পারছে না। স্বর ই বের হচ্ছে না গলা থেকে। মনে মনে বললো,
“আল্লাহ, একটু সময়। একটু সময়। আমাকে এখন নিও না”

খুব কষ্টে ধাক্কা দিলো সে টগরকে। ধাক্কা খেতেই তড়াক করে উঠে গেলো টগর। পাশে তাকাতেই মাথা ফাঁকা হয়ে গেলো তার। সীমান্তকে এমন অবস্থায় মোটেই আশা করে নি। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো সে। জোরে জোরে বললো,
“দোস্ত আমি এখনই হাসপাতালে নিয়ে যাবো তোকে, এখনই”

বলেই উঠে চিৎকার করতে লাগলো সে। সবাই জড় হতে লাগলো। সীমান্তের দৃষ্টি ঝাপসা হচ্ছে। আশেপাশের কোলাহল ক্ষীন হচ্ছে। তার মনে হলো সে তলিয়ে যাচ্ছে। তলিয়ে যাচ্ছে অতল সাগরে________

তিনদিন পর,
তিয়াশার পাশে বসে রয়েছে মৌপ্রিয়া। দিন পাঁচেক বাদে তার বিয়ে অন্তুর সাথে। বান্ধবীর সুখে তার পাশে থাকবে না এতোটা নিষ্ঠুর নয় মৌপ্রিয়া। নিজের দুঃখকে বড় করে দেখার সময় এখন নয়। তিয়াশাটা বহুকাল বাদে সুখ পাচ্ছে। ভেবেই ভালো লাগছে মৌপ্রিয়ার। তিয়াশা শাড়ী গুলো দেখিয়ে বললো,
“কোনটা পড়বো রে? আমি সত্যি ই খুব কনফিউজড”
“লালটা পড়, তোকে পুতুলের মতো লাগবে।“
“তুই না থাকলে আমার কি হতো বলতো?”
“এখন তোমার জীবনে আমার দরকার নেই, সে তোমাকে দেখে রাখবে।“

মৌপ্রিয়ার কথায় তিয়াশার গালজোড়া রক্তিম হয়ে উঠে। লাজুক কন্ঠে বলে,
“আর ঠেকাতে পারলাম নারে। মানুষটাকে আর ফেরাতে পারলাম না। অনুভূতিপ্রবণ মনের কাছে হেরে গেছি। অন্তুর ভালোবাসার কাছে মাথা ঠেকেছি।“
“যা যথার্থ তাই করেছিস। প্রকৃত ভালোবাসাকে ঠেলে দিতে হয় না তিয়া। তাকে শক্ত করে আঁচলে বাঁধতে হয়। বেশ ঠেলে দিলে সেই ভালোবাসা হারিয়ে যায়। আর প্রকৃত ভালোবাসা কজন পায় বল।“

মৌপ্রিয়ার কথায় সুপ্ত বেদনা লুকায়িত, সেটার উপস্থিতি ঠিক টের পেয়েছে তিয়াশা। সে কথা ঘুরিয়ে নিলো। আবারো শাড়ীর দিকেই ঘুরিয়ে দিলো মনটা। মৌপ্রিয়া ঠোটের কোনে হাসি ফুটিয়ে শাড়ি দেখতে লাগলো।

রাত ৯টা,
ইফতেকার সাহেব বাড়ি ফিরলেন কলেজের মিটিং সেরে। আজ জ্যামটাও বেশ ছিলো। আজ কলেজে টগর এসেছিলো। সীমান্তের অসুস্থতার কথা জানিয়েছে। হয়তো ছেলেটা বেশিদিন বাঁচবে না। আকুতি কলো ছেলেটা যেনো মৌপ্রিয়া বই টা বের করে। ইফতেকার সাহেব উত্তর দেন নি। সময় চেয়েছে কিছুদিন।
বাড়িতে ঢুকেই দেখা হলো নীলুর সাথে। তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“মৌ কোথায় রে?”

নীলু হিনহিনে কন্ঠে বলল,
“আর কই থাকবো, যায়ে দেখেন কালা শাড়ী পিন্দা, চুল ছাইড়ে পেত্নীর মতো বারান্দায় বইয়ে আছে।“
“তোর সাথে কথা বলেছে?”
“আমাকে পাগলায় কামরাইছে আমি তারে কিছু কই, ডর লাগে না মনে?”
“হুম, বুঝলাম। যা দুকাপ চা নিয়ে আয়। বাপ বেটি এক সাথে চা খাবো।“
“জে, আচ্ছা।“

বলেই নীলু চলে গেলো রান্নাঘরে। ইফতেকার সাহেব গেলেন মৌপ্রিয়ার রুমে। সত্যি মেয়েটা বারান্দায় বসে আছে। ঘর অন্ধকার, কালোর মাঝে যেনো মিলিয়ে যেতে চাচ্ছে সে। শান্ত নজরে তাকিয়ে আছে সে বাহিরের দিকে। ইফতেকার সাহেব মেকি উৎসাহ নিয়ে বললেন,
“কি রে মৌরানী, তারা গুনছিস? তা এই জন্য কয়টাকা দিচ্ছে তোকে তোর ভক্তরা।“

মৌপ্রিয়া উত্তর দিলো না। সে এখনো বাহিরেই তাকিয়ে থাকলো। ইফতেকার সাহেব পাশে বসতে বসতে বললেন,
“জানিস, ওই পাজি টগরটা এসেছিলো। আমাকে রিকুয়েস্ট করতে। আমি ঐ মিথ্যুকটাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছি।“
“মিথ্যে বলছো বাবা?”
“আমি আর মিথ্যে? অসম্ভব”
“আমি জানি তুমি তাকে বের করো নি। এখন আমার কাছে রিক্যুয়েস্ট করবে যেনো আমি বই টা বের করি।“
“তুই সত্যি বই টা বের করবি না?”

মৌপ্রিয়া চুপ করে রইলো উত্তর দিলো না। বরং শূন্য আকাশের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো,
“বাবা, আমাদের বাপ বেটির ভালোবাসার গল্পগুলো এতো বেদনাদায়ক কেনো? কেনো আমাদের ভালোবাসার ভাগ্যটা খারাপ? আমরা কি ভালোবাসতে পারি না?”

মেয়ের প্রশ্ন শূনে থমকে গেলেন ইফতেকার সাহেব। ইফতেকার সাহেব নিজেও জানে না এই উত্তর। বাবাকে চুপ করে থাকতে দেখে কথা পালটায় মৌপ্রিয়া। ধীর স্বরে বলে,
“কি যেনো বলতে এসেছিলে তুমি বলো।“
“সীমান্ত হাসপাতালে, খুব অসুস্থ। লিউকোমিইয়া তার শরীর ঝাঝড়া করে দিয়েছে। একটা চিঠি পাঠিয়েছে তোর জন্য। আমি টেবিলে রেখে যাচ্ছি, ইচ্ছে করলে পড়িস।“

তখন ই নীলুর প্রবেশ ঘটে। লাইট জ্বালায় ঘরে। তীব্র আলোতে চোখ ধাধিয়ে যায় মৌপ্রিয়ার। নীলু চা নিয়ে এসেছে। মৌ উঠে বাবাকে বলে,
“চলো চা খাই। কত দিন বাপ বেটিতে চা খাই না।“

মৌ এর স্থির থাকা দেখে মনটা কেঁদে উঠে ইফতেকার সাহেবের। মেয়েটা তার সত্যি ই পাথর হয়ে গেছে। তাই তো সীমান্তের অসুস্থতাও কাঁদাচ্ছে না তাকে।
ইফতেকার সাহেব যাবার পর চিঠিটা হাতে নেয় মৌপ্রিয়া। সাদা দামী কাগজে গোটা গোটা হাতে লেখা। সীমান্তের হাতের লেখা তার মতোই সুন্দর। মৌপ্রিয়া পড়তে শুরু করে,

“ “প্রিয়” শব্দটি ব্যাবহার করার খুব ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু তোমার আমার সম্পর্কটা এতোটাই জটিল যে প্রিয় শব্দটা আমি ব্যাবহার করতে পারবো না। এই চিঠিটা যেহেতু তুমি পড়ছো এর মানে আমার অন্তিম ক্ষণের কাছাকাছি আমি পৌছে গেছি। এখন আমি তোমার কাছে কিছু লুকাবো না। কারণ এখন যদি আমি তোমার থেকে লুকিয়ে যাই, হয়তো কথাগুলো কোনোকালেই বলা হয়ে উঠবে না, হয়তো। তবে আমি কিন্তু আশা ছাড়ছি না বাঁচার।

তোমার জন্য এই চিঠিটা যখন লিখতে বসেছি, তখন মস্তিষ্ক অজস্র শব্দ আমার দিকে ছুড়ে দিচ্ছিলো। কিন্তু কেনো যেনো কিছুই সাজাতে পারছিলাম না। ক্লান্ত আমি চোখ বুঝলাম, চোখ বুঝতেই তোমার সাথে কাটানো ক্ষুদ্র জীবনের মূহুর্তগুলো জীবন্ত হয়ে উঠলো। হাসি,কান্না,অভিমান, রাগ সমস্ত অনুভূতিগুলো জড়ো হতে লাগলো। অজান্তেই আমার ঠোঁটে তোমার মনের ব্যালকনির এক চিলতে কুসুমপ্রভাত ঠাই নিলো। জীবনের অন্তিম সময়টায় তুমিহীন কাটানোর ভয় চোখের কোনায় জড়ো হলো। আমি কিন্তু মরতে ভয় পাই না। তিনবছর রোগের সাথে যুদ্ধ করে করে আমি নিজের মনকে অসীম শক্তিশালী করে তুলেছিলাম, ভেবেছিলাম মৃত্যুর মুখোমুখি বীরের মতো হবো। পিছুটান রাখি নি কেবল এই বীরত্ব দেখাতে। কিন্তু এই প্রথম আমার ভয় হচ্ছিলো। কালো বিশ্রী ভয় আমাকে নাড়িয়ে দিচ্ছিলো। তখন আমার বুকের ভেতরে তোমার প্রতি সদ্য জন্ম নেওয়া নবঃ ভালোবাসাটুকু বেঁচে থাকার আকুতি মিনতি করতে লাগলো। আমি সত্যি ই ভাষা হারালাম। কলমটা চলতে চাইছে না, আমি কিভাবে তোমার জন্য চিঠিটা লিখবো বলো তো?

আমি চোখ মেললাম, আমার সাদা কাগজে তোমার মায়াবী মুখশ্রীটা ভেসে উঠলো। শ্যামলী মুখের ক্যানভাসের যেই অব্যক্ত অনুভূতিগুলো আমি যেনো অনুভব করছি। সেই বৃষ্টির দিনের স্পর্শ এখনো ঠোঁটে লেগে আছে জানো তো। আমি সেদিন তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। তুমি একরাশ বিষ্ময়, প্রশ্ন এবং অশ্রু নিয়ে আমার পানে চেয়েছিলে। তোমার ভালোবাসাটার প্রতিত্তোরে আমি কেবলই তোমাকে শীতল চাহনী দিয়েছিলাম। ঠান্ডা বর্ষাস্নাত বিকেলে আমার শীতল চাহনী তোমার উষ্ণ হৃদয়কে চুরমার করে দিয়েছিলো। আমি যে অপারগ ছিলাম কাজললতা, একজন মৃত্যু পথযাত্রী ব্যাক্তি কাউকে ভালোবাসার মিথ্যে আশা দিতে পারে না। সেটা যে নিষ্ঠুর হতো! অন্যায় হতো!
তুমি ভাবছো আমি ঠক, আমি তোমাকে ঠকিয়েছি। হ্যা, আমি মিথ্যে বলেছি। তবে তোমাকে ঠকাই নি। “ব্যার্থ মানুষ” কাউকে ঠকায় না। তুমি তো আমার সাহায্যই চেয়েছিলে। আমার মতামত, তোমার লেখনী। আমি “ব্যার্থ মানুষ” হিসেবে আড়ালে তোমাকে সাহায্য করতে চাই নি। চেয়েছি, নিজস্ব পরিচয়, স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে তোমাকে সাহায্য করতে। আর আমি সফল। তুমি এখন কেবল শব্দ লিখো না, তুমি সেই রঙ্গ বেরঙ্গের শব্দের অনুভুতি গুলো অনুভব করতে পারো। এটাই তো চেয়েছিলো। শুনেছি তুমি নাকি বইটা বের করবে না। আমার উপর অভিমান করেছো এক সাগর। অভিমানটা জমা থাক, যদি বেঁচে ফিরে আসতে পারি তবে নিজ হাতে ভাঙ্গিয়ে দিবো। স্রষ্টা করুনা করলে তোমার ওই শ্যামা মায়াবী মুখের ক্যানভাসে আমার সৌভাগ্য লেখা থাকতে পারে। হয়তো কোন এক গোধুলীতে আমি ফিরে এলাম তোমার কাছে, আবেগজড়ানো কন্ঠে বললাম,
“কাজললতা, আমি ফিরে এসেছি। শুধু তোমার জন্য”

স্বপ্ন দেখতে দোষ কি বলো! তবে তোমার কাছে আমার এক একটা আর্জি, “গাংচিল” বইটা তুমি ছাঁপাবে। বইটায় শুধু তোমার সঞ্চিত শব্দই নয়, আমার আর তোমার কাটানো অজস্র মূহুর্ত রয়েছে। তুমি আমার এই আর্জিটুকু রেখো। এই বইটাই আমার আর তোমার গল্পের সূচনা অধ্যায়। বইটা তুমি ছাপিও। এতোটুকু আর্জি রইলো।

ইতি
তোমার আবালচন্দ্র মাস্টারমশাই”

মৌপ্রিয়া খেয়াল করলো তার গাল ভিজে গেছে। ঠিক কতোদিন পর কাঁদছে জানা নেই। তবে সে কাঁদছে। আজ বুকফেটে বিষাদ সিন্ধু মুক্তি পাচ্ছে। সে কাঁদছে। কাঁদছে তার সীমান্তের জন্য____________________

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here