#গল্পের_নাম: ||গাঙচিল||
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____০৩
অহি বিনীত স্বরে বলল,
—“আসসালামু আলাইকুম, স্যার!”
রোদ্দুর সালামের উত্তর না দিয়ে বলল,
—“দুপুরে না বলে চলে গিয়েছো কেন?কতক্ষণ অপেক্ষা করিয়েছিলাম?এই ফাঁকে পালিয়ে গেছো?তোমাকে আমি সত্যি সত্যি রিমান্ডে নিবো!”
—“যারা পালিয়ে যায় তারা কোনো ক্লু রেখে যায় না।অনেকটা ঝরে পড়া নক্ষত্রের মতো।টুস করে সবার অগোচরে ঝরে যায়।কিন্তু আমি আপনাকে বলে আসলাম তো!কাগজে লিখে আসলাম।আপনি কাগজ পাননি?”
—“পেয়েছি।কাগজে কি লিখেছো মনে আছে?নাকি আরেক বার মনে করিয়ে দিবো?”
—“মনে আছে।”
—“খেয়েছো কখন?”
—“খাইনি এখনো।খাব!”
—“এক্ষুনি খেয়ে নাও।খাওয়া শেষ হলে আমায় জানিও!আর ইয়ে মানে একটু কথা আছে।”
রোদ্দুর ফোন কেটে দিল।অহি বিছানায় বসে ফোনের দিকে চেয়ে রইলো।তাকে এই প্রথম বাইরের কেউ জিজ্ঞেস করলো সে খেয়েছে কি না!তার বন্ধু নেই।কত রাত সে না খেয়ে থেকেছে কেউ খোঁজ নেয়নি।মুখে একবার ‘খেয়েছি’ বললেই কেউ তার পিছনের সত্যতা যাচাই করতে যেত না।সে সত্যি খেয়েছে কি না খতিয়ে দেখতো না।
—“বুবু,ভাত বেড়ে দে।চল!”
অহি সামনে তাকাল।দরজার সামনে শফিক এসে দাঁড়িয়েছে।শফিকের চেহারাটা এখনো বাচ্চা বাচ্চা।ভার্সিটিতে পড়ে দেখে বোঝা যায় না।অতিরিক্ত ফর্সা আর বকের মতো লম্বা চেহারায় কিশোর কিশোর ভাব।অহি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
—“গিয়ে বস।আমি আসছি।মা খেয়েছে রে শফি?”
—“জানি না বুবু।রুম অন্ধকার করে শুয়ে আছে।একটা ডাক দিলাম।উল্টো আমায় ধমক দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।”
অহি কিছু বলল না।এটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।তার মা সবার থেকে নিজেকে সবসময় গুটিয়ে রাখার চেষ্টা করে।বাবা জেলে যাওয়ার পর থেকে আরো বেশি করে নিজেকে আড়ালে রাখে।
শফিক এখনো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।অহি আর দেরি করলো না।ফোনটা বেডের উপর রেখে বের হলো।
অহিদের ভাড়া বাড়িটি বহু পুরনো।ইটের তৈরি দেয়াল।উপরে টিন দিয়ে ছাপড়ার মতো করা।দুটো রুম।আর বারান্দার দুপাশে দুটো রুম।বারান্দার রুম দুটোর একটাতে শফিক থাকে,আরেকটাতে রান্নাঘর।খাওয়া দাওয়া সব রান্নাঘরেই করা হয়।
রান্নাঘরে মাদুর বিছিয়ে শফিক বসে পড়লো।অহি র্যাক থেকে খাবার বের করে সামনে রাখলো।আয়োজন খুবই সামান্য।ভাত,আলু ভর্তা,বেগুন ভর্তা আর একটা ডিম ভাজি।শফিকের প্লেটে ভাত দিয়ে নিজের প্লেটেও ভাত নিল অহি।ভাতে নাড়াচাড়া করে মুখে দেয়ার আগে উঠে দাঁড়ালো।শফিক এক লোকমা ভাত শেষ করে বলল,
—“উঠে দাঁড়ালি কেন?খাবি না?”
—“মাকে ডেকে নিয়ে আসি।দেখি আসে কি না!”
অহি ভেতর ঘরে ঢুকে দরজায় ধাক্কা দিল।দরজা এখনো ভেতর থেকে বন্ধ।সে মৃদু স্বরে বলল,
—“মা,এসো! ভাত খেয়ে নাও!”
ভেতর থেকে কেউ উত্তর দিল না।সে দরজায় বার কয়েক টোকা দিয়ে মা মা বলে ডাকলো।কয়েক মিনিট পর চাপা সুরে ভেতর থেকে কেউ বলল,
—“মাথা ধরেছে আমার।ঘুমাব আমি!”
অহি সরে আসলো।ছোটবেলা থেকে তার প্রতি মায়ের এই অবহেলা, নির্লীপ্ততা দেখে দেখে এখন সয়ে এসেছে।আর কষ্ট হয় না তার!ফের শফিকের পাশে বসে কয়েক লোকমা ভাত পানি দিয়ে গিলে ফেলল।
রাত বারোটা প্রায়।অহি লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়লো।কেমন শীত শীত লাগছে তার।জ্বর আসবে নাকি?আজ অনেক দেরিতে গোসল করা হয়েছে।মাথার চুল এখনো চুকায়নি।অন্ধকারেই মাথার চুলগুলো বালিশে মেলে দিল সে।পায়ের নিচ থেকে পুরনো আধছেঁড়া কাঁথাটা টেনে গলা পর্যন্ত দিল।পা ভাঁজ করে চোখ বন্ধ করলো।
অহির চোখের পাতা ভারী হতেই আবার ফোন বেজে উঠে।বিরক্ত চোখে মুখে বালিশের চিপা থেকে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো রোদ্দুর।সে রিসিভ করে সালাম দিল।ওপাশ থেকে রোদ্দুর বলল,
—“খেয়েছো তো?”
অহি আস্তে করে বলল,
—“হুঁ!”
—“খাওয়ার পর আমায় ইনফর্ম করতে বলেছিলাম।মনে নেই?”
—“না, নেই!মাত্র মনে পড়লো।আমার কিছুই মনে থাকে না।প্রয়োজনীয় কিছুও মনে থাকে না।”
—“আমি প্রয়োজনীয় নাকি অপ্রয়োজনীয়?”
অহি উত্তর দিল না।বন্ধ চোখে বিড়বিড় করে বলল,
—“আমি আজ একটু শান্তিতে ঘুমাব।বহু রাত হলো ঘুমাতে পারি না।আমার বাবা সুস্থ মতো ফিরবে যে!আজ আমি ঘুমাব!”
ফোনের ওপাশ থেকে রোদ্দুর বলল,
—“কি বলছো অজান্তা?বুঝি না তো?তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?”
উত্তর আসলো না।রোদ্দুর চিন্তিত হয়ে বেলকনিতে আসলো।কান থেকে ফোন হাতে দিয়ে এদিক ওদিক করে হ্যালো হ্যালো করলো।পরমুহূর্তে কানে নিতেই অহির ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ কানে আসলো।ঘুমিয়ে পড়েছে?কথা বলতে বলতে?রোদ্দুরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।সে আলতো স্বরে দু বার বলল, “পাগলী”!
৪.
ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে অফিসে ঢুকলো রোদ্দুর।আজ সে তৃতীয় বারের মতো পাবলিক বাসে এসেছে।বহু মানুষের গায়ে গা লাগিয়ে ভিড় ঠেলে আসতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি!আজ কালের মধ্যে একটা মোটরসাইকেল কিনে ফেলবে সে।
নিজের আসনে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো রোদ্দুর।ক্লান্তিভাব একটু কমতেই বিদ্যুৎ কে ডাকলো।কনস্টেবল বিদ্যুৎ দরজায় কড়া নেড়ে ভেতরে ঢুকলো।
—” বিদ্যুৎ! ”
—“জ্বি স্যার!”
—“আসামি নং ৩০৪ মোঃ জলিল মোল্লার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করো।ওনাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার আছে।”
—“অকে স্যার!”
বিদ্যুৎ সালাম দিয়ে চলে যেতে রোদ্দুর টেবিলে রাখা ডকুমেন্টস গুলোতে নজর বুলানো শুরু করলো।ডেট ঠিক হয়ে গেছে।পরশুদিন জলিল মোল্লাকে কোর্টে হাজির করা হবে।সব এভিডেন্স গুছিয়ে রাখতে হবে।একটা নির্দোষ মানুষকে কিছুতেই শাস্তি পেতে দেয়া যাবে না।
আধঘন্টা পর রোদ্দুর জলিল মোল্লার সাথে দেখা করলো।জলিল বসে আছে বিশাল বড় এক হলরুমে।জানালাবিহীন হলরুম।চারপাশ খাঁ খাঁ!এর মধ্যে একটা চেয়ারে তিনি মাথা নিচু করে বসে আছেন।তার সামনে আরেকটা চেয়ার।রোদ্দুর গিয়ে সামনের খালি চেয়ারটাতে বসলো।
গভীর মনোযোগ দিয়ে সে জলিলকে দেখলো।জলিলের বয়স পঞ্চাশের বেশি হবে হয়তো।চুলে পাঁক ধরেছে।চোয়াল ভাঙা।কাঠখোট্টা টাইপের।দেখেই বোঝা যায় সংসারের ভাড়ে তিনি নুইয়ে পড়েছেন।সংসার নামক যুদ্ধক্ষেত্র পরিচালনা করতে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন।
রোদ্দুর বিনীন স্বরে বলল,
—“জলিল সাহেব!”
জলিল মুখ তুলে তাকালেন।পরমুহূর্তে চোখ সরিয়ে মাথা নেড়ে বললেন,
—“জ্বি!”
—“পরশুদিন আপনাকে কোর্টে হাজিরা দিতে হবে।আপনার আমাকে কিছু বলার আছে?আমি মোটামুটি জানতে পেরেছি।আপনার জবানবন্দি শুনতে চাচ্ছি।আমায় ভয় পাবেন না।নির্দ্বিধায় সব বলুন।আপনার মেয়ে অহির সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে।”
জলিল উসখুস করে এদিক ওদিক তাকাল।চারপাশ মনুষ্য শূন্য দেখে যথাসম্ভব গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল,
—“আপনাকে কিছু সত্যি কথা বলি পুলিশ সাব।কিন্তু দয়া করে এগুলো কোর্টে বহু মানুষের সামনে বলবেন না।”
রোদ্দুর জলিলের কথায় মাথা নেড়ে আশ্যস্ত করলো।কাউকে বলবে না সে।জলিল অতঃপর নিঁখুত ভাষায় বলল,
—“আম রূপসা ব্যাংকে পিয়নের চাকরি করি বহু বছর হলো।সেই থেকে জানতে পারি ব্যাংকের বসের স্বভাব চরিত্র ভালো নয়।রূপসা ব্যাংকের মালিক খালেকুজ্জামান প্রায় প্রতিদিন অফিসে আসতেন।এসি করা রুমে বসতেন।অফিসের মেয়ে কর্মচারীরা দীর্ঘ সময় নিয়ে তার রুমে অবস্থান করতো।এসব আমি দেখেও না দেখার ভান করতাম।আমার মেয়ে অহিকে আমি কোনোদিন অফিসের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেইনি।মাঝে মধ্যে না খেয়ে অফিসে গেলে আমার ছেলে শফিক দুপুরে খাবার নিয়ে যেত।কিন্তু বসের বদ নজর যেন আমার মেয়ের উপর না পড়ে সেজন্য অহিকে কঠোর নিষেধ করেছিলাম যেন আমার অফিসে না যায়।
কিন্তু আজ থেকে কয়েক মাস আগে একদিন একটা জরুরি প্রয়োজনে অহি আমার অফিস যায়।ও বাইরের চেয়ারে বসে আমার জন্য অপেক্ষা শুরু করে।আমি জানতাম না ও অফিসে এসেছে।হুট করে এদিক এসে দেখি অহি চেয়ারে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে।আর আমাদের বস তার সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করছে।দেখে আমার গা রি রি করে উঠলো।দ্রুত এগিয়ে গিয়ে যথাসম্ভব বিনয়ের সাথে বসের থেকে অহিকে সরিয়ে শাসন করলাম কেন অফিসে এসেছে!
এর ঠিক দুদিন পরেই বসের কেবিনে আমার ডাক পড়ে।খালেকুজ্জামান নামক পশুটা আমাকে জগতের সবচেয়ে কুৎসিত প্রস্তাব করে।তাও আমার মেয়ের ব্যাপারে!সে কয়েক রাতের জন্য আমার মেয়েকে চায়।বিনিময়ে প্রচুর টাকা দিবে।রাগে আমার শরীর থরথর করে কাঁপে।ঘৃণা ভরে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি।তিনি চুপচাপ থাকেন।আমার ক্ষমতা থাকলে জানোয়ারটাকে ওখানেই পুঁতে ফেললাম।তার কিছুদিন পরেই আমার মেয়ের বিয়েতে অঘটন ঘটে।আমি অবাক হইনি।আমি জানতাম এসব ওই বদ পশুটার কাজ!”
রোদ্দুরের চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেছে।হাত মুঠ করে নিজেকে থামানোর চেষ্টা করে।ইচ্ছে হয় এক্ষুনি গিয়ে খালেকুজ্জামান পশুটার টুঁটি চেপে ধরে!গলা থেকে মাথা আলাদা করে ফেলে।
জলিল নরম গলায় বলে,
—“আমার এই মেয়েটা বড্ড অদ্ভুত।সারাজীবন সবার অবহেলা পেয়ে এসেছে।অনেক দুঃখ কষ্ট পেয়েছে।কিন্তু কখনো সবার সামনে টুঁ শব্দটি করেনি।কেমন নির্বিকার থাকে সবসময়।কিন্তু ভেতরে ভেতরে গুমড়ে মরে।ওর জীবনটাই একটা কালো অধ্যায়।অনেক চিন্তা হয় মেয়েটাকে নিয়ে।”
রোদ্দুরের বুকের ভেতর পুড়ে ছারখার হয়ে যায়।হৃদপিণ্ডে রক্তক্ষরণ হয়।কোথায় যেন বিরহী সুর বেজে যাচ্ছে।সেই সুরে একবুক কষ্ট চাপা পড়ছে।সে নিজেকে সামলে জলিলের থেকে উঠে দাঁড়ায়।তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে রুম থেকে বের হয়ে যায়।
৫.
অহি ঢাকার ব্যস্ততম সড়কে হাঁটছে।কাঁধে পুরনো একটা ব্যাগ ঝুলানো।পায়ে অল্প দামের একটা স্লিপার।মনে হচ্ছে যখন তখন ফিতে ছিঁড়ে যাবে।গায়ের অল্প দামের সুতির থ্রি পিসের ওড়নাটা বাতাসে এলোমেলো উড়ে চলেছে।কাঁধের কাছে সেফটিপিন দিয়ে আটকানো বলে মুক্ত হতে পারছে না।
সে ও কোনো না কোনোভাবে পরিবারের সাথে গিঁটযুক্ত হয়ে আছে।সে চাইলেই মুক্তি পাচ্ছে না।কিন্তু তারও মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে যেতে ইচ্ছে করে দূর থেকে বহুদূরে।আর ভালো লাগে না সংসারজীবন।সর্বত্র কেমন টানাপোড়েন!এভাবে কতদিন চলে?দুদিন,তিনদিন না হয় একবছর!কিন্তু সে এগুলো বয়ে বেড়াচ্ছে বছরের পর বছর ধরে।
তার বাবা জলিল মোল্লা নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছে।তিনদিন হলো স্বসম্মানে মুক্তিও পেয়েছে।অহির বাবার কোর্টের শেষ শুনানির দিন সে যায় নি।কেন যায়নি জানে না!শুধু এটুকু সিউর ছিল যে তার বাবা রোজকার মতো ফিরবে।অনেকদিন পর সে সেদিন নিজ হাতে রান্না করেছে বাবার প্রিয় সব খাবার।তার শেষ রাতের স্বপ্নকে সত্যি করে সত্যি সত্যি তার বাবা শফিকের হাত ধরে বাড়ি ফিরলো।
কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলালো অহি।পায়ের নিচে তাকাতে বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।পায়ের স্লিপারের ফিতে ছিঁড়ে গেছে।আধ ছোলা নারকেলের খুলির সাথে লেগেছিল।সে চোখ তুলে ডানে বায়ে তাকাল।রাস্তার অপর পাশে ভ্যানে করে মধ্যবয়স্ক একজন ডাব বিক্রি করছে।
ছেঁড়া জুতো পড়েই অহি হাঁটা শুরু করলো। কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারলো না।হাঁটা যাচ্ছে না।অগত্যা কোনো উপায় না দেখে জুঁতো জোড়া খুলে ব্যাগের এক কোণায় ফেলে রাখলো।বাড়িতে গিয়ে সেলাই করা যাবে।
খালি পায়ে হাঁটতে বেশ লাগছে।মাঝে মাঝে দু একজন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে।ব্যাগ কাঁধে খালি পায়ে হাঁটা মানুষের সংখ্যা ঢাকা শহরে নিতান্ত কম নয়।তবুও তারা কৌতূহল দমাতে পারছে না।
ভুম শব্দ করে, একগুচ্ছ ধুলো উড়িয়ে একটা বাইক এসে থামলো অহির গা ঘেঁষে।ভয় পেয়ে দু পা পিছিয়ে গেল সে।এখনই তো বাইকের নিচে পড়ে পিষে যেত।তারপর কালকের পত্রিকার হেডলাইন হতো সে!বুকের জামা উঁচু করে একটু থুথু ছিটিয়ে বিরক্ত চোখে সামনে তাকালো।সঙ্গে সঙ্গে কলিজা শুকিয়ে গেল তার!
বাইকে রোদ্দুর স্যার বসে আছে।মাথা থেকে হেলমেট খুলে হাতে ধরে আছে।হেলমেট পড়ার কারণে মাথার চুল এলোমেলো ভাবে কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।কুঞ্চিত ভ্রু যুগল, রহস্যময় স্বচ্ছ চোখ, খাড়া নাক,ছিপছিপে ঠোঁট, সাথে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি নিয়ে কি অনিন্দ্য সুন্দর মুখোশ্রী!অহি চোখ সরিয়ে নিল।
রোদ্দুর অহির দিকে চেয়ে বিরক্তি ঝরা কন্ঠে বলল,
—“তোমাকে সহজ সরল মনে করেছিলাম অজান্তা!কিন্তু তোমার মাথায় যে এত ফিঁচলে বুদ্ধি তা তো জানা ছিল না।তোমার এইসব বুদ্ধি দিয়ে বেশি সুবিধা করতে পারবে না।কতদিন আমার থেকে পালিয়ে বেড়াবে?ঠিকই তোমাকে খুঁজে বের করলাম এবং বার বার করবো।”
এটা সত্যি যে অহি মানুষটার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।তার বাবা মুক্তি পাওয়ার পর আর যোগাযোগ করেনি মানুষটার সাথে।ফোন পর্যন্ত উঠায়নি!
সে সকালের দিকে গাবতলি এসেছিল একটা চাকরির খোঁজে।সেলসম্যান হিসেবে।তার বাবার চাকরি নেই।নতুন কাজ খুঁজছে সে।এই বয়সে এসে কেউ নিতে চাচ্ছে না।সংসারে নানা অভাব অনটন দেখা দিয়েছে।তাছাড়া শফিকের ইউনিভার্সিটিতে সেমিস্টার ফি জমা দিতে হবে।মোটা অঙ্কের টাকা!সময় হাতে একদম কম।সেজন্য সে একটা চাকরির খোঁজ করছে।তার স্কুলজীবনের পরিচিত একটা মেয়ে চাকরি খুঁজছে তার জন্য!আগামীকাল আবার শাহবাগের একটা অফিসে দেখা করবে।
সে আলগোছে বলল,
—“আপনি এদিকে কি করছিলেন স্যার?”
—“রোদ্দুর!রোদ্দুর হিম আমার নাম।স্যার স্যার করবে না।”
অহি কিছু বলল না।সে তাকিয়ে আছে রাস্তার উত্তর দিকে।সাত-আট বছর বয়সের বাচ্চা একটা মেয়ে ফুল বিক্রি করছে।তার ঝুড়িতে রাখা ভালোবাসার গোলাপ গুলো নেতিয়ে পড়েছে।পাপড়িগুলো শুকিয়ে গেছে।এখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়!ভালোবাসাও কি এভাবে দিনশেষে শুকিয়ে যায়?
রোদ্দুর বাইকের পেছন থেকে হেলমেটটা অহির হাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
—“কতক্ষণ ধরে এভাবে হাঁটছো?তোমাকে কেমন ক্লান্ত লাগছে।বাইকে উঠো।আমি নামিয়ে দিবো!”
—“না, না!লাগবে না।আমি বাসে উঠবো এখন।”
—“বাসে উঠতে হবে না।চুপচাপ পেছনে বসো।”
—“আমার মোটরসাইকেলে চড়তে ভয় লাগে।”
অহির ভয়ার্ত ফেস দেখে রোদ্দুরের হাসি পেল।অবিশ্রান্ত মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম,লম্বা বেণী থেকে কিছু চুল বের হয়ে এদিক ওদিক উড়ছে।একজোড়া ভীত চোখে যেন জগতের সব মায়া এসে স্তূপ জমিয়েছে।রোদ্দুর ঢোক গিলল।এই মেয়ে নিশ্চিত তাকে জাদু করেছে।কোনোরকমে বলল,
—“চুপচাপ উঠে পড়ো।যত দেরি করবে তত তোমারি ক্ষতি!ভালোয় ভালোয় উঠে পরো।”
—“আমার সাথে কোনোদিন ভালো কিছু হয়নি।সব ধরনের ক্ষতি সহ্য করার ক্ষমতা আছে আমার।”
রোদ্দুর মনে মনে বলল,
—“এখন থেকে তোমার সাথে সব ভালো হবে মিসেস রোদ্দুর হিম অজান্তা!তোমার এসআই আর কোনো ক্ষতি হতে দিবে না।”
মুখে বলল,
—“সেটাই!তুমি তো ভালো কথা শোনার মেয়েও না!আমি তো ভুলেই গেছিলাম। ”
বলেই রোদ্দুর অহির হাত টেনে নিজের কাছে আনলো।অহি চমকে তার মুখপানে তাকায়।এই প্রথম কোনো পুরুষের স্পর্শে তার মন নেড়ে উঠলো।বুকের গহীন সমুদ্রে উথাল পাথাল ঢেউ বয়ে গেল।কিন্তু মানুষটা কেমন নির্বিকার।সে হাত ছাড়িয়ে নিল।
রোদ্দুর দাঁতে দাঁত চেপে অহির মাথায় হেলমেট পড়িয়ে দিল।তার হার্টবিট সাইক্লোনের গতিতে বেড়ে চলেছে।কান ঝাঁ করছে।এই মেয়েটার সামান্য একটু হাতের স্পর্শে তার লজ্জা আর সুখে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
অহি বাঁধা দিতে দিতে ততক্ষণে হেলমেট পরানো শেষ!তারপর সে টেনেও হেলমেট খুলতে পারলো না।রোদ্দুর মুচকি হেসে অহিকে ঠেলে বাইকের পেছনে উঠালো।
রোদ্দুর নিজের মাথায় হেলমেট বেঁধে বলল,
—“শক্ত হয়ে বসো অজান্তা!পড়ে যাবে না কিন্তু।”
এই মানুষটার মুখে অজান্তা ডাক শুনে হৃদয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয় অহির।কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হয় ভেতর জুড়ে।এত মমতা নিয়ে এর আগে কেউ তাকে অজান্তা বলে ডাকেনি!
রোদ্দুর গাড়ি স্টার্ট দিতেই অহি তার শার্ট খামচে ধরলো।
(চলবে)
গতকাল আমাদের এদিকে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে।বিদ্যুৎ ছিল না।সাথে ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছিল।সেজন্য বোনাস পার্ট দিতে পারিনি।😒 আজ ইনশাআল্লাহ পাবেন।🥰