গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব-১৪

0
1867

#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_চৌদ্দ

পেছন থেকে কেউ মাথার মধ্যে আচমকা কিছু দিয়ে আ’ঘা’ত করতেই মাটি’তে লুটিয়ে পড়লো ফাইজা। নিচে পড়ে যাওয়ার আগে অব্দি দেখলো ফারদিনের চোখ দুটো বন্ধ। কিন্তু এইতো খোলা ছিলো চোখ দুটো তাহলে এখন বন্ধ কেনো? আর ভাবতে পারলো না চোখের সামনের সব কিছু ঝাপসা হয়ে এলো। আপনা-আপনি চোখ বন্ধ হয়ে এলো। তার পর আর কিছু মনে নেই। ফারদিনের র’ক্তা’ক্ত চেহারা’টা ভেসে উঠতে’ই ধড়ফড়িয়ে লাফিয়ে উঠে বসলো ফাইজা। তৎক্ষনাৎ মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করতেই দুই হাতে মাথা চে’পে ধরে আস্তে আস্তে চারদিকে চোখ বুলালো। ওর সামনেই নাদিয়া বেগম আর সায়মা দাড়িয়ে চিন্তিত ভঙ্গী’তে। কিন্তু ও তো ফারদিনের কেবিনে ছিলো তাহলে এখানে এলো কি করে? মাথা ব্যাথায় চোখ বুঝে আসচ্ছে। ফাইজা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ব্যাথা সহ্য করার চেষ্টা করে বলে উঠলো…

–আমি এখানে কি করে এলাম? আর আর উনার জ্ঞান ফিরে এসেছে জানো মা…

বলেই মুখে হাসির রেখা টানলো। ফাইজার কথা শুনে সায়মা খানম নিজের কান্না লুকাতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। আর নাদিয়া বেগম মুখে আঁচল গুঁজে কান্না নিবারনের চেষ্টা করলো। উনাদের অবস্থা দেখে ফাইজার মুখের চিলতে হাসি’টা বেশিক্ষন রইলো না। মুখে কালো মেঘ এসে ভর করলো। ফাইজা চিন্তিত স্বরে আবার বললো…..

–কাঁদছো কেনো? আর দীদা ওইভাবে চলে গেলো কেনো মা?

ফাইজার মা মেয়ের প্রশ্নের উওর খুঁজে পাচ্ছেনা। কি জবাব দিবে? মেয়ে’টা এত বড় একটা ধাক্কা সামলাতে পারবে তো? ভাবতে ভাবতেই রুমে প্রবেশ করলো নিরব। নিরব কে দেখেই ফাইজা হেসে বলে উঠলো…….

–ভাইয়া উনাকে কবে বাড়ি নিয়ে যেতে পারব? আর আমার হঠাৎ কি হলো জানিনা। মনে হলো কেউ পেছন থেকে কিছু দিয়ে আঘাত করেছে। এখনো ব্যাথা রয়েছে। হয়তো আমি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম বেশি খুশিতে।

বলেই শব্দ করে হেসে উঠলো। নিরব গম্ভীর কন্ঠে বললো….

–ফারদিন কোমায় চলে গেছে ফাইজা।

ফাইজার মনে হলো ওর মাথায় সম্পুর্ন আকাশ’টা ভেঙে পড়লো। মুখের হাসি’টা ইতোমধ্যে থেমে গেছে। মাথা’টা ভনভন করে ঘুরতে লাগলো। বিস্ফোরিত চোখে নিরবের দিকে তাঁকালো। লাগিয়ে বেড থেকে নেমে নিরবের সামনাসামনি দাড়িয়ে নিরবের দিকে শান্ত চাহনী দিয়ে বললো…..

–ভয় দেখাচ্ছেন তাইনা ভাইয়া। আমি জানি উনার জ্ঞান ফিরেছে। উনি আমার সাথে কথা ও বলেছে। এখন আপনি বললেই আমি বিশ্বাস করব না…..

বলেই মুচকি হাসলো। নিরবের কন্ঠস্বর বাধা পেয়ে শব্দ বের হচ্ছেনা। নিরব কয়েক’বার ঢোঁক গিলে ফাইজার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে উঠলো……

–তুমি কল্পনা করেছিলে তখন যে ফারদিনের জ্ঞান ফিরেছে ও কথা বলেছে?

বলেই একটু থামলো। ফাইজা পূর্বের মতোই শান্ত হয়ে তাঁকিয়ে আছে। নিরব পূর্নরায় বলে উঠলো….

–বোন জীবনের অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায়। হঠাৎ, ঝড় এসে সব লন্ডভন্ড করে দেয়। ঝড় থেমে যাওয়ার পর কিন্তু আবার পরিবেশ আগের রুপ ধারন করে। কিছু সত্যি মেনে নেওয়ার ক্ষমতা না থাকলেও মেনে নিতে হয়। তেমনি তোমাকেও এই সত্যি’টা মেনে নিতে হবে। ফারদিন সত্যি’ই কোমায় চলে গিয়েছে। কবে, কখন, কতদিনে? ওর জ্ঞান ফিরবে আমরা কেউ জানিনা…….

নিরবের কথা শুনে ফাইজা কয়েক-পা পিছিয়ে গেলো। মাথার যন্ত্রনায় মনে হচ্ছে মাথা ফেটে যাবে। পিছিয়ে যেতে যেতে নিরবের দিকে তাঁকিয়ে ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে নিলো। তারপর ধপ করে বেডে বসে বসলো। ওর কাঁদছে না। কোনো রিয়েক্ট করছেনা। নাদিয়া বেগম মেয়ে’কে জড়িয়ে নিলো দুই হাতে। তাও ফাইজা কাঁদছে না। কি ব্যাপার? ওর তো গলা ফাটিয়ে কান্না করা উচিত তাহলে ও কাঁদছে না কেনো। ফাইজা ওর মা’কে শক্ত করে ধরে বিড়বিড় করতে লাগলো। মেয়ে’টার অবস্থা দেখে নিরবের নিজেকে অপরাধী লাগছে? আবার রাগ ও উঠছে? কিন্তু ওরা তো নিরুপায়? কিছু করার নেই এই মুহুর্তে। তাই ফাইজার রুম ত্যাগ করলো।
____________________________________________
হসপিটালের ঢুকতে’ই কোনো পুরুষের শক্ত দেহের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে গেলো আরজা। কোমড়ে যথেষ্ট ব্যাথা পেয়েছে। কোমড়ে হাত দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো…..

–আহাম্মক নাকি আপনি দেখে চলতে পারেন না। মেয়ে দেখলেই শুধু ধাক্কা খেতে ইচ্ছে করে। এক থা’প্প’ড়ে নোংরামি বের করে দিব। যত্তসব ফা’ল’তু লোক…….

বলেই উপরে তাঁকাতেই ওর মুখ’টা থেমে গেলো। অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তি’টিকে দেখে কোমড়ে ব্যাথা নিয়েও লাফিয়ে উঠলো। জেহের ভ্রু কুচকে আরজার দিকে তাঁকিয়ে আছে। আরজা জেহের কে দেখেই মাথা চুল’কাতে লাগলো। না দেখেই একটা মেয়ে এমন ভাবে বকবক করতে পারে তা জেহের অজানা ছিলো। জেহের রাগী চাহনী নিক্ষেপ করে বললো…..

–তুমি বা’চা’ল জানতাম কিন্তু এত’টা বাঁচাল তা জানা ছিলো না……

আরজা অসহায় ফেস করে মাথা চুলকা’তে চুলকা’তে মিনমিনিয়ে বলে উঠলো…..

–সরি জেহের ভাইয়া আমি দেখিনি। ক্ষমা করবেন।

জেহের আর কথা না বাড়িয়ে সামনে পা বাড়ালো। বোনের বিপদের কথা শুনে আর বসে থাকতে পারলো না তাই চলে এসেছে আজ৷ আর আরজা ও আজ ফাইদিন’কে দেখার জন্য এসেছিলো। তখনি ঢুকতে গিয়ে দুজন বেখায়ালি ভাবে ধাক্কা লেগে যায়। জেহের পেছন পেছন আরজা ও এগিয়ে গেলো। অন্য সময় হলে দুজন জমিয়ে ঝগড়া করতো। কিন্তু আজ ওদের কারোর মনের অবস্থা ঠিক নেই তাই দুজনেই থেমে গেলো অল্প কথায়।
____________________________________________

–তোমাকে কতবার বলেছি হসপিটালের মধ্যে কিছু করতে যেও না ফেসে যাবে। শুনলে না আমার কথা। ওই নিরব প্রচন্ড চালাক সব বের করে ফেলবে অনায়াসে।

রেজওয়ানের কথা শুনে কাকন গুনগুনিয়ে গাইতে গাইতে গাইতে বললো….

–আহ রেজওয়ান এখন আমাদের পথের কাটা শেষ। এখন আর আমাদের কোনো ভয় নেই৷ তোমার ছেলে চিরদিনের জন্য কো’মায় চলে গিয়েছে…..

বলেই বিদ্রুপ করে হাসলো। রেজওয়ান বিরক্তি’তে “চ” সূচক শব্দ করলো। পরে বলে উঠলো…..

–এইসব আমি শুনতে চাইনি। যে ছেলে আমাকে বাবা বলে মানে না। সে ম-রলো কি বাঁচলো তাতে আমার কিছু আসে যায়না। তুমি হসপিটালের মধ্যে আট্যাক করে ঠিক কাজ করো’নি…..

রেজওয়ানের কথায় কাকন পাত্তা না দিয়ে গাড়ির চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে রুমের বাইরে চলে গেলো। আর রেজওয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মুখে যাই বলুক কিন্তু ফারদিনের এই অবস্থা হোক তাও সে চায়’নি।

____________________________________________
সময় প্রবাহ মান। কথায় আছে সময় এবং স্রোত কারোর জন্য অপেক্ষা করেনা। তেমনি সেদিনের পর আজ কেটে গেছে সাত দিন। অতি শোকে পাথরে পরিনত হয়েছে ফাইজা। সেদিনের পর হাজার’টা প্রশ্ন করলেও উওর পাওয়া যায়না ওর থেকে। সব সময় স্থির দৃষ্টি’তে তাঁকিয়ে থাকে সামনের দিকে। মনে হয় রাজ্যের ভাবনায় ডুবে আছে ও। চোখ মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। চেহারার মধ্যে কিছুদিন আগের চঞ্চল ভাব’টা নেই।ফারদিন সত্যি’ই কোমায় চলে গিয়েছে এই সত্য’টা ও কিছু’তেই মেনে নিতে পারে’নি। সেদিনের পর প্রতিদিন নিয়ম করে তিন বেলা ফারদিনের সাথে দেখা করতে হসপিটালে যায়। আবার নিজে নিজেই কথা বলে। হাজার প্রশ্ন করে কিন্তু ফারদিন তো কোনো প্রশ্নের উওর দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। ফাইজার কেনো যেনো মনে হয় ফারদিন ওর সব কথা শুনে তাও চুপ করে থাকে? ওর এটাও মনে হয় সেদিন সত্যি’ই ফারদিনের জ্ঞান ফিরেছিলো ও স্বপ্ন দেখে’নি। কিন্তু এই কথা’টা কাউকে বিশ্বাস করাতে পারিনি। এইসব ভাবতে ভাবতেই প্রতিদিনের মতো আজ ও রাত করে হসপিটালের থেকে বাড়ি ফিরলো জেহেরে’র সাথে। নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে ক্লান্ত বিষাদে ভরপুর নিস্তেজ দেহ’টা হেলিয়ে দিলো বিছানায়। কখন চোখ লেগে গেছে নিজেও জানেনা। নির্ঘুম রাত কা’টাতে কা’টাতে চোখের নিচে গাঢ় ও কালির দাগ পড়ে গেছে। ঘুমের মধ্যে’ই কেনো যেনো ওর মনে হলো কেউ ও’কে জড়িয়ে ধরে আছে? কিন্তু কে? কারোর গরম নিশ্বাস পড়ছে ওর মুখে,ঘাড়ে। ঘুম ভেঙে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো ফাইজা। রুমের ড্রিম লাইট জ্বালানো ছিলো। ড্রিম লাইটের আলোয় সামনের ব্যাক্তি’টিকে দেখে ফাইজার অন্তরঙ্গ কেঁপে উঠলো। এটা কি করে সম্ভব?

#চলবে

[ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। আজকের পর্ব পড়ে কার কি মনে হলো বলেন তো]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here