গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব-১৯

0
1190

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ চার

রাতের রাস্তা সোডিয়ামের আলোয় আলোকিত। হলুদ বর্ণা লাইট গুলো দারুণ রঙ সৃষ্টি করে আঁধার রাতে। ভিজে রাস্তায় মাটি থেকে এক নে’শা’লো ঘ্রাণ বের হচ্ছে। মাটি ভিজলে এক নিদারুণ সুগন্ধি ছড়ায়। একটু আগের ঝড়ের কারণে রাস্তায় হাজার খানেক পাতা ও ফুলের ছড়াছড়ি। সেই ভিজে ফুল পাতা ডিঙিয়ে একা রাস্তায় চলছে এক মানবী। যার ঠাঁই মেলে নি শ্বশুর বাড়িতে। যার প্রেমিকের বক্ষ মাঝে অন্য নারীর ঠিকানা। দর্শিনী গত এক ঘন্টা যাবত ধীর গতিতে হেঁটে বড় রাস্তায় উঠেছে। শরীরে জড়ানো সাদা শাড়ি। হাতে, গলায়,কপালে কোনো বিবাহিত চিহ্ন নেই। ঐ বাড়ি ত্যাগ করার সাথে সাথে ত্যাগ করেছে নিজের বৈবাহিক ঠিকানা। এখন সে একদম একা। এই নিস্তব্ধ রাস্তার মতন একা। যার কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই কিন্তু চলতে হবে আজীবন। গান ধরলো মানবী। গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলো,

“চল রাস্তায় সাজি ট্রামলাইন
আর কবিতায় শুয়ে কাপ্লেট
আহা উত্তাপ কত সুন্দর
তুই থার্মোমিটারে মাপলে
হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল
মিঠে কুয়াশায় ভেজা আস্তিন
আমি ভুলে যাই কাকে চাইতাম,
আর তুই কাকে ভালোবাসতিস…”

ক্লান্ত হলো মানবী। ফুটপাতের কিনারার বসে পড়লো। একটু বিশ্রাম দরকার। খিদেও লেগেছে। হঠাৎ তার নজর গেলো বা হাতের ছোট্ট সাদা ব্যাগটার দিকে। ব্যাগটার দিকে তাকাতেই ছ্যাঁত করে উঠে বক্ষ পিঞ্জিরা। মানুষটার আকুতি মিনতি মনে পড়ে। এই একটা মানুষ, যে দর্শিনীকে বিনা শর্তে,বিনা স্বার্থে ভালোবেসেছিল। বিদায় বেলাও মানুষটা অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলো। বাবা ডাকের মর্যাদা দিয়েছে মানুষটা। হ্যাঁ, দর্শিনী যখন বের হতে নেয় তখন তার শ্বশুরই পথ আগলে দাঁড়ায়। দর্শিনীর মনে পড়ে একটু আগের ঘটনা,

দর্শিনী ঘর থেকে কেবল বের হবে সে মুহূর্তে তার শ্বশুর পিছু ডাকে,
“চলে যাচ্ছো? থেকে গেলে হয় না?”

দর্শিনীর পা থেমে যায়। এই আকুতি মাখা কণ্ঠের বিপরীতে বলে উঠে,
“থাকতে তো চেয়েছিলাম আজীবন। আমায় কেউ রাখে নি। যার যতটুকু সময় প্রয়োজন ঠিক ততটুকু সময় আমি থেকে যাই। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে আমিও ফিরে যাই।”

দর্শিনীর বৃদ্ধ শ্বশুর কাঁপা কাঁপা পা নিয়ে এগিয়ে এলো। চোখে তার অশ্রুকণা। দর্শিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“তবে চলে যাও। মনে রেখো তোমার আরেক বাবা সবসময় তোমাকে নিরবে আশীর্বাদ করে যাবে। তোমার বাবা যে অক্ষম। তার জাঁকজমক ভাবে কিছু করার ক্ষমতা নেই। সে কেবল গোপনে তোমায় ভালোবাসবে।”

দর্শিনী শ্বশুরের পা ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। শেষ বিদায়ের বেলা ভদ্রলোক সাদা ছোট্ট থলেটা এগিয়ে দিয়ে বলেছিলো,
“এটা রাখো, বৌমা। পথিমধ্যে প্রয়োজন পড়বে।”,

এরপর আর দর্শিনী পিছু ফিরে চায় নি। এগিয়ে গিয়েছে নিজের গন্তব্যের দিকে। একবার পিছু ফিরে তাকালে সে দেখতো এক অসহায় বাবার আর্তনাদ। আর দু’তলা বিল্ডিং এ কারো গোপন ছায়া। যে গোপনে বিদায়ের সাক্ষী হয়েছিল।

ট্রাকের হর্ণের তীব্র শব্দে ধ্যান ভাঙে দর্শিনীর। সাঁইসাঁই করে একটা ট্রাক ছুটে গেল বড় রাস্তা দিয়ে। দর্শিনী ছোট্ট শ্বাস ফেললো। আগে এমন ট্রাক দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে হতো ট্রাকের নিচে। এখন আর সে ইচ্ছে হয় না। এখন বরং সব কিছু থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়।

রাত বাড়ার সাথে সাথে দর্শিনীর খিদের দাপট বাড়লো। কিন্তু সাথে কোনো খাবার নেই। মনকে অন্য দিকে ঘোরানোর জন্য শ্বশুরের দেওয়া ব্যাগটা খুললো। ব্যাগ খুলে সে অবাক,হতবাক। ব্যাগের মাঝে পুটলি বাঁধা কত গুলো তিলের নাড়ু,দুধের সন্দেশ। ছোট্ট বোতলে করে জল ভরা। দর্শিনী অবাক হয়ে যেনো আকাশ থেকে পড়লো। বাবা তবে আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিলো দর্শিনীর বিদায়ের কথা! দর্শিনীর চোখ ভরে এলো নোনাজলে। মানুষটা শেষ বেলাতেও কতটা নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে গেলো!

নিজের চোখ মুছে খাবার গুলো জাপ্টে ধরলো বুকে। এটাকেই বুঝি বাবা বলে? এ জন্যই পৃথিবীতে বাবাদের স্থান উপরে। কি সুন্দর নিজের ছেলের বউয়ের পছন্দের জিনিস গুলো গুছিয়ে দিয়েছে! দর্শিনী খাবার গুলো খুব যতনে খেলো। এমন তৃপ্তি তাকে কোনো খাবারই যেনো এ জীবনে দিতে পারে নি।

আবার উঠে দাঁড়ালো দর্শিনী, নতুন উদ্যমে। চলতে হবে তাকে অনেকটা পথ। রাত বাড়ছে। সাথে কনকনে হিমশীতল বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে। দর্শিনী পা বাড়ালো রেলস্টেশনের দিকে। বাড়ি ফিরতে হবে তাকে। আপাতত বাবা মায়ের আশ্রয়স্থলে ঠাঁই নিতে হবে। বেঁচে তো থাকতে হবে। বেঁচে থাকার জন্য নাহয় একটু কথা শুনবে।

ঢাকা থেকে সিলেটগামী ট্রেনে চড়ে বসলো দর্শিনী। ভোর হতে হতে সে সিলেট পৌঁছে যাবে। এই মিছে মায়ার শহরে আর পিছুটান রাখবে না। এ শহর সব কেঁড়ে নিলো। এই ইট পাথরের শহর কারো আপন হতে পারে না। কেবল গোগ্রাসে গিলতে থাকে মানুষের সুখ গুলো। দর্শিনী আর গিলতে দিবে না তার সুখ। যতটুকু পেয়েছে তা-ই গুটিয়ে নিয়ে সে চলে যাবে দূরে,বহুদূরে।

“এটা তো আমার সীট, মেডাম। আপনি ভুল জায়গায় বসেছেন।”

ভরা পুরুষালী কণ্ঠে ধ্যান ভাঙে দর্শিনীর। কথাটা বুঝতে না পেরে সে জিজ্ঞেস করলো,
“জ্বি? আমাকে কিছু বলেছেন?”

দর্শিনীর সামনে থাকা ছেলেটা ভ্রু কুঁচকালো। এবার পূর্ণদৃষ্টি দিলো দর্শিনীর দিকে। শুভ্র রাঙা শাড়ি পরিহিতা রমনীকে তার দারুণ লাগলো। তাই কণ্ঠে ধীর গতি রেখে স্বাভাবিক ভাবে বললো,
“হ্যাঁ, আপনাকেই বলেছি। এটা তো আমার বসার জায়গা। জানালার সাথে সীট আমার। পাশেরটা বোধহয় আপনার। আপনি ভুল জায়গায় বসেছেন।”

দর্শিনী টিকিট মিলিয়ে দেখলো ছেলেটা ভুল বলে নি। তাই সে সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“দুঃখীত। আমি খেয়াল করি নি। বসুন আপনি।”
“ধন্যবাদ।”

খুব সংক্ষেপে শেষ হলো তাদের কথা। দর্শিনী জানালার পাশে সীট ছেড়ে ছেলেটার ডানপাশে বসলো। মনে মনে কতক্ষণ নিজেকে গালাগালি করলো ভুল করার জন্য। ইতিমধ্যে ট্রেণ চলতে শুরু করেছে। দর্শিনীর মনে পড়লো বাবাকে সে জানায় নি আসার কথা। বাবাকে ফোন দিতে হবে। কিন্তু সে তো ঐ বাড়ি থেকে ফোন আনে নি। পাশের ছেলেটা তখন ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত। দর্শিনীর লজ্জা লাগছে ফোন চাইতে। কতক্ষণ নিজের মাঝে যু’দ্ধ চালিয়ে ধাতস্থ করলো সে ফোন চাইবে না। হুট করেই উঠবে বাবার বাড়ি।

“হ্যালো,আমি মৃত্যুঞ্জয়। আপনার কী আমার ফোনটা প্রয়োজন, মেডাম?”

দর্শিনী চমকে উঠলো। ছেলেটা কীভাবে বুঝলো তার যে ফোন প্রয়োজন? গায়ে পড়া স্বভাব নাকি ছেলেটার? দেখে তো তা মনে হয় নি। তবে,যেচে জিজ্ঞেস করেছে বলেই উল্টেপাল্টা চরিত্র ঝুলিয়ে দিবো! দর্শিনী নিজের মনেই কতক্ষণ বকবক করলো।

মৃত্যুঞ্জয় দর্শিনীর ব্যবহারে খানিক অবাক হলো। মেয়েটা কথায় কথায় ভাবনার রাজ্যে চলে যায় কেনো? মেয়েটা ফোনের দিকে অমন করে তাকিয়ে ছিলো বিধায়ই তো সে জিজ্ঞেস করেছে। নাকি যেচে জিজ্ঞেস করা উচিত হয় নি?

দর্শিনী নিজের মাঝে কতক্ষণ দ্বিধা দ্বন্দে থেকে অবশেষে রিনরিনে কণ্ঠে বললো,
“আমি প্রিয়দর্শিনী। ধন্যবাদ। আমার ফোনের প্রয়োজন নেই।”

মৃত্যুঞ্জয় যেনো আর কিছু শুনলো না। তার কানে বার বার একটা নামই বাজলো “প্রিয়দর্শিনী”। বক্ষ পিঞ্জিরা ছলাৎ করে উঠলো। না পাওয়া বস্তু পেয়ে গেলে যেমন আনন্দিত হয় হৃদয় আঙিনা তেমন আনন্দিত হলো তার হৃদয়। বহু দিনের স্বাধ যে এভাবে মিটবে কে জানতো? এবার কেবল সকাল হওয়ার অপেক্ষা। নতুন সকাল। নতুন আরম্ভ।

দর্শিনী চুপ করে তার মাথা টা এলিয়ে দিলো সীটে। কাল তার পরিবার তাকে দেখলে কেমন রিয়াকশন দিবে সেটাই ভাবনার বিষয়।

_

ভরা প্লাটফর্মের হৈচৈ ঘুম ছুটে যায় দর্শিনীর। চোখ মেলতেই দেখে তার গন্তব্যে এসে পড়েছে। হুড়মুড় করে উঠে বসে সে। তার পাশের সীট শূণ্য। ছেলেটা নেমে গেছে! কখন? সামান্য টেরও পেলো না দর্শিনী! কী ঘুম ঘুমিয়েছে সে!

দর্শিনী উঠে দাঁড়ালো। নিজের ব্যাগটা নিয়ে স্টেশনে নামলো। চারপাশে কুয়াশায় ঘেরা। কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছে বিধায় কুয়াশায় ভরে গেছে প্রকৃতি। দর্শিনী নিজের ব্যাগটা নামিয়ে শরীর সামান্য ঝাড়া দিলো। ক্লান্তি ভাব ছুটে গেছে শরীর থেকে। হঠাৎ সে অনুভব করলো তার শরীরে কেউ কিছু জড়িয়ে দিচ্ছে। দর্শিনী চমকে তাকাতেই দেখে চাদর। দর্শিনী অবাক হয়ে যায়। পিছে ঘুরতেই সেই অবাক ভাব আকাশ ছুঁয়ে যায়। বিষ্মিত কণ্ঠে বলে,
“তুমি!”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here