#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-5)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
আকাশে আজকে চাঁদের আলোর কোনো দেখা নেই। তারার সংখ্যাও অতি নগন্য। মেহজা আর ইরফান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেরই দৃষ্টি সামনে থাকা খোলা আকাশের দিকে। ইরফানদের এই রুমটি হলো গেস্ট রুম। কোনো বেলকনি নেই কিন্তু জানালা খুবই বড়। বেলকনির মতোই খোলা মেলা। ইরফান তখন মেহজার থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে মেহজাও ক্ষমা করেছে। ব্যাপারটাকে এত আহামরি গুরুত্ব দিয়ে শুধু শুধু বাড়িয়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ইরফান যেতেই চাচ্ছিল তবে কিছু একটা ভেবে মেহজার সাথেই কিছুক্ষণ থাকলো। ইরফান নিরবতা ভেঙে বলল
” তুমি কি আমার উপর এখনো রেগে আছো? চুপ করে যে!”
” আপনি কে যে আপনার কথাতে আমি রাগ করবো? ”
” বাহ! মুখে খৈ ফুটছে দেখি।”
” আপনিই তো ফুটাতে চাইছেন।”
ইরফান শব্দ করে হেসে উঠে। আর সেটাই যেন তাদের কাল হয়ে দাঁড়ায়। ইরফান যখন উচ্চস্বরে হাসছিল তখনি রুমের পাশ দিয়ে তাদের কাজের মহিলা হাসনা সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। মহিলাটির একটি বদ অভ্যাস আছে তিল কে তাল বানানোর। হাসনা এক প্রকার চিৎকার করে সবাইকে ডেকে উঠে। নিচ থেকে ইরফানের বাবা মাও হঠাৎ এমন চিৎকার চেচামেচিতে উপরে এসে পড়েন। ইরা, ইমা, ইকরা এবং তাদের স্বামীরাও চলে আসে কি হয়েছে দেখার জন্য। রুমের ভেতর থেকে মেহজা আর ইরফানও হঠাৎ এত চিৎকারে হকচকিয়ে যায়। সবাই হাসনাকে চিৎকার করার কারণ জিজ্ঞেস করতেই হাসনা বলে
” ঐ মেহজা আপা যে রুমে আছে সেখানে আমি বেডা মাইনছের গলার আওয়াজ পাইছি। খেক খেক হাসতেছিল। ছে ছে! রাত বিরাতে ঘরে বেডা মানুষ ঢুকাই! এমন মাইয়ারে ঘরে রাখাও তো পাপ।”
মেহজাকে নিয়ে এমন কথা বলাতে মাহিমা বেগম রেগে কিছু বলবেন তার আগেই সেই রুমের দরজা খট করে খোলার শব্দে সবাই সেদিকে তাঁকায়। ইরফানকে বেরিয়ে আসতে দেখেই মাহিমা বেগমের কথাও মুখে আটকে যায়। ইরফান বের হওয়ার পর তার পেছন থেকে মেহজাকেও আসতে দেখা যায়।
ইরফানের বাবা সত্যিই এমন কিছু দেখবেন আশা করেনি। সবাই অবাক হাসনাও কারণ সে জানেনা যে ইরফান ভেতরে ছিল। ইরফানকে সে জমের মত ভয় পায়। যা করার সে করেই ফেলেছে এখন কী হবে! হাসনা দ্রুত পায়ে সেখান থেকে সরে আসে। অদূরে দাঁড়িয়ে কল করে মেহজার মাকে। হাসনা মেহজাদের বাসাতেও কিছুদিন কাজ করেছে কারণ তখন মাহিমা বেগম ছিলেন না। মাহিমা বেগম থাকলে তাকে চব্বিশ ঘন্টা তাদের সাথেই থাকতে হয়। তো সেই কয়দিন সে আরো কিছু বাসাতেও কাজ করেছে। ইরফান নিজেই তাকে চব্বিশ ঘন্টার বদলে মাত্র এক ঘন্টা কাজ করিয়ে বিদায় দিত। আজ থেকে সে আবার আগের মত কাজ করতে এসেছিল। আর আজকেই সে এত বড় একটা কান্ড ঘটায়। মেহজার মাকে ফোন দিয়ে আরো কিছু বাড়িয়েও বলে। এসব করতে তার অন্যরকম আনন্দ লাগে। কিন্তু সে কখনোই বুঝতে চাইবেনা সামান্য আনন্দ কতটা প্রভাব ফেলতে পারে কারো জীবনে, কারো চরিত্রে!
ড্রয়িং রুমে মেহজার বাবা মা ভাই সহ ইরফানের পুরো পরিবার উপস্থিত আছে। সবার মুখ থমথমে। মেহজার গালে এই ফাঁকে দুইবার চড় ও পড়েছে। দুইটাই তার মায়ের থেকে। এক কোণায় দাঁড়িয়ে শব্দহীন কেঁদে যাচ্ছে সে। ইরফান সবার মধ্যেই আছে। রাগে তার শিরা উপশিরা কাঁপছে। এই মুহূর্তে তার হাসনাকে খুন করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কিছুই করতে পারছেনা বরং সবাই তাকে ফাঁসির কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। মাহিমা বেগম জানেন আর যাই হয়ে যাক না কেন তার ছেলে এমন কিছু কখনোই করবে না। এই বিশ্বাসও তার মধ্যে আছে। তবে তিনি নিশ্চুপ একটি কারণে, সেটি আরো ভয়াবহ বাকি সবার জন্য।
মজিদ সাহেব হুংকার ছেড়ে বলে উঠলেন
“এসব কী ইয়াজ! তোমার থেকে তো আমি এমনটা আশা করিনি। শেষ পর্যন্ত তুমিও এসবে নিজের নাম লেখালে!”
“বাবা! তুমি আমাকে বিশ্বাস করছো না কেন? তখন থেকে বলে যাচ্ছি আমাদের মধ্যে ঐরকম কোনো সম্পর্ক নেই। তারপরেও কেন এমন করছো?”
“যদি না থাকে তাহলে মেহজার রুমে কেন গিয়েছিলে তাও এত রাতে?”
“আমি শুধুই ওকে সরি বলতে গিয়েছিলাম।”
“সেটা দিনের আলোতেও বলতে পারতে। তুমি ভেবো না তুমি আমার ছেলে বলে তোমাকে আমি ছেড়ে দিব। তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে।”
“বাবা আমি যা করিনি তার শাস্তি কেন আমি নেব? আমি বলছি তো আমাদের মাঝে কিছুই হয়নি।”
মেহজার বাবা সেলিম সাহেব বলে উঠলেন
“এই মেয়ের জন্য সমাজে আজ আমার মাথা নিচু হলো। একে আমি তো আজ জানেই মেরে দিব।”
বলেই তিনি মেহজার দিকে তেড়ে গেলন তখনিই তার সামনে মাহিমা বেগম এসে দাঁড়ায়। তিনি কাঠকাঠ গলায় বলে উঠে
“এতগুলো লোকের সামনে নিজের এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তুলবেনা না। অন্তত আমার সামনে তো না। আমার ছেলে ও আপনার মেয়ে যদি দোষের কিছু করে থাকে তাহলে তারা শাস্তি পাবে। সেই শাস্তিতে তারাও ঠিক থাকবে সমাজে আপনাদের সম্মানও ক্ষুণ্ণ হবে না।”
“মানে?”
“মানেটা সহজ। এই মুহূর্তেই আমি ইয়াজ আর মেহজার বিয়ে দিতে চাই।”
‘হোয়াট! মা তুমি কি….
“তুমি কোনো কথা বলবেনা ইয়াজ। যা হচ্ছে এবং যা হবে তার জন্য তুমিই দায়ী। তোমার ভুলের জন্য না আমি মেয়েটার গায়ে কলঙ্কের দাগ লাগতে দিব না দুই পরিবারের কারো সম্মান ক্ষুণ্ণ করবো।”
ইরফান তার মাকে চিনছেই না। আসলেই কি উনি ইরফানের মা? নাকি মায়ের বেশে অন্য কেউ! মজিদ সাহেব বুদ্ধিমান লোক তিনিও মনে করছেন এইটাই ঠিক হবে। কিন্তু তিনি এখানে একবারো বুঝলেন এটা তার স্ত্রীর একটি স্বার্থপর ভাবনা। যা শেষ করে দিবে দুইটা জীবন। সবাই বুঝিয়ে শুনিয়ে মেহজার বাবাকে রাজি করালেন। মেহজার মাও রাজি হয়ে গেলেন। এখন যা হয়েছে তা বাদ দিলে ইয়াজিদকে তিনি সত্যিই খুব পছন্দ করতেন। মেয়ের জন্য এমন একটা ছেলেই তো তিনি খুঁজছেন। রাদিফ মোটেও রাজি না এই বিয়েতে কিন্তু রাফসান খুব খুশি। ইরা ইমা সন্তুষ্ট হলেও এই সিদ্ধান্তে ইকরা অসন্তুষ্ট। সে জানে তার ভাই নির্দোষ এমনকি সে এটাও জানে তার মায়ের এই সিদ্ধান্তটা ইচ্ছাকৃত। তিনিও জানেন তার ছেলে এমন কিছু করে নি তারপরেও সে এটাকে বিয়েতে পরিণত করলো।
সেই রাতেই কাজী এসে বিয়ে পড়িয়ে দেয়। মেহজা ইরফানকে স্বামী হিসেবে চাইতো কিন্তু এমন করে কখনোই না। সে কবুল বলতে রাজি না হওয়ার তার মা তাকে আরেকটা চড় দেয় তাদের মান সম্মানের দোহায় দেয়। তাই শেষমেষ বাধ্য হয়েই কবুল বলে। আর ইরফান বলে মেহজার গায়ে যাতে তার জন্য বিন্দুমাত্র কলঙ্কের দাগ না পড়ে সেই জন্য। ইরফান কবুল বলার সময় একবার তার মায়ের মুখের দিকে তাঁকায়। মাহিমা বেগমের মুখে বিজয়ের হাসি। ছেলের এমন অপমানে মায়ের মুখে এমন হাসি দেখে ইরফানের রাগটা আরো বেড়ে যায়। মায়ের প্রতি জমা হয় একরাশ অভিমান। যার অন্ত নেই হয়তো!
সেই রাতে মেহজাকে ইরফানের রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ইকরা তার পাশেই থাকে কেননা মেহজার হুট করেই অনেক জ্বর এসে যায়। ইরফান রাতে আর ঘুমায়নি। দুর্ঘটানাটির জন্য নয় মেহজার অসুখের জন্য। ইকরা ইরফানকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। মেহজার এখনো আঠারো হয়নি কিছু মাস বাকি আছে তাই তারা আপাতত বিয়ের বিষয়টি গোপন রাখছে। দুই পরিবারের বাহিরে আর কেউই জানবেনা তাদের এই সম্পর্কের কথা। এই গভীর সম্পর্কের কথা।
ভোর রাতে মেহজার জ্বর ছেড়ে যায়। পানি খেতে চাইলে ইরফান পানি এগিয়ে দেয়। মেহজা পানি খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। তখন ইরফান মেহজার পাশে শুয়ে পড়ে। হঠাৎ করে সে আবার উঠে বসে তারপর মেহজাকে দেখতে থাকে।
সেদিন রাতে ইরফান মেহজাকে ভালোভাবে দেখে নেয়। যেই চোখে মেহজার দিকে সে কখনোই তাঁকায়নি। তা হলো স্ত্রীর চোখে। এবং শুধু সেটিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না একটি পুরুষ একটি নারীকে যেভাবে দেখে ঠিক সেই রকম গভীর দৃষ্টিতে সে ঘুমন্ত মেহজার দিকে তাঁকায়। সত্যিই সে সেই রাতের সুযোগ নেয়, যা কখনো হওয়ার ছিল না তা তাদের মাঝে হয়ে যায়। দুর্বল মেহজা সবল ইরফানকে বাধা দিতে পারেনি শত চেষ্টার পরেও সে অসফল হয়।
সকালে উঠে ইরফান মেহজার দিকে একবার তাকায়। তখনকার রাগ আর কামনার কারণে সে যে ঘৃণিত কাজ করে ফেলেছে তাতে সে নিজেকে নিজে ধিক্কার দেয়। রেডি হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে ইকরাকে মেসেজ করে। তারপর কাক ডাকা ভোরেই সে চলে যায়।
ইকরা মেসেজটি যখন দেখে তখন ছয়টা বাজে। তার এলার্ম বন্ধ করতে গেলেই সে মেসেজটি দেখতে পায়। কাল বিলম্ব না করেই ছুটে চলে ইরফানের রুমে। সাথে করে নিয়ে যায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ঔষুধ।
রুমে ঢুকেই ঘুমন্ত মেহজাকে দেখে সে আৎকে উঠে। অসুস্থ মেয়েটির সাথে তার ভাই এমনটা করতে পারে কীভাবে! মেহজাকে দুইবার ডাকার পর মেহজা উঠে পড়ে। তার সারা শরীর ব্যাথা। এমন ব্যাথার সাথে সে কোনদিনও পরিচিত হয়নি। নিজের শোচনীয় অবস্থা দেখে সে ডুকরে উঠে। ইকরার নিজেরও কান্না পেয়ে যায়। মেহজাকে ঔষুধ খাইয়ে রেডি করিয়ে সব ঠিক ঠাক করে ফেলে। বেডশীট টেনে সরিয়ে ফেলে ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে তা অতি দ্রুত ধুয়ে শুকিয়ে নেয় এবং তা ইরফানের কাবার্ডের একটি গোপন ড্রয়ারে রেখে দেয়। কাজটি সে কেন করেছে তা জানেনা তবে এটা জানে এই কাজটির দরকার আছে।
সেদিনের পর ইরফানের নাম শুনলেই মেহজার ঘৃণা হয়। তিনমাস কেটে যায় মেহজা ইরফানের কোনো খবর পায়না। মেহজা কলেজে যাচ্ছে আসছে। সেদিন রাতটা সবাই ভুলে গেলেও তিনটি মানুষ ভুলে নি। তারা হলো ইকরা, ইরফান ও মেহজা।
#চলবে।
(গল্প এখন শেষের দিকে। বেশি বড় করতে চাইছিনা।)