গোধূলী আকাশ লাজুক লাজুক পর্ব-৮

0
1938

#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-৮)
লেখনীতে-ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

মেহজা ভিজে জবুথবু অবস্থায় ইকরার সামনে হাজির হয়। ইকরা মেহজাকে এমন অবস্থায় দেখে অস্থির হয়ে যায়। মেহজাকে এই অবস্থায় আর এখানে রাখা যাবেনা আবার তারও এই মুহূর্তে যাওয়া সম্ভব নয়। চিন্তার মাঝেই ইরফানও সেখানে হাজির হয়। এবার ইকরা চরম অবাক হয়। এরা দুজনেই ভিজে আছে। এরা কী একসাথে ছিল নাকি! নিশ্চয়ই ভেজাল একটা ঘটিয়েছে ইরফান। ইকরা রেগেই ইরফানকে বলে

“ইয়াজ! ভিজেছো কীভাবে? এমন একটা জায়গাতে এসেও শান্ত হয়ে থাকতে পারছো না?” ইকরা রাগলে ইরফানকে তুমি করেই বলে। ইরফান কিছুটা চটে গিয়ে জবাব দেয়,

“এই তুই আমাকে এমন ভাবে বকছিস যেন আমি ছোট বাচ্চা!”

“ছোট বাচ্চা নাহলেও তুই আমার ছোট ভাই তো!”

“তোর ঘ্যানঘ্যান করার স্বভাবটা আর যায়নি তাই না! আচ্ছা বাদ দে, আমি বাসায় ফিরে যাচ্ছি এভাবে থাকা অসম্ভব। ওদের ঝকঝকা ফকফকা ফ্লোরটা কীভাবে ভিজিয়ে চিটচিটে করে দিলাম দেখলি?”

“দেখছিই তো। তাহলে মেহজাকেও নিয়ে যা সাথে করে। মেয়েটার অবস্থা শোচনীয়। মেহজার ঠান্ডা লেগে যাবে।”

“আমি তো নিতেই পারি কিন্তু ও কী আর আমার সাথে যাবে।”

“না চাইলেও যেতে হবে। কারণ সেকেন্ড কোনো অপশন নেই এখানে এভাবে ভিজে অবস্থাতে থেকে ইতিমধ্যে অনেকেরই কুনজরের শিকার হয়ে চলেছে।”

মেহজা ইকরার এই কথাটা শুনে আৎকে উঠে। আশেপাশে তাঁকিয়ে দেখে কিছু লোক আসলেই ওর দিকে অশ্লীল ভঙ্গিতে তাঁকিয়ে আছে। শাড়িটা গায়ের সাথে লেপ্টে থাকায় খুব বাজে দেখা যাচ্ছে। নাদুস নুদুস মেহজার কোমরের ভাজ গুলোও দৃশ্যমান। ছিঃ এতক্ষণ কী একবারের জন্যেও খেয়াল করতে পারেনি? ইরফানও মেহজার দিকে একবার তাঁকায় তারপর সামনে থাকা লোকগুলোর দিকে তাঁকিয়েই মেহজাকে এক হাতে আগলে নেয়। আজকে সেও কোর্ট পড়ে আসেনি। কোর্টটা থাকলে হয়তো মেহজার গায়ে জড়িয়ে দিতে পারতো। ইরফান কঠিন দৃষ্টিতে সামনের লোক গুলোর দিকে তাঁকিয়ে চোখের ভাষায় তাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে যে তারা কতটা ভুল করেছে। এর শাস্তি তো পেতেই হবে। ওমনি লোক গুলো পালাই পালাই শুরু করে আর ইরফান তা দেখে রহস্যময় হাসি দেয়। তারা পালিয়ে গেলেও আর রক্ষা নেই ইতিমধ্যে সে তাদের ভালো করে চিনে নিয়েছে। এরা তার পূর্ব পরিচিত মানুষ। মেহজাকে জড়িয়ে নিয়েই সে গাড়ি পর্যন্ত যায়। তারপর পেছনে গিয়ে বসতে বলে। অন্যসময় হলে সামনেই বসাতো। কিন্তু এখন সে চাইছেনা মেহজা আর কোনো অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়ুক।

গাড়ি চলছে আপন গতিতে ইরফান থেকে থেকে লুকিং গ্লাসে মেহজাকে দেখছে। মেহজা কাঁপছে তার হয়তো শীত লাগছে।।ইয়াজিদ গ্লাস গুলো আগেই উঠিয়ে দিয়েছে যাতে বাতাস এসে আরো ঠান্ডা না লাগে। বাতাসের ঠান্ডা আর কী! যেখানে সে ভিজেই আছে সেখানে ঠান্ডা ততক্ষণ লাগবে যতক্ষণ না কাপড় বদলাচ্ছে। খুব দ্রুত গতিতে ড্রাইভ করতে শুরু করলে মেহজা বাঁধা দিয়ে বলে

“করছেন টা কি! মানুষ খুন করার ধান্দায় থাকেন শুধু? এক্ষুণি স্পীড কমান নয়তো এক্সিডেন্ট হবে।”

“পরের কথাটা বললেই হতো। আগের অনর্থক কথা গুলো বললে কেন? তুমি আমাকে খুন করতে দেখেছো কখনো? আর আমি কার খুন করেছি।”

“করেন নি করবেন। এই যে এখন স্পীড না কমালে এক্সিডেন্ট হবে আর এক্সিডেন্ট হলে আমি শেষ।”

“মেহজা!”

“কীসের মেহজা? আমি চিনি আপনাকে। আপনি শুধুই আমাকে মারার জন্যেই ফিরে এসেছেন। আমি মরলে তারপর আপনি নিজের পছন্দ মতো মেয়েকে বিয়ে করতে পারবেন। আমি বুঝিনা নাকি! সবই বুঝি আমি।”

মেহজার কথায় ইরফান কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর অল্প শব্দেই হেসে উঠে। মেহজা যেন আরো রেগে গেল। লোকটি তার মজা উঁড়াচ্ছে! তার মরতে আপত্তি নেই মরার সময় হলে এমনিতেই মরে যাবে। তার যত চিন্তা সব ইরফানকে ঘিরেই। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালালে তো তারই বিপদ। ইরফানের কিছু হোক তা মেহজা চায়না। সে মরে গেলে মরে যাক। ইরফান বাঁচুক, হাজার বছর বাঁচুক। ইরফানের জন্য মনে ঘৃণা যতটাই থাকুক না কেন তা ভালোবাসার থেকে বেশি নয়। ইরফান কেন বুঝেনা যে এটা তার বয়সের আবেগ নয়। সত্যিকারের ভালোবাসা! মনের ভেতরের হাহাকার গুলোকে বাড়তে দেয়না মেহজা। তাকে শক্ত হতে হবে। তার দূর্বলতা যেন মহান আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ না দেখে। তার পাশে আর কেউ না থাকুক তার রব তো আছে! তিনি তো জানেন , তিনি তো চিনেন তার বান্দাকে। সহায়তা তার থেকেই আসে আর কারো থেকে নয়। সবই একটি মাধ্যম শুধু।

পার্কিং এর জায়গায় গিয়ে গাড়ি পার্ক করে মেহজাকে নিয়ে লিফ্টে উঠে পড়ে। কেউ লিফ্টে না থাকায় সুবিধাই হলো। তবে ইরফান ঊনিশ নম্বর সংখ্যায় চাপ দেওয়াতে মেহজা কপট রাগ দেখিয়ে বলে

“এটা কি হলো? আপনি আপনার ফ্ল্যাটে যাবেন ঠিক আছে কিন্তু আমিও কি আপনার ফ্ল্যাটে যাব নাকি?”

কথাটা বলেই আঠারো তে চাপ দেওয়ার আগেই ইরফান তার হাতটি ধরে নেয়। লিফ্টও উপরে উঠে যায়। ইরফান গম্ভীর কন্ঠে বলে

“তুমি এখন আমার সাথে আমার বাসায় যাবে।”

“কখনোই না। আমার নিজের কি বাসা নেই?”

“হ্যাঁ তোমাকে তো তোমার নিজের বাসাতেই নিয়ে যাচ্ছি। স্বামীর ঘর মানেই মেয়েদের ঘর। এতবড় হওয়ার পরেও এটা জানো না!”

“জানি। তবে আমার স্বামী নেই। স্বামীর ঘর তো দূরের কথা।”

“কী!!!! জল জ্যান্ত স্বামীটাকে মৃত বানিয়ে দিলে?”

“মৃত বানালাম কোথায়? আমি তো আমার এমন স্বামীর কথা বলছি যে থেকেও নেই। বিয়ের রাতে অধিকার আদায় করেই সে হাওয়া! তার কোনো হদিস নেই। কোন দায়িত্বটা পালন করেছে সে! আপনিই বলুন মি. ইরফান ইয়াজিদ।”

কথাগুলো ইয়াজিদের বুকে গিয়ে লাগে। মেহজা তাকে নিয়ে এমনটা ভাবে? অবশ্য সে কাজটাই করেছে এমন যে মেহজা তাকে নিয়ে এমনটা ভাবতে বাধ্য হয়েছে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে। নিজেকে বড্ড অপারগ মনে হচ্ছে। মেহজার সুন্দর ভবিষ্যৎ তো তার কারণেই নষ্ট হয়েছে। সেদিন তার বোকামিতেই তাদের একটি পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ হতে হয়। সেই সম্পর্কটা সুন্দর করে না শুরু করে তিক্ততায় ভরিয়ে তুলেছে তো সে। দায়িত্ববান,সৎ, শালীন, ভদ্র ইরফান সেদিন চরম অভদ্রের কাজটাও করেছে। তার মস্তিষ্ক তখন শুধু তাকে একটি কথা বলেছে,

“যেটা করিসনি তার দায় কেন নিবি! না করেই যখন দোষী হয়েছিস তাহলে করেই ফেল। এখন তো আর বাঁধা দেওয়ার মতোন কিছু নেই। করে ফেল কাজটি।”

রাগ, জেদ কতটা ভয়াবহ হতে পারে আমরা কেউই জানিনা। এটি চরম থেকেও আরো চরম পর্যায়ে নিয়ে যায় কাউকে। ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয় এই অযাচিত রাগ। ইরফানের মুখটা ক্রমশ স্থির আর থমথমে হয়ে যাচ্ছে। মেহজার তাকে দেখে মনে হয় হয়তো কষ্ট পেয়েছে পরে আবার ভাবে এই নিষ্ঠুর লোকটি কষ্ট পায়নি। হয়তো ইগোতে লেগেছে। মনে মনে ধিক্কার জানায় ইরফানকে।

“খারাপ লাগছে শুনতে?”

“না।”

“ওহ তা কেন লাগবে। আপনার মধ্যে তো আর খারাপ লাগা আর ভালো লাগা নেই।”

“বেশি কথা আমি একদম পছন্দ করিনা।”

“তাতে আমার কি! আপনার পছন্দ অপছন্দ দিয়ে আমার কিছু যায় আসেনা।”

“তোর কার পছন্দ অপছন্দ যায় আসে! মি. সিনানের!”

“হোয়াট! সিনান ভাই! আপনি কি পাগল? কোন বিষয়ে কাকে টানছেন আপনি!”

“সঠিক বিষয়ে সঠিক মানুষটাকেই টানছি আমি।”

“আপনি একটা অসভ্য লোক।”

“হ্যাঁ, তবে তা শুধু তোমার সাথেই করি একটু আধটু।”

“অসভ্য লোক।”

“হ্যাঁ তো।”

“দূষিত পুরুষ।”

“জানি তো।”

মেহজা এবার রাগী চোখে তাঁকায় ইরফানের দিকে। ইরফান এবার শব্দ করেই হেসে উঠে। ঊনিশ তলায় লিফ্ট এসে পড়লে মেহজা বলে,

“আমি আমার বাসায় যাব। আপনার বাসায় আমি যাব না মি. ইরফান ইয়াজিদ।”

“আচ্ছা যাও। বাসার সবাই যখন তোমাকে এই অবস্থায় দেখবে তখন বড় মুখ করে বলো, “আমি মি. ইরফান ইয়াজিদের সাথে সুইমিং পুলে রোম্যান্স করেছি তো তাই এই হাল।” তখন বিষয়টা কেমন সুন্দর হবে তাই না! আর তুমি চিন্তা করবেনা একদম। আমি নিজেই তুমি ঘরে ঢোকার আগে আন্টিকে কল করে জানিয়ে দিব। সেটাই বরং ভালো হবে তোমাকে আর কষ্ট করে মুখ খুলে আবার কথা বানিয়ে সেগুলোকে লাইন বাই লাইন সাজিয়ে বলতে হবে না। আমি সেই কষ্ট থেকে তোমাকে বাঁচিয়ে দিব কেমন!”
মেহজা ইরফানের কথার জ্বালে আটকা পড়ে। ইরফান যে ইচ্ছেকৃত এমন করছে তা সে জানে। নত মুখেই দাঁড়িয়ে থাকে।
ইরফান মেহজার হাত ধরে টেনে নিয়ে বাসার কলিং বেল বাজায়। সাথে সাথেই মাহিমা বেগম দরজা খুলে দেয়। হয়তো তাদের পথ চেয়েই বসে ছিলেন ড্রয়িংরুমে। মায়ের সাথে ইরফান কোনো প্রকার কথা তো বলেইনি মেহজাকেও বলতে দেয়নি। উপরে নিজের রুমে এনে দরজা লক করে মেহজাকে বলে

“খুলো।”

“মানে! কি খুলবো?”

“শাড়ি খুলে ফেলতে বলছি।”

“কি!!!!! কেন?”

“আদর করবো তোমাকে তাই।”
একপ্রকার ধমকেই কথাটা বলে। মেহজা সত্যিই শাড়িটা খুলে নেয়। ইরফানের চোখ লাল তার ভয় লাগছে। সে হয়তো তার উপর রেগে গেছে। ইরফানের মুখটা কেমন শক্ত হয়ে রয়েছে। বোকা মেহজা বুঝলোই না ইরফান তার মাকে দেখেই এমনটা করেছে। মায়ের প্রতি অভিমান আর ক্ষোভটা চড়াও হয়ে উঠেছে। আর ইরফানের বরাবরই রাগ হলে চোখ মুখ অসম্ভব লাল দেখায়। যে কেউই প্রথম দেখায় ভয় পেতে বাধ্য আর সেখানে তো মেহজাকে সে ধমক দিয়েছে। ইরফান মেহজাকে মূলত শাড়ি বদলাতে বলছিল কিন্তু মেহজা কি মনে করল কে জানে! মেহজা ভুলটা করেই এইখানে। প্রেমিক পুরুষের সামনে শাড়ি খুলবে কেন সে? সাজা তো পেতেই হবে! ইরফান হেচকা টানে তাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। বাহিরে মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি হবে এবার। দুটো মানব মানবীও একে অপরের কাছে। খুবই কাছে! তিক্ততা গুলো ফেলে মিশে যায় একে অপরের সাথে। সূচনা হয় একটি ভিন্ন সকালের।

🍁🍁

“ইয়াজ দরজা খোল! মেহজা কোথায়? কি করেছিস ওর সাথে! দরজাটা খোল ইয়াজ!”

ইরফান শোয়া থেকে উঠে বসে মেহজার ঘুমন্ত মুখটির দিকে তাঁকায়। তারপর গায়ে একটি টি শার্ট জড়িয়ে দরজা খুলে। ইকরা ইরফানের দিকে তাঁকিয়ে বলে

“মেহজা কোথায়? কি করেছিস ওর সাথে! মা বলেছে রাতে টানতে টানতে রুমে নিয়ে এসেছিলি। ইয়াজ তোর এসব বেয়াদবি চলবেনা কিন্তু একদম।”

“চুপ কর তুই। আমাদের স্বামী স্ত্রীর ব্যাপারে তোর এত কৌতূহল কীসের? বদ্ধ রুমে আমি আমার বউয়ের সাথে কী করবো না করবো তা তোকে বলতে হবে! অদ্ভুত!”

ইরফান ইকরার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে মিনিট বিশেক পরে ফর্মাল স্যুটে বেরিয়ে পড়ে। যাওয়ার আগে ইকরাকে বলে যায়

“এই শুন! মেহজাকে একটি পিল খাইয়ে দিস।”

কথাটা বলে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায়নি ইরফান। ইকরা তো অবাকের চূঁড়ায় পৌঁছে যায়। কীভাবে হলো এমন কিছু! গতবারের মতোও এবারও ঔষুধ নিয়ে ছোটে ইরফানের রুমে। প্রতিবারই তার ভাই উল্টা পাল্টা কান্ড ঘটায় আর তাকে ঔষুধ নিয়ে ছুটতে হয়। আশ্চর্য!

#চলবে।

(এতদিন দেইনি তাই আজ বড় করে লিখেছি। আগামীকাল থেকে আবার প্রতিদিন দিব। কাজের চাপ কিছুটা কমেছে। তবে আজকে সবার মন্তব্য চাই অবশ্যই মান সম্মত মন্তব্য নাইচ ওয়াও গুড নেক্সট এসব বললে হবেনা। গল্পটা হয়তো শীগ্রই শেষ করে দিব। আমি লিখি আপনারা রেসপন্স করেন না তাহলে লেখে কী লাভ!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here