–“একি রৌদ্দুর ভাই আপনি? এতো রাতে আমার রুমে কী করছেন? অবিবাহিত মেয়ের রুমে এসেছেন, আবার দরজা বন্ধ করেছেন! বাড়ি ভর্তি মেহমান তারা কী ভাববে? আপনার মানসম্মান হারানোর ভয় নাই থাকতে পারে, কিন্তু আমার আছে! বের হন এখনি…”
রাগে গজগজ করতে করতে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে কথাগুলো বলল হানিয়া।
হানিয়ার পড়নে হলুদ গর্জিয়াস লেহেঙ্গা। দেখে মনে হচ্ছে লেহেঙ্গার ভারে ওর দেহখানি নুয়ে পড়ছে। হানিয়া এগুলোতে অভস্ত্য আছে, প্রায় ব্রাইডাল মেকাপ ফটোসুটে সাজতে হয় ওকে। কৃত্রিম প্রসাধনি সাঝেঁর ওপরে মুখে লেগে আছে বাটা হলুদের প্রলেপ। অন্য কারোর নয় হানিয়ার-ই বিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার সাথে। সে ওর চাচাতো ভাই রৌদ্দুর। ছোটবেলা থেকে রৌদ্দুর নামক ব্যক্তিটাকে হানিয়ার কেনো জানি পছন্দ না। কারণটা রৌদ্দুরের রুক্ষ, জেদি, বদমেজাজ। রৌদ্দুরও হানিয়াকে পছন্দ করত না। যখন ওদের বিয়ের কথা উঠল তখন হানিয়া বিয়েতে মত না ভেবেছিল রৌদ্দুর ভাই নিজেই বিয়ে ভেঙে দিবে বিয়েতে রাজি হবে না, কিন্তু পাশা উল্টে গেলো রৌদ্দুর ভাই নিজেই না-কি তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছে! হানিয়া তিন বছর ধরে বিয়ে আটকে রেখেছি নানান টালবাহানায়। কিন্তু এবার আর কোনো যুক্তিই খাটছে না। রৌদ্দুর বেশ আটঘাট বেঁধেই নেমেছে। হানিয়া বিয়েতে অমত, ও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে, এই বিয়ে ও কিছুতেই করবে না। তা-ও আবার চরিত্রহীন লোককের সাথে তো মটেও না! আজ রাত পেরোলেই কাল বিয়ে। একটু আগে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ করে রুমে এসে কৃত্রিম ফুলের গহনা গুলো খুলছিল তখন আচমকা দরজা আটকানোর শব্দে পিছনে ফিরে রৌদ্দুরকে দেখে হানিয়া রাগে গজগজ করতে করতে কথাগুলো বলল।
রৌদ্দুর হানিয়ার মাথা থেকে পা পর্যন্ত অবলোকন করল। যা হানিয়ার শরীরের আগুন ধরিয়ে দেওয়া মতো অসহ্য লাগছে। রৌদ্দুর বলল
–“আমিই তো তোর বর-ই! ওপস! আমি তো তোমার বর-ই!”
হানিয়া দৃঢ় কণ্ঠে বলল
–“আমাদের এখনো বিয়ে হয় নি রৌদ্দুর ভাই। আপনি আমার রুম থেকে যান।”
–“মধু! তোর নামটা কিন্তু সার্থক। ঠিক তোর মতো।”
হানিয়াকে বাসার সকলে আদর করে মধু বলে ডাকে। রৌদ্দুর আগে মধু নাম নিয়ে হানিয়াকে কত খেপিয়েছে। হানিয়াকে রৌদ্দুর কখনো অন্য সবার মতো মধু বলে ডাকত না। ডাকত মৌমাছি, ভিমরুল, বোলতা… বলে যা হানিয়ার হৃদয়টা কষ্ট পেত। হানিয়া এলোমেলো মস্তিষ্কে ভাবল কী করে বিদায় করা যায়? তাই সরাসরি জিজ্ঞেসা করল
–“কেনো এসেছেন? কোনো দরকার? ”
–“তোকে-ই দরকার!”
হানিয়া দু’হাতে লেহেঙ্গার ওড়না মুট করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দৃষ্টি নিচের দিকে ছিল এমন বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষের দিকে ওর তাকাতেও ঘেন্না লাগে! ‘তোকে-ই দরকার’ কথাটা শুনে হানিয়া চট করে চোখ তুলে তাকাল। ওর কঠোর দৃষ্টি দেখে রৌদ্দুর বলল
–“না মানে, আজ আমাদের হলুদ তোকে তো হলুদ দিতে পারলান না তাই হলুদ মাখাতে এসেছি। সকলের সামনে দিলে তো তুই লজ্জা পাবি তাই আর তখন দি নি”
হানিয়া খেয়াল করল রৌদ্দুরের এক’হাতে হলুদ, ও দাতে দাত চেপে বলল
–“আমি মোটেও লজ্জা পেতাম না রৌদ্দুর ভাই। বরং, এখন আপনাকে এতো রাতে অবিবাহিতা মেয়ের রুমে আসার জন্য এবং তাকে হলুদ মাখানোও বাহানায় ছোঁয়ার চেষ্টা করার জন্য আমার মস্তিষ্ক অন্য কিছু করতে বলছে!”
হানিয়া যেনো মজার কৌতুক বলেছে এমন ভাবে শব্দ করে হাসল রৌদ্দুর। যা হানিয়ার মোটেও পছন্দ হলো না। রৌদ্দুর চোখের পলকে হানিয়ার মুখে হলুদ লেপ্টে দিয়ে বলল
–“আজ কিছু করতে হবে না কাল ফাস্ট নাইটের জন্য তুলে রাখ। যা হওয়ার কালই হবে। এতো ধৈর্য্য হারা হোস না। আর কয়েকটা ঘন্টারই তো ব্যাপার”
রৌদ্দুরের স্পর্শ, কথায় হানিয়া রাগে পাশে থাকা গ্লাসটা টেবিলের ওপরে ভেঙে ওর দিকে ভাঙা অংশটা ঘুরিয়ে দিয়ে বলল
–“বের হবেন আমার রুম থেকে?”
হানিয়ার এমন রাগান্বিত রনচন্ডী রুপ দেখে রৌদ্দুর মনে মনে ভীতগ্রস্ত হলো। কিছু বলার আগে দরজার ওপাশ থেকে কল্যহাস্য ভেসে এলো। ভাই-বোনেরা মজা করে টিটকারি মেরে কথা বলছে যা হানিয়ার রাগ আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিল। রৌদ্দুর কুটিল হেসে প্রস্থান করার জন্য দরজা খুলতেই সকলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। মেয়েরা এসে হানিয়াকে ঘিরে ধরে ছেলেরা রৌদ্দুরকে নিয়ে যেতে যেতে মজা করছে। কলি (রৌদ্দুরের খালাতো বোন) বলল
–“হ্যাঁ রে, রৌদ্দুর ভাইকে বিয়ে করবি না বলে কত কাহিনী করলি আর এখন দরজা বন্ধ করে…হুম… হুম! আর একটা রাত অপেক্ষা করতে পারছিস না?”
হানিয়ার ভাই-বোন দু’জন ও দাঁড়িয়ে আছে কিছু বলছে না। বোনের বিয়েতে তারাও যে খুশি নয়।
হানিয়ার আরেক দুঃসম্পর্কের ফুপাতো বোন আলেয়া বলল
–“আরে ওগুলো হানিয়া আপু একটু ভাব নিল। ওনি মডেল ভাইয়া অভিনেতা একটু ভাবসাব না নিলে খারাপ দেখায় তাই আপু ভদ্রতার খাতিরে একটু ওমন করেছে। তাই না আপু?”
হানিয়াকে বলতে না দিয়ে ওরা নিজেদের মধ্যে নিজেরা বকবক করে যাচ্ছে। হানিয়াকে খচিয়ে আরেকজন বলল
–“এই দরজা বন্ধ করে কী করলি রে! বল না। আমরা আমরাই তো! চুমু টুমু খেলি নাকি?”
হানিয়া এসব সহ্য করতে না পেরে একপ্রকার চিৎকার দিয়ে বলল
— “আমার রুম থেকে যাও তোমরা প্লিজ। আমার ভালো লাগছে না একা থাকতে দাও প্লিজ।”
ওদের কোনো পরিবর্তন না দেখে, ওরা যাচ্ছে না দেখে হানিয়া ওদেরকে ঠেলে রেখেই জামাকাপড় নিয়ে ওয়াসরুমে ডুকে গেলো। কয়েকজন মুখ ভেংচি কেটে বলল “ঢং দেখেছিস! দেখ তলে তলে প্রেম করে বিয়ে করছে ওরা। একবাড়িতে থাকছে আবার একবাড়িতেই বিয়ে, কী কপাল।”
আলেয়া বিরবির করে বলল
–“রৌদ্দুর ভাই, আমার ক্রাস। তার বিয়ে দেখছি চোখের সামনে। আমার যে বুক ফাটছে তোমরা সেটা দেখতে পাচ্ছো না! ইশ, রৌদ্দুর ভাই…!”
হানিয়া ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো রুম খালি ওর দুই ভাই-বোন ছাড়া আর কেউ নেই। হানিয়া মুখ মুছতে মুছতে বলল
–“তোরা যাস নি এখনো? যা ঘুমিয়ে পড়, রাত হয়েছে অনেক।”
হামজা-হায়াত হানিয়ার থেকে তিন বছরের ছোট দু’জন-ই জমজ। হামজা-হিমির‘কে জন্ম দিয়ে তার একমাস সতেরো দিন পরেই ওদের মা সিড়ি থেকে পড়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরনে মৃত্যু ঘটে। আর হানিয়া যখন দশম শ্রেণির পরিক্ষা শেষে বাবারও মৃত্যু ঘটে। ছোট ছেলে-মেয়েগুলো অকালে অনাথ হলো বেড়ে উঠল বাড়ির কাজের লোক, চাচী-মামী, নানীর কাছে। হামজা খানিক রেগেমেগে বলল
–“আপি তুই কী সত্যি সত্যি এই বিয়েটা করবি? আমি ভেবেছিলাম তুই কিছু একটা করে বিয়েটা ভাঙবি কিন্তু না কালই তোর বিয়ে তা-ও ঐ বিশ্রী লোকটার সাথে ওর সাথে বিয়ে হলে তোর লাইফটা শেষ হয়ে যাবে!”
ভাইকে রেগে যেতে দেখে হানিয়া বেশ মজা পেয়ে বলল
–“বিশ্রী! কই? কত হ্যান্সাম, গুড লুকিং, ড্যাসিং, চকলেট বয়…”
হানিয়ার কথার ধরণ আর বর্ণনা শুনে হায়াত ফিক করে হেসে দিয়ে রিপিট করে বলল
–“হ্যান্সাম, গুড লুকিং, চকলেট বয়, ড্যাসিং জিজু হতে যাচ্ছে আমাদের”
হামজা রাগ সামলাতে না পেরে ঠাস করে হিমির মাথায় মে*রে বলল
–“গাধা দুইটা আমারে রাগাস না। আপি, তুই ভেঙে দে কিছু কর, নানুর প্রেশার বাড়ছে তোর চিন্তায় তুই চুপ করে কেনো আছিস?”
হায়াত এবার সিরিয়াস মুখে বলল
–“আপি তুই সত্যি এই বিয়েটা করছিস? এই বিয়েটার পিছনে এবাড়ির সার্থ লুকিয়ে আছে এদের এগুলো ভালোবাসা নয় ছলনা। তুই কী কিছু বুঝতে পারছিস না? নাকি বুঝেও চোখ-কান বন্ধ করে রাখবি?”
হানিয়া জানে কথা গুলো বুঝতে শেখার পর থেকে বুঝতে পারে তাদের তিন ভাই-বোন‘কে দাদাবাড়ির সকলে কৃত্রিম ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে। হানিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–“এতো চাপ নিস না। চিল এনজয় কর। আফটর আল তোদের একমাত্র বড় বোনের বিয়ে বলে কথা।”
হামজা তেতে উঠে বলল
–“কিসের চিল? সেখানে বিয়েটাই মানতে পারছি না। তুই যদি বিয়েটা করিস আপি। আমি বাসা থেকে চলে যাবো তুই তোর একমাত্র ভাই হারাবি মনে রাখিস।”
কথাটা বলে হামজা আর দাঁড়ালো না ধুপধাপ পায়ে বের হয়ে গেলো। হানিয়া চুপ করে দেখল শুধু। হায়াত বলল
–“আপি, তুই কেনো কিছু বলছিস না? তোকে কী কেউ ভয় দেখাচ্ছে? বল না, আপি। শেয়ার কর। দেখ আমরা ভাংব বিয়েটা।”
হানিয়া বোনের এমন সন্ধিহান, অস্থির কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
–“গোয়েন্দাগিরি না করে যা শান্তির ঘুম দে। আমিও খুব টায়ার্ড।”
–“সবসময় এমন করিস কেনো? সব কথা চেপে রাখিস কেনো? আমিও চলে যাব দেখে নিস আর খুঁজে পাবি না।”
হায়াত চলে গেলো। হানিয়া বেশ ভালোই বুঝতে পারছে তার ভাই-বোন দু’জন খেপে গেছে। দরজা বন্ধ করে দিয়ে দু-হাতে মুখ চেপে কেঁদে ফেলল। কান্না করার ফলে মাথা ধরে গেছে আয়নার নিজের প্রতিবিম্ব দেখল চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে কান্না করাই। ফোনটা হাতে নিয়ে কাঙ্ক্ষিত নম্বরটাই ডায়াল করল। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ ধরছে না। হানিয়া রেগে বিড়বিড় করে বলল
–“একবার ফোনটা ধর তোর গুষ্টির পিন্ডি চটকে দিব ইমু আমাকে টেনশনে রাখতে এতো ভালো লাগে! দূর! দূর! নিজেই প্লান দিয়ে কই মরছিস রে?”
হানিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন রেখে দিল সেদিকে আর না তাকিয়ে শুয়ে পড়ল। শরীরটা আর পারছে না ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। হানিয়া চোখ বন্ধ করতেই অক্ষিকোটর থেকে তপ্ত অশ্রুর ধারা গড়িয়ে পড়ল। বাবা-মা’কে এই সময়টাই খুব প্রয়োজন। এই বিয়ে ও কিছুতেই করবে না, প্লান এ কাজ করলে প্লান বি তো আছেই। রৌদ্দুরের মুখোশ খুলেই তবেই স্থির দম নিবে। নিজেকে খুব চালাক মনে করে কথায় আছে “অতি চালাকের গলায় দড়ি” সেটাই হবে।
তন্দ্রা আচ্ছন্ন হতেই ফোনটা বেজে উঠল। চোখ না খুলেই ও হাতড়ে ফোন খুঁজতে লাগল। কিন্তু ফলাফল শূন্য! অগত্যা চোখ খুলে দেখল টেবিলের ওপরে ফোন। অলসে ওর উঠতে ইচ্ছে করল না। দরকারী ফোন ভেবে উঠে ফোন হাতে নিলো ফোনের স্ক্রিনে ভাসছে “ইমু মামু”…
চলবে ইনশাআল্লাহ
#চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।০১ পর্ব।।
#তাসনিম_তামান্না
[আসসালামু আলাইকুম। অনেক দিন পর প্রায় তিন মাস পর ধারাবাহিক গল্প লেখা শুরু করলাম রেসপন্স করবেন সকলে। প্রথম পর্ব পড়েই সবটা নিজের মতো ভেবে নিবেন না। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠন মূলক মন্তব্য করবেন।]