চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।২২ পর্ব।। #তাসনিম_তামান্না

0
285

#চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।২২ পর্ব।।
#তাসনিম_তামান্না

হানিয়া একটু সুস্থ হতেই ভার্সিটিতে ক্লাস শুরু করছে। এমনিতেই পিছিয়ে আছে আর পিছিয়ে পড়তে চাই না। এই ক’দিন সেজাদেরও জ্বর ছিল বলে সোনিয়া ওকে অফিসে যেতে দেয় নি। সেজাদের কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। মাথায় শুধু ঘুরছে ‘’হানিয়া ওকে কী ভাবছে? হানিয়াও কী জ্বর এসেছে? কেমন আছে ও?’’ সুভানার কাছে হানিয়ার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেসা করতে গিয়েও বার বার পিছনে আসছে। সুভানা কী ভাববে ওর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে। কয়েকদিন সেজাদকে কোনো কাজ করতে, বাড়ি থেকে বের হতে দেওয়া হলো না। অফিসের সব কাজ সায়েমে ঘাড়ে এসে পড়েছে বেচারা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। সেজাদ ওর ওপরে সবসময় কম প্রেশার দেয় নিজেই সব কাজ করার চেষ্টা করে। কিন্তু সায়েমের লেজে গোবেচারার মতো অবস্থা দেখে সুভানা, সোনিয়া বেশ মজা নিচ্ছে। সেজাদ কিছু বলছে না চুপচাপ থাকে ওর ল্যাপটপ সোনিয়া কাজে চেয়েও কাজ করতে পারছে না।

সেজাদ সুস্থ হয়ে সর্বপ্রথম হানিয়া আর সুভানা কলেজের সামনে আসলো। হানিয়াকে একটাবার দেখার জন্য পরপর তিন দিন আসার পর চারদিনের দিন হানিয়া দেখ পেলো। পরিক্ষা পৌশু থেকে। হানিয়ার গায়ে এ্যাপ্রন পরা তার পাশে ডিপার্টমেন্টের সহপাঠীরা তাদের সাথে কোনো বিষয় নিয়ে ডিসকাশন চলছে। সেজাদের মুখে মাক্স পড়া সুভানা আজ ইউনিভার্সিটিতে আসে নি কিন্তু সাবধানের মার নেই। বার বার এগিয়ে যেতে গিয়েও পিছিয়ে আসছে। জীবনে প্রথম কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে গিয়ে নার্ভাস হয়ে যাচ্ছে। ও ওখানে দাঁড়িয়ে রইল হানিয়ার আসার অপেক্ষায় এদিক দিয়েই হোস্টেলে যাবার কথা। কেউ ওর দিকে বিশেষ নজর দিল না যে যার কাজে ব্যস্ত। হানিয়া সকল দরকারী টপিক আলোচনা শেষ করে বিদায় নিয়ে ব্যাগে বই ডুকাতে ডুকাতে সেজাদকে ক্রস করতে যাবে তখন সেজাদ ডেকে উঠল “হানিয়া!”

পরিচিত কণ্ঠে নিজের নামের ডাক শুনে ও দাঁড়িয়ে গেলো সেজাদ এগিয়ে এসে বলল “হানিয়া আ…”

সেজাদকে এখানে দেখে চমকে গিয়ে বলল “আপনি এখানে? কোনো কাজে?”

সেজাদ যেটা বলতে এসেছিল সবগুলিয়ে ফেলো তুতলিয়ে বলল
–“আ-আমি আসলে একটা ইম্পর্ট্যান্ট ক-কাজে এসেছিলাম এদিকে ত-তাই সু-সুভানাকে নি-নিয়েই যায় ভাবলাম।”

হানিয়ার মনে মনে অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে আছে কিন্তু নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে পালে ভাজ ফেলে বলল
–“ও আজ আসে নি। এক্সাম তো তাই। আসছি।”

সেজাদ সে কথা জানে নিজের মনে কথা গুছিয়ে নিচ্ছিল। ‘আসছি’ কথাটা শুনে টনক নড়ে উঠে। হানিয়া যেতে ধরলে আবার ডাকে ‘হানিয়া’ ও দাঁড়িয়ে গেলো। এই লোকের মুখে ওর নামটাই নতুনত্ব কিছু আছে বোধহয় কি সুন্দর স্পষ্ট করে ‘হানিয়া’ বলে মিষ্টি করে ডাকে। সে ডাকে সাড়া না দিলে কী হবে? অনর্থ হয়ে যাবে কী? বলল “কিছু বলবেন?”

–“না আব হ্যাঁ। হানিয়া সে দিনের জন্য আ’ম সরি। আ’ম রেইলি ভেরি সরি। আই ডোন্ট নো ঐ সময় আমার কী হয়েছিল। আমি শান্তি পাচ্ছি না রিগ্রেট ফিল হচ্ছে”

হানিয়ার সেদিনর দৃশ্য চোখের সামনে ভাসে উঠলো। ও না আটকালে কী হতো? কিস! আবার যে সে কিস নয় লিপ কিস! হানিয়ার শ্বাস আঁটকে গেলো। কিছু কঠিন কথা শোনাতে ইচ্ছে করছে। অসভ্য লোক! কিন্তু পারছে না কেনো? লোকটাকে কী বলে সম্মন্ধ করবে? ভাইয়া? ওমন একটা পরিস্থিতি কাটিয়ে চলে যাবার পর ভাইয়া ডাকটা আসছে না। হানিয়া গম্ভীর কণ্ঠে বলল “বান্ধুবীর কাছে তার বড়ভাইকে নিয়ে অনেক গর্ব করে কথা বলছে শুনেছি। আমিও আপনাকে রেস্পেক্ট করতাম। কিন্তু সেই আপনার দ্বারাই আমার অসম্মান হতে যাচ্ছিল।”

সেজাদ অস্থির মনে, চোখ ভর্তি অপরাধবোধ নিয়ে তাকিয়ে ছিল। হানিয়ার কথা শুনে মনের অস্থিরতা দ্বিগুণ বাড়লো। বলল “হানিয়া ট্রাস্ট মি। আমি এমন নই। আমি মেয়েদের থেকে সবসময় দুরত্ব বজায় রাখি। আমি সেদিন কীভাবে হলো আই ডোন্ট নো। আ’ম সরি। প্লিজ সরি”

হানিয়ার মনে হলো লোকটা মন থেকে গিল্টি ফিলিং করছে। তার দ্বারা ভুল হতে যাচ্ছিল ভুল তো হয় নি। ক্ষমা করাই যায়। তার সাথে বন্ধুবীর দ্বারা যেটুকু পরিচয় এবার থেকে রাস্তা দেখা হলেও আর একসাথে ঘুরবে না আবার যে তার দ্বারা যে ভুল হতে গিয়েও হয়নি সেটা হতেই বা কত সময় নেবে। হানিয়া বলল “ইট’স ওকে। নেক্সট টাইম থেকে খেয়াল রাখবেন। সবাই ঐ টাইপের মেয়েদের মতো হয় না। আসছি আমার দেরি হচ্ছে।”

হানিয়া আর দাঁড়ালো না চলন্ত পায়ে চলে গেলো। সেজাদও আর ডাকলো শুধু হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ওর শেষ কথাটাই বুঝতে পারছে মেয়েটার মনে ওর জন্য ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে। সে ভুল ধারণা ভাঙতে ওর কী করতে হবে জানা নেই।

—————–

সেদিন রাতটা আহমেদ বাড়িতে কাটানোর পর সকালে শ্বশুরের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বাপেরবড়ি এসেছে দোলা। নিজের সময় প্রয়োজন। নিজের মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু মনে হচ্ছে ও খেলার গুঁটি যা খেলা শেষে মূল্যহীন। রৌদ্দুরের কাছে ও তেমনই মূল্যহীন হয়ে গেছে। চলে আশার পর শ্বশুর মশাই প্রতিদিন একবার করে হলে-ও ফোন দিতো। কিন্তু রৌদ্দুরের ফোনের আশায় থাকত একটা বার গিল্টি ফিল হয় না মানুষটার? ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করে না? কেমন মানুষ সে? পাষাণ্ড একটা!

রৌদ্দুরের কেমন অস্বস্তি হচ্ছে ঘুমাতে যাওয়া আর ঘুম থেকে উঠার কর দোলার দেখা পেতো। ওর জিনিসপত্রগুলো এগিয়ে দিতো। মাঝে মাঝে নিজে নিজে কথা বলতো! মেয়েটা বোকাসোকা। ছোট খালা বছরের বেশির ভাগ সময়ই এবাড়িতে কেটে যায় বাড়ির কেউ কিছু বলে না। দোলাকে তিনি কষ্ট দিয়ে কথা বলে দোলা কখনো রৌদ্দুরের কাছে অভিযোগ করে নি হয়ত লুকিয়ে কেঁদেছে। রৌদ্দুর সবটা জেনেও না জানার ভান করে থাকত। মাঝ রাতে বা দোলার আগে সকালে ঘুম ভেঙে গেলে রৌদ্দুর তাকিয়ে থাকত স্বল্প উচ্চ পেটে তাকিয়ে থাকত কেমন জানি অনুভূতি হতো! ও চাইতো দোলা চলে যাক কিন্তু ও চলে যাওয়ার পর ও শান্তি পাচ্ছে না। ফোন দিতে গিয়েও ফিরে আসে। মন বলে মায়া বাড়িয়ে লাভ কী?

বারো দিন পার হয়ে গেলেও দোলা ফিরলো না। আহছানউল্লা আহমেদ চিন্তিত হলেন ফিরেবে কবে জিজ্ঞাসা করলে ও কথা এড়িয়ে যায়। আহছানউল্লার মেয়ের শখ ছিল কিন্তু রৌদ্দুর হওয়ার পর আর সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করলেও মিসকারেজ হয়ে যায় আর নেওয়া হয় নি সেজন্য হানিয়া, হায়াতের প্রতি খুব টান অনুভব করেন দোলা আসার পর ওকে আলাদা চোখে দেখে নি। কথা হানিয়াকে জানালো।

হানিয়ার এক্সাম চলছে বাড়ির লোকজন সাথে তেমন একটা কথা হয় না হামজা-হায়াত ও টেস্ট পরিক্ষা শুরু হয়েছে। সকলে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। আহছানউল্লার কথা শুনে হানিয়াও টেনশনে পড়ে যায়। দোলার খোঁজ নেওয়া হয় না। অথচ ওর খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল মেয়েটার জন্য রৌদ্দুর সাথে বিয়েটা ভেঙেছে। কিন্তু মেয়েটার জীবন অনিশ্চিত। হানিয়া চাচাকে আশ্বাসত করে বলল ও বিষয়টা জেনে যানাবে। হানিয়া সে অনুযায়ী দোলাকে ফোন দিল। ও তখন মন মরা হয়ে জানালার পাশে বসে কফি খাচ্ছিল। আননোন অদ্ভুত বাইরের দেশের নম্বর দেখে ভড়কে গেলো। প্রথম বার না ধরলেও দ্বিতীয় বারে ধরল। হানিয়া চটপটে কণ্ঠে বলল

–“হ্যালো সুইটি কিউটি ভাবী কেমন আছো?”

দোলা চমকে গেলো। হানিয়া! পরমুহূর্তে খুশি হয়ে গেলো বলল “তুমি! আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”

–“আর বলো না এক্সাম চলে। জীবনটা ভাজা ভাজা হয়ে গেলো।”

দোলা হাসলো। হানিয়ার কথা শুনতে ওর মজা লাগে মন খারাপ নিমিষেই দূর হয়ে যায়। হানিয়া বলল “তা কী করছ?”

–“এই তো বসে আছি। তুমি কী করছ নতুন পরিবেশ কেমন লাগছে?”

–“হুমম রহস্যময় পরিবেশটা খুবই ভালো। এনজয় করছি একা একা বাট মিস করছি সবাইকে। আচ্ছা তুমি কী রাগ করে আছো আমার ওপরে?”

–“কেনো বলো তো!”

–“এই যে তোমার রিসিভশনের পর এতোদিন তোমার খোঁজ খবর নিলাম না। আসলে ব্যস্ত ছিলাম ভুলে গেছি”

–“আরে ব্যাপার না। আমার রাগ, দুঃখ, কষ্ট আজকাল ফিল করতে পারি না। মনে হয় ফিলিংলেস হয়ে গেছি।”

হানিয়া এমন একটা সময়ের অপেক্ষা করছিলো। হুট করে তো আর জিজ্ঞাসা করা যায় না কী হয়েছে? তাই সুযোগ পেয়ে লুফে নিয়ে বলল
–“এনিথিংক রং দোলা?”

দোলা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলল
–“এভরিথিংক ইজ ফাইন!”

–“আমি তোমার ননদ হই এই সম্পর্কের সমীকরণ আপাতত কয়েকমূহুর্তের জন্য ভুলে যাও।… আমি তোমার কাছে এ্যাজ এ ফেন্ড হিসাবে শুনছি তুমি চাইলে শেয়ার করতে পারো। নিজেকে হালকা লাগবে।”

দোলা নিজেকে আটকাতে পারলো না। শব্দ করে কেঁদে উঠলো হানিয়া চুপ করে রইল ওকে একটু সময় দিলো নিজেকে সামলিয়ে নিতে। কিছুক্ষণ পর বলল
–“আমি ওবাড়িতে ওখানে ফিরতে চাই না হানিয়া। রৌদ্দুরের কাছে আমি একটা গেমের গুটি যেটার খেলা শেষে কোনো মূল্য নেই। ওর ফেন্ডদের সাথে বাজি রেখে আমাকে বোকা বানিয়ে মিথ্যা বলে বিয়ে করেছে। ওর শুধু আমার ভোগ করার ইনটেশন ছিল সেটা পূরণ হয়ে গেছে ও গেমে জিতে গেছে। আমি এসব জানার পর কীভাবে ওর সাথে থাকবো? তাও আমি মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম রৌদ্দুরের সাথে কিন্তু কি জানো একটা সম্পর্কে দুজনকে এগিয়ে আসতে হয় একজন বার বার কেনো নিজেকে বেহায়ার পরিচয় দিবে? আমি একাই আমার সন্তানকে মানুষ করতে পারব।”

–“কোথায় তুমি?”

–“বাবার বাসায় ছিলাম আজ দু’দিন হলো নিজের ফ্লাটে আসছি।”

–“একা? এই সময় রিক্স হয়ে গেলো তো! বাবার বাসায় থাকতে।”

–“না, বান্ধবী আছে দুজন। বিয়ের পরে মেয়েরা বাপের বাড়ি মেহমান হয়ে যায়, বেশি দিন থাকতে নেই কদর কমতে থাকে। তাছাড়াও জেদ ধরে ইন্টারে উঠার সাথে সাথে তো বাসা ছেড়ে হোস্টেলে উঠেছিলাম। হোস্টেল থেকে বান্ধবীরা প্লান করে ফ্ল্যাটে ভাড়ায় উঠলাম।”

হানিয়া দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো কী বলবে? এর সালিউশন কী? ও কথা ঘোরানোর জন্য বলল
–“তুমি কিসে পড়ছ? ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ আমি জানি না তাই জিজ্ঞেসা করছি।”

–“ইন্টার দিলাম রেজাল্ট বের হলো তখন জানতে পারলাম কনসিভ করছি।”

হানিয়া অবাক না হয়ে পারল না এতো ছোট রৌদ্দুর ভাইয়ের বউ! হ্যাঁ এতো ছোট বলেই আবেগের বশে রৌদ্দুর ভাইয়ের ফাঁদে পা দিয়েছে। কিন্তু দেখলে বোঝা যায় না মনে হয় ওর থেকেও বড়। রৌদ্দুরের সাথে পাশাপাশি দাঁড়ালে পারফেক্ট লাগে।
–“ও পিচ্চি ভাবী অর্নাসে ভর্তি হবে না? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সাম তো দিলা না।”

–“আমি পড়াশোনা নিয়ে ভাবছিনা।”

–“কেনো ভাবছো না? বেবি আসছে, বিয়ে করছ বলে পড়াশোনা বাদ দিলে চলবে? তুমি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাও।”

–“আমি এই অবস্থায় পারবো কি-না… ”

–“কেনো পারবে না? মিডিয়া থেকে তো অনেক মাস দূরে আছো। কোনো একটা কিছু নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখো। একা থাকলে ভুলভাল টেনশন করবে। আর যেকোনো কিছুতে আমি তোমার সাথে আছি। কোনো প্রবলেম হলেই আমাকে জানাবে।”

চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here