#চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।২৬ পর্ব।।
#তাসনিম_তামান্না
ইমন-রুহি’র প্রেমের গল্প শুরু হয়েছে কয়েকদিন ধরে। রোজ অফিস শেষে দু’জনে পার্কে বসে বুট, বাদাম খেতে খেতে দুজনে সময় কাটায়, মনের কথা, ইচ্ছে বলে। অফিসে কাজের মধ্যে দুজনের চোখে চোখ পড়লে হেসে ফেলে। সকলে আজ-কাল বাঁকা চোখে তাকায় ওদের দিকে কিন্তু ওরা কাউকে পাত্তা দেয় না। গল্প শেষে ইমনই রুহিকে নিজের বাইকে করে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ও বাসায় যায়। আজ-ও তেমনটাই করলো সন্ধ্যা হয়ে যায় প্রতিদিন। ফ্রেশ হয়ে বসার রুমে এসে বসলো। ইফাজ-হায়াত-হামজা বসে বসে টিভি দেখছে। হায়াত-হামজা আজ পরিক্ষা শেষ সেই খুশিতে পড়বে না। সালেহা রুটি বানাচ্ছে। ইরাবতী বেগম এসে বলল
–“আজ ক’দিন দেরি করে আসিস কেনো ইমন?”
ইমন মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো কেমন করে তাকিয়ে আছে ও বলল
–“এমনি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে আসি।”
–“কেমন বন্ধু?”
–“মা এমন আজব প্রশ্ন করছ কেনো?”
–“পড়ার একখান ভাবী এসে বলে গেলো তোর মোটর সাইকেলের পিছনে মেয়ে দেখেছে। মাইয়াডা কে?”
–“মা! তোমার বান্ধবীর সাথে কথা বলে বলে আবার আগের মতো ভাষা হয়ে যাচ্ছে। আর মেয়েটা আমার কলিগ লিভ চাইলো তাই পৌঁছে দিয়েছিলাম।”
–“সত্যি তো!”
–“এছাড়া অন্য কিছু হলে আমি নিজেই জানাবো অন্যর কাছ থেকে শুনতে হবে না। আমি নিজে আগে শিওর হয়ে নি।”
–“তারমানে ওর সাথে তোর কিছু চলতাছে?”
–“মা, চলতাছে কেমন ভাষা এটা? চলছে হবে ওটা কি সুন্দর ভাষা চলছে। আর চলতাছে ক্ষ্যাত ভাষা। তুমি আমার মতো হ্যান্সাম ছেলের মা হয়ে এসব ভাষা ইউজ করো! ছিঃ মা ছিঃ”
সিরিয়াস মোমেন্টে ইমনের এমন কথা শুনে হামজা-হায়াত-ইফাজ মুখ টিপে হাসলো। এখন শব্দ করা যাবে না করলেই ইরাবতী বেগম খেপে যাবে। দু’চার ঘা লাগিয়ে দিতে পারে। ইরাবতী ভয়ংকর রেগে গেলো ইমনের কান টেনে বলল
–“আমারে রাগাস না। তুই কথা ঘুরাইতাছোস ইমন। মাইয়াডা কেডা ছবি দেখা।”
–“আহ্ মাআআ লাগছে…মা ছবি নেই। সময় হোক আমি জানাব তোমাকে।”
–“আমি মানব না শহরের মেয়ে তোর জন্য আমি মেয়ে খুঁজবো। বড় বউমার মতো মেয়ে খুঁজে আনব। সংসারে শান্তি থাকব শহরের মেয়ে আনলে আমার সংসার ভেসে যাবে।”
শাশুড়ীর চিৎকার চেচামেচিতে সালেহা দৌড়ে আসলো। ইরাবতী কথা গুলো বলতে বলতে ওর কান ছেড়ে ইমনের বাহুতে চাপড় মারলো। সালেহা বলল
–“মা ছাড়ো ওকে। এতো বড় ছেলের গায়ে হাত তুলছ।”
–“বউমা ইমনকে বোঝাও আমি কিন্তু শহরের মেয়ে মানব না। যেই বেহায়া পনা দেখি রাস্তাঘাটে ওসব মেয়েকে আমি বাড়ির বউ করব না।”
ইরাবতী বকতে বকতে চলে গেলো ইমন চুপচাপ বসে রইল। শাশুড়ী চলে যেতেই সালেহা ইমনের পাশে বসলো ইফাজ-হায়াত-হামজাও উঠে ইমনকে ঘিরে ধরলো। সালেহা বলল
–“কী রে মেয়েটাকে?”
ইমন হেসে ফেললো বলল “অফিসে একসাথে কাজ করি ভাবী। ও অনেক ভালো তোমাদের সবার কথা শুনে ও। তুমি মা’কে প্লিজ রাজি কারাও।”
ইফাজ খুশি হয়ে বলল “চাচু চাচি কে দেখবো। প্লিজ”
–“ছবি নাই তো!”
–“তাহলে কী ঘোড়ার ডিমের প্রেম করিস যে একটা ছবি নাই।”
ইমন মাথা চুলকে বলল
–“কাল ছবি দেখাবো।”
–“তুই বরং ওকে একদিন বাড়িতে আন দেখি তুই কেমন মেয়ে পছন্দ করেছিস।”
–“কিন্তু মা…”
–“বলবি মধুর বান্ধবী!”
ইমন হেসে ফেললো বলল
–“আচ্ছা।”
–“এখন দাঁত না কেলিয়ে বাজারের লিস্ট দিচ্ছি সেগুলো নিয়ে আসুন দেবরজী। না হলে শাশুমা আবার খেঁপে যাবে।”
হামজা-হায়াত কিছু বলতে পারলো। দুজনের একই মনের ভাবনা। হানিয়া একবার বলেছিল ইমনের বউ আসলে ইফাজ বড় হলে তার বউ আসলে তখন তাদের এবাড়িতে থাকা পছন্দ নাও হতে পারে। সে অনুযায়ী হানিয়া একটা ফ্লাট ও কিনেছিলো। সেখানে কেউ থাকে না ইরাবতী বেগম থাকতে দেন না। হানিয়া মাঝে মাঝে গিয়ে সেখানে থাকে। সেখানে জিনিস পত্র নেই বললেই চলে ঘুমানোর জন্য একটা বেড, কয়েকটা পাতিল আরো ছোটোখাটো দরকারী জিনিস পত্র।
ওদের ভাবনার মাঝে ইফাজ বাজারে যাওয়ার জন্য বায়না ধরলো। হায়াত ওসব ঝেড়ে ফেললো মাথা থেকে মনে মনে ভাবলো এমন কিছু হলে নিশাদকে বিয়ে করে ফুপিবাড়ি নামক শশুড়বাড়ি চলে যাবে। সে-ও বায়না করলো ও-ও যাবে। হামজা চুপ করে আছে ও ব্যাপারটা ফেলতে পারছে না। ইমন ওদের সকলে রেডি হতে বলে নিজেও রেডি হতে গেলো।
ইমন গ্রোসারিসুপারশপে ঘুরে ঘুরে সব দেখে দেখে শপিং বাস্কেটে রাখছে। ইফাজ, হায়াত, হামজা অন্যদিকের দরকারী জিনিস পত্রগুলো দেখছে। এর মাঝে জেনি ওর সামনে এসে দাঁড়ালো।
–“কী সমস্যা? পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”
ইমন বিরক্ত হয়ে পাশ কেটে চলে গেলো। জেনি ওর হাত জড়িয়ে ধরে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে আহ্লাদি গলায় বলল
–“নতুন প্রেম শুরু করেছ জান?”
ইমন রেগে হাত ঝাড়া মেরে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল
–“আমি যা-ই করি না কেনো তোমার কী? তোমার সাথে আমার যা বা যেটুকু সম্পর্ক ছিল সব শেষ করে ফেলেছি। এখন তোমার আর আমার পথ আলাদা।”
–“কি বলো! আমাদের রিলেশন শেষ হলো কবে? ওটা তো আমরা ঝগড়া করে কত কীই বলি তাই বলে সব ধরে বসে থাকতে নেই জান”
–“সাট আপ জেনি আমি পাবলিক প্লেসে সিনক্রিয়েট করতে চাইছি না। আর হ্যাঁ ওর সাথে এখন প্রেম করছি ফিউচারে বিয়েও করবো।”
–“সেটা আমি থাকতে হতে দিব না। আমার শিকাড় আমারই থাকবে। আমি এতো সহজে হারতে শিখি নি।”
ইমন মনে মনে ভয় পেলো মুখে স্বাভাবিক ভবে বলল
–“কী চাও তুমি?”
জেনি আবেগে আবারও ইমনের হাত জড়িয়ে ধরে বলল
–“আগে তোমার সাথে টাইমপাস করতে চাইতাম। এখন বিয়ে করে সারাজীবন তোমার সাথে কাটাতে চাই। তোমাকে আমার চম্বুকের ন্যায় আকর্ষন করে জান। প্লিজ আমাকে আপন করে নাও আই প্রমিজ তোমাকে এতো সুখ দিবো। ঐ মেয়েটার কথা মনে পরবে না।”
ইমনের গা ঘিনঘিন করে উঠলো। এমন নির্লজ্জ মেয়ে ও আর দু’টো দেখে নি। জেনির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল
–“লাইফটা গেম নয় যে যখন যা খুশি বলবে আর আমিও করবো। রুহি তোমার মতো নির্লজ্জ, গায়ে পড়া মেয়ে না। আমার লাইফের একটা মাত্র ভুল তোমার সাথে রিলেশনশিপে যাওয়া। সবচেয়ে বড় ভুল। আর তোমার মতো মেয়েকে না আমি কোনো কোনো ভালো ভদ্র ঘরের ছেলে বিয়ে করবে না। হাহ্!”
ইমন সামনের দিকে এগোলো। জেনি রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল “অন্য কেউ নয় তুমি আমাকে বিয়ে করবে আই প্রমিজ ইউ।”
–“সুস্থ মস্তিষ্কে এমন ভুল করবো না।”
ইমন কথাটা বলে চলে গেলো, জেনি ওর সাথে গেলো না। জেনি বিরবির করে বলল “আমাকে কেউ বিয়ে করবে না? দরকার নেই বিয়ের এভাবেই বেস্ট আছি। নো নো আমাকে অপমান করার শাস্তি ইমনকে পেতেই হবে। এমন অবস্থা করবো যে আমাকেই বিয়ে করবে হবে জান।”
———————
বাংলাদেশ তখন রাত একটা বাড়ির লোকজন ঘুমে কাঁদা হয়ে গেছে। হামজা জেগে ওর মাথায় একটা কথা ডুকলে সেটা বের করা খুবই মুশকিল। নরওয়েতে কখন রাত আটটা বাজে। বাইরে তুষার বর্ষণ হচ্ছে দুই বেডের মাঝখানে টেবিলের সামনে জানালা সেটা এখন খোলা যাবে না তাহলে ঠান্ডায় আর থাকা যাবে না রাতেবেলায় তাই লাইট অফ করে দিলে ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় তুষার বর্ষণ সুন্দর স্পষ্ট দেখা যাবে। কিন্তু এখন পড়ার সময় টেবিলের দু’প্রান্তে হানিয়া আর রাত্রি পড়াশোনা মনোনিবেশ করেছে। চাইলেও তুষারবিলাস করতে পারছে না। হানিয়া আজ রাত্রিকে নিয়ে শপিং করেছে বাড়ির জন্য। সাথে সায়েমের বার্থডে গিফটও। হানিয়ার ফোনটা ঝংকার তুলে বেজে উঠল। ওদের পড়া থামলো। রাত্রি একপল চেয়ে আবারও নিজের পড়ায় মন দিল। হানিয়া ফোন হাতে নিয়ে। হামজার কল দেখে ভ্রু কুঁচকে গেলো এখন বাংলাদেশে অনেক রাত সচারাচর এতোরাত অবধি হায়াত হামজা জাগে না। এগারোটার মধ্যে পড়া শেষ করে ভোরে উঠে আবার পড়তে বসে। হানিয়া রাত্রির পড়ার ডিস্টার্ব না করে। ও জ্যাকেট, টুপি পড়ে। রুমের বাইরে আসলো। রুমে হিটার থাকলেও করিডরে নেই। হাতেপায়ে মোজা পড়ায় ছিল। ওর কোল্ড এলার্জি একটু ঠান্ডা লাগলেই জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যাথা ধরবে। ফোন ধরলো সময় নিয়ে।
–“হ্যালো!”
–“আপি!”
–“শুনছি বলো… কী হয়েছে?”
–“আপি কিছু ভালো লাগছে না।”
–“ভালো না লাগার কারণটা কী শুনি!”
–“আপি!”
–“হুম!”
–“পাপা-মাম্মাকে মিস করছি। ওরা নেই কেনো রে? পরিবার নেই কেনো? আমাদের নিজের বাসা নেই কেনো? যেখানে নিরদ্বিধায় বলতে পারব আমার বাড়ি, আমাদের বাড়ি! এমন কেনো নেই আপি?”
হানিয়ার মন ভার হয়ে গেলো। ভাইবোন দু’টোকে ভালো রাখতে পারছে না! পাপার দেওয়া কথা রাখতে পারছে না। বলল
–“কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?”
–“না! ইমন মামার বিয়ে হলে মামী তো আমাদের এখনে থাকা পছন্দ নাও হতে পারে। আচ্ছা…তুই, হায়াত বিয়ের পরে শশুড়বাড়ি চলে যাবি। সেখানে পরিবার পাবি। আপি আমি একা! তোরা আমাকে ভুলে যাবি না তো!”
হানিয়ার অক্ষিকোটর থেকে তপ্ত অশ্রু কণা গড়িয়ে পড়লো। বলল
–“আমি কখনো বিয়ে করব না, হামজা। তোদের নিয়ে সারাজীবন পার করে দিব। আর যদি তোদেরকে কখনো ভুলে যায় তাহলে তার আগে যেনো আমার মরণ হয়।”
চলবে ইনশাআল্লাহ