চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।২৭ পর্ব।। #তাসনিম_তামান্না

0
290

#চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।২৭ পর্ব।।
#তাসনিম_তামান্না

রহস্যময় নরওয়ের প্রকৃতির ওপরে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। হানিয়ারও একই অবস্থা আজ সারাদিনটাই সূর্যের দেখা মেলে নি। রাতের অন্ধকারে মতো সারাদিন বুদ হয়ে আছে। অল্প তুষারের আস্তরনের ঢাকা পড়েছে অসলো শহরের রাস্তাঘাট। কনকনে শীতে হিম শীতল বাতাসে জুবুথুবু হয়ে আছে। নিজেকে প্যাকেট বানিয়ে বেরিয়েছে তা-ও শীত লাগছে। সর্দি কাশিতে নাজেহাল অবস্থা। এক্সাম শেষ রেজাল্ট দেয় নি অথচ ক্লাস হচ্ছে। আজকে সব শিক্ষার্থীদেরকে এ্যাসাইলামে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে বিদেশি পাগলগুলোকে দেখলে সুস্থ মনে হয়। কিন্তু একাকজনকে চেতিয়ে দিলেই তাদের আসল রূপ বের হয়।

আজকে সুভানাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা ক্লাস শেষে কিন্তু ও হানিয়াকে ইউনিভার্সিটিতে না পেয়ে ফোন করে রাগারাগি করেছে। ও ভেবেছে হানিয়া চলে গেছে ওকে না বলে ওদের বাসায় যাবে না সেজন্য। যখন শুনলো ওদেরকে এ্যাসাইলামে নিয়ে গেছে তখন শান্ত হলো। হানিয়া আসতেই দুজনেই একসাথে বাসায় ফিরলো।

সেজাদ নিজেকে বুঝতে পারছে না। আজকাল হানিয়াকে দেখার জন্য ওর মনটা ছটফট করে সেই অস্থিরতায় থাকতে না পেরে ছুটে আসে ইউনিভার্সিটির সামনে কখনো হোস্টেলের সামনে ভাগ্যে থাকলে কখনো দেখা মেলে কখনো না। মাঝে মাঝে এই অপেক্ষা ওর বিরক্ত লাগে আবার কখনো মিষ্টি লাগে। এমন কেনো করে বুঝতে পারে না। আজ কয়েকদিন ধরে ভীষণ ব্যস্ত ভাগ্নের জন্ম নিজেরাই সব গুছিয়ে নিয়েছে। সায়েমের কথা মনে এখন কোনো কিছু করা হবে না, কোনো ডেকোরেশনের লোকজনও আসবে না ওরাই ড্রইংরুম গুছিয়ে নিবে। সাঈদের ইচ্ছে ছিল এবার দেশে গিয়ে বাবা-মা সাথে ছেলের জন্মদিন পালন করবে কিন্তু সময় সল্পতার কারণে হয়ে উঠলো না। শালী-শালারা পাত্তা দিচ্ছে না নিজেরা সব করছে।

তিলোত্তমা প্রেমকুঞ্জে বাড়িতে ঢুকতে লাইজুর সাথে দেখা হলো কুশল বিনিময় শেষে ওদের ফ্রেশ হতে বললো। রুম হিটার চালানো থাকায় হানিয়া একটু আরাম পেলো এতোক্ষণ ঠান্ডা জমে ছিল। আগে যে রুমটা ওকে দেওয়া হয়েছিল এবারও ঐ রুমটাতেই থাকতে দেওয়া হলো ওকে। ফ্রেশ হয়ে নিচে আসলো সন্ধ্যা গেছে।

নামাজ আদায় করে শাবনূর বেগম ড্রইংরুমে এসে তাসবী পাঠ করতে বসেছে। হানিয়া নিচে আসলো। ওর শরীরটা ভালো লাগছে না। কিন্তু আত্মীয়দের বাড়িতে এসে তো শুয়ে থাকা যায় না। জ্যাকেট টুপি পড়ে নিচে নামছিল তখনই হাঁচু দিতেই শাবনূর বেগম তাকিয়ে হানিয়াকে দেখলো। হানিয়া এসে নাক টানতে টানতে বলল

–“কেমন আছেন দাদুমণি?”

–“আমি তো আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। কিন্তু তোমার অবস্থা তো সুবিধাজনক মনে হইতাছে না। এই ক’দিনে ঠান্ডা লাগাই ফেলছো এখনো এই শীতের মেলা দিন থাকবো।”

–“আসলে আমি এখানকার ওয়েদারের সাথে মানিয়ে নিতে পারছি না। কোল্ড এলার্জি তো একটুতেই ঠান্ডা লেগে যায়।”

–“খাড়াই রইছ ক্যান বও।”

–“সোনিয়া আপু, সোহানকে দেখছি না।”

–“হেরা তো নিজেদের বাসায় জামাই রে লইয়া আইয়া পড়ব নে কখন।”

সুভানাও হানিয়ার পাশে এসে বসলো। দু’জনে ফিসফিস করে কথা বলছে। শাবনূর বেগম তাসবী পাঠ করতে করতে সেদিকে তাকাচ্ছে বার বার। এর মধ্যে সুভানার বাবা সেলিম এহসান আর তার বড় চাচা সাইফুল এহসান এসে উপস্থিত হলো সুভানা ওদের পরিচয় করিয়ে দিলো কুশলাদি বিনিময় করলো। সাইফুল এহসান বলল

–“মামনি মেডিসিন নিয়েছ? তোমাকে দেখেতো জ্বর আসবে মনে হচ্ছে।”

–“জি নিয়েছি আঙ্কেল। এখানকার ওয়েদারের সাথে একচুয়ালি আমি কোয়াপারেট করতে পারছি না।”

সেলিম এহসান বলল
–“আস্তে ধীরে সয়ে যাবে আমাদেরও তো প্রথম প্রথম অসুস্থতা লেগেই থাকতো।”

সেজাদ আর সায়েম এখনো অফিস থেকে ফিরে নি। লাইজু সকলের জন্য কফি কুকিজ নিয়ে আসলো। সকলে গল্প করতে করতে খাচ্ছে। সেলিম এহসান আর সুভানার ভালোবাসা আহ্লাদ দেখে হানিয়ার খুব ভালো লাগছে নিজের আর পাপার সাথে কাটানোর সময়ের কথা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তার মধ্যে লাইজুর ফোড়ন কেটে কথা বলা। ও উপভোগ ওদের পাঁচ জনের একসাথে পরিবারটাও কল্পনস করে ফেললো। ওদের পাঁচ জনের পরিবারের সঙ্গে একসাথে কাটানোর কম সময় পেয়েছিলো। হানিয়ার তখনকার কথা অতো মনে নেই। কফি খেয়ে হানিয়ার একটু শান্তি পেলো।

সায়েম আর সেজাদের সাথে হানিয়ার দেখা হলো ডিনারের সময়। সেজাদ কথা না বললেও সায়েম গল্পের ঝুড়ি খুলে বসলো। হানিয়া সেজাদকে বুঝতে পারে না ও সকলের সামনে ওর সাথে কথা বলে না অথচ সকলের অগোচরে নিজেই সেধে এসে কথা বলে। হানিয়া বিরবির করে বলল “শা*লা লুইচ্চা গিরগিটি”

হানিয়া রুমে এসে দেখলো নিশাদের ফোন এতো রাতে বাংলাদেশ থেকে ফোন দেখে ভ্রু কুঁচকে গেলো। এই বেয়াদবটা দরকার ছাড়া ফোন দেয় না। হানিয়া ফোন কানে ধরে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালো। আজ চন্দ্রপ্রভায় চারিদিকে আলোকিত আকাশে সবুজ রংয়ের অরোরার দেখা যাচ্ছে। হানিয়া আচমকা মনটা চনমনে হয়ে উঠলো। উৎফুল্ল হয়ে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো পাশের ছাদ বারান্দার রুম থেকে আলো এসে বারান্দায় পড়ছে।

সেজাদ বারান্দায় আসলো। পাশের বারান্দায় হানিয়াকে কারোর সাথে ফোনে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কী বলছে সেটা বোঝা বা শোনা যাচ্ছে না। চাঁদের আলোয় হানিয়ার সুমুখশ্রীটা বেশ লাগছে। বিরবির করে ‘চন্দ্রকন্যার’ বলেও আনমনে হাসলো। পরক্ষণে হাসি মুখ আঁধারে ডুবে গেলো এসব কিসের লক্ষ্মণ? এই মেয়েটার ওপরে কেনো এতো টান কাজ করছে? কেনো বার বার দেখতে ইচ্ছে করে? এটা কী ফল ইন লাভ? সেজাদ এহসান প্রেমের পড়েছে হানিয়া আহমেদের? তুষার বর্ষণে কেঁপে উঠল শীতে। হানিয়া দিকে তাকাতেই দেখো ও এদিকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেই রুমে ডুকে গেলো। সেজাদ ঠাই দাঁড়িয়ে রইল শীত ওকে কাবু করতে পারলো না! বুকের হৃদয় কম্পন টের পাচ্ছে।

❝চন্দ্রপ্রভায় তুষার বর্ষণে যুবকটি জানতে পারলো তার সর্বনাশ হয়ে গেছে। সর্বনাশের মূলকেন্দ্র বিন্দু চন্দ্রকন্যা!❞

সেজাদ রুমে ডুকে থম মেরে বেডে বসে রইলো। এই সর্বনাশের শেষ কোথায়?

দরজা ধাক্কানোর শব্দে সেজাদের ভাবনার সুতা কাটলো। দরজা খুলে শাবনূর বেগমকে দেখে ভড়কে গেলো। সচারাচর তিনি ওপরে আসে না সিঁড়ি ভাঙতে পারে না পা ব্যাথা করে।

–“দাদুমণি তুমি? এতো রাতে? কিছু হয়েছে?”

–“আয় তো আমার লগে…”

–“কোথায়?”

হানিয়া কম্ফোর্ট গায়ে দিয়ে শুয়ে আরাম করে ফোন দেখছে। দরজায় নক কেউ করতে। উঠলো দরজা খোলার উদ্দেশ্যে কিন্তু পরক্ষণে থেমে গেলো কে এসেছে সেজাদ না তো! রাত ও বেশ হয়েছে। হানিয়া বলল “কে??”

–“দরজা খোলো আমি”

শাবনূর বেগমের গলার স্বর শুনে স্বস্তি পেলো দরজা খুলে দিলো ওনার সাথে সেজাদকে দেখে অবাক হলো।

–“ঘুমাই গেছিলা না-কি?”

–“না না জেগেই ছিলাম। আপনারা এখন? কিছু বলবেন?”

–“হ কমু বইলাই তো আইছি। সুভানা যে পোলারে পছন্দ করে হেতির সম্পর্কে কও তো! কী করে? কোনহানে থাহে?”

হানিয়া অপ্রস্তুত হয়ে গেলো কী বলবে খুঁজে পেলো না সুভানা এসব সম্পর্কে বাড়ির লোকজনকে কিছু জানাতে নিষেধ করেছে। নিজেও বলবে না ওকেও বলতে দিবে না। কিন্তু চুপিচুপি ঠিকই প্রেম করে যাবে। শাবনূর বেগম বিছানার উপর বসলো সেজাদ, হানিয়া দাঁড়িয়ে আছে।

–“কী হইলো কিছু বলতাছ না ক্যান?”

–“সুভানার কাছে শুনুন ও-ই ভালো বলতে পারবে।”

–“হেই ছেমড়ি তো কিছু কয় না। তুমি তো সব জানোই বইলা ফেলো। পোলাডা কেমন? কোন বংশের? কী করে? খোঁজ নিয়া যদি দেখি পোলা ভালো তাইলে বিয়া হইব।”

হানিয়া সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলো কী করবে বা বলবে বুঝতে পারছে না। ভাবলো বলে দেই ভালো হলে মানলে বিয়ে হবে না হলে পালিয়ে যাবে।

–“ছেলে ভালোই। নাম জাকি করিম। ইউকে’তে EEE ইন্জিনিয়ারিং লাস্ট ইয়ার পড়ছে। ওর বাবা একজন এমপি।”

–“আর হেরা ক্যামনে পরিচয় হইছে?”

–“আমাদের স্কুলের সিনিয়র ছিল। কিন্তু ওরা কখনো নিজে থেকে কথা বলত না। তারপর আমার বড়ভাইয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রিত ছিল। তখন থেকেই ওদের নম্বর আদান-প্রদান কথা শুরু হয়।”

–“ছবি আছে? দেখাও”

হানিয়া ইনস্টাগ্রাম থেকে জাকির ছবি বের করে দেখালো।

–“পোলা তো দেখতে ভালোই। পোলার বাপের নম্বর আছে?”

–“নাই”

–“দাদুভাই দেখছোস পোলা খোঁজ লাগাই দেখ পোলা কেমন? মাইয়া বড় হইয়া গেছে। কোনো অঘটন ঘটানোর আগে মাইয়া বিয়া দিয়া দিতে হইবো”

হানিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল “কী অঘটন ঘটাবে? আপনার নাতনির ওপরে বিশ্বাস নাই?”

–“হ আছে। কিন্তু পোলাডা ফুসলাইয়া মাইয়াডার ক্ষতি কইরা দিলে।”

হানিয়া কিছু বলল না। শাবনূর বেগম গম্ভীর কণ্ঠে বলল “তোমারও কী কেউ আছে নাকি? কাউরে পছন্দ টছন্দ করো না-কি?”

–“কেনো?”

–“তোমাদের দুই বান্ধবীরে এক লগে বিয়া দিয়া দিতাম।”

–“ধন্যবাদ এতো উপকারের কোনো দরকার নাই।”

শাবনূর বেগম মুখমোচরালো বলল “চল দাদুভাই।”

সেজাদ বলল “তুমি যা-ও। আমি জাকি’র নম্বর নিয়ে আসছি।”

শাবনূর চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে কিছু না বলে চলে গেলো। হানিয়া একটু ভীতি হলো।

–“নম্বর দিন।”

ও নম্বর দিলো। নম্বর নেওয়ার পরও ও ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। কিছু বলার জন্য উসখুশ করছে কিন্তু বলতে পারছে না। সেজাদ নার্ভাস হাও ফানি! হানিয়া বিরক্ত হয়ে বলল
–“যাচ্ছেন না কেনো? মানছি আপনাদের বাসা তাই বলে সারারাত দাঁড়িয়ে থাকবেন না-কি?”

–“গুড নাইট। Have beautiful dreams about me. (আমাকে নিয়ে সুন্দর স্বপ্ন দেখুন)

–“ওকে…গুড নাইট”

হানিয়া না বুঝে কথাটা বললেও পরক্ষণে বুঝতে পেরে চোখ বড়বড় করে তাকালো সেজাদের দিকে। ওর হাসি দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সেজাদ চলে গেলেও ও ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল।

চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here