চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।২৮ পর্ব।। #তাসনিম_তামান্না

0
319

#চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।২৮ পর্ব।।
#তাসনিম_তামান্না

এতো কৃত্রিম আলোর মধ্যে হঠাৎ আলো চলে গেলো, কক্ষে অন্ধকারে বুদ হয়ে গেলো, তার মধ্যে কটমটিয়ে দরজা খুলে আবছা আলো এসে রুমে প্রবেশ করলো এক সুঠাম দেহের যুবক। তার পারফিউমের ঘ্রাণে কক্ষ বুদ হয়ে ম-ম করছে। মেয়েটা ভয় পেয়ে দেওয়ালের সাথে সিঁটিয়ে গেলো। এই ঘ্রাণটা ওর পরিচিত যুবকের মুখ দেখা যাচ্ছে না। মেয়ের নিকটে এসে দাঁড়িয়ে নিজের দু’হাতের মাঝে বন্দী করলো ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো মেয়েটার কমলালেবুর কোয়ার ন্যায় অধরের দিকে মেয়েটা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল “সেজাদ!… সেজাদ নাহ!”

সেজাদ তখন ঘোরের মাঝে থেকে মহনীয় কণ্ঠে বলল “হুঁশশ! আই কিস ইউ, হানিয়া!”

হানিয়ার বাঁধা দিলো না নিজেও ঘোরে চলে গেলো। অধরে অধরে সন্ধি ঘটলো। অধর সন্ধিক্ষণে যখন বুদ হয়ে ছিল তখনই নারী কণ্ঠে হানিয়া নাম ধরে কেউ একাধারে ডেকে যাচ্ছে। হানিয়া চোখ খুলে নিজের অবস্থান বুঝে নিতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিলো। ঝট করে উঠে বসে নিজের ঠোঁটে হাত দিলো আয়নার সামনে গিয়েও দেখলো নাহ ঠিক আছে। পরক্ষণে নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলো তার এমন বেহায়া স্বপ্নকে গালিও দিলো। কেউ জানলে কী হবে? সেজাদ এমন স্বপ্ন জানলে লজ্জায় মাথা কাটা যাবে।

সময় নিয়ে দরজা খুললো সুভানা ওকে ঠেলে বিরক্ত হয়ে সোফায় বসে বলল “তোকে ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। যা শরবত নিয়ে আয়।”

–“নিচ থেকে আসলি হাতে করে শরবত হাতে করে আনতি।”

–“ভেবেছিলাম তোকে আমার ছোট জা বানাবো। তুই তো দেখছি আমার ছোট জা হওয়ার যোগ্য না। বড় জার মুখে মুখে কথা বলস”

–“তোর দেবরকে আমি কেনো কোনো মেয়েই বিয়ে করবে না শালা একটা মিচকে শয়তান।”

–“এমনে বলিস না বেচারা একটু সহজসরল সাদাসিধা।”

–“ঐয়েএহ চুপ যা। বেচারা না ও দেখাই হাবলা কিন্তু ভিদভিদে শয়তান। আর বিয়ের আগে এতো দেবর দেবর করিস না।”

–“থাক আমার ভুল হয়েছে। যা ফ্রেশ হয়ে আয়। আপুরা সকাল সকাল চলে আসছে। নিচে বসে নাস্তা করছে।”

হানিয়া ফ্রেশ হয়ে দুজনের নিচে আসলো। সাঈদ শালা, শশুড়দের সাথে বসে আছে। ড্রইংরুমে একাংশ জুড়ে সবুজ, হলুদ, সোনালী রঙের বেলুন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। হানিয়া সেজাদকে দেখে স্বপ্নর কথা মনে পড়ে লজ্জায় মিয়িয়ে গেলো। সোহান একটা বেলুন উড়িয়ে খেলছিল হানিয়াকে দেখে ‘সুইটগার্ল’ বলে দৌড়ে এলো। সকলে কথা থামিয়ে ওদের দিকে তাকালো। সোহানকে কোলে নিয়ে গালে চুমু খেয়ে বলল “হ্যাপি বার্থডে, সুইটহার্ট।”

সোহান তুললিয়ে বলল “ত্যা ত্যাংকিউ। হাউ আর ইউ, সুইটগার্ল?”

–“ফাইন। এন্ড ইউ?”

–“ভেরি গুড আছি।”

সামনে দিকে তাকাতেই ওর হাসি উড়ে গেলো সকলে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে বিব্রতবোধ করলো। সুভানা বুঝতে পেরে বলল

–“জিজু এই যে আমার বান্ধবী তোমার আরেকটা শালিকা।”

–“হ্যালো, শালিকা বালিকা তালিকা।”

হানিয়া ভেবাচেকা খেয়ে হেসে কুশলাদি বিনিময় করলো। সেজাদকে এই প্রথম পরিবারের সাথে হেসে কথা বলতে দেখছে। আগে দেখে নি। লোকটা কী ওর সামনেই শুধু ভালোমানুষ হওয়ার চেষ্টা করে? ওরা নাস্তা করে। ডেকোরেশনের কাজে লেগে পড়লো। সায়েম সুভানা বেলুনগুলো সেট করছে। হানিয়া পাম্প দিয়ে বেলুন ফুলিয়ে গিট দিচ্ছে। আর ওর পাম্প করা বেলুন গুলো নিয়ে যাচ্ছে ছোট বার্থডে বয়। সে আজ ভিষণ খুশি। সেলিম এহসান আর সাইফুল এহসান বাইরে গেছে। সেজাদ আর সাঈদ কোনো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে ডিসকাশন চলছে। আর মহিলারা কিচেনে বিভিন্ন ধরনের খাবার বানাচ্ছে। ওদের দুজনের কথার মাঝে সেজাদ বার বার হানিয়ার দিকে তাকাতে দেখে সাঈদ চাপা কণ্ঠে ভ্রু নাচিয়ে বলল

–“শালাবাবু প্রেমে পিচলেছ না-কি!”

সেজাদ আমতা আমতা করে বলল “তেমন কিছু না।”

–“তা হানিয়া কি করা হচ্ছে?”

সেজাদ থতমত খেয়ে গেলো। হানিয়া বলল “বেলুন ফোলানো হচ্ছে।”

–“এদিকে একজনের মন ফাটিয়ে ফেললে!”

হানিয়া বুঝতে না পেরে বলল “এ্যাঁ!”

সেজাদ গম্ভীর কণ্ঠে বলল “সাঈদ ব্রো স্টপ দিস ননসেন্স।”

সাঈদ হেসে ফেললো। হানিয়া এদের কথার মানে কিছু বুঝতে পারলো না। সায়েম হানিয়াকে ডাকতে ও উঠে গেলো। শাবনূর বেগম এসে বসলো বলল “কী গো নাতজামাই হাসো ক্যান?”

–“সুইটি শালাবাবু তো পিচলে গেছে!”

–“ব্রো, স্টপ ইট!”

সেজাদ উঠে উপরে চলে গেলো। সাঈদ হেসে ফেললো। শাবনূর বেগম গম্ভীর হয়ে বলল “বিদেশিনী পছন্দ করল নাকি? এতোদিন বাংলাদেশে ঘটক লাগাই মাইয়া দেখাইলাম পছন্দ হইল না এই তার কারণ?”

সাঈদ ইশারায় হানিয়াকে দেখালো। শাবনূর বেগম হানিয়াকে দেখে বিরবির করে বলল “জানতাম এই মেয়ে রূপ দিয়া আমার নাতিকে পটাবো।”

বিকালের মধ্যে ড্রাইয়ংরুম সাজিয়ে ফেললো ওরা। ওদের থিম ‘জঙ্গল’ সবুজ রংয়ের গাছের পাতার রং তার মধ্যে বাঘ, হরিণ, সিংহসহ আরো বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর বেলুন। সকলে সবুজ রংয়ের ড্রেস পড়েছে। সোনিয়া, সাঈদ আর বার্থডে বয় সোহান পড়েছে গোল্ডেন কালারের ড্রেস। মেইন স্ট্রেজে ফটোসেশান করছে সবাই। হানিয়া ফোনে রুবার সাথে ম্যাসেজ করছে। প্রেগ্ন্যাসিতে মুড সুইং হচ্ছে তার দরুন হানিয়া নাহিদ ভাইকে জ্বালিয়ে মারছে। হানিয়াও মজা উড়াচ্ছে। শাবনূর বেগম এসে বলল
–“এখানে দাঁড়াইয়ে ফোন টিপতাছ ক্যান?”

–“আমার সবকিছুতেই আপনার সমস্যা হয় কেনো বলুন তো!”

–“তুমি ছেমরি এতো কথা কও ক্যান? তোমার নানীরে আজই কইব দাঁড়াও”

–“আপনি কি আমার সাথে ঝগড়া করতে আসছেন? তাহলে পরে আসুন এখন আমার মুড নাই”

–“তুমি…”

সাঈদ ডাকলো সকলকে এখনই কেক কাটা হবে। শাবনূর বেগম হানিয়াকে আর কিছু বলল না মুখ ভেংচি কেটে চলে গেলো। হানিয়া দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। এই মহিলার মতিগতি ও কিছু বুঝতে পারে না এই ভালো তো এই খারাপ। ইরাবতী বেগমকে বললে সেও জ্ঞান ঝাড়বে। সোহান কেক কেটে সবাইকে খাইয়ে দিলো। সবাই বিভিন্ন গিফট দিয়েছে। সোহান সেটাতে ভিষণ খুশি। এবারের জন্মদিনে ওর বেশি গাড়ি উঠেছে। হানিয়া বাচ্চাদের কার দিয়েছে, সেজাদ বাচ্চাদের বাইক, সায়েম সাইকেল, সুভানা ওর পছন্দের ভিডিও গেম দিয়েছে। আর বড়রা সোনা দিয়েছে। রাতের খাবার শেষে সোনিয়া বলল
–“ভাই ডিসেম্বর মাসে তো ক্রিসমাস মার্কেট হয় চল সবাই মিলে ঘুরে আসি।”

সাঈদ বলল
–“সারাদিন কাজ করে আবার এখন বেড়াতে যাবে? তোমরা মেয়েরা পারোও বটে।”

–“তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছি একবারও? তুমি কেনো কথা বলছ? আমি তো আমার ভাইকে বলছি।”

সাঈদ দু-হাত তুলে স্যালেন্ডার করার মতো করলো। যেনো বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সোনিয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলল
–“সবসময় তুমি এমন করো! না সময় দাও না কোথাও নিয়ে যা-ও।”

–“আচ্ছা সরি।”

–“সরি বলে বলে তুমি সাত বছর পার করে দিলে।”

সেজাদ বলল “আচ্ছা হয়েছে থাম তোরা। সাঈদ ভাই আর তুই গিয়ে ঘুরে আয়। সোহান থাক বাসায় ও ঘুমে ঢুলছে।”

–“নাহ, গেলে সবাই যাবো। হানিয়া তুমি গিয়েছ নাকি মেলায়?”

–“নাহ”

–“আজ যাবে রেডি হয়ে না-ও। সুভানা, সায়েম যা গোছা।”

অগত্যা ছোটরা সবাই গেলো। বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনে সোহান সবার আগে রেডি হয়ে সোফায় বসে ঘুমিয়ে পড়ছে। ওকে আর কেউ ডাকলো না মেলায় গিয়ে জাগানো যাবে তাকে। ছয়জন মিলে এক গাড়িতেই উঠলো। সকলে গল্প করছে হানিয়া আর সেজাদ চুপচাপ বসে আছে ওদের কথা শুনছে। সায়েম বলল
–“হানিয়া চুপ কেনো আজ? সেজাদ ব্রো’র বাতাস লাগছে না-কি!”

হানিয়া হকচকিয়ে গেল। সাঈদ হেসে বিরবির করে বলল “সেটা হতে বেশি আর টাইম নেই।”

হানিয়া বলল “না আসলে দেখছিলাম আমাকে চুপচাপ থাকলে কেমন দেখাই”

সুভানা বলল
–“তুই এটা আমার কাছে জিজ্ঞাসা করলেই পারতি। শোন, আমি তোকে বলছি তোকে চুপ থাকলে না লেজ ছাড়া বাঁদরের মতো লাগে”

–“আমি যদি বাঁদর হই তুইও বাঁদর। বাঁদরের ফ্রেন্ড নিশ্চয়ই কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ হয় না।”

সাঈদ অবাক হয়ে বলল “আরে বাস এদের তো দেখছি মুখ না বারুদ চললে আর ব্রেক করে না!”

সায়েম বলল “ব্রো ইউ নো ওদের কাছ থেকে আমি ও ভুলভাল শিখে ফেলছি।”

সুভানা তেতে উঠে বলল “ভুলভাল তোমাকে শিখতে বলছে কে?”

ওদের কথার মাঝে সেজাদ গাড়ি থামালো ওরা নেমে ভেতরে ঢুকলো। সেজাদ গাড়ি পার্কিং করে ওদের সাথে জয়েন্ট করলো। বছরের শেষ সময় শীতের প্রকোপ বেশি। বরফের আস্তরণ পড়ে আছে সবজায়গায়। কিন্তু তুষারপাত হচ্ছে না। রাত হলেও লোকজন সমাগম আছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে না তাদের শীত লাগছে সকলের পাতলা সোয়েটার পড়া। অথচ ও প্যাকেট হয়ে এসেছে। হানিয়া একটু সুস্থ হলেও ক্রিসমাস মেলায় এসে ঘুরে ঘুরে দেখছিল এটা ওটা কিনছিলো। পনেরো মিনিট যেতেই হাঁচি দিতে দিতে শহিদ হওয়ার জোগার হলো। সুভানাকে বলে মেলা থেকে বাইরে আসলো টিস্যু কিনে ডাস্টবাস্কেটের পাশে বেঞ্চে বরফ সরিয়ে বসলো। নাকমুখ মুছে বাস্কেটে ফেলছে।

–“এখানে বসে আছেন কেনো?”

সেজাদের কণ্ঠ শুনে হানিয়া না তাকিয়েই বলল
–“শখ করে বসে আছি। আপনার কোনো সমস্যা?”

–“সমস্যা আপনার হচ্ছে। এটা নিন খেলে ভালো লাগবে।”

হানিয়া এবার তাকালে সেজাদ ওর দিকে হট কফির অন-টাইম পট এগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও না করলো না নিয়ে নিলো এটারই দরকার ছিল। বলল
–“থ্যাংক্স”

–“গাড়িতে গিয়ে বসতে পারেন এখানে বেশ ঠান্ডা”

–“ঠিক আছি”

বলতে না বলতে আবারও হাঁচি দিলো। সেজাদ অন্য দিকে তাকিয়ে কটাক্ষ করে বলল “হাহ্! ঠিক আছে।”

ওর কটাক্ষতে হানিয়ার জেদ চাপ কফিটাও খেলো না ওখানে রেখে রেগে বলল “আপনার কফি আপনি খান। এতো দরদ কে দেখাতে বলেছে আপনাকে?”

সেজাদ শান্ত কণ্ঠে বলল “আমার ওপরে জেদ করে নিজের ক্ষতি করবেন না।”

হানিয়া কিছু বলল না চলে গেলো মেলার ভিতরে। সেজাদ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বিরবির করে বলল “যার জন্য করো চুরি সে-ই বলে চোর! ওয়াও গ্রেট!”

চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here