#চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।৩৭ পর্ব।।
#তাসনিম_তামান্না
ইরাবতী বেগম সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সেজাদকে হামজার সাথে ওর রুমে পাঠিয়ে দিলো। হামজা ব্যাগ রেখে বলল “আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। আমার ড্রেস তো আপনার হবে না মামারটা এনে দিচ্ছি।”
সেজাদ কিছু বলল না তার ভিষণ অস্বস্তি হচ্ছে। এভাবে কখনো কারোর বাসায় থাকা হয় নি। এমনকি লাইজুর বাবার বাড়িতে রাতে থাকে নি কখনো। হামজা ড্রেস এনে দিলো ও ফ্রেশ হয়ে এলে হামজা ফ্রেশ হতে গেলো। ইফাজ এসে দরজা খুলে উঁকি দিলো। সেজাদ দেখতে পেয়ে হাতের ইশারায় ডাকলো। ইফাজ হাতে থাকা নাস্তার ট্রেটা রেখে বলল “আপনার কিছু লাগবে, ভাইয়া?”
–“এখনো পর্যন্ত কিছু লাগবে না লাগলে জানাব। তোমার নাম কী?”
–“ইফাজ। ক্লাস সেভেনে পড়ি। রোল বারো। আর কিছু?”
–“বাহ্! তুমি তো দেখছি ইনটেলিজেন্ট। না বলতেই বুঝে যাও”
ইফাজ টিশার্টের কলোয়ারটা ঠেলে ভাব নিয়ে বলল “আই নোউ!”
হামজা মুখ মুছতে মুছতে বলল “ওর চাপাবাজীতে পটবেন না ভাইয়া। ও কিন্তু চাপাবাজ”
ইফাজ রেগে ভ্রু কুঁচকে তেড়েফুঁরে এসে হামজার পিটে দুম করে কিল বসিয়ে বলল “আমার পেজটিস পাঙ্কচার করে আবার আমার নামে বদনাম করছিস?”
হামজা রেগেমেগে ওর টি-শার্ট চেপে ধরে বলল
–“ঐ বড় ভাইয়ের গায়ে হাত দেস? চিনোস আমারে? আমার বোনে কিন্তু আমারে ক্যারাটে শিখাইছে আমি একটা আছাড় মারলে উঠতে পারবি তো?”
সেজাদ ভড়কে গেলো ওদের দু’জনকে আলাদা করে বলল “তোমরা ঝগড়া করছ কেনো? এটা কিন্তু খুবই খারাপ।”
–“ওরে বুঝান ভাইয়া। আসেন ওনি ছোট চুনোপুঁটি হয়ে আমারে মারতে। হাহ্!”
সেজাদ হেসে ফেললো বলল “দিস ইজ নট ফেয়ার ইফাজ। ইটস ভেরি ব্যাড”
ইফাজ মন খারাপ করে বেডে বসে দু-হাত বুকে বেঁধে বলল “সবসময় সবাই ভাইয়াকে সাপোর্ট করে আমাকে কেউ ভালো বলে না। আমি ও ক্যারাটে ক্লাসে ভর্তি হতো। কালই আপি আর চাচুকে বলবো। আম্মুর কথা শুনব না।”
–“যা পারিস কর গা। মর গা তু”
———————–
হানিয়া হায়াতের রুমে ডুকে দেখলো রুম ফাঁকা। বারান্দায় গিয়ে হায়াতকে পেলো। চুপচাপ দুপা জড়িয়ে ধরে বসে আছে। ওর পাশে বসে বলল “এনিথিংক রং হায়াত?”
উত্তর আসলো না। ও জড়িয়ে ধরল হায়াতকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল “আপসেট কেনো? বল আমাকে। আমি তো সব কথা বুঝতে পারি না সোনা। না বললে বুঝব কীভাবে?”
হায়াত তবুও উত্তর দিলো না। হানিয়া চুপ থেকে বলল “নিশাদ কিছু বলেছে তোকে? বল আমাকে ওর কী করি দেখিস আমার বিড়ালছানা বোনকে কষ্ট দেওয়া ওর বের করছি…”
হায়াত ওকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো বলল “আ’ম লুজার আপি। তোমার বোন খুব খারাপ। সে তোমাকে শুধু শুধু কষ্ট দেয়। আমি খুব খারাপ আমি তোমার বোন হওয়ার যোগ্য না।”
–“চুপ কী হয়েছে বল আমাকে…”
হায়াত কিছু বলতে পারলো না ওকে ছেড়ে দিয়ে কাচুমাচু করে কাগজটা বাড়িয়ে দিলো। হানিয়া সবটা দেখে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল “কখন? কবে? যেতে হবে?”
হায়াত চুপ থেকে বলল “কাল-ই!”
–“হ্যাঁ তো যাবো এটাতে এতো মন খারাপ, কান্নাকাটি করার কী আছে?”
–“আপি ওরা আমাকে এক্সামে বসতে দিবে না। টেস্টে ফেইল করা মানে এ বছর লস। আমার এক্সাম দেওয়া হবে না আপি। তুই ওখানে গেলে ওরা তোকে বাজে কথা বলবে আমার জন্য তুই বাজে কথা শুনবি আমি আমি কিছুতেই মানতে পারব না…”
–“উফফ্! এতো বুঝতে হবে না তোকে। আর তোর কোনো ইয়ার লস যাবে না। আমি জানি সেদিন এক্সামটাই তুই অসুস্থ ছিলি। এবার কিন্তু বোর্ড এক্সামে ভালো করতে হবে। পারবি তো?”
হায়াত ওকে জড়িয়ে ধরে বলল “পারব, খুব পারব। সবটা দিয়ে চেস্টা করবো। ভালোবাসি আপি।”
হানিয়া ওর কপালে চুমু খেয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। ওর ভিষণ কষ্ট হচ্ছে সেই আবারো অপ্রিয় কথাগুলো শুনতে হবে। শুনতে হবে “তুমি বাচ্চা মেয়ে হয়ে আরো দু’টো বাচ্চাকে কীভাবে সামলাবে? বাবা-মা না থাকলে তো বাচ্চারা বিগড়ে যাবে।” ইত্যাদি ইত্যাদি। ও এগুলো ভাবতে পারলো না। ওকে ছেড়ে দিয়ে বলল “উঠে ফ্রেশ হয়ে নে আমি আছি তো! আর বাসায় গেস্ট এসেছে এভাবে থাকলে তাদের সাথে কথা না বললে তারা তোকে অহংকারী বলবে।”
——————-
রাতের খাবার খেতে বসলো। সালেহা অনেক আইটেম সুস্বাদু খাবার রান্না করেছে। ইমন আর ইজাজের সাথে সেজাদ আর শাবনূর বেগমের দেখা হলো খাবার টেবিলে। চোখমুখে তার মলিনতা ছেয়ে আছে। হাসি মুখে কুশলাদি বিনিময় করলে। এতোদিন পর হানিয়াকে এবাড়িতে দেখে কেউ কোনো কথা বলল না শুধু চোখাচোখি হতেই হানিয়া ভেংচি কাটলো। ইমন নিজের মতো খেয়ে উঠে গেলো। একে একে সকলে উঠে গেলো হানিয়া বসে রইল। সালেহাকে বলল “তোমার দেবরের ভাবটা দেখছ? আমাকে মারলো। একবার সরিও বলল না। ক’দিন পরে চলে যাবো আর আসব না। তখন দেখিও তোমার দেবর ভাব কাকে দেখায়।”
সালেহা বিরক্তি নিয়ে বলল “তোদের এসব ঝগড়াঝাটিতে আমাকে কিছু বলবি না। নিজেরা ঝগড়াঝাটি করবে আবার মিলে যাবে আর আমরা আঁটি হয়ে গড়াগড়ি দিব।”
–“আমি কথা বলব না তোমার দেবরের সাথে দেখে নিও। ও যতক্ষণ না রুহিদের বাড়ি যেতে রাজি হচ্ছে।”
ইমন ওখানে ছিল হানিয়া ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছিল সালেহা সেটা বুঝতে পারি নি। ইমন বলল “ভাবি বলে দাও কারোর সাথে কথা বলার জন্য তোমার দেবর বসে নেই। আমার লাইফ আমাকে বুঝতে দাও।”
–“ওকে। যার যার লাইফ তার তার তাই তো! ফাইন এরপর আমি যেগুলো করব তোমরা কেউ আটকাতে আসবে না। কেননা লাইফটা আমার আর আমি যা খুশি করবো।”
সালেহা হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো বলল “কী সব শুরু করলি তোরা? বাচ্চা তোরা এখনো?”
–“শুরু তোমার দেবর করছে। নিজেকে সবার থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। তাকে চুরি আর শাড়ি পড়ে আঁচলে মুখ লুকিয়ে বসে থাকতে বলো।”
–“এবার কিন্তু বেশি বেশি হচ্ছে। আরো দু’চারটা খেতে না চাইলে চুপ হয়ে যা।”
–“যার যার মুখ তার তার। বাক স্বাধীনতা বলেও একটা কথা আছে। কেউ আমাকে দমাতে পারবে না। কেউ যদি অন্যায় না করে লুকিয়ে থাকতে চাই আর যারা অন্যায় করেও বুক ফুলিয়ে সমাজে চলে তাদের দুই কোয়ালিটির লোকজনকে কী বলে মাম?”
ইমনের রাগে লাগলো হানিয়ার গালে আবারও চড় পড়লো। সালেহা ধমকে উঠলো “ইমন কী হচ্ছে এগুলো?” হানিয়ার চোখজোড়া টলমল করে উঠলো। হানিয়া চলে গেলো রুমে। সে তো কোনো খারাপ কথা বলছ না। শুধু ইমনকে আবার আগের মতো করে ফিরে পেতে চাইছে। সেটার জন্য মার খেতে হচ্ছে বার বার। আর কিছু বলবে না।
——————
দোলা একটু-আধটু হাঁটাচলা করছে। বাচ্চাকে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। প্রথমবার মা হয়েছে এসব কাজে আনাড়ি। রৌদ্দুর সবসময় মেয়েকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করছে। মেয়েকে বুকে নিলে শান্তি খুঁজে পাই। দোলা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে শুধু এই মানুষের পরিবর্তন মানতে কষ্ট হচ্ছে এইলোকটা ভালো হয়ে যাচ্ছে। মনের কোণে সন্দেহরা দানা বাঁধে আদেও কী ভালো হয়েছে না-কি সব কিছু ছল। রৌদ্দুর বলল “কী হলো ঘুমাচ্ছ না কেনো?”
–“আব্বু বলছিল কাল হানিয়ার জন্মদিন একটা উইশ তো করতে পারি।”
রৌদ্দুর বলল “কাল উইশ করো আজ ওকে ফোনে পাবে না। রাত বারোটায় এতো উইশ পাই যে ওর ফোন অফ করে রাখে।”
–“তুমি কীভাবে জানো?”
–“বাবাকে দেখেছি। ওকে ফোনে না পেয়ে উইশ করার জন্য ওবাড়ি চলে যেতে কেক নিয়ে।”
–“ওরা এবাড়িতে কেনো থাকে না?”
–“ওদের ইচ্ছে হলে আসে এবাড়িতে থাকে আবার চলে যায়। মূলত আমার জন্য থাকে না ওদেরকে সহ্য করতে পারি না। বুঝে হয়ত! বাবাও কিছু বলে না।”
–“তুমি কখনো উইশ করো নি?”
–“উহুম!”
–“কেনো? বড়ভাই হও তুমি। তোমার থেকে এইটুকু আশা করতেই পারে।…
রৌদ্দুর কিছু বলল না চুপ করে রইল। দোলা আবারও বলল “আচ্ছা, তুমি ছেলে হিসেবে দায়িত্ব পালন করো না। ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করো না। স্বামী হিসাবে স্ত্রীকে শিকার করো না। আর বাবা হিসেবে সন্তানকে নষ্ট করে দিতে বলো। আর এখন হুট করে ভালো হয়ে গেলে? আবার তোমার প্রতি সন্দেহ হয়। তুমি আদেও ভালো হয়েছ না-কি সবটা অভিনয়।”
রৌদ্দুর চুপ করে থাকলো। দোলা উত্তরের আশায় থাকলো না পাশ ফিরে শুলো চোখ দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। রৌদ্দুর বলল “আমার তখন সাত বছর। ছোট চাচার একটা মেয়ে হয়। সকলে খুব খুশি আমিও খুশি ছিলাম আমার একটা বোন আসবে। কিন্তু সবাইকে যখন দেখলাম ওকে বেশি বেশি আদর করে গিফট কিনে দেয়। এমনকি আমার বাবাও তখন আমার মন খারাপ হতো হিংসা হতো। খালামণি ডিভোর্স হয়ে তখন থেকে আমাদের বাসায় থাকে। আমাকে বলল তোমার সব আদর ভালোবাসা, বাবা সব ঐ মেয়েটা নিয়ে নিচ্ছে। সেই থেকে মানতাম ও আমার শত্রু। সুযোগ পেলে ঠাস ঠাস করে মেরে কাঁদিয়ে চলে যেতাম। ও বড় হতে লাগল বাবাকে দেখতাম প্রতিদিন আশার সময় কিছু না কিছু আনতো আমাদের দুজনের জন্য কিন্তু আমার এই ওর জন্য জিনিস পত্র আনা পছন্দ হতো না। চাচ্চুর আরো দুটা বেবি হলো সবাইকে দেখতাম তাদের নিয়ে ব্যস্ত চাচি মারা যাওয়ায় তাদের প্রতি আলাদা দরদ আমার ভালো লাগে না। মধু একদিন ভাইয়া ভাইয়া করে ছুটে আসে আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দি। ও ব্যথা পেয়ে কান্নাজুড়ে দিলো। বাবা সেটা দেখতে পেয়ে আমাকে ভিষণ বকা দিল। আমার রাগ জেদ গিয়ে পড়ল ওর ওপরে। খালামণি আমাকে বলল আমার বাবাকে ও কেড়ে নিয়েছে। একদিন আমি ওকে খুব মারলাম। ওর জ্বর হলো গায়ে মারের দাগ লাল লাল ফুটে উঠছে। বাবা আমাকে মারলো সাথে মা-ও আমাকে বকলো। চাচ্চু আমাকে বকলো না। শুধু বলল ‘ভাইবোনরা কী তোমাকে খুব জ্বালায়? এবার থেকে জ্বালালে আমাকে বলবে। এভাবে মারবে না। ওরা আমার কলিজার টুকরা ওদের কিছু হলে আমি ব্যথা পাই ভিষণ কষ্ট হয়।’ আমি ও সেদিন ভিষণ ভয় পেয়েছিলাম মধুর অবস্থা দেখে। বাবা আমাকে বোডিংয়ে পাঠিয়ে দিলো। আরো রাগ লাগলো। বাসায় আসলে ওদের তিনজনকে বকাবকি করতাম দু’চারটা মারতাম ওরা কাউকে কিছু বলত না। মনে মনে ভাবতো এই ভাইয়াটা ভিষণ খারাপ। তারপর আমি মিডিয়াতে ব্যস্ত হয়ে যায়। সফল হই। মেয়েরা আমাকে ব্যবহার করে উপরে উঠতে চাই আমি ও বাঁধা দি না মজা নিতাম। তারপর হঠাৎ একদিন বাবা বলল হানিয়ার সাথে বিয়ে দিবে চাচু রাজী না। চাচু মারা যাওয়ার পর বাবা হানিয়াকে বিয়ের কথা বললে ও রিজেক্ট করে সেটা শুনে আমার রাগ উঠে। মনে মনে চ্যালেঞ্জ নি বিয়ে করে সব শাস্তি দিব। ও রাজি হয় না। তারপর তুমি আসো। গেম খেলছি। কিন্তু মায়ায় পড়ে গেছি। সেটা থেকে কখনো বের হতে চাই না”
দোলা ওর দিকে ফিরে তাকালো বলল “একটা কথা বলি? আমি কিন্তু তোমার মনে খারাপ কিছু ঢোকাতে চাইছি না। শুধু… ”
রৌদ্দুর বিরক্তি সূচক শব্দ করে বলল “কী বলতে চাও বলো।”
–“তোমার খালামণি আসলে আমার মনে হয় ওনি তোমার মনে খারাপটা ডুকিয়ে দিয়েছে।”
–“হ্যাঁ আমি জানি। কিন্তু এতোগুলো বছর পর বুঝতে পেরেছি। খালামনি চাচুকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু চাচু রাজি হয় নি তাই আমাকে দিয়ে ওদের ওপরে রাগ মেটাতো। তোমাকেও খালামণি সহ্য করতে পারে না তোমাকে বকে!”
চলবে ইনশাআল্লাহ