#চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।৪৭ পর্ব।।
#তাসনিম_তামান্না
নতুন দিন। নতুন পরিবেশ। সূর্যের আলো জানালার পর্দা ভেদ করে হানিয়ার চোখে মুখে লাগছে। সেজাদের ঘুম থেকে উঠে হানিয়ার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ভেজা চুলে বিলিকেটে দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল “থ্যাংকিউ, আ’ম প্রাউড অফ ইউ, জান।”
হানিয়া নড়েচড়ে পিটপিট করে চোখ খুলে সেজাদকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জা পেয়ে গেলো। সরে গিয়ে ব্ল্যাংকেট দিয়ে নিজেকে মুড়িয়ে নিলো। সেজাদ শব্দ করে হেসে দিয়ে বলল “তুমি যে এতো রোমান্টিক আগে জানতাম না তো!”
হানিয়া ওভাবেই বলল “আগে কী আপনি আমার বর ছিলেন?”
সেজাদ হেসে ওকে কম্বলসহ টেনে এনে পেটে হাত বুলিয়ে বলল “বেশি কষ্ট হচ্ছে? মেডিসিন তো দিয়েছি ঠিক হয়ে যাবে।”
হানিয়া লজ্জায় মাথা কাটা গেলো তেঁতে উঠে বলল “সাট আপ, সেজাদ। তুমি খুব শয়তান। আমাকে লজ্জা দিচ্ছ।”
সেজাদ হেসে নিজেও ব্লাংকেটের নিচে গিয়ে এলোপাথারি চুমু খেলো হানিয়া ওকে দূরে সরানোর চেষ্টা করে বলল “সরুন মাথা ফাটিয়ে দিব কিন্তু।”
তখনি দরজায় নক করলো সোহান তার ছোট ছোট হাত দিয়ে দরজায় থাপ্পড় মেরে বলল “মামাই, ওপেন দ্যা ডোর। আমি সুইটগার্লের কাছে যাবো।”
সুভানা ওকে শিখিয়ে দিলো বলল “বল মামাই তোমাদের কী এখনও বাসর শেষ হয় নি?”
সোহান অবুঝের মতো বলল “মামাই তোমাদের এখনো বাতর শেত হয় নি?”
হানিয়া সেজাদ দু’জন দু’জনর দিকে তাকিয়ে ছিটকে দূরে সরে গেলো। হানিয়া একটা কম্ফোর্ট থ্রি-পিস পড়ছিল সেটা টেনেটুনে ঠিক করলো। সেজাদ টি-শার্ট পড়ে দরজা খুলে দিলো। সুভানার দিকে তাকিয়ে বলল “ফাজিল হয়েছিস। এসব কী শেখাচ্ছি ওকে।”
সুভানা হেসে বলল “যা সত্যি তা-ই তো শেখাচ্ছি।”
–“এক থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দিব।”
ওরা রুমে ডুকলো। সেজাদ ওয়াসরুমে চলে গেলো। সুভানা হানিয়াকে জহুরির চোখ দিয়ে দেখে ভ্রু নাচিয়ে বলল “ফাস্ট নাইট কেমন কাটলো?”
হানিয়া এড়িয়ে গিয়ে বলল “টায়ার্ড ছিলাম ঘুমিয়েছি। সুইটহার্ট, তুমি বললে আমার সাথে থাকবে। ঘুমিয়ে পড়ছিলে কেনো?”
–“ঘুমু এসে গিয়ে ছিলো, সুইটগার্ল। আজকে তোমার সাথে থাকব।”
সুভানা ওর চুল টেনে বলল “মিথ্যাটাও ঠিক মতো বলতে পারিস না প্রমাণ রেখে দিস।”
–“শুন বেশি পাকনামি করবি না। ভাবি হয়েছি তোর রেসপেক্ট দিয়ে কথা বলবি।”
–“তুই এখন ভাবিগিরি দেখাবি?”
–“হ্যাঁ, ভাবিরা সংসারে ননদকে সহ্য করতে পারে না। তাই আমি ও আজ থেকে তোকে তাড়ানোর কলকাঠি নাড়তে শুরু করে দিবো।”
–“পাড়ার কাকিমাদের মতো কুটনীনামি করবি? এতো খারাপ তুই? আগে জানলে আমার ভাইকে তোর সাথে বিয়ে দিতাম না।”
–“সর আমার ও ঠেকা পড়ে নি তোর ভাইকে বিয়ে করার।”
–“ঠেকা পড়ে নি তাই বাসর সেরে ফেলছ।”
সেজাদ ওয়াসরুম থেকে মুখ মুছতে মুছতে বের হলো। হানিয়া বলল “শুনুন আপনার বোনকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করবেন কবে? আমাকে দেখে তার বিয়ে করার শখ জাগছে।”
সুভানা মুখ কাঁদো কাঁদো করে বলল “বিশ্বাস করো ভাইয়া আমি কিছু বলে নি ওসব বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলছে।”
–“আমি মিথ্যা বলি না।”
–“হ্যাঁ তো, তুমি সত্যবাদী যুধিষ্ঠি!”
সোহান ওদের কথা শুনছে নতুন নতুন শব্দ শিখছে সেই বলে উঠলো। “জুতিস্টি, টেকা, বাতর…”
সেজাদ ওকে কোলে তুলে বলল “এসব কী বলছ মামাই?”
–“খালামুণি, সুইটগার্ল এসব বুলে। আমি শিখে নিয়েছি।”
সেজাদ ওদের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না সোহানকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। সুভানা শব্দ করে হেসে উঠলো। হানিয়া বলল “সবাই ঘুম থেকে উঠে গেছে?”
–“হ্যাঁ তোদের মতো তো কাল আর কারোর বাসর ছিল না।”
–“কথায় কথায় বাসর টানছিস কেনো? কান জ্বালানি চড় খাবি কিন্তু।
–“ওও আর আমি বসে বসে চড় খাবো? আমার ও হাত আছে আমিও মেরে দিব।”
–“তোর মা’কে গিয়ে বলছি দাড়া সব পাকনামি বের হয়ে যাবে।”
হানিয়া ফ্রেশ হয়ে নিচে আসলো তখন নয়টার বেশি বাজে। লাইজু আর সোনিয়া কিচেনে ব্রেকফাস্ট তৈরি করছে। হানিয়া গিয়ে বলল “কী কী করছেন আপনারা? আমি কী করবো?”
লাইজু বলল
–“তুমি নিউ বউ তুমি বসে বসে দেখো। বাড়িতে গিয়ে তুমি সব কাজ করবা আর আমি সিরিয়াল দেখবো।”
সোনিয়া বলল “মামণি শাশুড়ি হিসাবে তুমি খুব ডেঞ্জারাস হবা দেখছি।”
হানিয়া হেসে বলল
–“শাশুড়িরা এমন ডেঞ্জারাস না হলে ঝগড়া জমবে না তো! তাই না আন্টি?”
লাইজু রেগে গেলো হঠাৎ ধমকে বলল “তোমার আন্টি কে?”
–“মানে আপনিই তো!”
–“আমি তোমার আন্টি?”
–“না না আপনি আমার পিয়ারা শাশুমা।”
শাবনূর বেগম তার ঘরের সামনে দাড়িয়ে বলল “এই মেয়ে আমার ঘরে আহো তো।”
হানিয়া ওনার কথা পাত্তা না দিয়ে বলল “রুটি, পরোটার সাথে তারকারি কী?”
–“এই মেয়ে আমি তোমাকে ডাকতেছি না? শুনতে পাও না না-কি?”
সোনিয়া বলল “হানিয়া তোমাকে ডাকছে যাও শুনে এসো”
–“ওনি আমাকে ডাকছে? আমার তো একটা নাম আছে আপু। সবাই সেটা বলেই ডাকে। ওনার উচিত এই মেয়ে, এই ছেমরি না ডেকে আমার নাম ধরে ডাকা, তাহলে আমার বুঝতে সুবিধা হয়।”
শাবনূর বেগম সুর টেনে বলল “আমোলো যা কী এই মেয়ে ডাকছি তো কী হইছে? ঢং!”
ওনি মুখ ভেংচি কেটে চলে গেলো। হানিয়া প্রতিত্তোর করল না। লাইজু বলল “শুনো বউ, আমার শাশুমা একটু ঝগরুটে ওনাকে এমনেই মেনে নিতে হবে। এতো বছরেও ওনি বদলান নি।”
সোনিয়া বলল “দাদুমণির কথায় কষ্ট পেয়ো না হানিয়া। একটু মানিয়ে নিও।”
হানিয়া কিছু বলল না চুপচাপ কিছুক্ষণ সেখানে থেকে রুমে চলে গেলো। সেদিন রাতে…
~ফ্ল্যাসব্যাক~
সেদিন রাতে শাবনূর বেগমের কথা শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে ছিলো। ওনিও বুঝতে পেরেছিলেন হানিয়া শুনতে চাইছে বিয়েটা কেনো হলো? ওর হাত টেনে ওনার রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে দিল। হানিয়া মনে মনে ছটফটানি বাড়তে লাগলো কী বলবে ভেবে? না পেরে বলল “কী বলতে চান? তাড়াতাড়ি বলুন।”
–“আমার কথা শেষ পর্যন্ত শুনবে। তুমি জানো? সেজাদের মা তাদেরকে ছেড়ে অন্য জায়গায় বিয়ে করেছে?”
হানিয়া আকাশ থেকে পড়লো। ও জানতো মারা গেছে নিজে নিজে বুঝে নিয়েছিল। সুভানাও এব্যাপারে কিছু বলে নি। ও বলল “মানে?”
–“সেজাদের বাবা ও মায়ের প্রেমের বিয়ে। সব ভালোই যাচ্ছিল। সাইফুল চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করলো। ব্যবসায় প্রথমে প্রচুর লাভ হতো। ওদের মা চেরিও প্রচুর অপচয় করত। সোনিয়া হলো। সেজাদ হলো। ওদের যাতে কষ্ট না হয় সে জন্য দিনরাত খাটতো। ব্যবসায় পর পর তিন বছর লস খেলো। পুরোপুরি হাত ফাঁকা করে বসে পড়লো। আবারও চাকরি খুঁজতে শুরু করলো। কিন্তু চেরির আর ধৈর্য্য ধরে না তার মানিয়ে নিতে পারছে না। ওর বাবা-মা’র সাইফুলকে এমনিতেই পছন্দ ছিল না কারণ পেয়ে ওরাও চেরিকে সব ছেড়ে আসতে বলল। চেরি সেজাদ, সোনিয়াকে ছেড়ে যেতে নারাজ ওর বাবা-মা কী সব বোঝালো একবছরে মধ্যে ডিভোর্স হলো। ছেলেমেয়েদের নিতে চাইলেও সাইফুল দিলো না চেরিও জোর করলো না উটকো ঝামেলা কে পোহাতে চাই? মা চলে যাওয়ায় সেজাদ, সোনিয়াও শান্ত বাচ্চা হয়ে গেলো। আস্তে আস্তে বুঝতে শিখলো বাস্তবতা। চেরি ওদের সাথে দেখা করতে আসলে প্রথম প্রথম দেখা করলেও পরে দেখা না করার জন্য জেদ ধরতো। মা’কে ঘৃণা করতে শুরু করলো। সেজাদ সেই থেকে মা’কে ঘৃণা করে। বিয়ে করতে ভয় পাই আমি আগেও ওর জন্য মেয়ে দেখেছি। ওর মতে ওর ভাগ্যটা যদি ওর বাবার মতো হয়। যেখানে মা ছেড়ে চলে গিয়েছে বউ যেতে কতক্ষণ? মায়ের মতো বিশ্বাস্ত কেউ নেই সেই মা’কেই বিশ্বাস করতে পারল না কখনো।”
–“বুঝলাম, কিন্তু এসবের মধ্যে আমাকে কেনো টানলেন? আমিই কেনো? পৃথিবীতে কী মেয়ের অভাব পড়েছিল?”
–“মেয়ের অভাব নয়। দায়িত্বশীল, বিশ্বস্ত সঙ্গীর বড় অভাব। তোমার মধ্যে আমি সেগুলো দেখেছি। তুমি তোমার বাবা-মা’র অবর্তমানে ভাইবোনকে যেভাবে আগলে রেখেছ। তোমার ব্যপারে তোমার নানু অনেক গর্ব করে বলে। তখনই আমার মনে হলো তোমার মতো কাউকেই সেজাদের জীবনে দরকার। যে ওকে আগলে রাখবে। ভালোবাসবে।”
–“ওহ, বাহ! যেই শুনলেন আমি বিয়েতে না করে দিয়েছি সেই এমন একটা প্লান করলেন?”
–“শুনো ছেমরি, আমার নাতি খারাপ না। সে অনেক ভালো তুমি সুখে থাকবে। তাছাড়াও ওখানে তুমি হোস্টেলে একা থাকো। বিপদ-আপদে তো আমাদেরকে কিছু জানাও না। তোমার নানুও টেনশন করে একা একা কী করো না করো কি খাও। তোমার জীবনের কিছু পাল্টাবে না তুমি যেভাবে চলতে সেভাবেই চলবে আমি জানি সেজাদ তোমাকে বাঁধা দিবে না।”
–“আমি এসব নিতে পারছি না। আমার লাইফ আর সব কিছু আপনারা ঘটাচ্ছেন। আমার সব কিছু ভাবার জন্য সময় লাগবে।”
হানিয়া রুম থেকে বের হয়ে। কিছুক্ষণ ভেবে লাগেজ গুছিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো।
ফ্ল্যাসব্যাক ইনড
চলবে ইনশাআল্লাহ