#চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।৪৮ পর্ব/অন্তিমপাতা।।
#তাসনিম_তামান্না
দেশ ছেড়ে যাবার সময় ঘনিয়ে এসেছে। আজ সন্ধ্যায় ফ্লাইট সবাই গোছগাছ শুরু করে দিয়েছে। হানিয়া সকাল সকাল কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে গেছে। সেজাদ ঘুম থেকে উঠে ওকে পাই নি। ভেবেছে নিচে আছে। কিন্তু ব্রেকফাস্টের টেবিলে দেখতে না পেয়ে সকলে সেজাদকে প্রশ্ন করলো। ও উত্তর দিতে পারলো। ফোন দিলে ফোন অফ দেখাচ্ছে। ও বাড়িতে শুনলো সে আছে কিনা। তারাও খোজ দিতে পারলো না। সেজাদের খাওয়া হলো না উঠে গেলো। এই ক’দিনে হানিয়া এভাবে না বলে হঠাৎ উধাও হয়ে যায় নি। তাও আজ আবার সন্ধ্যায় ফ্লাইট। এই শীতেও সেজাদ টেনশনে দরদর করে ঘেমে উঠলো। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলো হানিয়া ফিরল না। অনেকদিন পর ওর ভীষণ কান্না পাচ্ছে মা চলে গেলে প্রায় কাঁদত আবারও কান্না পাচ্ছে চোখগুলো লাল হয়ে আছে। হানিয়া ওকে সুখের ঠিকানা দেখিয়ে পালিয়ে গেলো? কেনো এমন করলো সে? সবাই টেনশনে শেষ। সোনিয়ার তার ভাইয়ের এমন অবস্থা দেখে কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না। কতটা ভালোবাসলে, কতটা কষ্ট পেলে ছেলে মানুষ কাঁদে?
–“ভাই তুই মন খারাপ করিস না। ও ফিরে আসবে দেখিস”
–“আর কখন ফিরবে আপু? বিকাল হয়ে গেছে। আর কয়েকঘন্টা পর ফ্লাইট। ও মায়ের মতো চলে গেছে। আমার ভাগ্যটাই খারাপ।”
তার কিছুক্ষণ পর কলিং বেল বাজলো। দরজা খুলে হানিয়ার হাস্যজ্জল মুখশ্রী ভেসে উঠলো। ইরাবতী বেগম খেপে গিয়ে ঠাস করে ওর মুখে চড় মেরে দিলো। হানিয়া হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শাবনূর বেগম বলেন “আহ সই মারলি ক্যান?”
–“ওর বোঝা উচিত ওর বিয়ে হয়ে গেছে। কোথাও যেতে গেলে স্বামীর পারমিশন নিতে হয়।”
সাইফুল এহসান বলল “বাচ্চা মেয়ে বকবেন না। মামণি তুমি রুমে যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। একটু পরেই তো বের হতে হবে আমাদের।”
হানিয়া কিছু না বলে রুমে চলে গেলো। সেজাদ সবার সামনে কিছু বলতে পারে নি। সেও ওর পিছনে পিছনে গেলো। রুমে ডুকে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ওর বাহু টেনে বলল “কোথায় ছিলে সারাদিন? কোথায় আছো? ঠিক আছো কিনা একটাবার বলার প্রয়োজন মনে করলে না?”
হানিয়া ওর হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে দিয়ে বলল “আপনার মতো গাধা লোক পৃথিবীতে একটাও নেই। চিরকুটে লিখে গিয়েছিলাম। আমার ফোনে চার্জ ছিল না এযে এখনো চার্জ লাগানো। আর চিরকুটটা আপনার ফোন দিয়ে চাপা রাখছিলাম যাতে আপনি সহজে দেখতে পান। আমার উচিত ছিল আপনার ঘুমের ওপরে মায়া না দেখিয়ে আপনাকে বলে যাওয়া। আমার ভুল হয়েছে রিয়েলি ভেরি সরি। আমাকে মার খেতে দেখে খুশি হয়েছেন নিশ্চয়ই? হ্যাপি!”
হানিয়া জামা নিয়ে ওয়াসরুমে ডুকলো। সেজাদ টেবিলের ওপরে ভাজ করা সাদা কাগজটার দিকে এগিয়ে গিয়ে হাতে নিয়ে বেডে বসলো। সেখানে সুন্দর হাতে লেখা
❝এই যে মিস্টার শুনুন,
আপনি এতো সুন্দর করে ঘুমাচ্ছেন যে ডাকতে ইচ্ছে করলো না। তো আসল কথায় আসি, সকালে উঠে দেখি আমার ফোনে চার্জ নেই। আমি একটু বের হচ্ছি ফিরতে লেট হবে। বাবা-মা কবরের ওখানে যাবো আর বড় ভাইয়ার সাথে একটু দরকার আছে সেগুলো মিটিয়ে ফিরব। বাই!❞
সেজাদ শান্ত হয়ে বসে রইল। এমন বড় ভুল হয়ে যাবে ও বুঝতে পারে নি। হানিয়া ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে নিজের মতো জিনিসপত্র সব গোছাতে লাগল। সেজাদ ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল “আ’ম এক্সট্রিমলি সরি, জান। বিশ্বাস করো আমি একটুও বুঝতে পারি নি। সরি!”
হানিয়া মলিন কণ্ঠে বলল “ইটস ওকে!”
–“প্লিজ রাগ করে মন খারাপ করে থেকো না।”
–“আচ্ছা আপনি নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন। আপনাকে ধোঁকা দিয়ে, আমি চলে গেছি আর ফিরব না।”
সেজাদ কিছু বলল না। চুপ করে রইল। হানিয়া হতাশ হয়ে বলল “একটা সম্পর্কে বিশ্বাসটাই আসল। সেখানে এই ক’দিন আমার সাথে থেকে আপনার এই টুকু বিশ্বাস অর্জন করতে পারলাম না? আপনার বোঝা উচিত ছিল আমি বিয়েটা নিজের ইচ্ছেতে মেনে নিয়েছি আপনার সাথে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থাকব প্রতিজ্ঞা করেছি। আর আপনি ভেবে নিলেন আমি চলে গেছি? যাওয়ার হলে সেদিনই চলে যেতাম।”
সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা এয়ারপোর্টে ডুকে গেলো। হায়াত-হামজা বোনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। আবারও বোনের সাথে দূরত্ব। এর শেষ কোথায়?
হানিয়া আর সেজাদ পাশাপাশি বসে আছে আর কিছুক্ষণের মধ্যে ফ্লাই করবে ওরা। হানিয়া জানালা দিয়ে তাকিয়ে বার বার চোখের পানি মুছতেছে। তখনকার পর থেকে ও আর সেজাদের সাথে কথা বলেনি সেজাদ বললেও প্রতিত্তোর করে নি। সেজাদ ওর নাক টানা দেখে বলল “স্টপ ক্রাই। আমরা তো আবার আসব।”
ফ্লাইট ফ্লাই করতেই হানিয়া ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। তার বাবার সাথে ফ্লাই করার প্রথম বারের কথা মনে পড়লো আবারও। বিড়বিড় করে বলল “মিস ইউ, পাপা।”
সেজাদ ওর দিকে তাকিয়ে ওকে আগলে নিলো। হানিয়া ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। সেজাদ কিছু বলল না ওকে কাঁদতে দিলো।
ওরা বাসায় ফিরলো। হানিয়া সেজাদেের সাথে কথা বলছে না বার বার এড়িয়ে যাচ্ছে। হানিয়া ক্লান্তিতে ঘুম আসতে সেজাদ বলল “সরি প্লিজ এটাই প্রথম এটাই শেষ বার। আর কখনো এমন হবে না। প্লিজ প্লিজ প্লিজ সরি সরি সরি।”
হানিয়া ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে বলল “মনে থাকে যেনো এখন ঘুমাতে দাও আমার ক্লাস আছে।”
সেজাদ ওর মুখশ্রীতে এলোপাতাড়ি চুমু খেলো হানিয়া ঘুমিয়ে পড়লো। সেজাদও তার অর্ধাঙ্গিনীকে দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লো। মান-অভিমানের পালা শেষ হলো। আবারও কখনো মান-অভিমান চলছে শুরু হবে, ভালোবাসা-বাসি হবে এটাই তো জীবন।
সবার ব্যস্ত জীবন চলছে হায়াত-হামজার পরিক্ষা শেষ হানিয়া ওদেরকে ও দেশে নিতে চাইলে। হামজা-হায়াত বারণ করে দেয় তারা যাবে না। কেনো যাবে না হানিয়া জিজ্ঞেসা করলো না। ও বিষয়টা ধরে নিয়েছে। ওর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ওখানে ওরা একা কী করবে? বোনের শশুর বাড়িও থাকা যাবে না বিষয়টা দৃষ্টি কটু।
হামজা নিজে থেকে বলল “আপি এইচএসসি দিয়ে আমি আমেরিকায় স্কলারশিপ নিতে চাই। হায়াত দেশেই মেডিকেল আর পাবলিকে এক্সাম দিবে। ওকে তো চিনিসই আর নিশাদ ভাইও যেতে দিবে না। ঝামেলা বাঁধাবে। তাই যেমন আছে তেমনই থাক।”
হানিয়া জোর দিয়ে কিছু বলতে পারলো না। চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। শরীরে দূরত্ব বাড়লে, মনের দূরত্বও বাড়ে। ওর বেশ কয়েকদিন মন খারাপ ছিল। সেজাদ বিভিন্ন ভাবে ওর মন ভালো করার চেষ্টা করেছে।
তুষারপাতের রাতে ওরা দু’জনে মিলে কফি খাই। দুজন দুজনের মনের সব কথা, ইচ্ছে শেয়ার করে। দু’জনে খুনসুটিতে মেতে থাকে। সাথে মান-অভিমান চলে। এমন ভাবেই যাচ্ছে চন্দ্ররাজা আর চন্দ্ররাণির সংসার। তারা নিজেদের আগলে রেখে ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছে। শান্তি খুঁজে পয়েছে।
এমনই এক ব্যস্ত দিনে খবর এলো রৌদ্দুর এক্সিডেন্ট করেছে। অবস্থা বিশেষ ভালো না। হানিয়া, সেজাদ ইমার্জেন্সি টিকিটের খোঁজ করলো। পেয়েও গেলো ওরা দু’জনে যখন দেশে ফিরলো। আহমেদ বাড়ি তখন শোক ভিলা। সেই হামিদ আহমেদের মৃত্যুর দিন যেমন ছিল ঠিক তেমন। আহছানউল্লা আহমেদ, রাবেয়া আহমেদ, দোলার বিদধস্ত অবস্থা কেঁদে কেটে অসুস্থ হয়ে গেছে সকলে বাচ্চাও কাঁদছে বুঝে গেছে হয়তো তাকে বাবা ছাড়া বড় হতে হবে।
হানিয়া রৌদ্দুরের লাশ দেখলো মাথায় গুরুতর আহত হয়ে হয়েছে ব্যন্ডেজ করা। হানিয়াও কেঁদে ফেললো “ মানুষ মরার আগে ভালো হয়ে যায়। রৌদ্দুর ভাই, তুমিও বুঝি মরার প্রস্তুতি নিয়ে ভালো হয়ে গেছিলে? তোমার বউ, সন্তান, বাবা-মা তাদের কথা ভাবলে না? এতো নিষ্ঠুর কেনো তুমি? সব দায়িত্ব থেকে পালিয়ে গেলে? তুমি আমার কাছে লুজারই রয়ে গেলে।”
সেজাদ ওকে ধরে বলল “শান্ত হও। সবাইকে সামলাও। এভাবে ভেঙে পড়ো না।”
হানিয়া ওর দিকে তাকালো। সেজাদ ওকে আশ্বস্ত করে বলল “তুমি পারবে।”
~ সমাপ্ত ~
বিঃদ্রঃ১– আসসালামু আলাইকুম। অবশেষে গল্পটা শেষ হলো। যারা শেষ পর্যন্ত এমন ভুজুংভাজুং গল্পে ছিলেন তাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও ভালোবাসা❤️🩹।
বিঃদ্রঃ২– ‘চন্দ্রপ্রভায় তুষার বর্ষণে’ গল্পের হামজার প্রেমকাহিনী ও হায়াতের বিয়ে সংসার সম্পর্কিত গল্প আসবে যদি আপনারা চান। তবে গল্পের নাম তখন পাল্টাবে।
বিঃদ্রঃ৩– এবং গল্পটা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কেমন লেগেছে জানাবেন। ভুলত্রুটি শালীন ভাবে ধরিয়ে দিবেন।