চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।০৬ পর্ব।। #তাসনিম_তামান্না

0
425

#চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।০৬ পর্ব।।
#তাসনিম_তামান্না

সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে নিকষ কালো অম্বরিতে ধূসর মেঘ, চাঁদ, তারার মেলা। আজ রাতটাই বাংলাদেশের দীর্ঘকালীন সময়ের শেষ রাত। সকাল আটটায় ফ্লাইটে পাড়ি জমাতে হবে ভিনদেশের মাটিতে। আজ রাতটাই এবাড়ির কারোর ঘুম হলো না বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। আজ হানিয়া-হামজা-হায়াত একসাথে শুয়েছে অনেক কষ্টে হানিয়া ওদেরকে ঘুম পাড়িয়ে উঠে বারান্দায় চলে এসেছে। এভাবেই রাতটা কেটে গেলো…

ছয়টার দিকে সকলে মিলে রওনা দিল এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। গাড়িতে বসে আছে সকলে হানিয়ার নানী ও মামীর মাঝে বসেছে। হানিয়ার নানী ইরাবতী বলল
–“শুন যা যা বলেছি মনে আছে তো?”

–“হুম। তোমার সাবধানবানী মুখস্থ, টুঠস্থ হয়ে গেছে আর বলো না প্লিজ।”

–“হুম মনে রাখিস। ঠিক মতো খাবি সবার আগে সুস্থতা। হামজা-হায়াতকে নিয়ে টেনশন করতে হবে না আমরা সবাই আছি তো!”

–“তোমরা শুধু আমার ভাইবোন দু’টোর খেয়াল রেখো। ওদের যে আমরা ছাড়া কেউ নেই।”

এয়ারপোর্টে এসে দেখল। ফুপাতো ভাই নিশাদ, নাহিদ ও তার স্ত্রী, ফুপি দাঁড়িয়ে আছে। দাদুবাড়ি থেকে এই ফুপিটাই ওদের যত্ন করে। চাচু আসতে চাইলেও হানিয়া বারণ করে দিয়েছে। এমনিতেই হানিয়া চলে যাবার ব্যাপারে এখন রৌদ্দুর ও তার মা কিছু জানে না। হানিয়ার চলে যাবার সময় ঘনিয়ে আসতেই সকলে লাইনে দাঁড়াতে শুরু করেছে চেক করছে। হায়াত বলল

–“আপি তোকে ভিষণ ভালোবাসি”

হানিয়া হায়াতের কপালে চুমু খেয়ে বলল
–“আমিও ভালোবাসি তোদের সবাইকে। ভাই ও নিজের খেয়াল রেখ মাম, নানুমণিকে জ্বালাবে না সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরবে।”

সকলের চোখে অশ্রু হানিয়া দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেলো ও লাইনে দাঁড়িয়ে পিছু ফিরে তাকালো। সকলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। পিছনে ফিরে যাবে? ছুটে চলে যাবে? ইচ্ছে করছে খুব। ইমন, নিশাদ হানিয়ার পাশে এসে দাঁড়াল। নিশাদ বলল

–“কি রে শুঁটকি পালানোর ফন্দি আঁটছিস না-কি?”

হানিয়া তাকিয়ে মলিন হাসল। নিশাদ বলল
–“আমার লাইনটা ক্লিয়ার করে দিয়ে গেলি! এবার অনেক কিছু চলবে। তুই জানতেই পারবি না।”

–“আমার তোর ওপরে বিশ্বাস আছে এমন কিছুই তুই করবি না।”

–“এতো দিন বলিস নাই তো! বাই দ্যা ওয়ে এতো বিশ্বাস করিস না ব্যাহেনা যদি ভেঙে ফেলি!”

–“আমি জানি ভাঙবি না। শুধু গুন্ডামীটা কমা বাকি দায়িত্ব আমার আগেই বলেছি।”

–“ওখানটাই তো সমস্যা।”

ইমন বলল “নিশাদ এখন ওসব কথা থাক। হানিয়া…!”

হানিয়া তাকিয়েই আছে আগে থেকে। ইমন বলল “যাহ”

–“আর কিছু বলবি না মামা?”

ইমনের কপোল গড়িয়ে অশ্রু পড়ল বলল
–“নিজের খেয়াল রাখিস। ওখানে তোর মামা নাই।”

হানিয়ার চোখেও পানি বলল “আমার মামা আমার সাথে সবসময় থাকে! থাকবে!”

হানিয়া এয়ারপোর্টে ভিতরে চলে গেলো বুকটা ভীষন ভারী। সবাই এমন থাকবে তো? সময় সব কিছু বদলে দিবে না তো?

সকল ফর্মালিটি ফিলাপ করে ফ্লাইটে উঠে বসল জানালার পাশে সিট পেয়েছে কিন্তু সমস্যা হলো প্লেনের পাখা পড়েছে তার জন্য মনটা খারাপ হয়ে গেলো হানিয়ার। ফ্লাইট ফ্লাই করার সময় হানিয়ার ভয়ে বুকটা ধুপধাপ করছিল। ওর পাশে একটা বয়স্ক মহিলা বসেছে। ওনি হানিয়ার হাত ধরে বলল “কিছু হবে না মেয়ে ভয় পেয়ো না।”

হানিয়া কেনো জানি অচেনা মানুষটার কথায় ভরসা পেলো হাত আঁকড়ে ধরল কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হতেই পাশে ফিরে মহিলাকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হানিয়া একটু লজ্জা, অসস্থি ঘিরে ধরল আমতাআমতা করে বলল “থ্যাংকিউ!”

–“ওয়েলকাম। প্রথম বার উঠেছ বুঝি?”

–“না আসলে ফ্লাই করার সময় ভীষণ ভয় লাগে মনে হয় এখনি পড়ে যাবো।”

–“ওহ ইট’স ওকে বেটা। ভয় লাগলে চোখ বন্ধ করে রাখবে।”

হানিয়া মাথা নাড়িয়ে সাই জানালো। সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো মেঘের দেশে চলে এসেছে মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। আসলে তা নয়। হানিয়ার মনে আছে আবছায়া প্রথম যেদিন ফ্লাইটে উঠেছিল সে ওতো কিছু বুঝে না সেদিন নানুভাই মারা গিয়েছিল। তখন তড়িঘড়ি করে ঢাকা থেকে প্লেনে খুলনা এসেছিল। ভয় পেয়ে বাবাকে বলেছিল “পাপা আমি যাব না। প্লেন যদি ভেঙে পড়ে যায়।”

বাবা আশ্বাস দিয়ে বলেছিল “পাপা আছে না কিছু হবে না। একটু পরে দেখো মেঘের দেশে চলে যাব আমরা।”

হানিয়া প্রথম প্রথম ভয় পেলেও মেঘেগুলোকে এতো কাছ থেকে দেখে সেদিন ওর ভিষণ আনন্দ লেগেছিল। বলেছিল “পাপা মেঘগুলোকে নিয়ে চলো আমি ওদেরকে নিয়ে খেলব।”

হানিয়ার বাবা ধৈর্যের সাথে উত্তর দিয়ে ছিল
–“ওদেরকে তো ছোঁয়া যায় না মা!”

অবুঝ হানিয়া প্রশ্নফোয়ারা বৈয়ে দিল। জেদ ধরে বলল নিয়ে জেতেই হবে। ওনি রাগলেন না ধমকও দিলেন না হেসে বলল
–“কটন ক্যান্ডি কেমন মা?”

হানিয়া অভিমান নিয়ে মুখ ফুলিয়ে বলল
–“জানি না।”

–“কটন ক্যান্ডি মুখে নিলে কী হয়? বল তো? হাওয়া হয়ে যায় পেট পর্যন্ত যায় না তাই না মা?”

হানিয়া অভিমান করে থাকলেও বাবার কথা মন দিয়ে শুনে সম্মতিসূচক মাথা নাড়াল। ওনি বলল “মেঘও কটন ক্যান্ডির মতো স্পর্শ করলেই পানি হয়ে যায়। আমি তোমাকে কটন ক্যান্ডি কিনে দিব ঠিক আছে মা?”

হানিয়া খুশি হয়ে গেলো। আবারও সে এটা-সেটা নিয়ে প্রশ্ন ছুড়তে শুরু করল। ওনি ধৈর্য্য সহকারে উত্তর দিতে লাগল। কথাগুলো ভাবতেই হানিয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠল। এরইমধ্যে সকালের ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেলো। পাস্তা, ফিরনি, বিরিয়ানি, চিকেনসহ আরো কিছু খাবার। ও খেয়ে নিল পাশে বসা আন্টিটাও এটা সেটা কথা বলছে হানিয়া একটু হালকা হলো মন খারাপটা না কমলেও ওনার সাথে কথা বলতে খারাপ লাগছে না।

ডুবাই এসে ফ্লাইট চেজ্ঞ করতে হবে আন্টিটার সাথে যাও ফ্রী হয়েছিল এবার একা পড়ে গেলো আরো খারাপ লাগছে। মহিলাটা কানাডা যাবে আর ও যাবে নরওয়ে দুজনের পথ আলাদা। হানিয়া ওর প্লেন স্টেশন খুঁজে সকল ফর্মালিটি ফিলাপ করে আবারও ফ্লাইটে উঠলো এবার জানালা ভালো যায়গায় পড়েছে। এবার দীর্ঘ জার্নি হানিয়া ঘুমাতে চেয়েও ঘুমাতে পারছে না মুভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে গেলো। পাশে অন্য দেশের একটা মেয়ে বসেছে। ঘুম থেকে উঠে খাবার খেল ওটস, সালাত, বিফ, কেকসহ আরো কিছু খাবার।

•••
~তিলোত্তমা প্রেমকুঞ্জ~

শাবনূর বেগম নাতিদের সাবধান বানী শুনচ্ছে। প্রতিবারই কোনো কাজে দূরে গেলেই তার বিখ্যাত বিখ্যাত বানীগুলো শেষ না করে ছাড়ে না এবার ও তাই হলো। সায়েম বিরক্তি নিয়ে বলল
–“স্টপ প্লিজ অনেক হয়েছে এবার লেট হবে, ব্রো কিছু বলবি না?”

–“ইয়াহ! একজ্যাক্টলি দাদুমণি এখন বের না হলে অনেক লেট হবে ফ্লাইট ও মিস হবে।”

–“থাক থাক তোমাদের আমার কথা শুনতে যতসব বাহানা। প্রতিবারই আমার কথাগুলো শুনে শেষ করতে গেলে তোমাদের দেরি হয়ে যায়।”

ওরা বিদায় নিয়ে গাড়ির উদ্দশ্যে বেরিয়ে এলো সোনিয়া মুখ চেপে লুকিয়ে হেসে বলল “ভাই তোরা সাবধানে থাকিস”

এমন সময় ঝড়ের বেগে উপস্থিত হলো সুভানা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল
–“চলো ব্রো।”

সায়েম চোখ ছোট ছোট করে বলল
–“হোইয়ার আর ইউ গোয়িং? এয়ারপোর্ট?”

–“ইয়েস, তোমাদের পৌঁছে দিতে।”

সেজাদ ভ্রু কুঁচকে বলল
–“হোয়াই?”

সোনিয়া বলল “আরে ও ফান করছে ওর একটা ফ্রেন্ড আসবে বলেছিল তাকেই রিসিভ করতে যাচ্ছে।”

ওরা রওনা দিল। সায়েম বলল “তোর ফ্রেন্ডটা কি বয়েজ অর গার্ল?”

–“গার্ল”

–“কেমন দেখতে সুন্দর?”

–“কেনো? তোমার জেনে লাভ কী? প্রেম করতে দিব না ওর সাথে খবরদার ওটা ভুলেও মনে মাথা এনো না। এমন কিছু করলে খুব খারাপ হবে। তুমি তোমার ঐ আলতু-ফালতু গার্লফ্রেন্ড নিয়েই সুখে থাকো।”

সায়েম সুভানার মাথায় মেরে বলল
–“জাস্ট একটা কোয়শ্চন করলাম আর ওনি আমাকে এতোগুলা কথা শুনিয়ে দিলি। শোন আমি তোর বড় তাই জ্ঞান দিস না।”

সুভানা মাথায় হাত বুলিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল
–“বিগ ব্রো। কিছু বলবে না?”

সেজাদ শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো দুজনের দিকে। দুজনই চুপচাপ বসে রইল। এয়ারপোর্টে পৌঁছে সায়েম বলল “কই তোর ফ্রেন্ড?”

–“বড় ভাইয়া!”

–“টু মার্চ সায়েম। এতো লেইম কথা কিভাবে? কোথা থেকে পাস?

–“ব্রো…”

–“নো মোর ওয়ার্ড। লেটস গো।”

বাংলাদেশ থেকে নরওয়ে ১৭ ঘন্টা ৫৩ মিনিট বসে কাটানোর জন্য হানিয়ার ব্যাক পেইন হচ্ছে। হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে। এয়ারপোর্টে থেকে হেলতে দুলতে বের হওয়ার সময় হটাৎ হাত লাগল। পিছনে ফিরে চমকে গেলো…

চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here