#চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।০৯ পর্ব।।
#তাসনিম_তামান্না
রাত তখন ১টা ৪৮ বাজে হানিয়া আজ চারদিন ধরে সুভানা দের বাসায় আছে। কাল হোস্টেলে উঠবে। কিন্তু সুভানার হানিয়াকে যেতে দেওয়ার মত না হানিয়া ও ছাড়বে না যাবেই। সারাদিন ইউনিভার্সিটির ক্লাস করে, ঘুরাঘুরি করে বাসায় আসতে আসতে রাত নয়টা বেজে গেছে। খাওয়া-দাওয়া করে। বাসা ফোন দিয়ে কথা বলেছে। সুভানা আর ও মিলে আজ সারারাত মুভি দেখবে বলে ঠিক করছিল। কিন্তু সুভানা মুভির ৪৫ মিনিট যেতে না যেতেই ঘুমে কাঁদা। হানিয়ার পানির পিপাসা লেগেছে কিন্তু রুমে খাওয়ার পানি নাই। হানিয়া কয়েকবার সুভানাকে ডাকল বাটও উঠল না তাই ও একাই নিচে গেলো। ড্রইংরুমে স্বল্প আলো দিয়ে আলোকিত করা যা দিয়ে মোটামুটি দেখতে পাচ্ছে চারিপাশটা। ওর মনে মনে ভয়ও লাগছে পানি খেয়ে গ্লাসটা রাখতেই পিছন থেকে কেউ বলে উঠল…
–“হু আর ইউ?”
হানিয়া এমনিতেই ভয়ে ছিল তার ওপরে আচমকা পুরুষালি কণ্ঠস্বরে ভড়কে গেলো। মনে প্রশ্ন জাগল ‘এবাড়িতে ছেলে কোথা থেকে আসলো? চারদিন তো কোনো ছেলেকে চোখে পড়ে নি। তাহলে? ভুত? না, না। হয়তো আংকেল আসছে।’ হানিয়া নিজের মনে নিজেকে সাহস এনে মুখে হাসির রেখা টেনে পিছনে ফিরে জ্বল জ্বল ধূসর চোখওয়ালা মানবকে দেখে ভড়কে গেলো মুখের হাসি গায়েব হয়ে গিয়ে অক্ষিজুগল বৃহৎ আকৃতি ধারণ করল। অস্ফুটস্বরে বলল “ভু…ত!”
কথাটা বলে ঢলে পড়তে নিলে সেজাদ আগলে নিলো। মেয়েলি কোমললতি কায়ার সংস্পর্শে তার পুরুষালী চিত্তর কম্পন টের পেলো। সেজাদ শান্ত দৃষ্টি অশান্ত হয়ে পড়ল। অস্থির হয়ে বলল “হোয়াট দ্যা হেল!”
বার কয়েক ডাকার পরও মেয়েটি চোখ খুলল না। সেজাদ হানিয়াকে কোলে তুলে সোফায় শুইয়ে দিল। পাশের ল্যাম্পশেডটা জ্বালিয়ে দিয়ে মেয়েটির মুখশ্রী স্পষ্ট অবলোকন হলো। কয়েকপল তাকিয়ে থাকল হিসাব নেই আচমকা হুঁশ আসতেই। সোনিয়ার রুমের দিকে অগ্রসর হলো। গিয়ে ডাকল। সোনিয়া তখন সোহানকে ফিডিং করাচ্ছিল। সেজাদের এতো রাতে ডাক দেওয়ায় ভ্রু কুঁচকে চিন্তিত হয়ে দরজা খুলে বলল “কী হয়েছে ভাই?”
সেজাদ ইতস্তত করে বলল “একটা মেয়ে… আব আই ডোন্ট নো… হু আর সী।”
সোনিয়া সেজাদের কথা বুঝতে পারল না শুধু বুঝল মেয়ে ঘটিত কোনো ব্যাপার উৎসাহ নিয়ে বলল
–“কী বলছিস? তুই প্রেমে পড়েছিস? মেয়েটা কেমন? পিকচার আছে? আমার ভাই প্রেমে পড়েছে মানে স্পেশাল ব্যাপার আছে। বল না মেয়েটা…”
সোনিয়ার কথা শুনে প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলো দ্রুত সামলে নিয়ে বিরক্ত নিয়ে বলল
–“স্টপ আপু। হোয়াট দ্যা হেল। নিউ কোনো মেয়ে আসছে এ বাসা? তাকে প্রশ্ন করলাম ‘হু আর ইউ’ আমাকে দেখে সেন্সলেস হলো। আর তুই কী উল্টো পাল্টা কোয়শ্চেন করছিস?”
সোনিয়ার তার ভাইয়ের কথায় হানিয়ার কথা মাথায় আসল। চমকে প্রশ্ন করল “ও কোথায়?”
–“ড্রইংরুমের সোফাই”
সোনিয়া দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসল পিছনে পিছনে সেজাদও আসলো। হানিয়ার চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে দেখে ভড়কে গেলো। ও দ্রুত পানি নিয়ে এসে হানিয়ার চোখে মুখে পানির ছিঁটা দিতে লাগল। সেজাদের দিকে তাকিয়ে বলল
–“কী হলো ওর? রাতেই তো ভালো কথা বলছিল। এখন জ্ঞান ফিরছে না কেনো?”
সেজাদ গম্ভীর কণ্ঠে বলল “আই ডোন্ট নো। বাট সেন্সলেস হওয়ার আগে ভুত বলেছিল।”
সোনিয়া রেগে গেলো বলল “তুই তো ভুতের মতোই চলাচল করিস মেয়েটার আর কী দোষ!”
সেজাদের সোনিয়ার কথায় ভ্রু কুঁচকে গেলো কোনো প্রতি উত্তর করল না। তাকালো শান্ত হয়ে থাকা মেয়েটার সুশ্রীর দিকে সোনিয়া ডাকল “হানিয়া! হানিয়া! ওপেন ইউর আইস। হানিয়া!”
ঠোঁট নাড়িয়ে ফিসফিস করে বলল “হানিয়া!”
তখনি হানিয়া চোখদ্বয় পিটপিট করে তাকালো। ঝাপসা চোখে সোনিয়াকে দেখে চোখ ঝাপটিয়ে স্পষ্ট করে তাকালো। সোনিয়া বলল “হানিয়া আর ইউ ওকে?”
হানিয়া উঠে বসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। দুহাতে মাথা চেপে ধরল। হঠাৎ মাথা ব্যথা শুরু করছে ওর আজ কদিন নতুন জায়গায় এসে ঘুম হচ্ছে না এডজাস্ট করতে প্রবলেম হচ্ছে। সোনিয়া আবার প্রশ্ন করল “কী হয়েছিল হঠাৎ জ্ঞান হারালে! এতো রাতেই বা এখানে কী করছিলে?”
হানিয়া তখনকার কথা মনে পড়ল মাথা তুলে তাকাতেই দুই জোড়া প্রশ্নাত্মক চোখের দৃষ্টিতে ভড়কে গেলো অন্ধকারে সেই লোকটা না! হানিয়া সময় নিল প্রশ্নটার উত্তর দিতে ওরাও সময় দিল হানিয়াকে। হানিয়া হতাশ, অসহায় চোখে সোনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল
–“আসলে রুমে পানি ছিল না, পানি খেতে এসেছিলাম। হঠাৎ ছেলের কণ্ঠ শুনে ভয় পেয়ে গেছিলাম এখানে তো সোহান ছাড়া কোনো ছেলেকে দেখি নি। ভেবেছিলাম আংকেল এসেছে মেবি বাট ওনার চোখ অন্ধকারে ভ্যাম্পেয়ারদের মতো জ্বল জ্বল করছিল। নতুন জায়গায় তো ভয় পেয়ে গেছিলাম। সরি।”
সেজাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হানিয়ার ভাবভঙ্গি অবলোকন করছিলো। ওর কথাগুলো শুনে ভ্রু কুঁচকে গেলো। সোনিয়া শব্দ করে হেসে বলল
–“আমার ভাই রোবট থেকে ভ্যাম্পেয়ার হয়ে গেছে! তা-যা বলেছ ভুতের মতোই শব্দ ছাড়া চলাচল করে। আমি নিজেই মাঝেমাঝে ভয় পেয়ে যায়। আচ্ছা ভাই তুই সত্যি করে বলতো তোর কোনো এক্সট্রা ম্যাজিক পাওয়ার আছে নাকি?”
সেজাদ সোনিয়ার হাসি বা কথা কোনোটাই সহ্য হলো না। সেজাদ স্বল্প উচ্চারণ করে বলল “ডিজগাস্টিং”
সেজাদ সেখান থেকে প্রস্থান করতেই। হানিয়া হাঁফ ছেড়ে ভালো করে নিশ্বাস নিল। এতোক্ষণ ছেলেটার দিকে যতবার তাকিয়েছে ততবারই তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সাক্ষী হয়েছে। সেই দৃষ্টি ওর শরীরে কাঁটার মতো বিঁধচ্ছিল, অস্বস্তি, হাঁসফাঁস, অক্সিজেন সাপ্লাই কম লাগছিল। ও নিজেকে এলিয়েন রুগী হিসাবে ভূষিত করল। সোনিয়া বলল “আচ্ছা, রুমে যা-ও অনেক রাত হলো। ঘুমাও কাল তো ক্লাস আছে না?”
–“নাহ। কিন্তু ওনি কে?”
–“ওহ আমার ছোট ভাই। আচ্ছা…যাও রেস্ট করো। আর কোনো প্রবলেম হলে ডেকো।”
–“আচ্ছা”
•••
দোলা শ্বশুরবাড়ি নামক স্থানে আসার পর থেকে মানসিক অশান্তিতে ভুগছে। এ বাড়িতে মন খুলে কথা বলার মতো কেউ নেই। শাশুড়ী দেখলেই তো দু-চারটা কথা শুনাতে পারলে শান্তি পান। ওনার দুচোখের বৃষ যেনো সে। শ্বশুর মশাই ভালো মেয়ের মতোই দেখে তিনি বেশির ভাগ সময় কাজেই থাকে। আর স্বামী! তার সাথে যেটুকু সময় থাকা হয় ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে। শারীরিক নির্যাতনের চেয়ে এই মানসিক নির্যাতন বেশি পোড়ায় ওকে। বিয়েটা জানাজানি হওয়ার পর থেকে বাবার বাড়ির লোকজনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে ওর মায়ের সাথে ছাড়া কারোর সাথে তেমন কথা হয় না। মা-ও ব্যস্ততা দেখায় আজ-কাল। ও একা! কেউ নেই। দোলার দীর্ঘ শ্বাস আসে। রৌদ্দুর এসেছে। দোলাকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছু বলল না। ওর মাথায় অন্য প্লান ঘুরছে। কীভাবে হানিয়াকে দেশে আনা যায়। ফ্রেশ হয়ে এসে শান্ত কণ্ঠে বলল
–“দোলা শোনো”
দোলা চমকালো অনেক দিন পর রৌদ্দুরের মুখে ওর নামটা আজ মিষ্টি লাগলো। মিষ্টি করেই ডেকেছে যে! দোলা খুশি হলো উৎসাহ নিয়ে বলল
–“কিছু বলবে? কী বলো!”
–“তোমাকে বিয়ের দিন সকালে কে এনেছিল এখানে? কে খবর দিয়েছিল?”
দোলা মিয়িয়ে গেলো। বুঝতে পারল মিষ্টি ভাষার কারণ তাচ্ছিল্য করে হেঁসে দিল। কিছু বলল না চুপ করে রইল। তা দেখে রৌদ্দুর বলল
–“কিছু জিজ্ঞেসা করছি তোমাকে”
–“তো! জিজ্ঞাসা করলেই বলতে হবে? আর আমি এসেছিলাম বলে কষ্ট হচ্ছে? হানিয়াকে বিয়ে না করার কষ্ট!”
রৌদ্দুর দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে হিসহিসিয়ে তেড়ে এসে বলল “যেটা জিজ্ঞাসা করছি উত্তর দাও রাগিও না।”
–“বলব না কী করবে মা*রবে? মা*রো! এটাই বাকি আছে।”
রৌদ্দুর নিজেকে সংযত করে রুমের বাইরে চলে গেলো। ওর যাওয়ার পানে দোলা তাকিয়ে রইল। বুকে পাহাড় সময় কষ্ট এই কষ্টের পাহাড়ের ধ্বংস হবে কবে? কবে দেখা মিলবে ভালোবাসার ঢেউ!
চলবে ইনশাআল্লাহ