চিঠি দিও
১৬
______________
মিয়ানমার থেকে নাফ নদী হয়ে মাদকের একটি বড় চালান দেশে ঢুকবে। দীর্ঘ দু সপ্তাহের নাটকীয় ঘোরাফেরার পর রওনকরা ইতোমধ্যে উপস্থিত হয়েছে সাবরাং বলে একটা জায়গায়। এটি টেকনাফ মূল ভূখণ্ডের সর্ব-দক্ষিণের একটি ইউনিয়ন। এর অন্তর্গত গ্রাম শাহপরীর দ্বীপ। যুদ্ধোত্তর দেশটা অনেকখানি গুছিয়ে নেয়ার পর কাটছাঁট করে ভ্রমণ করার মতো বেশ জায়গা পাওয়া গেছে। তার মধ্যে শাহপরীর দ্বীপ একটি। তবে ভ্রমণ পিপাসু নয় বরং আনিস শেখের পরামর্শে জেলের বেশে লোকালদের মধ্যে মিশে আছে রওনকরা। দিনের আলোয় কিংবা রাতের আঁধারে অন্যান্য জেলেগুলোর মতো সমুদ্র সেঁচে মাছ আহরণের চেষ্টায় মত্ত থাকার অভিনয়ে শামিল ওদের আড়ালে আবডালে অভিযানটা চালিয়ে যেতে সমস্যা হয়নি। অধিকাংশ অভিযান যদিও রাতের আঁধারে হয়েছে! তবে সফল হয়েছে। সফলভাবে দুটো বোটের মালামাল ইতোমধ্যে ঢাকামুখী করতে পেরেছে তারা। মালামাল সব যাচ্ছে অভিনব কায়দায়। মাছ এবং লবণের গাড়িতে করে। তত্বাবধানে আছে রওনক এবং আনিসের খাস কর্মচারী সোহেল। রওনকের কাজ যেকোনভাবে মালামাল গাড়িতে তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করা, আর সোহেলের তা পৌঁছল কি না তার খবর সংগ্রহ করা। ক্লান্তিহীন, নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে তারা। আজ এখানে তাদের শেষ দিন। রাতে শেষ বোটটা এলে পার্টির হাতে বাকি অর্ধেক টাকা বুঝিয়ে দিয়ে রওনকরা রওয়ানা হবে আপন নীড়ের উদ্দেশ্যে, আপনজনদের কাছে।
প্রতিদিনের মতো আজও সদলবলে নৌকাযোগে অবস্থান করছে ওরা শাহপরীর দ্বীপে।
এই দ্বীপটায় তিনটে সৈকত রয়েছে। এবং এখান থেকে মায়ানমারের মঙডু প্রদেশ দৃশ্যমান;একটু সামনে এগোলে আরাকান পাহাড় ও সেন্টমার্টিনও দেখা যায়।
আজ শেষ বিকেলের দিকে বেরিয়েছে রওনকরা।
অস্ত্র-শস্ত্র সমেত। দুদিন যাবৎ একটা খচখচানি ভাব জাগছে রওনকের মনে। সবাইকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলেছে। কেন যেন মনে হচ্ছে আজ তাদের ওপর অ্যাটাক হতে পারে। মনে হওয়ার বিশেষ কারণ হলো এই, এলাকাটায় এসেছে থেকে কেউ একজন তাদের নজরে নজরে রাখছে। সুক্ষ্ণভাবে খেয়াল করেছে রওনক। এ ক’দিনে যেখানে যেখানে গেছে সেখানে অপরিচিত আততায়ীর পদচারণা টের পেয়েছে। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছে না এই আততায়ী কার পক্ষের।
অল্পকিছুক্ষণ হয় সমুদ্রে নামানো হয়েছে নৌকো। চঞ্চল কল্লোলিত ঢেউয়ের মুহুর্মুহু ধাক্কায় দুলতে দুলতে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। নৌকোর কিনারে দাঁড়িয়ে দুহাত কোমরে রেখে চারিদিক পর্যবেক্ষণ করছে রওনক। যতদূর চোখ যায় বিস্তৃত জলরাশী। সমুদ্রের ধারঘেঁষা দিগন্তজোড়া লবণপ্রান্তর আর জেলেদের ছোট্ট ছোট্ট কুঁড়েঘরগুলি দৃষ্টিতে ছোটো হয়ে এসেছে। রোদের তেঁজ তেমন দেখা যায়নি আজ। সারাদিন আকাশ ঘষা স্লেটের মতো কালচে ধূসর বর্ণ ধারণ করে রেখেছে। থেকে থেকে শীতল বাতাস গা ছুঁয়ে দিচ্ছে। বাতাসে ভেসে আসছে আর্দ্র মাটির সোঁদা গন্ধ। কোথাও বৃষ্টি হয়েছে নাকি? এখানেও তবে বৃষ্টি নামবে। ঠিক অভিমানী কন্যার নোনা অশ্রুমালার মতো ঝুপ ঝুপ।
আকাশ এবং সমুদ্রের মধ্যে একটা মিল খুঁজে পায় রওনক। দুটোই কিন্তু দু অর্থে পানি। একটা জমাট বাঁধা পানি, অন্যটা ফেনীল ঢেউয়ের তরল পানি। দুই পানি একত্র হওয়ার সময় অনেক সংকেত পাওয়া যায়। এই যেমন বিষণ্নতা মেখে ভেসে বেড়ানো মেঘরাশি , বুঁজে আসা আঁধার, বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ।
আজ ওরা ছাড়া আর কেউ নৌকো নামায়নি। সবটাই পরিকল্পিত। বুঝতে পারছে রওনক। পিছু হটার সুযোগও আর নেই। প্রাণ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। পরিস্থিতি যা আসে মোকাবিলা করতে হবে।
ফোঁস করে শ্বাস ফেলে ঘুরে তাকায় রওনক। নৌকোয় অবস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
— অস্ত্র হাতে নিয়া সবাই প্রস্তুত থাকো। বাকি আলোটুকু নিভে গেলে প্রয়োজন হইতে পারে।
— ভাই আপনি কি কিছু সন্দেহ করতেছেন?
সহসা প্রশ্ন করে কেউ একজন। হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে রওনক।
— করতেছি।
— মালামাল!
ছেলেটার কণ্ঠে শঙ্কা প্রকাশ পায়। রওনক অভয় দিয়ে দৃঢ় গলায় বলে,
— জান-মাল কোনো কিছুরই ক্ষতি হইতে দিব না আমি। ভরসা রাখো আর সতর্ক থাকো।
এরপর সময় কাটে পলকে পলকে। মাগরিবের আজানের পর আঁধার নামে ঝুপ করে। নৌকো নিয়ে ফিরতি পথ ধরে ওরা। কিনারে পরিকল্পিত জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে। নিগুঢ় আঁধার মাঝে কুপির ক্ষীণ আলো পরিচিত মুখগুলোকে চেনার সুযোগ করে দেয় কেবল। থেকে থেকে বাতাসের ধাক্কায় কুপিটাও নিভে যেতে চায়। সময় বাড়ার সাথেসাথে আর্দ্র হাওয়ার বেগ বাড়তে থাকে। হুড়মুড় করে আছড়ে পড়া সে হাওয়ার ভর সইতে পারে না কুপির আগুন। পতপত করে কয়েকবার কেঁপে উঠে বুঁজে যায়। আবারও জ্বালানো হয় তাকে। এই করে করে একসময় সে ক্ষণ আসে। জলরাশিতে অস্থিরতা তুলে অস্ত্রবাহী ট্রলার পাড়ে ভেঁড়ে। কাঁচা রাস্তা মাড়িয়ে এসে যায় ঢাকাগামী বাহনটিও। দ্রুত হাত পা চালিয়ে ওগুলো বাহনে তুলে পার্টির হাতে টাকা বুঝিয়ে দেয় রওনক। এরপর মালবাহী বাহন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে পার্টিকে বিদায় জানিয়ে তারা রওয়ানাই হবে, সেই মুহুর্তে কোত্থেকে একদল আততায়ীর অকস্মাৎ হামলা পড়ে তাদের ওপর। হামলার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে থাকলেও লোকবল কিছু কম হওয়ায় আঁধার ফুঁড়ে পাল্টা আ ক্র ম ণে বেশ অসুবিধে হয় রওনকদের। ওদিকের পাল্লা ভারী। পরপর গুলিবর্ষণে নাকাল করে ফেলতে চায়। রওনকরা তবুও লড়ে যায় ওদের সাধ্যমতো। একসময় শত্রুপক্ষের তেঁজ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। রওনকদের দলের কয়েকজন আহত হয়ে পড়ে। রওনক বুঝে যায় পাল্টাঘাতে সময় ব্যয় করলে জীবন নিয়ে ফেরা সম্ভব নয়। একমাত্র পলায়নেই বাঁচা সম্ভব। আহত সঙ্গীদের কাঁধে চাপিয়ে কাঁচা রাস্তা দিয়ে ফিরতি পথ ধরে তারা। যে করেই হোক লোকালয়ে ঢুকতে হবে। যেতে যেতেই কয়েকটা ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে রওনক, মিজান। শত্রুরা ঘাট বেঁধে পেছনে পড়েছে। ফিরতি পথ ধরতে দেখলে ওরাও থেমে থাকে না। পিছু নেয়। পায়ে গতি বাড়িয়ে লোকালয়ের কাছে চলে এলে ওপাশের গু”লি”ব”র্ষণ বেড়ে যায়। বিষয়টা ঠিক আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার মতো। কাউকে না কাউকে লেগে যাক। এবং লেগে যায়ও। রওনককে। ডান দিকে কাঁধ বরাবর এবং তৎসংলগ্ন একটু নীচে তীক্ষ্ণ শেলের আভাস পায় ও দুটো । অজান্তে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে
যন্ত্রণা সূচক একটি শব্দ। হাতের পাশাপাশি অবশ হয়ে আসতে চায় সমস্ত শরীর। ঈষৎ বেঁকে বাঁ হাতে চেপে ধরে নিজের ডান কাঁধ। হাতের ভেতর উষ্ণ তরলের উপস্থিতি। বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চায় কিন্তু পারে না। পাশে থেকে মিজান আ”র্ত চি ৎ কা র করে ওঠে,
— রুনু!
ঝাপসা চোখে ওর দিকে ফিরে তাকায় রওনক। দু’র্বল পা জোড়া টলে ওঠে। পড়ে যাওয়ার আগে মিজান ধরে ফেলে ওকে। তন্মধ্যে লোকালয়ে
গুলির শব্দ অস্থিতির সৃষ্টি করে। কুপি হাতে
লাঠিসোঁটা নিয়ে বেরিয়ে আসে স্থানীয়রা। আততায়ীরা পলায়নের পথ ধরে। কিছু লোক তাদের ধাওয়া করে। কেউবা আ”হ”ত দলটার কাছে এগিয়ে আসে।
জ্ঞান হারাবার পূর্বেই নিজেকে জ্ঞানশূন্য লাগে রওনকের। পাখির পালকের মতো ভরশুন্য মনে হয়। চোখের তারায় আবছা হয়ে ভাসে আপনজনদের মুখগুলি। ধূসর ছায়ার অবয়বে ও দেখে বাবাকে, দেখে মাকেও। এরপর বড় ভাইকে। বছর আঠারো আগে ফেলে আসা ছোট্ট রওনককে, যে একসময় মায়ের ন্যাওটা ছিল। স্মৃতিতে ভাসতে থাকে ইটরঙের তিনতলা বাড়ি, চারজনের সুখের সংসার, সুখের সংসারের অকস্মাৎ ভাঙন.. ফেলে আসা সব;সব। টের পায় আরও একটি ছায়ার উপস্থিতি। একমাত্র এই ছায়াটি খুব স্বচ্ছ, খুব স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় ওর চোখের পর্দায়। গানের ধুয়ার মতো খিলখিল হাসি মস্তিষ্কজুড়ে প্রতিধ্বনিত হয়। চিরচেনা হাস্যোজ্জ্বল চোখজোড়া চিনতে পেরে যন্ত্রণাকাতর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। আপনখেয়ালে ও যেন শুনতে পায় জাদুকরী কণ্ঠে কারোর ডাক। কেউ অধীর হয়ে তাকে শুধচ্ছে,
— ফিরবেন তো?
ঈষৎ মাথা এলিয়ে ও বিড়বিড় করে,
— ফিরব। অবশ্যই ফিরব; অপেক্ষা কোরো।
_____________
“ইদানিং খাওয়া,ঘুম কিচ্ছু ঠিকমতো করো না তুমি আছিকের বাবা। নাহ্ রুনু আসুক এবার। ওকেই বলতে হবে ওর বড় ভাইয়ের কাজকারবার। তারপর যা বিচার করার করুক”
ঘুমন্ত আশিকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গোঁজ মুখ করে বলল হাসনা।
রিডিং গ্লাসের ফাঁক দিয়ে সহধর্মিণীর পানে তাকিয়ে তাঁর বাচ্চামি কথায় হেসে উঠল বদিউজ্জামান। হিসেবের খাতাপত্র গুটিয়ে সোজা হয়ে বসল। কৌতুকের সুরে বলল,
— ছোটো ভাইয়ের কাছে বড় ভাইয়ের নালিশ। মানসম্মান আর আস্ত থাকবে!
— তাছাড়া আর পথ খোলা রেখেছ তুমি?
— বয়সের সাথে মানুষের খাওয়ার রুচি কমে যায় হাসনা। অস্বাভাবিক কিছু নয়।
— তুমি ইচ্ছে করেই কম খাও। দিনে দিনে কেমন শুকচ্ছ। কোনদিন খাওয়াদাওয়াই ছেড়ে দেবে। অথচ তোমাদের জন্য কত কষ্ট করে হাত পুড়িয়ে রান্না করি আমি।
হাসনার গলায় তীব্র অভিমানের ছাপ। উপলব্ধি করে পুনরায় হেসে ওঠে বদি। বছর সাতেক আগে যখন এই অভিমানী কন্যাটিকে বউ করে ঘরে এনেছিল তখন তাঁর কাছে জীবনটা ছিল খুব অনিশ্চত৷ অনিশ্চিত ছিল ভবিষ্যৎ। পঙ্গুত্বের জীবনে নতুন কাউকে জড়ানোর বিন্দুমাত্র আগ্রহ তাঁর ছিল না। কিন্তু ওপাশের মানবীটি ছিল নিজ সিদ্ধান্তে অবিচল। ভালোবাসার মানুষকে আপন করার পণ করেছিল সে। কত বাঁধা বিপত্তি আসে আসুক। ডিঙতে এক পায়ে খাঁড়া।
হাত বাড়িয়ে তরল গলায় বদি ডাকল,
— আয় তো বউ। আমার পাশে এসে বয়।
স্বামীর আহ্লাদী ডাকে শোয়া থেকে চট করে উঠে বসল হাসনা। চোখ সরু করে মুখ ভার করে বলল,
— বলিনি ছোটোলোকদের মতো বউকে তুইতোকারি করবে না।
— একদিন করলে কিচ্ছু হয় না। এটা তো আমার আদরের ডাক।
সহাস্যে বলল বদি। তা শুনে মুখ বাঁকায় হাসনা। তথাপি ছেলের পাশে বালিশ দিয়ে নিঃশব্দে এসে স্বামীর পাশে বসে। চট করে তাকে বুকে আগলে নেয় বদি। মাথায় হাত বুলতে বুলতে বলে,
— তোমার অভিমানী স্বর পুরোনো কথা স্মরণ করালো। মনে পড়ে বছর সাতেক আগের ঘটনাটা? কীভাবে ভালোবাসা নিবেদন করেছিলে আমায়। কীভাবে বাঁধা পড়লে পঙ্গু লোকটার সাথে।
স্বামীর বুকে মুখ গুঁজে কপট রাগল হাসনা। সরোষে বলল,
— বলেছি না পঙ্গু বলবে না নিজেকে।
— তো কি বলব। পঙ্গু নই আমি?
— না নও। তুমি আমাদের মতই পরিপূর্ণ।
— কথায় অপূর্ণতা ঢাকে না হাসনা।
— ঢাকে। আলবাত ঢাকে।
আর কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে বদি তৎক্ষণাৎ হাসনা শাঁসাল,
— আর কিছু বলেছ তো উঠে চলে যাব।
— আচ্ছা আচ্ছা আর বলব না। মাফ করো আমাকে।
হাল ছেড়ে দেয় বদি। তা দেখে মুচকি হাসে হাসনা৷
আসলেই মানুষটার সাথে তার বিয়ের ঘটনাটা একসময় অকল্পনীয় ছিল। একদম ভাবনার অতীত।
হাসনা হলো পুরান ঢাকার মেয়ে। ওখানেই জন্ম, ওখানেই বেড়ে ওঠা। এদিকে বদি উত্তরবঙ্গের ছেলে। দূরদূরান্ত পর্যন্ত দুজনের চেনাজানা কিংবা দেখা সাক্ষাতের কারণ ছিল না। চেনাপরিচয়টা আসলে হুট করেই হয়ে গিয়েছিল। হাসনার বড় ভাইয়ের মাধ্যমে।
হাসনার পরিবার তেমন শিক্ষিত নয়। চৌদ্দপুরুষের কেউ কখনও স্কুলের বারান্দাটি মাড়ানোর সময় পায়নি। জীবন চালানোর জন্য টাকা এবং সুখ্যাতির বাইরেও যে অন্যকিছুর প্রয়োজন হয় কখনও উপলব্ধি করেনি তাঁরা।
উপলব্ধিটা হয়েছিল অনেক পরে। একমনে ব্যবসা করে প্রচুর অর্থযশের মালিক হয়ে সমাজে একটা অবস্থান তৈরি করার পর অনেক মানুষের সাথে যখন মেশার প্রয়োজন পড়ল তখন মনে হলো প্রতিপত্তি যতই থাকুক বিদ্যে না জানা মানুষকে সমাজে কেউ ঠিক দাম দিতে চায় না। মুখে মুখে প্রশংসা করলেও আড়ালে ঠিকই হাসাহাসি করে । আর পদে পদে অবজ্ঞা সইবার মতো সহনশক্তির অধিকারী সাধারণত কেউ হয় না৷ হাসনার বাবারও অতখানি সহনশক্তি ছিল না। তাই সমাজে এতখানি অবজ্ঞা সইবার পর একসময় তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন নিজে পড়াশোনা করেননি তো কি হয়েছে, তার পরিবারের সন্তানরা করবে। স্কুলের গণ্ডি না পেরোনো ব্যবসায়ীর সন্তানেরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবে৷
সেই পড়াশোনার পথে গিয়েই মূলত হাসনার বড় ভাইয়ের পরিচয় ঘটে বদিউজ্জামানের সাথে। ছেলেমানুষের পরিচয় মানেই বন্ধুত্ব গাঢ় হতে সময় নেয় না। তাদেরটাও নেয়নি। পরে যদিও বদিউজ্জামান ঢাকা কলেজ ছেড়ে নিজ শহর রংপুরে চলে আসে এবং ভর্তি হয় কারমাইকেলে। তবুও যতটুকু সময় ঢাকায় ছিল হাসনার ভাই আর তার গাঢ় বন্ধুত্ব হয়েছিল। বন্ধুত্বটাকে ধরে রাখতে নিয়মিত চিঠি আদানপ্রদানে তাদের কথাবার্তাও হতো।
বদির কথা শুনেছিল হাসনা ভাইয়ের মুখে। তখনও মানুষটাকে সামনে থেকে দেখেনি। ভবিষ্যতেও দেখবে কি না জানা ছিল না। তবে ভাইয়ের মুখে যতটুকু শুনেছিল তাতেই হাসনার মন এসে গিয়েছিল বদির ওপর। গল্প শুনতে শুনতেই মানুষটার অস্পষ্ট অবয়ব এঁকে নিয়েছিল হাসনা মানসপটে। ধরা-ছোয়ার বাইরের মানুষটার জন্য অদ্ভুত একটা টান অনুভব করত শুরু থেকেই। সেই টান ভালোবাসার রূপ নিলো দেখা হওয়ার পর। সদ্য হাত হারিয়ে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল বদি। ডাক্তারের পরামর্শে হাওয়া বদলের প্রয়োজনে ঠাঁই নিতে হয়েছিল তাকে হাসনাদের বাড়িতে। মূলত হাসনার ভাই প্রাণপ্রিয় বন্ধুর সাথে ঘটে যাওয়া দু র্ঘ ট না টা সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর এক মুহুর্ত চুপ বসে থাকতে পারেনি। ছুটে এসেছিল এই শহরে। তারপর সে-ই নিয়ে যায় বদিকে নিজের সাথে। যদিও বদি যেতে চায়নি। জোর করেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। চোখের সামনে প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে ধুঁকে ধুঁকে ম র তে দেখতে চাইবে কে?
এতদিন যে মানুষটাকে কেবল কল্পনায় রূপ দিয়ে এসেছে, অকস্মাৎ তাকে চোখের সামনে দেখার পর অবাকই হয়েছিল হাসনা। পাশাপাশি অবর্ণনীয় আনন্দে ভেসে গিয়েছিল। তার চোখজোড়াকে বদির অপূর্ণতা কখনও আকর্ষণ করেনি বরং বদির প্রখর ব্যক্তিত্ব আকর্ষণ করেছিল। কল্পনা থেকে বেরিয়ে সামনে উপস্থিত হওয়া রক্ত মাংসের মানুষটাকে সে চোখের পলকে ভালোবেসে ফেলেছিল। ভালোবাসা লুকিয়ে রাখার ইচ্ছে কখনও হয়নি তার। উপলব্ধিটুকু গাঢ় হলে সে সবটা জানিয়ে দিয়েছিল বদিকে। সহসা এমন কিছুর সম্মুখীন হতে হবে চিন্তায়ও আনেনি বদি। নিজের পঙ্গুত্ব নিয়ে প্রবল হীনমন্যতা তৈরি হয়েছিল বদির মধ্যে। ফলে হাসনার ভালোবাসা নিবেদনকে করুণা বৈ অন্যকিছু মনে হয়নি তার কাছে। রাগে,অপমানে কড়া শব্দে প্রত্যাখ্যান করেছিল সে হাসনাকে। তার ভুল ধারণা দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিল হাসনা। সরল-সোজা স্বীকারোক্তির বিনিময়ে ভুল ধারণা আর অপমানের শিকার হতে হবে সেও চিন্তা করেনি। রাগ হয়েছিল তারও প্রচুর। তথাপি দমে যাওয়ার পাত্রী সে ছিল না। ভালোবাসাকে আপন করেই ছাড়বে প্রতিজ্ঞায় দৃঢ়তা এসে গিয়েছিল। বদি তো চলেই আসতো তক্ষুণি। কতকিছু করে ওকে আটকালো। শুরুতে বদি যে ভদ্রতাসূচক কথা তার সাথে বলতো ঐ ঘটনার পর সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। না পেরে সে বাড়িতে বলে পড়া দেখিয়ে নেয়ার বাহানায় বদির কাছে যেতে লাগল। নিয়ম করে বোঝাতে লাগল নিজের ভালোবাসাটুকু। কখনো চিঠি লিখে বোঝাতো কখনোবা পড়ার ফুরসতে। একসময় বদিও বুঝতে পেরেছিল করুণা নয়, সত্যিকার ভালোবাসে মেয়েটি তাকে। তথাপি এতখানি ভালোবাসা স্বীকার করার সাহস তার মধ্যে ছিল না। কেউই মানতো না এরূপ অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক। মানেওনি। হাসনার বাবা যখন জানতে পেরেছিল একমাত্র কন্যাটি তার অগোচরে একটা মধ্যবিত্ত ঘরের পঙ্গু ছেলেকে আপন করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, তখন ভীষণ রেগে গিয়েছিল। রেগেমেগে রীতিমতো অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল সে বদিউজ্জামানকে। এবং সপ্তাহ পেরোতে না পেরোতেই হাসনার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল এক ব্যবসায়ীর পুত্রর সাথে। বিয়েতে রাজি ছিল না হাসনা। একপ্রকার ঘরবন্দী করে রাখা হয়েছিল তাকে। ওদিকে বেশ জোরেসোরে আয়োজন চলছিল। লোক ডেকে, বাড়ি সাজিয়ে ধুমধাম করে বিয়ে দেয়ার কথা ছিল। বাবা’র রোষের মুখে পড়ে বধূ সেজে আসরেও বসেছিল হাসনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার বিয়েটা হয়নি। কোনো অজ্ঞাত কারণবশত বর উপস্থিত হয়নি বিয়েতে। বিয়ের আসরে কনে বসিয়ে বর না আসা কতখানি হাস্যকর ও অপমানজনক ঘটনা। রাতারাতি কতশত বানোয়াট গল্প ছড়িয়ে পড়েছিল এলাকায়। হাসনার চরিত্র নিয়ে, ওদের পুরো পরিবার নিয়ে। লোকের কটুবাক্যে বেঁচে থাকাই দায় হয়ে পড়েছিল সকলের। হাসনার বাবা ভেবে পাচ্ছিলেন না কি করবেন! তখুনি কেউ একজন পরামর্শ দিলো যে ছেলেটাকে আশ্রয় দেয়া হয়েছিল, মেয়ের ভাইবন্ধু। ওর সাথেই বিয়ে দেয়া হোক একে। এই মেয়েকে অন্য ঘরে না পাঠানো অবধি মাথার ওপর থেকে কলঙ্কের কালি মুছবে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছিল হাসনার বাবার। পরামর্শে রাজি হওয়া ছাড়া অন্য পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। শেষে অবশিষ্ট সম্মানটুকু বয়ে নিয়ে পা রেখেছিল সে বদিউজ্জামানের দোরগোড়ায়। সব শুনে বদিউজ্জামানও মুখ ফেরাতে পারেনি। তার চোখের সামনে কেবল অসহায় হাসনার মুখখানা ভেসে উঠছিল বারংবার। কোথাও না কোথাও সেও তো ভালোবেসে ফেলেছিল হাসনাকে। বাঁধা ছিল কেবল তার পঙ্গুত্ব।
কিন্তু শেষ মুহুর্তে এসব দিকে আর নজর দেয়া সমীচীন মনে হলো না। বিনা দ্বিধায় রাজি হয়ে গেল বদি। এবং হাসনার বাবাকে শর্ত দিলো অগোচরে এতকিছু হয়ে গেছে, ওর পরিবার যেন এসব জানতে না পারে। আর পাঁচটা স্বাভাবিক বিয়ের মতো তাদের বিয়ে হবে। বাধ্য হয়ে নয় পছন্দ করেই পাত্র নির্বাচন করা হয়েছে হাসনার জন্য এমনটাই যেন সকলের সামনে উপস্থাপন করা হয়। রাজি হয়েছিল হাসনার বাবা। এরপর অন্যসব সাধারণ বিয়ের মতোই বিয়ে হয়েছিল তাদের। বাইরের লোক কথা ছড়ানোর চেষ্টা করেছে, তবে শক্তহাতে ওসব সামাল দিয়েছে বদিউজ্জামান এবং হাসনার পরিবার।
আজ পর্যন্ত ওদের বিয়ের সত্যি হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ ছাড়া আর কেউ জানে না।
জানার প্রয়োজন তো নেই। সুন্দর একটা পরিবার, সন্তান নিয়ে ওরা সুখে আছে এটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার।
পূর্ব স্মৃতি রোমন্থন শেষে আলগোছে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল হাসনা। যতটুকু জ্ঞাত, ঘটনার গভীরতা তার চাইতে শতগুণ বেশি গভীর। সেদিন ভরা সভায় বর না আসার একমাত্র কারণ হলো এই, বিয়ের ঠিক তিনদিন আগে রাতের আঁধারে বাড়ি থেকে পালিয়ে ঐ ছেলেটার দরজায় উপস্থিত হয়েছিল হাসনা। বিয়েতে যে তার মত নেই এই সত্যখানা জানিয়েছিল হবু বরকে। জানিয়েছিল তার সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে একমাত্র বদিউজ্জামানের বসবাস। নতুন করে কাউকে জায়গা দেয়া তার পক্ষে অসম্ভব । সাথে অনুরোধ করেছিল সে যেন এই বিয়ে ভেঙে দেয়। তৎক্ষনাৎ তো ছেলেটা রাজি হয়নি, তবে শেষ পর্যন্ত হাসনার অনুরোধ রেখেছে। আসেনি বিয়েতে। ঐ জাদুটা কীভাবে হলো জানা নেই হাসনার। কেবল মুখের কথায় রাজি হওয়ার মতো ছেলে ও ছিল না। তবে?
এরপর আর ভাবতে ইচ্ছে করে না হাসনার । যা গত হয়েছে তা ঘেঁটে কোনো লাভ আছে কি? বৃথা মুহুর্তগুলোর ওপর এক পোচ কালি লেগে যাবে।
— কি ভাবো চুপটি করে?
বদিউজ্জামানের কথায় নড়েচড়ে বসে হাসনা। শার্টের বোতাম খুঁটতে খুঁটতে বলে,
— ভাবছি রুনুটা তো পুরো ঘরছাড়া হয়ে গেছে। এবার ওকে বেঁধে রাখার পায়তারা করতে হবে।
— আচ্ছা তো কীভাবে করবে সেটা?
— ওর একটা বিয়ে দিয়ে দেব। লাল টুকটুকে বউ ঘরে আনবো। একমাত্র বউ এলেই ঘরে মন আসবে ওর।
— তাই?
— তা নয় তো! আসুক না একবার।
— বহুদিন হয়ে গেল ওর কোনো খবর নেই। কথাবার্তা কিছু হয়েছিল তোমার?
চিন্তাগ্রস্ত গলায় বলে বদি। ওর চিন্তা হাসনাকেও ছুঁয়ে যায়।
— হয়নি। ছেলেটার কি আমাদের কথা একদমই মনে পড়ে না গো? সারাটাদিন ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় কাটে আমার। কিসব গুণ্ডাপাণ্ডাদের সাথে মেশে। বিপদাপদ কিছু হয়ে গেলে..
— ওসব কথা বোলো না হাসনা। আমার ভাই খুব সাহসী ছেলে। কিচ্ছু হবে না ওর। কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না।
একটু থেমে পুনরায় বলে,
— আমি বরং কালই ক্লাবে গিয়ে ওর খোঁজ নিয়ে আসব। ছেলেপেলেগুলো জানতে পারে ওর অবস্থান।
— তাই এসো। এত দুশ্চিন্তা আর নিতে পারি না আমি।
চলবে,
Sinin Tasnim Sara