চিঠি দিও
১৭
_________
গ্রীক উপকথায় প্রেমের দেবী ভেনাসের পায়ের রক্ত থেকে গোলাপের জন্ম। তাই গোলাপকে বলা হয় প্রেমের প্রতীক। চমৎকার সুদর্শনা এই ফুলটি তার শোভাবর্ধক সৌন্দর্যের জন্যেই শতাব্দী ধরে পৌরাণিক কাহিনীগুলোতে ঠাঁই পেয়ে এসেছে। তবে খালি চোখে দেখার মতো অবর্ণনীয় সৌন্দর্যে আগাগোড়া মোড়া থাকলেও তাকে ছোঁয়ার সহজলভ্যতা প্রকৃতি থেকে কিন্তু দেয়া হয়নি। তাকে ছোঁয়ার দুঃসাহস দেখাতে চাইলে প্রতিঘাত সহ্য করার মতো মনোবলও থাকা চাই। কারণ অসীম সৌন্দর্যের পরতে পরতে সে লুকিয়ে রেখেছে তীক্ষ্ণ ঘাতক কাঁ’টা। যাকে অসাবধানতায় ছুঁয়ে গেলে আঘাতে জর্জরিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এজন্যই বোধহয় কবিরা লেখেন, কিছু সৌন্দর্য দূর থেকে দেখাই ভালো। কাছে পাবার আকাঙ্ক্ষা করলে সংজ্ঞা পাল্টে যেতে পারে।
ছাদের এক কোনে তক্তপোষের ওপর আধশোয়া হয়ে বইয়ে চোখ ডুবিয়েছে অতনু। হাতে ধরে রাখা কার্ল মার্ক্স এর “The Communist Manifesto”। সমাজতত্ত্বের ওপর লেখা চমৎকার একটি বই। অবশ্য অতনুর চোখজোড়া বইয়ে নিবন্ধ রাখলেও মনটা তার এদিকে নেই। মনটা তো একটুখানি সামনে বসা তার প্রাণপ্রিয় অর্ধাঙ্গিনীর দিকে যে কাঁচি হাতে কচ কচ করে গোলাপের কাঁটা এবং বর্ধিতাংশ ডালপালাগুলি কাটছে।
সবে বেলা সাড়ে এগারোটা। সকালের নাশতা শেষে নিত্য অভ্যেস মতো আসমা শখের গাছগুলির যত্নে লেগে পড়েছে। অর্ধ বেলা অতনুরও আজ অবসর। তাই সুযোগ মতো সেও চলে এসেছে আসমার পিছু পিছু। বহুদিন হয় বউটাকে সময় দেয়া হয় না৷ তাই ঠিক করেছে আজ অর্ধবেলা সে লিখে দেবে চমৎকার এই মেয়েটির নামে।
বই বন্ধ করে চট করে উঠে বসল অতনু। পুরো ছাদময় চোখ বুলিয়ে দেখল সাদা গোলাপের চারায় ভরে গেছে ছাদের কার্নিশ। এতগুলি গাছ তো সে এনে দেয়নি। আসমা কি আবারও আনিয়েছে?
— কি ব্যাপার আবারও গাছ আনিয়েছ তুমি?
কৌতুহলবশত প্রশ্ন করল। আসমা ফিরে তাকাল তার দিকে। মাথা দুলিয়ে বলল,
— উঁহু। মেজো ভাইজান ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছেন।
— গতকাল?
পুনরায় সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল আসমা।
— হু।
— কই আমি তো দেখলাম না।
— তুমি ফিরলে রাতে। ততক্ষণে আমাদের সব গোছানো হয়ে গেছে।
— বাহ্ তুমি তো ছাদটাকে পুরো গোলাপ বাগান করে দিচ্ছ।
জবাবে মিষ্টি হাসল আসমা। বলল,
— জানো না গোলাপ প্রেমের প্রতীক। আমি তো যত্ন করে প্রেম বুনছি।
— তাই? তো আমার গায়েও একটু প্রেম মেখে দাও না। দেখি প্রেম মেখে একটু প্রেমিক হতে পারি কি না!
আসমার পাশে বসতে বসতে বলল অতনু। ওর কথা শুনে ভীষণ লজ্জা পেল আসমা। বুকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,
— ইশশ কি করছ তুমি। কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
— কেন? কেলেঙ্কারির কি আছে। নিজের বউয়ের পাশে বসলে পাপ লাগে বুঝি!
— তুমি তো শুধু পাশে বসার উদ্দেশ্য নিয়ে আসনি। দোহাই তোমার। বাড়িতে ভাইজানরা আছেন। তাঁদের সামনে লজ্জায় ফেলো না আমায়।
এ কথার বিনিময়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে উঠল অতনু। বলল,
— না বলে প্রাইভেসি ন”ষ্ট করার মানুষই নয় আমার ভাইয়েরা।
— কাজ করছি কিন্তু আমি।
এবারে শক্ত গলায় বলল আসমা।
— আমিও তোমায় সাহায্য করতেই এসেছি। অন্য কিছু না।
বলতে বলতে আসমার হাত থেকে কাঁ”চিটা নেয়ার চেষ্টা করল অতনু। কিন্তু আসমা তো দেবে না। চট করে হাত ছাড়িয়ে নিতে গেলে তার হাতের ধাক্কায় গোলাপের ছোট্ট টবটা টুপ কটে উল্টে পড়ে গেল ছাদের ওপর। নিমেষে কাদামাটি, চারা সব ছড়িয়ে একাকার।
কপট রে”গে আসমা বলল,
— দেখলে তো কি হলো! গোছানো কাজ আরও বাড়িয়ে দিলে। একদম কথা শোনো না তুমি আমার।
— এইরে স্যরি সিস্টার। দাও আমি ঠিক করে দিচ্ছি আবার।
— সিস্টার মানে? বউকে কেউ সিস্টার ডাকে!
বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ফেলল আসমা। নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে থতমত খেয়ে গেল অতনু। দু’হাতে কান ধরে অপরাধী গলায় বলল,
— স্যরি মিস্টেক।
এসবে পাত্তা দিলো না আসমা। রা’গে মুখ ফিরিয়ে ছড়িয়ে যাওয়া কাদামাটি সামলানোর চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সাথে বিড়বিড় করে নিজের রাগের বহিঃপ্রকাশ করতেও ভুলল না।
অতনু পুনরায় এগিয়ে এলো তার কাছে। চারাগাছটা টবে স্থাপন করে ক্ষীণ স্বরে বলল,
— দেখি অপরাধ করেছি গেটিসও দেই একটা।
এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগে টুক করে ওর গালে ঠোঁট চেপে ধরল। ছটফটিয়ে সরে গিয়ে সতর্কতার সাথে আশপাশটায় চোখ বুলতে বুলতে বিরক্তি নিয়ে আসমা বলল,
— কি হচ্ছেটা কি!
— প্রেম হচ্ছে। স্বামী থেকে প্রেমিক হচ্ছি।
একটুখানি কাদা গালে মাখিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসল অতনু। আসমা হাল ছেড়ে দিলো। কেবল অনুনয়ের সুরে বলল,
— কাজটা সম্পূর্ণ করতে দাও দোহাই।
— তবে আমারও সাহায্য নিতে হবে।
শর্ত জুড়ে দিলো।
— ঠিকাছে। তাই হবে।
এরপর আর কি, চারহাতের ভালোবাসায় এলোমেলো সবটা সুন্দরভাবে গুছিয়ে উঠল।
নিষেধের বালাই তোয়াক্কা করল না অতনু। কাজ শেষে পেছন থেকে জাপটে ধরে পুনরায় স্ত্রীর গালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। বরং ঠোঁটটা সময় নিয়ে চেপে ধরে রইল। মেয়েটার গাল এত কোমল কেন? ঠিক যেন মখমল। ত্বক থেকে কি মিষ্টি একটা সুবাস ভেসে আসছে। ঠোঁট চেপে রেখেই অস্পষ্ট স্বরে শুধল,
— কি মাখা হয়েছে মুখে?ঘ্রাণটা তো চমৎকার।
লজ্জায় বুঁজে আসতে চাইছে আসমার গলা। তথাপি উত্তরে ক্ষীণ গলায় সে বলল,
— কি আবার! ক্রিম মেখেছি।
— তোমার মতো….
কথা সম্পূর্ণ করতে পারল না অতনু। সিঁড়ি থেকে উপমার গলা ভেসে আসতে শোনা গেল। ভাবী, ভাবী ডাক পেড়ে এদিকেই আসছে সে।
উপমার গলায় দু’জনে সতর্ক হয়ে গেল। ছিঁটকে সরে অতনু গেল তক্তপোষের কাছে আর আসমা তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু দুজনেরই হাত দুখানাতে তো কাদামাটি লেপ্টেই রইল।
ছাদে পা দিয়ে সেজো ভাই চক্ষুগোচর হতেই বিস্মিত হলো উপমা। মুখের ওপর বই ধরে আছে কেন ওভাবে? তাও আবার উল্টো করে। ভ্রু জোড়া সংকুচিত করে বলল,
— বইটা তো উল্টো ধরেছ সেজো ভাই।
— ওহ্… হ্যাঁ.. আচ্ছা।
তড়িঘড়ি করে বই সোজা করে ধরল অতনু।
— এই অসময়ে বাড়িতে কেন? অফিসে যাওনি?
সন্দিহান গলা উপমার। আলগোছে সংক্ষিপ্ত শ্বাস
ফেলে বই মুখের ওপর থেকে সরালো অতনু। স্বাভাবিক গলায় বলল,
— আজ যাব না। ছুটিতে আছি।
— অহ্ আচ্ছা।
সাবলীলভাবে আসমার দিকে এগিয়ে গেল উপমা।
— ভাবী আমার বায়োলজি প্রাক্টিক্যাল খাতাটা কোথায় রেখেছ? পাচ্ছি না তো।
— কেন দেরাজের ওপর পাওনি? ওখানেই তো সব ক’খানা গুছিয়ে রাখা আছে।
— পেলাম না তো।
মাথা চুলকোল উপমা। ঠোঁট কামড়ে কি যেন মনে করার চেষ্টা করল আসমা। এরপর বলল,
— আচ্ছা অভ্রর পড়ার টেবিলে দেখো তো। তোমাকে লুকিয়ে একবার খাতাটা নিয়ে গিয়েছিল। রাখতে ভুলে গেল নাকি!
— উফফ এই ছেলেটা!
বিরক্তি স্বরে কথাটা বলে গমন পথে পা বাড়াল উপমা। দরজা পেরিয়ে দুকদম গিয়ে কি মনে করে পুনরায় ফিরে এলো। তক্তপোষের কাছে দাঁড়িয়ে দুষ্টুমি মাখা গলায় বলল,
— আমি কিন্তু দূর থেকে সব দেখেছি সেজো ভাই।
— ক..কি দেখেছিস তুই?
সহসা উপমার দিকে তাকিয়ে রা’গবার বৃথা চেষ্টা করল অতনু। ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু হেসে উপমা কাদামাখা অতনুর হাতের দিকে আর আসমার গালের দিকে ইশারা করল। নাক উঁচু করে বলল,
— আমি কিন্তু সব্বাইকে বলে দেব। মজা হবে না?
— এই বে’য়াদব লজ্জা করে না তোর?
— ইশশ একদম ধমকাবে না। নইলে কিন্তু..
— আচ্ছা আচ্ছা বল কি চাই তোর? ঘুষ ফুস দিলে মুখ বন্ধ রাখবি তো?
— উমম! ডিল ভালো। বলো কি দিবে ঘুষে?
— তুই কি চাস?
— আজ হাটবার নয়? সন্ধ্যায় তবে মালপোয়া খাওয়াতে হবে। শংকরের দোকানের গরম গরম মালপোয়া। ইশশ ভাবতেই তো জিভে জল চলে আসছে।
— কিন্তু বিকেলে যে আমি বাইরে বেরোব রে। মায়ের কাছে টাকা দিয়ে যাব। সবাই মিলে চলে যাস।
— না না তা হবে না। তোমাকে থাকতেই হবে। গেলে আমরা সবাই যাব কেউ বাদ পড়বে না।
— আরে আমার কাজ..
— উঁহু শুনছি না। হলে ডিল ফাইনাল করো নইলে আমি..
— আচ্ছা আচ্ছা ঠিকাছে। সবাইকে তাহলে জানিয়ে দে সন্ধ্যায় রেডি থাকতে। শংকরের দোকানে মালপোয়া খাওয়াতে নিয়ে যাব।
— এখন তো আমার সময় নেই। জান্নাতিকে বলে দিচ্ছি ও-ই সবাইকে জানাবে। আমি তবে এখন আসি।
— শোন। যাচ্ছিসটা কোথায়?
পেছন থেকে ডেকে উঠল অতনু। বেনি দোলাতে দোলাতে উপমা জবাব দিলো,
— কলেজে। প্রাক্টিক্যাল খাতাগুলো সাইন করে নিতে যাই।
— লিখনকে বলে দেই। গাড়ি করে যা।
— না না। আমি একলা যেতে পারব। ঐ বাঁদরমুখোটার সাথে যেতে আমার বয়েই গেছে।
— আরে শোন।
— নাহ্ হবে না।
ডানে বাঁয়ে মাথা দুলিয়ে তরতর করে নেমে গেল উপমা। আসমা এতক্ষণে মুখ তুলে চাইল। এতটা সময় লজ্জায় লাল-গোলাপি হচ্ছিল ও।
উপমার দেহাবয়ব মিশে যাওয়ার পর অতনু বলল,
— এত জেদি কেন ও? একদম কথা শুনতে চায় না দেখছি।
— আহা থাক না৷ একা যেতে আনন্দ পায় ও। কখনো বন্ধুদের সাথে মিলেমিশে যায়। সমস্যা নেই তো।
— যে দু র্ঘ ট না টা হলো! এরপর তো ওকে একা ছাড়তে মন সায় দেয় না। শ ত্রু তো কম নেই আমার। সরাসরি আমার ওপর তো হা ম লা করতে পারবে না। পরিবারের ওপর দিয়ে শোধ নেয়ার চেষ্টা করবে।
— উপমা যে তোমার বোন এই পরিচয় তো তেমন কেউ জানে না। বাইরে গেলে খুব সাবধানে চলাচল করে ও।
— আ গু ন যতই লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হোক না কেন লেলিহান শিখার আঁচ দূর থেকে টের পাওয়া যায়। যত সাবধানতাই বজায় রাখা হোক যেকোনভাবে বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেছে। নইলে এতবড় স্পর্ধা কার হয়!
— তুমি খোঁজ পাওনি কারা ওসব করল?
— খোঁজার চেষ্টাই তো করছি।
বলতে বলতে ভাবুক হয়ে গেল অতনু। হা”ম”লাকারীকে তো সে পেয়েছে কিন্তু মৃ”ত অবস্থায়। তার পৌঁছনোর আগেই কেউ পৌঁছে গেছে ঐ অবধি। এতখানি চপল গতি আর এতবড় হাত কার সেটাই এখন জানার চেষ্টা করছে অতনু।
_______________
বিছানার পাশে কাঠের টুলের ওপর গম্ভীর মুখে বসে আছে বদিউজ্জামান। ওদিকে আঁচলে মুখ চেপে গুনগুন করে কাঁদছে হাসনা। অর্ধ শায়িত রওনকের কোলে বসা আশিক একবার বাবার দিকে তাকাচ্ছে, তো একবার ক্রন্দনরত মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। বাবার গম্ভীর মুখশ্রী আর মায়ের কান্নার সঠিক অর্থ তার বোধগম্য হচ্ছে না। দীর্ঘটা সময় পর্যবেক্ষণের পর কিছু না বুঝলে অসহায় শিশুটি চাচার দিকে ঘুরে তাকাল। ছোট্ট দু বাহু দ্বারা কণ্ঠ বেষ্টন করে ফিসফিস করে শুধল,
— মা কাঁদে কেন চাচ্চু?
— মা একটু ক”ষ্ট পেয়েছে তো তাই কাঁদছে।
রওনকও ফিসফিসিয়ে জবাব দিলো ওকে।
— কিন্তু কষ্ট পেয়েছে কেন?
— চাচ্চুর হাতে ব্যথা দেখে কষ্ট পেয়েছে।
এবার চোখ ঘুরিয়ে ব্যান্ডেজ করা রওনকের হাতটার দিকে তাকাল আশিক। বিষণ্ন গলায় বলল,
— তোমার ব্যথা দেখে তো আমিও কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু আমার তো কান্না আসছে না। এখন কি করব চাচ্চু?
বাচ্চাটার কথা শুনে হাসি পেয়ে গেল রওনকের। সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
— পুরুষ মানুষের কাঁদতে আছে নাকি রে ব্যাটা! তুই তো আমার ঢাল। শক্তি দিবি আমাকে। ভেঙে পড়বি কেন।
— আমি শক্তি দেব তোমাকে? আমার অনেক শক্তি চাচ্চু। ইয়াআআ।
শার্টের হাতা গোটাতেই নিচ্ছিল বাচ্চাটা তন্মধ্যে মায়ের ধমকে থেমে গেল।
রওনক ওকে আগলে নিয়ে বলল,
— আহ্ ভাবী বৃথা ধ ম কা চ্ছ কেন ওকে? বাচ্চা মানুষ।
— তাহলে কি তোমাকে ধমকাব? নাহ্ আমার তোমাকেই শাসন করে, রেগে-ধমকে বাড়িতে রাখা উচিৎ ছিল। তাইলে এই দিন দেখা লাগে!
— কিছু হয়নি তো ভাবী। আমি ঠিক আছে। কেন যে তোমরা দুশ্চিন্তা করছ!
— ঠিক আছো? এইটাকে ঠিক থাকা বলে রুনু? দুই দুইটা গু লি লাগছে তোমারে। অল্পর জন্য খালি..
কথা সম্পূর্ণ না করেই আঁতকে উঠল হাসনা। যেন ভ”য়ানক দৃশ্যটা চোখের সামনে দেখছে সে।
এ পর্যায়ে মুচকি হেসে রওনক বলল,
— এত সহজে আমার কিছু হচ্ছে না ভাবী। সকাল বিকেল এত দোয়া করো তুমি আমার জন্য। তোমার দোয়াই তো আমার শক্তি শেল।
এ কথার প্রেক্ষিতে হাসনা কিছু বলল না বরং তরল গলায় বদিউজ্জামান বলল,
— তোর কিছু হওয়ার আগে আমার প্রাণটা যেন নিয়ে নেন সৃষ্টিকর্তা। এই দুই চোখ দিয়ে তোর ক্ষ”তি দেখতে পারব না আমি।
— আহ্ ভাইয়া তুমিও!
ভীষণ বিরক্ত হলো এবার রওনক।
— কে এসব করল কিছু জানিস রুনু? খোঁজ পেয়েছিস?
স্বাভাবিক হয়ে প্রশ্ন করল বদিউজ্জামান। রওনক যেহেতু তার কাজের কথাটা পুরোটাই চেপে গেছে তাই সত্যিটা বলতে পারল না। তড়িৎ একটা গল্প বানিয়ে বলে দিল মিছিলের মধ্যে হঠাৎ দা ঙ্গা বেঁধে গিয়েছিল। সেখানেই অজ্ঞাত কে বা কারা ফাঁকা গু লি ছোঁড়ে। সেখানেই আ ঘা ত প্রাপ্ত হয় রওনক। বদিউজ্জামান পুরোটা বিশ্বাস না করলেও অবিশ্বাসও ঠিক করতে পারল না। রাজধানীতে মিছিলের নাম করে দা ঙ্গা – হা ঙ্গা মা নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোজ কেউ না কেউ অপ্রত্যাশিত গু লি কিংবা পে ট্রো ল বো মা র কবলে পড়ে প্রা ণ হা রা চ্ছে। ওসব
পথে চলাফেরা করা মানে জীবন নিয়ে ফিরতে পারবে কি না অনিশ্চয়তা। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে উঠে পড়ল বদিউজ্জামান।
— ঠিকাছে অনেক হয়েছে এসব আলাপ আলোচনা। দু র্ঘ ট নার ওপর তো কারোর হাত নেই। অসুস্থ শরীর নিয়ে আর এত কথা বলতে হবে না রুনু। তুই শুয়ে থাক। রেস্ট কর।
— আর খবরদার বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করবে না। পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া অবধি গেটের বাইরে এক পা নয়।
শক্ত গলায় সতর্ক করে দিতে ভুলল না হাসনা। কোনঠাসা হয়ে কোনোরকমে মাথা নাড়ল রওনক। সে কি ঘরে বসে থাকা লোক? একজন যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার জন্য। তাকে তো জানাতে হবে শেষ পর্যন্ত ফিরে এসেছে
প্রতিক্ষিত মানুষটা তার দুয়ারে। অপেক্ষার দিন ফুরিয়েছে৷ না জানে কতখানি অস্থিরতা জেঁকে বসেছে প্রিয়তমার মনে।
ভাই-ভাবী বেরিয়ে যাওয়ার পর আশিককে বুকে নিয়ে কতক শুয়ে রইল রওনক। পুটুর পুটুর গল্প করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে গেল আশিক। ঘুম জড়ালো না রওনকের চোখজোড়ায়৷ বিনিদ্র সে পরিকল্পনা বানাতে লাগল কীভাবে বাইরে বেরুনো যায়।
সুযোগ একসময় এলো তার কাছে। বদিউজ্জামান বেরিয়ে গেল বাজার করতে আর হাসনা কি যেন কাজে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আপনা থেকে হেঁটে আসা সুযোগকে হাতছাড়া করা সমীচীন মনে করল না রওনক। ঘুমন্ত ভাস্তেকে বুক থেকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ঝটপট সে হাতমুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নিলো বেরোনোর জন্য। শার্ট গলিয়ে ঘড়িতে সময় দেখে ধারণা করল এইসময় উপমার ক্লাস চলে। সে নাহয় গিয়ে অপেক্ষা করবে ক্যান্টিনের সামনে। হোন্ডার চাবি নিতে নিতেও নিলো না৷ এক হাতে তো হোন্ডা চালানো সম্ভব নয়। রিকশা বা ভ্যানে করে যেতে হবে। মানিব্যাগ পকেটে ঢুকিয়ে দরজা আটকে সাবধানে পা টিপে টিপে বের হলো। কোনোরকমে বাড়ির গেটটা পেরুলে হয়। গলির মাথায় অগণিত যানবাহন পাওয়া যাবে।
লাইব্রেরির পাশঘেঁষে ঘাসের ওপর একা একা বসে আছে উপমা। সামনে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে রাখা প্রাক্টিক্যাল খাতাগুলি। আগামী সপ্তাহে পরীক্ষা। বন্ধুরা সব আগেই খাতা সাইন করে নিয়েছে। বেশ কয়েকদিন কলেজ মিস পড়ায় সাইনগুলো তার নেয়া হয়নি। এজন্যই তো আজ একা একা আসতে হলো। ধুরর! নাক-মুখ কুঁচকে এলোমেলো পাতাগুলি পরপর সাজাতে শুরু করল উপমা।
মাথার ওপর নীলগিরি গাছের ছায়া। সবটা গোছানো হলে অভ্যাসবশত চোখ তুলে চাইলে উপমা দেখতে পেলো হলুদ, সাদা ফুলে একদম ভরে গেছে গাছগুলি। ফুলের সুতীব্র ঘ্রাণে চারিদিক ম ম করছে। ঘ্রাণটা অবশ্য স্নিগ্ধ কোমল নয়। বেশ কড়া। শুকনো মসলার মতো৷ মনে হচ্ছে মসলার রাজ্যে এসে বসেছে ও। পাকোয়ান হবে বলে মসলা সংগ্রহ করতে পাঠানো হয়েছে ওকে৷ নিজের বোকা বোকা ভাবনায় নিজেই বিরক্ত হলো উপমা। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে সবটা গুছিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল। অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখেছে ম্যাম ক্লাস নিচ্ছেন সিনিয়রদের। শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। বেশিক্ষণ অবশ্য লাগবে না। ঘড়ির কাঁটা বলছে অল্প পরেই ছুটির ঘণ্টা বাজবে। বিচার বিবেচনা করেই লাইব্রেরির পাশে এসে বসেছে উপমা। এখানে পাশেই ক্যান্টিন। ক্লাস শেষ হলে সহজেই বোঝা যাবে। ম্যামও তো এ পথ দিয়েই যাবেন।
ও অবশ্য একটু আড়ালেই বসেছে। লাইব্রেরির পাশ ঘেঁষে ছোট্ট নীলগিরির বাগান। ঘন ঘন উর্ধ্বমুখী ইয়া বড় গাছগুলোর ছায়ায় জায়গাটা বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। মানুষ আসতে চায় না এদিকে। সবাই আসলে ক্যান্টিনে বসতেই বেশি পছন্দ করে।
তবে নে”শাপানি খাওয়া ছেলেগুলো এখানে আসে। নিভৃতে গাঁ”জা খেতে সুবিধে হয়। কেউ ডিসটার্ব করার নেই। উপমা অবশ্য সামনে থেকে কখনও দেখেনি। তবে এখানে এলে অসংখ্য ছোটো ছোটো কাগজ, কালো কালো কিসের গুঁড়ো আর সিগারেটের ফিল্টার পড়ে থাকতে দেখে। আজও দেখেছে।
পুনরায় আশপাশটায় চোখ বুলিয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেলল উপমা। হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা গাছের ডাল কুড়িয়ে নিয়ে একটা একটা করে পাতা ছিঁড়তে লাগল। খানিক পর মনে হলো কেউ যেন ওর চুলে হাত দিয়েছে, শুধু তাই নয় রীতিমতো বেনি ধরে টানছে। ভ্রু কুঁচকে ফিরে তাকাতেই এক সেকেন্ডের জন্য কাঠ হয়ে গেল উপমা। একি? কাকে দেখছে সে। যে মানুষটাকে একপলক দেখার তৃষ্ণায় তৃষিত হয়েছিল চোখদুটো। যার অপেক্ষায় মরমে মরমে মরছিল সে এতটাদিন। সেই মানুষটা আজ এতদিন পর তার সামনে? তাও এমন অকস্মাৎ ভাবে।
বলা বাহুল্য রিকশা নিয়ে রওনক এই পথ দিয়েই ক্যান্টিনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। যেতে যেতে পথে হুট করেই এদিকে চোখ পড়ে যায়। এবং কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে চিনতে এক মুহুর্ত দেরি হয় না তার। ঠোঁটের কোনে ফুটে ওঠে অবর্ণনীয় হাসির ছটা। এরপর ক্ষণকাল দেরি না করে রিকশা ছেড়ে দিয়ে সরাসরি পা বাড়ায় এদিকে।
ময়াল সাপের মতো উপমার বেনিটা হাতের মুঠোয় পেঁচিয়ে নিতে নিতে স্মিতহাস্যে রওনক শুধল,
— একা কেন, সাঙ্গপাঙ্গ আসেনি?
তৎক্ষনাৎ জবাব দিতে পারল না উপমা। সে এখনও ঠাহর করতে পারছে না ভুল দেখছে নাকি সঠিক। অন্দরমহলে রীতিমতো ভা ঙ চু র শুরু হয়েছে তার। নোনা অশ্রুর স্রোত বেড়িবাঁধ ঠেলে তীব্র গতিতে উপচে পড়তে চাইছে চোখের সীমানা ছাড়িয়ে।
এক পর্যায়ে স্বগতোক্তিতে সে বলল,
— আপনি ভ্রম নাকি বাস্তব?
ক্ষীণ গলায় কথাটা বললেও রওনকের কান অবধি পৌঁছতে সময় নিলো না। চমৎকার হেসে সে জবাব দিলো,
— ছুঁয়ে দেখো।
উপমার মনবাসনাও এমন। তাই মুহুর্ত দেরি না করে ততক্ষণাৎ সে হাত বাড়িয়ে দিলো রওনকের পানে। ঈষৎ ঝুঁকে রওনকও সহাস্যে এগিয়ে দিলো নিজের সুকুমার মুখখানি উপমার হাতের নাগালে। খোঁচা দাড়িতে ঢেকে যাওয়া ওর কপোলে হাত বোলাতেই শিরশির করে উঠল উপমার পুরো শরীর। চট করে উঠে দাঁড়িয়ে অভিমানরত গলায় সে বলল,
— এতদিনে আসার সময় হলো?
প্রিয়তমার অনুরাগ পুরোটা উপলব্ধি করতে পারল রওনক। ওষ্ঠাধরে অতি মৃদু অতি মধুর হাসি ফুটিয়ে বেনি ছেড়ে মাথার পেছনে হাত রাখল উপমার। আলতো করে মাথাটা বুকে চেপে ধরে শুধল,
— ডাকু সর্দারনী বুঝি অপেক্ষা করছিল আমার জন্য?
রওনকের মুখে “ডাকু সর্দারনী” সম্বোধন শুনে চকিতে মুখ তুলে চাইল উপমা। ভেঙচি কেটে বলল,
— একদম না।
— তবে এ অনুরাগ কিসের?
— জানি না।
দ্বিগুণ অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিলো উপমা। ঠোঁট কামড়ে হেসে সস্নেহে ওর গালে হাত রাখল রওনক। নিজের দিকে ফিরিয়ে কোমল গলায় বলল,
— অভিমানের সম্পর্ক কার সাথে হয় জানা আছে তো?
জবাব দিলো না উপমা। রওনকই ফের বলে উঠল,
— তাহলে কি ডাকু সর্দারনীর তরফ থেকে হ্যাঁ ধরে নেব?
— কিসের হ্যাঁ? কেউ তো আমাকে সরাসরি কিছু বলেনি।
বাঁকা উত্তরে ঠোঁট কামড়াল রওনক। কোমল গলায় ক্ষীণভাবে শুধল,
— ভালোবাস?
প্রশ্নটাকে এড়াতে চাইল না উপমা। প্রিয়তমের চোখে চোখ রেখে পাল্টা প্রশ্ন করল,
— আপনি বাসেন?
— বাসি। আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি উপমা। ভীষণ।
সহজ স্বীকারোক্তিতে লাজরাঙা হয়ে উঠল উপমার মুখখানা। তথাপি দৃষ্টিজোড়া মিলিয়ে রেখে সে বুঁজে আসা গলায় প্রতুত্তর করল,
— আমিও।
— আমিও কি?
— ভা..ভালোবাসি আপনাকে।
শেষের দিকে শব্দগুলি যেন জড়িয়ে যাচ্ছিল জিভে। এত লজ্জা!
ঘোরগ্রস্তের মতো প্রিয়তমার লাজরাঙা মুখখানি অবলোকন করে যাচ্ছিল রওনক। একপর্যায়ে আলতো করে চিবুকের কাছটায় হাত রাখল। আঙুল বুলতে বুলতে বলল,
— তোমার চিবুক সুন্দর।
হঠাৎ প্রশংসায় লজ্জা দ্বিগুণ বেড়ে গেল উপমার। কপোলদ্বয় এবং কান গরম হয়ে উঠল। চট করে মুখ লুকিয়ে নিলো সে রওনকের বুকে। এতক্ষণেও তার দৃষ্টি ব্যান্ডেজ করা হাতটায় পড়েনি। বুকে মাথা রাখতে গিয়ে অপাঙ্গে দৃষ্টি পড়ে গেল। তৎক্ষনাৎ ঠোঁটের কোনের সমস্ত হাসি কর্পুরের মতো উবে গেল। র”ক্তশুন্য ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে রওনকের পানে চাইল সে। রওনক বুঝতে পারল এতক্ষণে প্রিয়তমার নজর পড়েছে তার ক্ষ”তে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। প্রিয়তমার চোখের সীমানায় ফুলে ওঠা নোনাপানিগুলোকে নখের ডগায় নিয়ে কোমল স্বরে বলল,
— আমার মতো মানুষের সাথে পথ চলা খুব কঠিন উপমা। প্রত্যেক সেকেন্ডে নি র্ম ম কিছু শোনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে। এটা কীভাবে হলো আজ বলব না। মানসিকভাবে শক্ত হও। নি র্ম ম থেকে নি র্ম ম তম সত্য শুনে যেদিন তোমার চোখজোড়া ভিজে উঠবে না সেদিন বলব আমার সমস্ত ক্ষ তে র কথা।
— আপনি এত নিষ্ঠুর!
অল্প ঠোঁট নাড়িয়ে এতটুকুই উচ্চারণ করতে পারল উপমা। বিনিময়ে রওনক কাষ্ঠ হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
— মাফ করো। তোমার চোখের কোলে এক বিন্দু বিষাদ সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। হৃদয় এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যায়। এদিক থেকে যে আমি নিরুপায়;একদম নিরুপায়।
চলবে,
Sinin Tasnim Sara