চিঠি দিও ১৮

চিঠি দিও ১৮
______

“চাচা এক কেজি চিনি আর এক প্যাকেট সুজি দিয়েন।”
এতটুকু বলে একটু থামল বকুল। মাথার ওড়নাটা ভালো করে টেনে ইতস্ততভাবে প্রায় অস্পষ্ট স্বরে পুনরায় বলল,
— আর এ খরচটাও খাতায় লিখে রাখেন। পরের মাসের প্রথম সপ্তাহে একসাথে সব টাকা দিয়ে দেব।
দোকানদার তখন মাত্র চিনির বস্তায় হাত দিয়েছে। বাকির কথা শুনে তার হাতজোড়া থেমে গেল। আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বকুলকে আপাদমস্তক তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে খ্যাঁক করে উঠল।
— ট্যাকা দিতে পারবা না তো খরচ নিতে আসো কেন? কোননো বাকি টাকি দিবার পাবো না। আগেরই তো ম্যালা জমি আছে।
— সব টাকা পরিশোধ করে দিব চাচা। এ মাসটায় একটু হাত টান পড়েছিল বলে দিতে পারিনি।
অনুনয়ের সুরে বলল বকুল। মাঝবয়েসী দোকানদারের তবু মায়া হলো না। ক র্ক শ স্বরে সে রীতিমতো ধ ম ক দিয়ে উঠল বকুলকে।
— ট্যাকা নাই তা ভালোমন্দ খাওয়ার শখ ক্যান? লইজ্জা-শরম নাই।

এ পর্যায়ে কিছু বলতে গিয়েও জিভটা নড়ল না বকুলের। চোখ দু’খানা হয়ে উঠল অশ্রুসজল। ঝাপসা চোখে আঁড়ভাবে আশপাশটায় তাকিয়ে দেখল দোকানের সামনে কাঠের বেঞ্চের ওপর বেশ কয়েকজন পুরুষ মানুষ বসা। সকলের চোখে কি তাচ্ছিল্য ভেসে বেড়াচ্ছে? লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পারল না। গলার কাছে কা ন্না দলা পাকিয়ে আটকে আছে। না বেরুতে পারছে, না গিলতে পারছে। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। ওড়না শক্ত করে চে পে ধরে আরেকবার চেষ্টা করল দোকানদারকে বোঝানোর। কিন্তু লাভ হলো না। দ্বিতীয়বার কটু কথা শুনে মানসম্মান ক্ষোয়াতে হলো।
শেষে হাল ছেড়ে দিলো বকুল। দীর্ঘশ্বাস চেপে ফিরতি পথ ধরল। মায়ের শরীরটা আবারও
খা রা প করেছে। সেই যে বসন্ত হলো এরপর নানারকম অ সুস্থতা লেগেই আছে। সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে জ্বরটা। আজ পনেরো দিন যাবৎ জ্বর। একবার কমে তো একবার বাড়ে। ডাক্তার বেশকিছু টেস্ট দিয়েছেন। দুটো করানোর পর আর টাকা কুলোয়নি। মোটা অংকের টাকাই পাঠিয়েছিল এবার ভাইয়েরা। সবটা ডাক্তারের পেছনে চলে গেল। সেদিন হাসপাতাল থেকে ফিরে ওবাড়ি গিয়েছিল। ছোট ভাই রেখে গিয়েছিল তার জন্য হাজার তিনেক টাকা। বড় ভাবী হাতে গুঁজে দিলো। ওতে মাসের এ ক’টাদিন বেশ চলে যেত। কিন্তু সেই টাকাও অজ্ঞাতে বাবা চুরি করে নিয়ে গেল। সংসার চালানোর টাকা সব লাগিয়ে দিলো জু”য়া”য়। জু য়া-জু য়া করে সংসারটা পুরো মাটি করে দিলো বাবা। সকালবেলা ডালের কৌটোয় নোটগুলো না পেয়ে দুচোখ ফে টে কান্না আসছিল বকুলের। লোকে বলে পৃথিবীতে নাকি খারাপ বাবা নেই? তবে তার ভাগ্য সবার থেকে আলাদা হলো কেন!
প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে ওড়নার কোণ দিয়ে চোখের পানি মুছে বাড়ির দিকে পা বাড়াল বকুল।
পাড়ায় বখাটেদের সংখ্যা বেড়েছে। পাঁচ-ছয়জনের একটা গ্রুপ আছে। নিয়ম করে মেয়েদের উত্যক্ত করা ওদের স্বভাব। গলির মাথায় একটা বেঞ্চের ওপর বসে সারাটাদিন আড্ডা দেবে। কোনো মেয়েমানুষকে পথ দিয়ে যেতে দেখলে মোটরসাইকেলে করে পিছু নেবে, শিঁষ বাজাবে এবং অশ্লীল মন্তব্য করবে। বেশ কয়েকদিন এসবের শিকার হয়েছে বকুল। আজও অন্যথা হলো না। মোড় ঘুরতেই
ব দ মা শ গুলোর দেখা পাওয়া গেল। দূর থেকে দেখেই ওরা মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিয়েছিল। সুযোগ বুঝে এবার বকুলের পিছু নিলো। শিঁষ বাজাতে বাজাতে নোং রা মন্তব্য ছুঁ ড়ে দিতে লাগল বকুলের দিকে । ভেতরে প্রচন্ড রা গ জমা হলেও তা নিয়ন্ত্রণ করে মাথা নীচু করে হাঁটছিল বকুল। ওদের সাথে পেরে ওঠার সাধ্য ওর নেই, শেষে ইজ্জত ক্ষোয়াতে হবে। এতে ওরা সুযোগ পেয়ে গেল বেশি। চোখে চোখে ইশারা করে একজন বকুলের কাপড়ে টান দেয়ার চেষ্টা করল। হাতটাও বাড়িয়েছে ঠিক সেই মুহুর্তে হুট করে মোটরসাইকেলের চাকা কোনো কিছুর সাথে আটকে ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে গেল রাস্তায়। কেউ কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারল না কি হলো। তবে খানিক বাদে ওদের যে সঙ্গীসাথীরা অন্য মোটরসাইকেলে ছিল তারা এমন কিছু একটা দেখল আতঙ্কিত হয়ে তৎক্ষনাত ইউ টার্ন নিয়ে বাতাসের বেগে বেরিয়ে গেল। আশেপাশে যেসব মানুষ আছে ওরাও মাথা বাড়িয়ে কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে রইল কি হচ্ছে দেখার জন্য। এতটুকু সময়ের মধ্যে পেছনে কি হচ্ছে বুঝতে পারল না বকুল। তবে পড়ে যাওয়ার শব্দ সেও পেয়েছে। না চাইতেও কৌতুহলী হয়ে পড়ল। হয় না হয় করে একসময় পেছনে তাকালে বিস্মিত হয়ে দেখল ব খা টে গুলোর দুজন মোটরসাইকেলসমেত রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছে। আর মোটরসাইকেলের চাকা থেকে মোটাসোটা মতো একটা লাঠি টেনে বের করছে ওর ছোট ভাইয়া রওনক। ভাইকে দেখে এতক্ষণে যেন প্রাণ ফিরল বকুলের। সাথে হয়ে পড়ল আবেগি। এতক্ষণের জমতে থাকা কা ন্নাগুলি আর দমিয়ে রাখতে পারল না। রাস্তায় দাঁড়িয়েই অসহায়ের মতো শব্দ করে কেঁদে ফেলল। এ কা ন্নার অর্থ হলো এই, “আমার সাথে যতগুলি অ প রাধ, অবিচার হলো তার বিচার করবে না ভাইয়া?”
এদিকে বখাটেগুলো গায়ের ওপর থেকে মোটরসাইকেল সরানোর চেষ্টা করতে করতে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে লাগল রওনকের কাছে। ওরা জানে শত অনুনয় বিনয় করলেও রওনকের হাত থেকে ওদের নিস্তার নেই৷ তবুও খুব করে চেষ্টা করতে লাগল। রওনক শান্ত দৃষ্টিতে একবার বখাটেগুলোর দিকে আরেকবার বোনের দিকে তাকাল। এরপর লাঠি হাতে সোজা এগিয়ে গেল বকুলের কাছে। ক্রন্দনরত বকুলের হাতে লাঠি ধরিয়ে দিয়ে গমগমে স্বরে বলল,
— এতটা দিন যাবৎ যতবার শিঁষ বাজিয়েছে, যতবার ওড়নায় টান দেয়ার চেষ্টা করেছে সবগুলোর হিসেব হবে আজ। এটা ধরো আর মনের যত রা গ, ঘৃ ণা আছে সবটা মিটিয়ে নাও যাও।
জলভরা চোখে অবাক দৃষ্টিতে ভাইয়ের পানে চাইল বকুল। রওনকই পুনরায় বলল,
— কি হলো যাও।

এবারে আর দ্বিরুক্তি করল না বকুল। লাঠিটা শক্ত করে চেপে ধরে চপল পায়ে এগিয়ে গেল। কতদিন যাবৎ ঘৃ ণা পুষছিল এই ছেলেগুলোর প্রতি, সমাজের প্রতি, জীবনের প্রতি। প্রত্যেকটা প্র তি ঘা তে সেসব ঝুরো পলেস্তারার মতন খসে খসে পড়তে লাগল। এলোপাথাড়ি মা র খেয়ে ছেলেগুলো পারে না ওর পা ধরে মাফ চায়।
মা র তে মা র তে হাঁপিয়ে গেলে লাঠির ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াল বকুল। এতদিনের জমিয়ে রাখা অভিমান, অভিযোগগুলো বিষাদ হয়ে ঝরে পড়ছে ওর দুচোখ বেয়ে। আজ বিষাদকে বাষ্প বানিয়ে মিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে না ওর।
দূর থেকে সবটা দেখছে রওনক। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছে মৃদু হাসির রেখা। বোন বলে স্বীকৃতি দিতে চায় না সে মেয়েটিকে, অথচ তার মন জানে চমৎকার এই মেয়েটির জন্য হৃদয় গহীনে একটা গোপন কুঠুরি তৈরি হয়ে গেছে; যার নাম মায়া কুঠুরি। প্রতিদিন খুব যত্ন করে বোনের জন্য সে মায়া জমায়। সবাই ভাবে ওর মায়ের দ্বিতীয় পরিবারটাকে ও ভীষণ ঘৃ ণা করে। কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। ঘৃ ণা, বি দ্বেষ সমস্তটা মা আর তাঁর স্বামী নামক লোকটার জন্য হলেও ছোটো ছোটো ভাইবোন দুটিকে সে ভীষণ পছন্দ করে। ছোটোটা তো আশিকের বয়েসী। কি সুন্দর চাঁদপানা মুখ। অভাবের তাড়নায় শুষ্ক-নির্জীব লাগে। যতটা পারে সাহায্য করে রওনক। অজ্ঞাতে অথবা সরাসরি। তবুও অভাবটুকু মেটাতে পারে না। ওদের অভাব তো কেবল টাকাপয়সার নয়, যত্নেরও। আদর, ভালোবাসা, যত্ন এসব পেলে ওদেরকেও আর সকলের মতো স্বাভাবিক লাগত। রওনক জানে তার ক্ষমতা আছে ভাইবোনদুটোর অভাব মেটানোর। সে যদি একবার তাদের নিজ বাড়িতে জায়গা দেয় তাহলেই সমস্ত দুঃখ ঘুচে যাবে। কিন্তু সে করে না। ওদের প্রতি মায়া জমলেও মা নামক মহিলাটিকে আজ পর্যন্ত সে ঘৃ ণা করে। এতখানি ঘৃ ণা বক্ষে ধারণ করার পর কাউকে মমতা দেখাতে ওর ইচ্ছে করে না। না চাইলেও বকুল এবং তার ছোট ভাইটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ওদের মা। ওদের স্থান দিতে গেলে মাকেও দিতে হয়। কিন্তু সেটা করা রওনকের পক্ষে অসম্ভব। প্রাণ থাকতে ঐ ধোঁকাবাজ মহিলাটিকে দ্বিতীয়বার তাদের সংসারে পা রাখতে দেবে না রওনক; কিছুতেই না। অতীত সে ভুলে যায়নি। ভুলে যায়নি ছোট্ট রওনককে ফেলে প্রেমিকের হাত ধরে মায়ের পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা। আজ এতটা বছর হয়ে গেল মানসপট থেকে স্মৃতিগুলো মুছতে পারল না। প্রত্যেক মুহুর্ত প্রেতাত্মার মতো তাড়া করে ফেরে ওকে দৃশ্যটা। শরীরের মধ্যে যেন আ গু ন ধরিয়ে দিয়েছে কেউ এমন দ গ্ধ অনুভূতি হয়। সেসব ভাবনায় যেতে ইচ্ছে করছে না এখন।
হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে এগিয়ে গেল রওনক। মোটরসাইকেল সরিয়ে ছেলেদুটোকে বের করল। এরপর নিজেও কয়েক ঘা বসাতেই কোঁকাতে কোঁকাতে ছেলেদুটো ওর পা চেপে ধরল। বারংবার মাফ চাইতে লাগল। রওনক ইশারায় বকুলকে দেখালে বকুলের পা ধরেও মাফ চাইল। এরপর রওনক ওদের সতর্ক করে দিলো দ্বিতীয়বার এই পাড়ায় যেন দেখতে না পায়। দেখলেই কোনো কথা নেই শু ট করে দেবে।
ভয়ে ছেলেগুলোও প্রতিজ্ঞা করল, চলে যাবে ওরা এই পাড়া থেকে। আর কক্ষনও মুখ দেখাবে না।
ওদের বাকি সঙ্গীগুলোকে ধরতে মিজানসহ আরও দু’জন ছেলে গেছে। ক্লাবে নিয়ে গিয়ে ওগুলোকেও উত্তম-মধ্যম দেবে বলে ঠিক করেছে রওনক। এবং আ হ ত ছেলেগুলোকে কিছু টাকা ধরিয়ে রিকশা ডেকে হাসপাতালে পাঠালো চিকিৎসা করাতে। যাহোক কিঞ্চিৎ মানবতাবোধ তো ওর আছে নাকি!
এতক্ষণে বেশ কিছু লোক জমে গেছে আশেপাশে। সবাই আ’তঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রওনকের দিকে। ওদের দিকে চোখ তুলে একবার তাকাতেই সুরসুর করে স্বস্থানে পা বাড়াল সব। ওড়নায় মুখ চেপে বকুল তখনও কাঁদছে। জায়গাটা ফাঁকা হলে রওনক এবার বোনের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কাঁধে হাত রাখতেই লাউ ডগার মতো হেলে পড়ল বকুল ভাইয়ের বাহুতে। লাঠি ফেলে দু’হাতে বাহু জড়িয়ে মুখ গুঁজে ক্রন্দনরত স্বরে বলল,
— এত অসম্মানের চাইতে মৃ ত্যু ও শ্রেয় ভাইয়া। আর পারছি না আমি, আর পারছি না।
— কাঁদবে না বোকা মেয়ে। এত দ্রুত হাল ছেড়ে দিলে হয়? একপাক্ষিক সুখ ভোগ করার জন্য কেউই আসেনি পৃথিবীতে। পৃথিবীটা সংগ্রামের। প্রত্যেক মুহুর্ত লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। হাল ছেড়ে দিলে কীভাবে হবে?

বিনিময়ে কিছু বলল না বকুল। বিরতিহীন কান্না তখনও চলছে। ছোট্ট শ্বাস ফেলে ওকে সোজা করে দাঁড় করালো রওনক। চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
— যতদিন আমি আছি ভ য় নেই তোমাদের। সকল বিপদে আপদে ছায়ার মতো আমাকে পাশে পাবে; কথা দিচ্ছি।
এবার কান্নাকাটি থামিয়ে বলো তো এই বেলায় যাচ্ছটা কোথায়? আজ তো বন্ধের দিন।
কান্না কিছুটা কমেছে বকুলের। নাক টেনে ক্ষীণস্বরে সে বলল,
— সকালের খাওয়া হয়নি। খাবার কিনতে এসেছিলাম।
— তো কোথায় খাবার?
হাত ফাঁকা দেখে প্রশ্ন করল রওনক। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বকুলের। অসহায়ভাবে সে বলল,
— কিনতে পারিনি৷ টাকা নেই। বাকি দেয়নি দোকানদার।
একথা শুনে ভীষণ ক ষ্ট পেলো রওনক। বকুলের হাত চেপে ধরে বলল,
— ঠিকাছে চলো।
— কোথায়?
— চলো দেখতে পাবে।
বকুলের হাত ধরে সোজা সে দোকানের সামনে এনে দাঁড় করালো। বলা বাহুল্য মাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনাটা দোকানদারও চাক্ষুষ দেখেছে। ইতোমধ্যে সে বুঝে গেছে মেয়েটার সাথে কোনো না কোনো সম্পর্ক আছে গু ণ্ডা ছেলেটার৷ ছেলেটাকে অবশ্য সে চেনে। ইলেকশনের সময় মিছিলগুলোতে বারকয়েক দেখেছে। রাজনীতি করা ছেলে। র ক্ত গরম, কাউকে টের পায় না। ভ য়ে সিঁটিয়ে রইল দোকানদার। কণ্ঠে বিনীতভাব ফুটিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল,
— কিছু লাগবে ভাইজান?
বিনিময়ে কঠোর চোখে তাকাল রওনক। পকেটে হাত দিয়ে যতগুলো টাকা ছিল সব মুঠোয় পুরে বের করে দোকানদারের সামনে
ছুঁ ড়ে দিলো। শীতল গলায় বলল,
— একটা সংসারে মাসকাবারি যা যা লাগে প্যাকেট করে দাও। কোনো খরচ যেন বাদ না যায়৷
আর হ্যাঁ ও আমার বোন হয় চিনে রাখো। ওর নামে যতগুলি বাকি আছে সব আজ বিকেলের মধ্যে পেয়ে যাবা। নতুন একটা খাতা করবা। ও যেদিন যে খরচ নিয়ে যাবে সব আমার নামে লিখে রাখবা। আমি এসে টাকা মিটিয়ে দিয়ে যাব। বুঝতে পেরেছ?
— জ্বী জ্বী।
কাচুমাচু করে বলল দোকানদার।
— নাম জানো তো আমার?
পুনরায় রাশভারি কণ্ঠে প্রশ্ন করল রওনক। শুকনো ঢোক গিলে দোকানদার মাথা নাড়ল,
— না।
— জানো না মানে!
চোখ গরম করে ধমকে উঠল রওনক। ধমকে চমকে উঠে মুখ কালো করে ফেলল দোকানদার। মাথা নীচু করে আমতা আমতা করতে লাগল। রওনকই পুনরায় বলল,
— লিখে রাখবা রওনক ভাইজান৷
— জ্বী আচ্ছা।
— নাও এবার যা যা বলেছি প্যাকেট করো।

মাথা নেড়ে চটপট বাজার গোছাতে লাগল দোকানদার।
এসব দেখে মাথা নীচু করে ক্ষীণস্বরে বকুল বলল,
— আমাদের এসব কিচ্ছু চাই না ভাইয়া।
রওনক তাকেও ধমকাল,
— বেশি বুঝতে যাবা না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো।
ধমকে ঈষৎ কেঁপে উঠে আর কিছু বলার সাহস পেলো না বকুল।

কম সময়ের মধ্যে মাঝারি সাইজের দুটো ব্যাগ ভরে গেল খরচে। ব্যাগদুটো এগিয়ে দিয়ে খাতা নিয়ে হিসেব কষতে লাগল দোকানদার। পুরনো হিসেব মিলিয়ে মোটা অংকের টাকাই দাঁড়াল। ভ য়ে ভ য়ে সবটা সে বুঝিয়ে দিলো রওনককে। রওনক যা টাকা দিয়েছে তাতে অর্ধেকটা মিটে যায়। বাকি অর্ধেক বিকেলে দিয়ে যাবে বলে দিলো রওনক।
দোকানদার যদিও নাখোশ কিন্তু মুখে বিনীতভাব ফুটিয়ে রাখল। পারলে সে টাকাই নেয় না এমন ভাব। শেষে এক খিলি পান এবং এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে ব্যাগ হাতে বাইরে বেরুলো রওনক। বকুল নিতে চাইছিল একটা ব্যাগ, দ্বিতীয় ধমকে আর সাহস হলো না।
ওরা বেরিয়ে আসার পর ঘৃ ণা র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সরোষে দোকানদার বিড়বিড় করল,
” আমি জাহানুর এসলাম বটির মইদ্যত ছাই ছাড়া তোক ছেঁচা দেই কুইত্তা”

রওনকের ক্ষ ত এখনও সেরে ওঠেনি। ব্যান্ডেজটা রয়ে গেছে হাতে। তা সত্ত্বেও অপর হাতে সে ভারী ভারী দুটো বাজারের ব্যাগ বইছে। ক ষ্ট হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে যাচ্ছে, বেশ ঘামছেও। দেখতে দেখতে আর সহ্য হলো না। জোর করে একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে বকুল বলল,
— খালি হাতে হাঁটতে ইচ্ছে করে না ভাইয়া।
রওনক শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছু বলল না। একটুখানি কষ্ট হচ্ছিল তারও।
কিছুটা পথ গিয়ে পুনরায় বকুল ভয় মিশ্রিত গলায় বলল,
— একটা প্রশ্ন করি ভাইয়া?
— করো।
— ইয়ে মানে আপনি হঠাৎ এদিকে।
হাঁটার গতি মন্থর করে একপলক চাইল রওনক। ধীর কণ্ঠে জবাব দিলো,
— কাজে আসছিলাম।

কাজটা মূলত তার এই, বকুলের পরিবারের খোঁজখবর নেয়া। সেই যে হাসপাতালে রেখে এলো এরপর দেখাসাক্ষাৎ আর হয়নি। লোক রেখেছিল অবশ্য আড়াল থেকে খোঁজখবর রাখার। ভেবেছিল নিজে এসে একবার দেখে যাবে। নানা ব্যস্ততায় হয়ে ওঠেনি। এরপর তো বাইরে গেল। ফিরে এসে দেখা করত। তখুনি শুনতে পেলো কয়েকটা ব খা টে উৎপাত করছে পাড়ায়। শিকার হয়েছে বকুলও। মাথা ঠিক রাখতে পারেনি রওনক। সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে সোজা চলে এসেছে ব দ মা শ গুলোকে শায়েস্তা করতে। আজ ঘটনাটা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ না করলেও ব খা টেগুলো মা র খেতো। সেরকম ব্যবস্থাই করেছিল রওনক। তবে ভালই হয়েছে। স্বশরীরে আসার পর আরও অনেক কিছুই দেখতে পেয়েছে যা অনেক আগেই দেখা উচিৎ ছিল। না চাইতেও অবহেলা করে ফেলেছে সে ভাই-বোন দুটোকে। আর এজন্য নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না রওনক।
— ভাইয়া আপনার হাতে কি হয়েছে?
বকুলের কথায় ধ্যান ভা ঙ ল রওনকের। সংক্ষেপে জবাব দিলো,
— অ্যা ক্সি ডে ন্ট করেছিলাম।
— সেকি! কীভাবে?
— করেছিলাম একভাবে। যাইহোক এসে গেছে তোমার বাড়ি। এই নাও বাজারের ব্যাগ ঝটপট খাবার তৈরি করে খেয়ে ফেলো। এতটা সময় অভুক্ত থাকা ঠিক নয়। আর তোমাকে যে বলেছিলাম কোনো প্রয়োজন হলে জানাবে৷ এতকিছু হয়ে গেল জানালে না কেন?
— গিয়েছিলাম আপনাদের বাড়িতে। বড় ভাবী টাকাও দিয়েছিলেন কিন্তু টাকাগুলো…
কথা সম্পূর্ণ করল না বকুল। না করে বলল,
— আপনিও বাড়িতে ছিলেন না।
— হু শহরের বাইরে গিয়েছিলাম কাজে।
— বসবেন না ভাইয়া?
— উঁহু। সময় নেই। আমি বরং যাই বকুল।
পিছু ঘুরে গমনোদ্যত হলো রওনক। তৎক্ষনাৎ ডেকে উঠল বকুল,
— একটু দাঁড়াবেন ভাইয়া?

রওনক দাঁড়াল। ব্যাগ হাতে ছুটে বাড়ির ভেতরে গেল বকুল। ফিরে এলো মিনিট দুয়েক পর। হাতে কালো চামড়ার একটা মানিব্যাগ। মানিব্যাগটা রওনকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ইতস্ততভাবে বলল,
— আমার প্রথম উপার্জনের টাকা দিয়ে আপনার জন্য একটা উপহার কিনেছিলাম। নিজ হাতে দেব, এতদিন সুযোগ হয়নি। আজ হলো। না করবেন না ভাইয়া। প্লিজ।

প্রথম উপার্জনের টাকা শুনে সহসা চমকে উঠেছিল রওনক। বাইরে প্রকাশ না পেলেও চমকটা তার চোখজোড়াকে কম্পিত করল। এত স্নেহমাখা আবদার সে ঠেলতে পারল না। বাধ্য হয়ে হাতে নিলো উপহারটা। তবে মুখে বলল,
— উপহার কেন আবার?
ভাই যে উপহার গ্রহণ করবে কল্পনাও করেনি বকুল। বাঁধভাঙা আনন্দে সিক্ত হয়ে উঠল তার মন। চমৎকার হাসি ফুটিয়ে নীচু স্বরে সে বলল,
— কারণটা মানিব্যাগের ভেতরের ছোট্ট কাগজটায় আছে। বাড়ি গিয়ে দেখবেন কেমন? আজ তবে আসি ভাইয়া। সাবধানে থাকবেন, ঠিকমতো ঔষধপত্র খাবেন। আর বাইরে কম ঘুরবেন। একটা দুর্ঘটনা ঘটল, শরীরকে একটু রেস্টও তো দিতে হয় নাকি?
একদমে কথাগুলো বলে দাঁড়াল না বকুল। ভয়ে তার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। ভয় কমাতে রীতিমতো পালিয়ে এলো। শেষের কথাগুলো একটু শাসনের ভঙ্গিমায় বলেছে। যদি ভাই ধমক দিতো!
এদিকে বকুলের গমন পথে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল রওনক। মেয়েটা মাত্র শাসন করল ওকে? কেন যেন ভালো লাগল। খুব ভালো লাগল।

মানিব্যাগের ভেতর চার ভাঁজ করা ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো। হাঁটতে হাঁটতে কাগজটা বের করল রওনক। ভাঁজ খুলে পড়তে শুরু করল৷ লেখা,

“প্রিয় ছোটো ভাইয়া,
সামনে থেকে আপনাকে কখনো তৃপ্তিভরে ডাকতে পারি না। ভয় করে যদি ধমক দেন? ডাকতে না পারার কারণ কেবল ভয় নয় অবশ্য। এর সাথে মিশে আছে একপ্রকার অপরাধবোধও। বাবা-মায়ের কৃত অপরাধের বোঝা কখনও সন্তানদের কাঁধে এসে চেপে যায়। বোঝাটা যে কেন এত ভারী!
আমাদের চরম দুঃসময়ে বটবৃক্ষের ছায়া হয়ে যে মানুষটা পাশে দাঁড়িয়েছে, দু’হাতে আগলে রাখার মতো নিরাপত্তা দিচ্ছে সেই মানুষটার সাথে, তাঁর পরিবারের সাথে একসময় চরম অন্যায় করেছে আমার মা-বাবা ভাবলে অপরাধবোধে নুয়ে আসে মাথাটা। আপনি, আপনারা কখনও ক্ষমা করতে পারবেন কি আমাদের?
আচ্ছা অপরাধবোধ কাজ করলে কি ভালোবাসা মানা? ভাইয়া আপনি কি জানেন, কি চমৎকার একটা মানুষ আপনি। আমাদের জীবন নামক বিষাদগ্রস্ত মেঘময় আকাশের একমাত্র উজ্জ্বল নক্ষত্র;the brightest star of our sky. আমরা আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসি ভাইয়া। অসম্ভব।
ইতি,
বকুল ও বিহন
পুনশ্চঃ পড়াশোনার পাশাপাশি একটা টিউশনি শুরু করেছি ভাইয়া। আপনাদেরকে জানানো হয়নি। বেতন কম হলেও চলে যাওয়ার মতো।
গতমাসে প্রথম বেতনের টাকা হাতে পেলাম। টাকাটা হাতে পাওয়া মাত্র মনে হলো এই টাকায় একটা চমৎকার মানুষের জন্য উপহার কিনে ফেললে কেমন হয়? সামর্থ্যে যতটুকু কুলোয় কিনেছি। পছন্দ না হলেও ফেলে দেবেন না ভাইয়া। স্মৃতি রক্ষার্থেও নিজের কাছে রাখবেন। অনুরোধ।”

পুনরায় চিঠি ভাঁজ করে মানিব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলল রওনক। অজান্তে চোখের কোলে অশ্রু জমে গেছে। আনন্দাশ্রু। হাতের তালু দিয়ে অশ্রুটুকু মুছে হাসলো রওনক। স্বগতোক্তি করল,
“স্নেহের বকুল, আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার দেবার জন্য ভাইয়ের পক্ষ থেকে তোমাকে বুকভরা স্নেহ এবং ভালোবাসা। আগামী দিন দেখা হলে তৃপ্তিভরে ভাই ডাকার সুযোগটা অবশ্যই দেব তোমাকে।”
_______________

আজ সন্ধ্যাভোজে সকলে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছে। আলোচনার বিষয়বস্তু আশিনের বিয়ে। চাকরি জীবনের দুই বছর তো হয়েই গেল। এখনও ছেলের বিয়ে-থা করে সংসার সাজানোর কোনো ইচ্ছে নেই। মেজো ছেলেকে নিয়ে খুব স্বপ্ন, খুব আশা শিল্পীর। দেখেশুনে বেয়াই বাড়ি পছন্দ করবে, চাঁদাপানা একটা মুখ বাড়ি আনবে। যার নূরের মতো চেহারা থেকে ঠিকরে পড়া আলোয় বাড়ি ঝলমল করবে। যদিও এমন আশা তাঁর সব ছেলেকে নিয়েই ছিল। তবে ভাগ্য দোষে দুই ছেলে তাকে কেবল নিরাশই করল। আবিদটাকে অবশ্য পুরোপুরি দোষারোপ করা যায় না। মায়ের অনুগতই ছিল বড় ছেলে। মাও বড়মুখ করে যাচাই-বাছাই করে মনমতো পাত্রী নির্বাচন করেছিল ছেলের জন্য। বড় ঘর, সম্মানের দিক দিয়েও উঁচু বংশমর্যাদার। মোটকথা ঈর্ষা করার মতো একটা সম্বন্ধ।

বিয়ে দিতে গেলে আগে পরে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু ঐ সম্বন্ধটাতে কেন যেন পূর্ব কোনো সমস্যায়ই পড়তে হয়নি। নিঝঞ্ঝাট এগিয়ে যাচ্ছিল সব। তখন কি আর কেউ আন্দাজ করতে পেরেছিল সবটাই ছিল একটা চোখের ধোঁকা, ভ্রম৷ কিংবা বলা যায়, মহা প্রলয়ের পূর্বের নিস্তব্ধতা। কত আনন্দ, কত স্বপ্ন নিয়ে ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিল বিয়ে করাতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে ঘটল এক অঘটন। বিয়ের আসর ছেড়ে পাত্রী উধাও। কোথায় গেল? কোথায় গেল? পরে পাওয়া গেল চিঠি। প্রেমিকের হাত ধরে মেয়ে ভেগেছে। মেয়ের পরিবার জানতো সব। প্রেম মানবে না বলে জোর করে বিয়ে দিচ্ছিল। মেয়েও কি কম যায়! শেষে কপাল পুড়ল আদরের ছেলেটার। ভরা আসরে অসম্মানিত হওয়ার পর ছেলে এমনভাবে বিয়ে বিমুখ হয়ে গেল! কিছুতেই আর মতি ফেরাতে পারল না শিল্পী। আর এদিকে সেজোটি, সে তো আপন মর্জির মালিক। কাউকে না বলে, না জানিয়ে একলা একলা বিয়ে করে ফেলল তাও আবার বউ তুলে এনে। মা-বাবার মনস্কামনা কোনদিন তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
ছোটোটিকে নিয়ে আশা নেই। ওকে এখনও দুধের শিশু বলা চলে।
তাই বর্তমানে সমস্ত শখ, আহ্লাদ মেজো ছেলেটিকে ঘিরে। কে জানে সেও কেন মায়ের মন রাখতে চাইছে না।
এই যে এত শখ করে ঘটককে বলে রাখল। বাড়ি বয়ে এসে ঘটক পাত্রির ছবিও দিয়ে গেল। কিন্তু পাত্রি দেখতে রাজি নয় আশিন। কেন রাজি নয়? কোনো উত্তর নেই। বাধ্য হয়ে তাই ভাসুরের শরণাপন্ন হয়েছে। তিনি বাড়ির কর্তা। ভালোমন্দ তিনিই বুঝুক। সমাধান করুক৷
বহুদিন থেকে ভাই এবং ভাইবধূর দুশ্চিন্তার বিষয়টা শুনে আসছেন রঞ্জু সাহেব। ভাইয়ের সাথে যা চিঠিপত্র আদানপ্রদান হয় কিংবা টেলিফোনে কথা হলেও ছেলেদের বাউণ্ডুলে জীবন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে ভাইটি। এই বয়েসে এমন দুশ্চিন্তা করতে দেখে খারাপই লাগে রঞ্জু সাহেবের। তাই অনেক ভেবেচিন্তে চিঠি পাঠিয়ে মেজো ভাস্তেকে এবার ডেকে পাঠিয়েছেন তিনি। যা কথা সামনে থেকেই হোক।
সেই কথাই আজ হচ্ছে। বিয়েতে কেন রাজি নয় আশিন উপর্যুক্ত কারণ তাকে দর্শাতে বলা হচ্ছে। উপস্থিত পরিবারের সদস্যদের ওপর একবার নজর বোলালো আশিন। বিয়েতে রাজি না হওয়ার কারণ সকলের সামনে সে বলতে পারবে না। কারণটা খুব লজ্জার। আবিষ্কার করার পর থেকে লজ্জায় সংকুচিত হয়ে আছে সে বহুদিন যাবৎ। তথাপি কিছু একটা তো বলতে হয়। নড়েচড়ে বসে গলা খাঁকারি দিয়ে বড়বাবার দিকে একপলক চাইল আশিন। মাথা নীচু করে বলল,
— আমি এখন বিয়ের জন্য প্রস্তুত নই বড় বাবা।
ছেলের মুখ থেকে এমন ধারা কথা শুনে আকুলিবিকুলি করে উঠল শিল্পী। রাগত্ব গলায় বলল,
— ভাইজান ওদেক পুছেন ওরা কি আমার
ম রা মুখ দেখপার চায়? এই সংসারটাত কয়টাদিন শান্তিমতো থাকতে পারছি। ছেলেমেয়ে বড় হইলে বাপ মায়ের দুঃখ ঘুচে। আমার সাত রাজার ধনেরা দুঃখ কমাবে কি পারলে নতুন নতুন দুঃখের আমদানি করে।

ভাই বধূর তীব্র স্বর একটু বিরক্তির সৃষ্টি করল রঞ্জু সাহেবের মধ্যে। তিনি শান্তিপ্রিয় মানুষ। বড় বড় সমস্যা ঠান্ডা মস্তিষ্কে সমাধান করতে পছন্দ করেন। অল্পে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হাহাকার করা ওনার ধাঁতে নেই। তথাপি হাত তুলে স্বাভাবিক গলায় বললেন,
— আহ্ শান্ত হও শিল্পী। আশিন কি বলতে চাই শুনি। ওর পক্ষটাই তো গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্যই আজ বসা।
হ্যাঁ আশিন বলো তোমার কি সমস্যা বলো তো?
বড় বাবার গম্ভীর গলা শুনে ছোট্ট করে শ্বাস টানল আশিন। শুকনো ঠোঁট অশুষ্ক জিভ দ্বারা ভিজিয়ে বলল,
— মাত্র চাকরি শুরু করলাম বড় বাবা। গুছিয়ে নিতে সময় প্রয়োজন।
— এটা তো পুরোনো অযুহাত আশিন। নতুন কিছু বলো।
এবার অস্বস্তিতে পড়ে গেল আশিন। আমতাআমতা করে বলল,
— আবিদ ভাই এখনও…
— আবিদ কেন বিয়ে করছে না তা তোমার অজানা নয়। কোনোকিছু করেই তো তাকে বোঝানো সম্ভব হয়নি। এখন যদি তুমিও বালকসুলভ আচরণ শুরু করো তাহলে কীভাবে হয় আশিন?
একটু থেমে পুনরায় বললেন,
— দেখো বাবা, ছেলেমেয়েকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার পর সুস্থ সুন্দর সংসার গড়ে দেয়ার পর, দুচোখ ভরে তাদের সুখ দেখার পরই বাবা-মায়ের কাঁধ থেকে দুশ্চিন্তার বোঝা নামে। তোমাদের তিন ভাইকে মানুষ করতে কতখানি কষ্ট করতে হয়েছে তোমাদের বাবা-মায়ের কিছুই অজানা নয় তোমার কিংবা তোমার ভাইদের। কষ্টকে ওরা কষ্ট মনে করেনি কেবল তোমাদের মুখে হাসি ফুটে উঠতে দেখে। তোমাদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ দেখে।
একাকী জীবন সুখের হয় না আশিন। দিনশেষে প্রত্যেক মানুষের একটা পিছুটান থাকতে হয়। যাকে আঁকড়ে ধরতে বারবার ফিরে আসতে মন চাইবে। যে হবে তোমার সবচাইতে ভরসার জায়গা। তোমার আত্মিক-মানসিক শক্তি।
পরিবার থাকা সত্ত্বেও কাজের সূত্রে বাইরে থাকো। কি খাচ্ছ-না খাচ্ছ, কীভাবে দিন যাচ্ছে, অসুস্থতার দিনগুলিতে কেউ যত্ন-আত্তি করতে পারছে কি না এসব নিয়ে সবসময় তোমার মা দুশ্চিন্তায় থাকেন। তাঁর দুশ্চিন্তাও কি অমূলক?
তোমার বাবা, আমার ভাইটা সারাটাজীবন পরিবার থেকে দূরে দূরে থাকল। কাজের জন্যই তাকে ভিন্ন শহরে একাকী জীবন
কা টা তে হলো। তোমরা এত বড় হয়ে গেছ। সকলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছ। তবুও তার দুশ্চিন্তা একবিন্দু কমেছে? সে যখনই চিঠি লেখে তখন আবিদকে নিয়ে, তোমাকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তার কথা প্রকাশ করে। অভ্র এখনও ছোটো। আমাদের বিয়োগের পর ওর দায়িত্বও তো তোমার কাঁধেই এসে পড়বে। তোমরা একাহাতে ওর ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করতে পারবে, ওর মানসিক সাপোর্ট হতে পারবে কতটা? কতটা ওর আবদারের জায়গা হয়ে উঠতে পারবে? সমস্ত অভাব মেটানোর পরও একটা শূন্যতা রয়ে যাবে। এই শূন্যতার জায়গাটা মেটাতে পারবে কেবল একজন নারী। স্নেহ, মমতায় ইট-পাথরের বাড়িকে সংসার করে তুলবে।
এছাড়াও আমাদের এত সম্পদ, প্রতিপত্তি। এসবকে এগিয়ে নিতে হলে বংশ বাড়ানো চাই।
তোমার সমস্যাটা যদি আমাদেরকে খুলে না বলো তাহলে কীভাবে বুঝব বাবা বলো তো?

এ পর্যায়ে কিছু বলার জন্য ঠোঁট নড়ে উঠল আশিনের। কিন্তু বলতে পারল না।
তা দেখে রঞ্জু সাহেবই পুনরায় বললেন,
— তোমার কোনো পছন্দ থাকলে নির্দ্বিধায় বলতে পারো আশিন। আমরা সে দিকটাও বিচার করে দেখব।
পাশ থেকে শিল্পীও বলল,
— হ্যাঁ তোর পছন্দ থাকলে বল৷

এতক্ষণ যাবৎ একমনে চুপচাপ বসে ছিল উপমা। পছন্দের কথা শুনে একটু নড়ে উঠল। ফ্যাকাশে হয়ে উঠল ওর মুখ। দৃষ্টিজুড়ে খেলা করতে লাগল তীব্র অস্বস্তি আর একটুখানি দ্বিধা। দৈবাৎ আশিনও কেন যেন চোখ রাখল ঠিক তার দ্বিধান্বিত দু চোখে৷ চেহারার সমস্ত রঙ উড়ে গেল উপমার। একমনে প্রার্থনা করতে লাগল সেদিনের সেজো ভাবীর কথাটা যেন মিথ্যে হয়;পুরোটা মিথ্যে হয়। কিন্তু মিথ্যে তো তার নিজেরই মনে হচ্ছে না। মেজো ভাইয়ের চোখের ভাষা আজ বড্ড অপরিচিত। অপরিচিত এই ভাষাটিকে ভীষণ ভয় করছে উপমার। তার সমস্ত সত্তা জুড়ে যে অন্য কারোর বসবাস। রওনকময় এ জীবনে নতুন কাউকে কল্পনা করা তার পক্ষে মৃত্যুসম;স্রেফ মৃত্যুসম।
উপমার থেকে চোখ সরিয়ে সোজা হয়ে বসল আশিন। নীরবতা ভেঙে ক্ষীণস্বরে বলল,
— আমাকে একটু সময় দিন বড়বাবা। মা। ভরসা রাখুন আমার ওপর। আমাকে নিয়ে যে আশা-আকাঙ্ক্ষা জমা আছে আপনাদের মনে একটিকেও বিফলে যেতে দেব না। শুধু আমার অন্তর্দ্বন্দটা একটু কা টা তে দিন। একটা দ্বিধার সাগর পাড়ি দিচ্ছি আমি। দ্বিধাটুকু সরাতে দিন। এরপর নিজে থেকেই সদুত্তর নিয়ে আসব আমি আপনাদের কাছে।

আশিনের কণ্ঠে এমন কিছু ছিল সকলে বাধ্য হলো ওকে সময় দিতে। বি”পদের কথাটা আলগোছে এড়িয়ে গেল তা দেখে উপমারও যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। অন্য কেউ তার প্রসন্ন মুখমণ্ডলের জ্যোতি দেখতে না পারলেও আশিনের চোখ এড়াতে পারল না কিছুই। না বোধক আশংকায় বুক ভার হয়ে এলো তার। হতাশা মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাসের ভারে ভেতরে ভেতরে সে যেন ন্যুব্জ হয়ে পড়ল। ক্ষণস্থায়ী জীবনটার আনাচে-কানাচেতে জটিলতার বিচরণ এত স্বতঃস্ফূর্ত কেন?
চলবে,
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here