চিঠি দিও ২২

চিঠি দিও
২২

খিদেয় হাল বেহাল উপমার। কলেজ থেকে ফিরে কোনোরকমে ব্যাগ নামিয়ে রেখে কাপড়টাও ছাড়েনি ওভাবেই ছুটে এসে ডাইনিংয়ে বসেছে। ডাইনিং ভরা খাবার সাজিয়ে রাখা কিন্তু প্লেটে তুলে দেয়ার মতো কেউ নেই। বাড়িতে আপাতত সে, বড় মামা সেজো ভাই-ভাবী আর অভ্র। মামি জান্নাতিকে নিয়ে মেজো ভাইয়ের সাথে ঢাকায় চলে গেছেন। কয়েকটা মাস ওখানে থাকবেন বলে ঠিক করেছেন। বড় মামাই অবশ্য পাঠালেন ওনাকে। এক তো প্রয়োজন ছাড়া মামির বাইরে বেরুনো হয় না, তারওপর তিনটে পুরুষ মানুষ ব্যস্ত শহরটায় একা একা পড়ে থাকে। নিয়মের বালাই নেই তাদের জীবনে। সবসময় তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন মামি। আর কত? এবার একটু চিন্তার ভারটা নামুক।

সেজো ভাবীকে আশেপাশে দেখতে পেলো না উপমা। ভাবল কোনো জরুরি কাজে ব্যস্ত বোধহয়। ডাকল না আর তাকে। নিজেই প্লেটে খাবার তুলে নিয়ে টপাটপ মুখে পুরতে লাগল।
রওনক কিন্তু তখন বসার ঘরে উপস্থিত। অতনুর ডাকে রা করেনি। বিনা বাক্যে লিখন নামক ছেলেটার সাথে চলে এসেছে। আসলে সে নিজেও এইটেই চাইছিল। ডাঙ্গায় থেকে যে কুমিরের সাথে লড়াই সম্ভব নয় এ তো বুঝেই গেছে এতদিনে। সুযোগ খুঁজছিল পানিতে নামার। ভাবতেও পারেনি সুযোগ একা একাই হেঁটে আসবে তার কাছে। সুযোগ যখন এসেছে লুফে নেয়াই সমীচীন। অতনুর জগতে আপাতত প্রয়োজন হয়েই ঢুকুক ও৷ প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় তো পড়েই আছে৷

রওনক যে সোফাটায় বসেছে এখান থেকে ডাইনিং পুরোটা দেখা যায়। উপমাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ও। বসেছে তো একদম মুখোমুখি। এতক্ষণে উপমারও তার দিকে নজর পড়া উচিৎ ছিল। কিন্তু সে বেচারি খাওয়া-দাওয়ায় এত ব্যস্ত! প্লেট থেকে দৃষ্টিই সরাচ্ছে না।
রওনক অবাক হয়ে দেখছে উপমাকে। তার প্রিয়তমা যে এতখানি পেটুক ধারণাও করতে পারেনি সে! কেমন গাপুসগুপুস করে খাচ্ছে৷ এত তাড়াহুড়ো করছে যেন ট্রেন ছুটে যাবে। নিঃশব্দে হাসল রওনক। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“আস্তে খাও। ট্রেন ছুটে যাচ্ছে না তো”
খাওয়ায় ব্যস্ত উপমার কানে কথাটা ঠিকঠাকভাবে পৌঁছয়নি তখনও। এক মনে খাবার খেতে খেতে সে ভাবল কেউ কি কথা বলছে? কিন্তু কে কথা বলবে, আশেপাশে তো তেমন কাউকে দেখেনি সে।
ক্ষিধের তীব্রতা এত বেশি চোখ তুলে তাকাতেই ইচ্ছে করছে না উপমার। কে কথা বলছে বলুক ওদিকে দৃষ্টি না দিয়ে খাওয়ায় মন দেয়াই ভালো, ভাবল উপমা।
রওনকের হাসি গাঢ় হলো। মেয়েটা এত মিষ্টি কেন! এই যে গাল ভরে ভরে খাচ্ছে, রওনকের ইচ্ছে করছে ফোলা ফোলা গাল দুটোতে টুপটুপ করে ক’খানা চুমু খেয়ে আসে।
কিন্তু নাহ্, এতখানি দুঃসাহস দেখানো ঠিক হবে না। যমের মুখে যমের অপেক্ষায় বসে আছে সে। যখন তখন বিনা নোটিশে যমরাজ এসে উপস্থিত হবে তার সামনে। উল্টোপাল্টা কিছু করতে দেখলে বাক্য ব্যায় করবে না সোজা প্রাণ বায়ু টেনে বের করে নেবে। থাক অকালে প্রাণ হারানোর কি দরকার! বিয়ের আগেই মেয়েটা বিধবা হয়ে যাবে। তারচেয়ে নিরাপদ দূরত্ব থেকে মনে মনে আদর করাই ভালো। ক্ষীণ আশংকায় কোমরের পেছনে একবার হাত দিয়ে দেখল রওনক। নাহ্ পিস্তলটা ঠিক জায়গায়ই আছে। ভয় নেই।

ও যখন এসব এলেবেলে ভাবনায় মশগুল তখনই দ্রুত খেতে গিয়ে খাবার তালুতে উঠে গেল উপমার। মুখ চেপে ধরে কাশতে কাশতে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে রীতিমতো অস্থির হয়ে উঠল সে।
রওনকের ভাবনা সাঙ্গ হলো উপমার কাশির শব্দে। তাকিয়ে দেখল পানির জগ টেনে নেয়ার অবস্থায় ও নেই। কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করল রওনকের। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বিলম্ব করল না, তৎক্ষনাৎ বসা থেকে উঠে ছুট লাগাল ডাইনিংয়ের দিকে। দ্রুত হাতে গ্লাস টেনে নিয়ে পানি ভরে উপমার দিকে এগিয়ে দিয়ে মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলতে লাগল। চিন্তাগ্রস্ত ওর কণ্ঠস্বর ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো,
“আস্তেধীরে খাবে তো মেয়ে। কেন যে তোমার সবকিছুতেই তাড়াহুড়ো!”
বলা বাহুল্য পানিটায় তখন মাত্র চুমুক দিয়েছে উপমা। তন্মধ্যে অপ্রত্যাশিত কণ্ঠস্বরটা কর্ণদ্বয়ে প্রতিধ্বনিত হওয়ামাত্র আপনা থেকে কাশি বন্ধ হয়ে গেল। পানি ভুলে বজ্রাহতের মতো চোখ তুলে তাকাল সে। ঠিক দেখছে নাকি কল্পনা করছে বুঝে উঠতে পারল না। কিছুটা দ্বিধা, কিছুটা চমক নিয়ে উঠে দাঁড়াল। এমন তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ানোর কারণ কি, রওনক ঠিক বুঝতে পারল না। ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিযোগে শুধল,
— কি হলো?
উপমা মূর্তির মতো তাকিয়ে আছে তার দিকে। হতভম্ব গলায় বিড়বিড় করে সে বলল,
— চিমটি কাটুন তো। হুট করে কেন যেন আপনাকে দেখছি। আপনি সত্যি নাকি ভ্রম বুঝতে পারছি না।

এতক্ষণে রওনকেরও বোধগম্য হলো উপমার হতভম্ব দৃষ্টির অর্থ। সে যে কভু বার্তা বিহীন হুট করে এই বাড়িতে এসে উপস্থিত হতে পারে বিষয়টা তো আনএক্সপেক্টেড উপমার কাছে। সেক্ষেত্রে অবাক হওয়া জায়েজ। ঠোঁটে দাঁত চেপে পুনরায় শব্দ বিহীন হাসি হাসল রওনক। দুষ্টুমি ভর করেছে ওর ওপর। ভ্রম নাকি সত্যি, তার প্রমাণ আজ অভিনব কায়দায় দেবে ও; যার স্মৃতি সারাজীবনেও আর ভুলতে পারবে না তার প্রিয়তমা।
সতর্ক দৃষ্টিতে আশেপাশটায় চোখ বুলিয়ে কেউ নেই নিশ্চিত হলো রওনক। এরপর বিলম্ব না করে মুখ নামিয়ে চট করে উপমার চিবুকে চুমু খেয়ে বলল,
— এখনও মনে হচ্ছে আমি ভ্রম?

ছোট্ট একটু ছোঁয়া, কিন্তু ভীষণ জীবন্ত। দৃষ্টির ভ্রম নয় ছোঁয়াটুকু পেয়ে নিশ্চিত হলো উপমা। চোখ বড় বড় করে তৎক্ষণাৎ মুখে হাত চাপা দিলো। ভয়ার্ত গলায় ফিসফিসিয়ে বলল,
— আপনার কি মাথা খারাপ। বলা নেই কওয়া নেই হুট করে এখানে এসেছেন কেন? বাড়ির লোক কেউ দেখে ফেললে কি ভয়নক বিপদ হবে ধারণা করতে পারেন? সেজো ভাই দেখলে তো জ্যান্তই পুঁতে ফেলবে দুজনকে।

রওনকের দুষ্টুমিভাব পুরোটা কাটেনি। প্রেয়সীর ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর বরং তাকে দুষ্টুমিটা চালিয়ে যাওয়ার দিকে জোর নির্দেশ দিলো। নীচু হয়ে সেও উপমার মতো ফিসফিসিয়ে বলল,
— তোমাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছিল যে। সেদিনের পর তো দেখাই দিলে না। পরীক্ষা নিয়ে এত ব্যস্ত! মিস করছিলাম তোমায়।
— আমি তো চিঠি পাঠিয়েছিলাম আপনাকে। পাননি? আপনার বন্ধু দেয়নি?
বলা বাহুল্য এ কয়দিনে রওনক কোনো চিঠিপত্র পায়নি। কার হাত দিয়ে পাঠিয়েছিল উপমা? মিজান? উফফ এই ভুলো মনা ছেলেটা! মিজানের ওপর ভীষণ বিরক্ত হলো রওনক। বাইরে অবশ্য বুঝতে দিলো না চিঠিটা ও পায়নি। বরং দুহাত পকেটে পুরে সোজা হয়ে ভ্রু জোড়া সংকুচিত করে বলল,
— ওসব চিঠিপত্রে মন ভরে নাকি! হাজারবার তোমাকে দেখেও তো আমার তৃষ্ণা মেটে না।

উপমার বিস্ময়ভাব বাড়ছে বৈ কমছে না। দোতলার সিঁড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে সরোষে সে বলল,
— তাই বলে আপনি এতবড় দুঃসাহস দেখাবেন? নাহ্ এভাবেই যদি দুঃসাহসিকতা দেখাতে দেখাতে আমার হার্ট অ্যাটাক করিয়ে দিতে চান তাহলে বলব একেবারে মেরে দিন আমাকে। কোমরে পিস্তলটা আছে না? ওটা বের করে শুট করে দিন। মানুষ এত পাগলামি করে কীভাবে। ছিঃহ্!
বলতে বলতে উপমার চোখজোড়া অশ্রুসজল হয়ে উঠল। বড় মামা না থাকলেও এই সময়টায় সেজো ভাই তো বাড়িতে থাকে। সে যদি একবার দেখে নেয় তাদের এই অবস্থায় কি তাণ্ডব শুরু করে দেবে ঠিক নেই। রেগে খু/ন টুনও করে ফেলতে পারে। সকল ভয় তো তার রওনককে নিয়ে।

ভাবুক উপমাকে দেখে ওর মনের খবর খানিক আঁচ করতে পারল বোধহয় রওনক। কাতর ওর মুখখানা দেখে যেমন ক্ষীণ কষ্ট অনুভূত হলো, তেমনই হাসি পেলো উপমার বোকা বোকা চিন্তায়। এত সহজে বিশ্বাস করে নিলো মেয়েটা ওকে? একবারও ভাবল না প্রেমিক হোক আর যাইহোক এভাবে হুটহাট অপরিচিত কারোর পক্ষেই সম্ভব না র‍্যান্ডম একটা বাড়িতে ঢুকে অতিথির মতন ড্রইংরুমে বসে থাকা, যদি না স্বয়ং বাড়ির কর্তা/কর্তৃ তাকে ঢুকতে দেয়।
প্রিয়তমার অশ্রুতে টুলটুল চোখজোড়া দুষ্টুমিটাকে আর চালিয়ে যেতে দিলো না। ভাবল এক্ষুণি সবটা জানিয়ে দেবে। সংক্ষিপ্ত শ্বাস ফেলে বলতে উদ্যত হলো সেই মুহুর্তে দোতলা থেকে খট করে দরজা খোলার শব্দ ভেসে এলো৷ শব্দের উৎস অনুসরণ করে রওনক এবং উপমা দুজনে একসাথে দোতলায় তাকাল। সেজো ভাই আসছে আশংকায় উপমার মুখখানা নিমেষে রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। কাতর চোখে চাইল ও রওনকের পানে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে রওনক স্বাভাবিক। ঘাড় ফিরিয়ে এক পলক ফ্যাকাশে মুখখানায় নজর বুলিয়ে কিছু না বলে ধীরপায়ে ড্রয়িংরুমে ফিরে গেল। রওনকের প্রস্থানের পর উপমাও তাড়না অনুভব করল। কোনোরকমে খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে এক ছুটে সোজা রান্নাঘরে ঢুকে গেল। সিঁড়ি থেকে অতনু বোধহয় দেখেছে ওকে। কে জানে কোন ঘূর্ণিঝড়টা বয়ে যায় ওর ওপর দিয়ে! দমবন্ধ করে আড়াল থেকে এদিকটায় নজর রাখতে লাগল উপমা।

ওদিকে অতনু নেমে এসে রওনককে ড্রয়িংরুমে বসা দেখল। এক ডাকে যে চলে এসেছে বিষয়টা দেখে কিঞ্চিৎ খুশিই হলো । তারমানে ওদের চিন্তাধারায় মিল আছে। মেকি একটা হাসি ঝুলিয়ে আন্তরিকভাবে এগিয়ে এলো ও রওনকের দিকে। যদিও মেকি আন্তরিকতা বুঝতে বেগ পেতে হলো না রওনকের। তথাপি নিজেও একটা তারল্যভাব বজায় রেখে কুশল বিনিময় করল অতনুর সাথে। আসমাকে চা-নাশতা বলে দিয়ে রওনককে নিয়ে সোজা কাচারি ঘরের দিকে এগিয়ে গেল অতনু। কনফিডেনসিয়াল কথাবার্তা নিভৃতে চারদেয়ালের মাঝে হওয়াই ভালো। এতে কথা পাঁচকান হওয়ার ভয় নেই।

দীর্ঘ সময় কেটে যাওয়ার পরও উল্লেখযোগ্য কিছু যখন দেখতে পেলো না তখন কচ্ছপের মতো মাথা বের করে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল উপমা। কিন্তু একি রওনক কিংবা অতনু কেউই তো নেই ড্রয়িং রুমে। ভ্রু জোড়া সংকুচিত করে সশরীরে বের হয়ে এলো রান্নাঘর থেকে। কোমরে হাত রেখে পুরো চত্বরে চোখ বুলিয়ে কোথাও দেখতে পেলো না তাদের। কি ব্যাপার! রওনক কি তবে হ্যালুসিনেশনে এসেছিল তার?
— আন্নি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছ? ফিরলে কখন? কাপড়ও তো ছাড়নি দেখছি।
কাছে থেকে আসমার গলার স্বর শুনে চিন্তাভঙ্গ হলো উপমার। কোমরে হাত রেখেই সে প্রশ্ন করল,
— কেউ এসেছে নাকি ভাবী?
— হ্যাঁ পার্টির লোক। কি যেন কাজে এসেছে তোমার ভাইয়ার কাছে।
— তো গেল কোথায়?
— তাকে নিয়ে কাচারি ঘরে বসল তোমার ভাইয়া। এখন চা-নাশতার ফরমায়েশ হয়েছে৷
— সেকি! এই দুপুরবেলা?
— হু। দেখি আমি যোগাড়যন্ত্র করি। তুমি যাও কাপড় ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে এসো। ভাত খাবে।
— ভাত তো আমি খেয়েছি।
— কখন খেলে?
অবাক হলো আসমা।
— এসেই। আচ্ছা ভাবী আমি যাই ফ্রেশ হই।
হড়বড় করে জবাব দিয়ে গমনোন্মুখ হলো উপমা। ভ্রু কুঁচকে ওকে বোঝার চেষ্টা করল আসমা। পারল না; হাল ছেড়ে দিয়ে তাই রান্নাঘরে ঢুকে গেল।
কয়েক ধাপ সিঁড়িতে গিয়ে থেমে পেছনে উঁকি দিয়ে একবার কাচারি ঘরে চোখ বোলানোর চেষ্টা করল উপমা। পর্দার ফাঁক দিয়ে রওনককে চিনতে অসুবিধে হলো না। ওহ্ তারমানে তাকে বোকা বানানো হচ্ছিল! এসেছে সে সেজো ভাইয়ের কাছে,অথচ নাম দিচ্ছিল উপমার। কি বদমাশ! আত্মা উড়িয়ে দিয়েছিল পুরো। হাতের নাগালে আসুক না একবার। মজা নেয়ার ফল দেখাবে ভালো করে। উপমাকে বোকা বানানো! হুহ্।
দাঁত কিড়মিড় করতে করতে ধপধপ সিঁড়ি বেয়ে ঘরে চলে গেল উপমা।
___________

রওনককে নিয়ে কাচারি ঘরে বসার অনেকক্ষণ হয়েছে। কথা শুরু করছে না কেউই। রওনক মূলত সময় দিচ্ছে অতনুকে। যেচেপড়ে সে কিছুই বলবে না বা জিজ্ঞেস করবে না । যা বলার,করার অতনুই করবে। যেহেতু ও ডেকে পাঠিয়েছে। ওর দিকটা পরিষ্কার শোনা হলে এরপর নিজের যা কথা উপস্থাপন করবে রওনক। ততক্ষণ বোবার মতো নির্বাক বসে থাকবে।
অতনুর অবশ্য এতে ভালই হয়েছে। শত্রুর মুখোমুখি হয়ে স্বাভাবিকভাবে কথা বলা বিরাট ধৈর্যের একটা কাজ। গুছিয়ে টুছিয়ে সময় নিয়ে কথা শুরু করা উচিৎ। এতে পরিবেশ-পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে। অতিরিক্ত সময়টাকে কাজে লাগিয়ে একটু থিতু হলো অতনু। ভেতরে ভেতরে সবটা গুছিয়ে নিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে রওনকের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
— তোকে হুট করে ডেকে পাঠানোর কারণটা নিশ্চয়ই অজানা নয় তোর কাছে।
রওনক মৃদু হাসল। কৌতুক মিশিয়ে উত্তর দিলো,
— জ্বী।
ওর পানে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল অতনু৷ বলল,
— ওপেনলি কথা বলি রওনক। আমি জানি আমার বিষয়ে কিচ্ছু অজানা নয় তোর। আমি কি চাই, কোন পথ ধরে এগোচ্ছি আর কেউ না জানলেও তুই ঠিকই জানিস, খবর রাখিস। এবং আমারও তা অজানা নয়৷
একটু থেমে পুনরায় বলল,
— যে পদটার জন্য আমি এতকিছু করেছি, এতদিন অপেক্ষা করেছি সেটা আমার চোখের সামনে অন্য কারোর নামে হয়ে যাবে এটা মানতে পারব না আমি।
— এ ব্যাপারে আমি কি করতে পারি ভাই?
জেনেও অবুঝের মতো করে বলল রওনক।
এতে অতনু বোধহয় একটু উত্তেজিত হয়ে পড়ল। শক্ত গলায় বলল,
— পদটা পাইয়ে দিতে তোর সাহায্য কাম্য। বিচার-বিবেচনা করে যা বুঝেছি কারো সাহায্য ছাড়া অতদূর অবধি পৌঁছনো আসলে সম্ভব না আমার পক্ষে। এক্ষেত্রে সহযোগীটা তুই হলে বিষয়টা মন্দ হয় না।
— এ কেমন কথা বললেন ভাই? আমি নগন্য মানুষ…
এ পর্যায়ে হাত তুলে রওনককে থামিয়ে দিলো অতনু। বলল,
— সব জেনেবুঝেও অবুঝের মতো আচরণ করবি না রওনক। নাটক-সিনামায় অভিনয় করছি না আমরা। যা সত্য তাই প্রকাশ কর।

রওনকও এবারে একটু নড়েচড়ে বসল। শ্বাস টেনে সরাসরি অতনুর দিকে তাকিয়ে বেশ দৃঢ়তার সাথে বলল,
— পার্টি এক হইলেও আপনার-আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা কারো অজানা নয়। আমরা দু’জনেই খুব ভালোমতো জানি একে-অপরকে ঠিক কতটা অপছন্দ করি আমরা। কাজের শুরুটাই যেখানে আমাদের দ্বন্দ্ব দিয়ে সেখানে আমি আপনার সাথে এক হয়ে কাজ করব ভাবলেন কীভাবে আপনি?
— দেখ রওনক এই মুহুর্তে পার্সোনাল প্রবলেমগুলাকে সাইডে রেখে লাভের কথা চিন্তা কর। নিজাম চৌধুরীর ছেলে ক্ষমতায় এসে গেলে দলের যে আমূল পরিবর্তন হবে না এমনটা কিন্তু বলা যাইতেছে না। এক্ষেত্রে কমিটির সকলের পজিশন একটা অনিরাপত্তায় এসে যায়।
— ভবিষ্যৎ কে জানে? সে তো এখন পর্যন্ত এসেই পৌঁছায়নাই;ক্ষমতা হস্তান্তর দূরের ব্যাপার৷ তাছাড়া সে আসার পর আমি যদি কোনোভাবে তার কাছে আমার ফায়দা বেশি দেখতে পাই তাহলে আপনার হয়ে কাজ করব কেন?
রওনকের এ কথার প্রেক্ষিতে আগুন জ্বলে উঠল অতনুর ভেতরে। ইচ্ছে করল এক্ষুনি উঠে কো’প দিয়ে দেহ থেকে ধড়টা আলাদা করে দেয় ওর। কিন্তু রাগের পরিণাম এই মুহুর্তে ভালোকিছু বয়ে আনবে না এটাও তার জানা। তাই ক্রোধটাকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করে বলল,
— দলে এই মুহুর্তে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি কিন্তু আমি। অন্যদিকে তোর নামের সাথে নির্দিষ্ট কোনো পদই যুক্ত নেই। তোকে আর আমাকে পাশাপাশি দাঁড় করালে শওকত চৌধুরীর সামনে আমার পজিশনটাই দিনের আলোর মতো চকচকে হয়ে ধরা দেবে। সেক্ষেত্রে লাভের চাইতে ক্ষতিটা কার বেশি রওনক? যে পদটা পুঁজি করে তুই এগোতে চাইছিস সেটা তো মরিচীকার মতো অস্থায়ী।
অতনুর বাঁকা কথা শুনেও হাসি অবিচল রইল রওনকের ঠোঁটের কোণে। হাসি বিলীন না করেই কণ্ঠস্বরে বেশ কাঠিন্য ভাব এনে সে বলল,
— আপনি যে আমাকে টিস্যুর মতো ইউজ করে পরবর্তীতে ফেলে দেবেন না তার কি গ্যারান্টি? আজকে আপনার কথামতো রাজি হয়ে গেলাম, এরপর কাজ শেষে দেখা গেল আমার নামনিশানা গায়েব করে দিলেন। তাহলে লাইফ রিস্ক নিয়ে আমি আপনার সাথে কাজ করব কেন?
— শোন রওনক অতীতটা ছাড়া তোর সাথে আমার শত্রুতার কোনো কারণ নেই। আর অতীত ধরে রাখা তোর স্বভাব হতে পারে কিন্তু আমার স্বভাব না। আমি সবসময় ভবিষ্যৎ চিন্তা করতে পছন্দ করি। কাজ আর পার্সোনাল গ্রাজেস আমার কাছে সবসময়ই আলাদা।
— মুখের কথায় কতটা নির্ভরতা আছে ভাই?
— ঠিকাছে তাহলে তুই ই বল তুই কি চাস? আমার কাজটার বিনিময়ে কি চাই তোর?
হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গিতে বলল অতনু। বিনিময়ে কয়েক মুহুর্তের মৌনতা ধারণ করে রইল রওনক। সময় নিয়ে বলল,
— চাওয়া আছে আমার দুটো। একটা হলো, আসন্ন কমিটি নির্বাচনে পুরো কমিটির নকশা পাল্টাতে হবে। মিন্টু ভাই, যে আপাতত সভাপতির পদে বসে আছে, তাকে সরিয়ে আপনি হবেন সভাপতি আর আপনার পদটা মানে সাধারণ সম্পাদকের পদটা আমাকে দিতে হবে৷
— কি বলতেছিস বুঝেশুনে বলতেছিস? এটা তো আমার হাতেই নাই। এসবের সিদ্ধান্ত নেবেন নিজাম সাহেব।
সরোষে বিরোধ করে উঠল অতনু। বিপরীতে রওনক শীতল গলায় বলল,
— আর সেই নিজাম সাহেবের কাছের মানুষও আপনিই। এতটুকু কাজ যে আপনার দ্বারা অসম্ভব না সেটা আপনিও জানেন অতনু ভাই। ভেতরের কথা কিছু জানা আছে আমার। শুনেছি চৌধুরী সাহেব অতি শীঘ্র মিন্টুকে বহিষ্কার করতে যাচ্ছে। কারণ সে বেঈমানী করেছে দলের সাথে। নির্বাচনে দলের অনেক গোপন খবর বিরোধী দলের কাছে লিক করে দিয়েছে। আর মিন্টুকে সরিয়ে দিলেই অটোম্যাটিক ওর পদটা আপনার কাছে চলে যাবে। এরপর আপনার পদ হবে শূন্য। এখন আপনি যদি চান…
কথা সম্পূর্ণ করল না রওনক। অতনু একটু দমে গেছে। এত ভেতরের খবর ছেলেটা পাচ্ছে কোত্থেকে? আনিস শেখ! স্বগতোক্তিতে আনিস শেখের উদ্দেশ্য নোংরা কতক গালি ছুঁড়ল অতনু সহসা। এরপর ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বলল,
— আর দ্বিতীয় চাহিদা?
— ওটা কাজ শেষে বলব।
— ঠিকাছে তুই যেমন চাইছিস সেভাবেই সব হবে। এবার বল আমাকে সাহায্য করতে তুই রাজি কি না?
— যেই মুহুর্তে আমি পদ পাব সেই মুহুর্ত থেকে মনে করেন আপনার ছায়া হয়ে যাব।
— তোর সততার প্রমাণ?
— ছায়াকে কখনো প্রমাণ দিতে হয় না ভাই। ছায়া অক্ষয়। পৃথিবীতে সমস্তকিছু ছেড়ে গেলেও ছায়া কখনো সঙ্গ ত্যাগ করে না।
একটুখানি থেমে রওনক পুনরায় বলল,
— মুখের কথা আর বন্দুকের গুলি কখনো ফেরানো যায় না। আমি রওনক একবার বলে দিছি আপনার হয়ে আমি কাজ করব তার মানে অবশ্যই করব। এ আমার ওয়াদা। মনে সন্দেহ থাকলে বিকল্প যে ব্যবস্থা ভালো মনে হয় নিয়ে রাখবেন। পূর্ণ স্বাধীনতা রইল।
আজ তবে উঠি।
গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল রওনক। অতনু বলল,
— যাবি! আসল কথাই তো হলো না।
— আজকের মতো কথা এতটুকুই। যেই মুহুর্তে আপনি আপনার কথা রাখবেন সেই মুহুর্ত থেকে আমিও আমার বিশ্বস্ততা দেখাতে শুরু করব। চিন্তা নেই। আজ থেকে যাওয়া-আসা লেগে থাকবে। আস্তেধীরে সব কথাই হবে।

এরপর আর অপেক্ষা না করে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল রওনক। ওর গমন পথে নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল অতনু। কিছু বলল না। পুরোপুরি ভরসা ও রওনককে কখনোই করতে পারবে না। বিকল্প ব্যবস্থা তো অবশ্যই নিয়ে রাখতে হবে৷ এখন থেকে প্রত্যেকটা পদক্ষেপ সাবধানে ফেলতে হবে। ভুলত্রুটির অবকাশ যেন না থাকে।

বাইরে বেরোনোর পথে আসমার সাথে দেখা হলো রওনকের। কোনোকিছু করেই আসমা আটকাতে পারল না ওকে এক কাপ চা খাওয়ার জন্য। সহাস্যে রওনক জানাল আগামী দিন এসে খাবে৷
ওদিকে দোতলার বারান্দা থেকে সবটাই দেখল উপমা। হাতে ওর দু’টো কাগজ। রওনকের জন্য ছোট্ট ছোট্ট চিঠি লিখেছে ও। ভেবেছিল ভাঁজ করে চায়ের কাপের নীচে রেখে দেবে। কাপ ওঠালেই চিঠি পাবে মানুষটা। কিন্তু এর তো সবকাজেই তাড়াহুড়ো। চা না খেয়েই চলে যাচ্ছে। এখন সাধের চিঠি দুটো তবে কীভাবে দেবে? বেশ ভাবনায় পড়ে গেল উপমা। ওদিকে সদর দরজা পার হয়ে অনেকটা চলে গিয়েছে রওনক। এরপর তো আর থামানো যাবে না।
কোনোকিছু না পেয়ে তড়িৎ একটা কাগজ মুচড়ে দলা পাকিয়ে রওনকের মাথা বরাবর ছুঁড়ল উপমা৷ নিশানা সই ওর। সোজা রওনকের মাথার পেছনে লেগে গড়িয়ে পড়ল নীচে। পায়ের গতি রোধ হয়ে গেল রওনকের। ভ্রু কুঁচকে মাথার পেছনে হাত বুলিয়ে আশেপাশে তাকাল। দৃষ্টিগোচর হলো অদূরে বারান্দায় দাঁড়ানো উপমাকে। চোখের ইশারায় জানতে চাইল, “কি?”
তর্জনী উঁচিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা কাগজটা দেখালো উপমা। কাগজটা রওনকের পায়ের কাছেই পড়েছিল। ঈষৎ ঝুঁকে তা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিলো। দলামোচড়া করে বল বানানো হয়েছে। ঘাড় ফিরিয়ে পুনরায় বারান্দার দিকে নজর বোলালো। তা দেখে চট করে বারান্দা থেকে সরে পড়ল উপমা। মৃদু হাসল রওনক। কাগজ হাতে করে সোজা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গলির মুখে আড়াল হয়ে দাঁড়াল। এরপর দু’হাতের তালুতে চিঠি নিয়ে সোজা করে পড়ার চেষ্টা করল। উপমা লিখেছে,
“দেখা করিনি বলে গত কয়েকদিনে একবারও কল করেননি। আবার আজ বাড়ি বয়ে এসে বোকা বানালেন। আমার মতো সহজ-সরল বাচ্চা মেয়েটার সাথে এমন নিষ্ঠুরতা করতে একবিন্দু কষ্ট হলো না আপনার?”
চিঠি পড়ার মাঝখানে অন্য আরেকটা কাগজের দলা এসে সামনে পড়ল রওনকের। হাতের কাগজটা ভাঁজ করে দ্বিতীয়টা কুড়িয়ে নিয়ে পড়তে শুরু করল।
“আমার কথা তো মনেই পড়ে না আপনার। এত চিঠি দেই ভুল করেও উত্তর লেখেন না। কি, নতুন কাউকে পেয়ে গেছেন? শুনে রাখুন, খবর নিয়ে যদি জানতে পারি নতুন কারো সাথে আপনার খুটুরমুটুর চলছে আমি উপমা একদম ঘুষি মেরে ওই মেয়ের দুই পাটি দাঁত খুলে ফেলব বলে দিলাম। সরল রেখার মতন সহজ মেয়ে মোটেও ভাববেন না আমাকে। একবার যেহেতু “ভালোবাসি” শব্দটা আমার জন্য উচ্চারণ করেছেন। আপনার ভালোবাসার একমাত্র অধিকারীনি কেবল আমি হয়ে গেছি। আমার অধিকার ভুলেও অন্য কাউকে দেয়ার চেষ্টা করবেন না। পরেরবার দেখা হলে চিঠির উত্তর দেবেন। বারবার কেন শুধু আমিই চিঠি পাঠাব? কেন আমিই বলব ভালোবাসি। আপনার বুঝি দায় নেই! আর হ্যাঁ পরীক্ষা শেষ হয়েছে আমার। প্র্যাক্টিক্যাল বাকি। রাত্রিবেলা সুবোধের মতো কল দেয়া হয় যেন। অপেক্ষা করব”

দুটো চিঠি ভাঁজ করে একত্রে বুকপকেটে রাখতে রাখতে বিস্তর হাসল রওনক। সাধে কি নাম দিয়েছে ডাকু সর্দারনী। এক হাত মেয়ে কি সুন্দর শাসাচ্ছে তাকে। পুরো ভাইয়ের হাত পেয়েছে।
চলবে,
Sinin Tasnim Sara
★রিচেক হয়নি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here