চিঠি দিও ২৪

চিঠি দিও
২৪
__________
সরোবরের স্বচ্ছ জলের মতন ত্বক। টলটলে, মসৃণ। সেই ত্বকের ভেতরের সবকিছু খালি চোখে দৃশ্যমান। একটু মনোযোগী দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যায় ত্বকের ভেতর ছোট্ট ডিম্বাকৃতির কিছু একটা গর্ভনাড়ি দ্বারা সংযুক্ত। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো এই, ডিম্বাকৃতির পর্দাটার ভেতর কোনো মানবশিশুর ভ্রুণ নয় বরং শ্বেতশুভ্র একটা গোলাপ কলি ভেসে বেড়াচ্ছে। দৃশ্যটা নজরবন্দি হওয়ার পর আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে বার কয়েক দেখে নিলো আসমা। চোখের ভ্রম কি না যাচাই করার জন্য আঙুল দিয়ে চোখ কচলেও দেখল। নাহ্ ভ্রম তো নয়। জঠরে তার মানবশিশুর পরিবর্তে সত্যি সত্যি একটি সাদা গোলাপের কলি ঠাঁই পেয়েছে। ভীতু আসমা কম্পমান তার হাতজোড়া আলতো করে জঠরে ছোঁয়াতেই কলি নড়েচড়ে প্রস্ফুটিত গোলাপের রূপ নিতে শুরু করল। পুরোটা পারল না যদিও। মাঝপথে হুট করে জঠরের স্বচ্ছ ত্বকটায় তীক্ষ্ণ ধারালো কিছুর আঘাত অনুভব করল। চোখ তুলে দেখল একটি ছোট্ট রূপোলী স্ক্যাল্পেল। ত্বক ফেটে গলগল করে নিংড়ে যেতে শুরু করল ভেতরের সবকিছু; এমনকি অর্ধ প্রস্ফুটিত গোলাপটাও। যন্ত্রণা হলো আসমার, ভীষণ যন্ত্রণা। শরীরে, মনে। গুমরে উঠল ভেতরটা, ব্যথাতুর গোঙ্গানি কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে আসতে চাইল। কিন্তু ব্যথাটাকে প্রকাশ করল না সে৷ ভীতু আসমার মধ্যে কোত্থেকে একরাশ সাহস সঞ্চিত হলো। জঠরের নীচে হাত পেতে বানের মতো ভেসে যাওয়া র’ক্তের মধ্যে অর্ধ ফোটা গোলাপটাকে আগলে নিলো। উষ্ণ, কোমল নিষ্প্রাণ একটা গোলাপ যার সম্পূর্ণ অবয়ব নেই। ভীষণ মমতায় গোলাপটাকে বুকে চেপে ধরল আসমা। এতক্ষণে তার অপ্রকাশিত যন্ত্রণাটুকু ডালপালা মেলে বেরিয়ে আসতে শুরু করল। ক্রন্দন আহাজারির রূপ নিলো। আহত সিংহির হিংস্রতা ভর করল তার ওপর। আগলে রাখা নিষ্প্রাণ গোলাপকে ছুঁয়ে সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো এই মৃত্যুর প্রতিশোধ তাকে নিতেই হবে যেকোনো উপায়ে।
পারতপক্ষে এই দৃশ্যটুকুকে দুঃস্বপ্ন বলে ধারণা করা যেতে পারে। কিন্তু আদতে কি এ দুঃস্বপ্ন?

বারান্দা ধরে বার কয়েক হেঁটে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো আসমা। ধিকিধিকি আগুন তার হৃদয় অলিন্দে জ্বলছে-নিভছে। আগুনের তেজ দৃষ্টিতে খানিক দৃশ্যমান। কঠোর দু-চোখজোড়া সিলিংয়ে নিবদ্ধ। মস্তিষ্কে একটা শব্দ বারংবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, “প্রতিশোধ”। এই প্রতিশোধ, এই ছাইচাপা আগুন আজকের নয়। বছর কয়েক আগের। যখন হাতবদল হয়ে ডানপন্থীরা পাকাপাকিভাবে শহরে কবজা জমিয়ে নিলো।
একটু একটু করে আগুনটা তার সমস্ত মায়া-মমতা, ভালোবাসা শুষে নিয়েছে। ফেলে রেখেছে অঙ্গারের মতো শুষ্ক খটখটে একটা মন।যে মনে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছাড়া অন্যকিছুর স্থান নেই।
এই যে আজকের এই সংসার, সর্বগুণান্বিতা গৃহিণীর আভিজাত্যের দাপট সব একটা নাটকের অংশ। জীবনটা তার হয়ে গেছে ঠিক মহাকালের মঞ্চ। হাওলাদার পরিবারটাকে কেন্দ্র করে একটা মঞ্চনাটক সাজিয়েছে সে। টিভির পর্দার মতো নয়, বাস্তব নাটক। যেখানে চরিত্ররা কেউই জানে না এই নাটকের সমাপ্তি কি। সমাপ্তি শুধু সে-ই জানে, যার হাত ধরে নাটকের সূচনা হয়েছে; অর্থাৎ আসমা।

“ভাবী ভাবী, কোথায় তুমি? আমি তোমাকে খুঁজি”

বারান্দার অপরদিক থেকে উপমার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। মাথা কাত করে স্থির দৃষ্টিতে উপমাকে দিকে তাকাল আসমা। এই মেয়েটার সমাপ্তিও সে নিজ হাতে লিখবে। যদিও মেয়েটার এসবের সাথে কোনো সংযোগ নেই। নিঝঞ্ঝাট বাচ্চা একটা মেয়ে; মায়া মায়া কথা বলে। সবাইকে দু’হাতে আগলে রাখতে চায়। কিন্তু প্রতিশোধের অনলের কাছে এসব মায়া-মমতার স্থান ভীষণ ঠুনকো; একেবারে নেই বললেই চলে। পারতপক্ষে প্রতিশোধের খেলায় ওর সম্পৃক্ততা না থাকলেও অপরাধ শুধু এতটুকু ও অতনু হাওলাদারের বোন। এই পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষেরই অপরাধ কেবল এইটেই। বিষয়টা খানিক দুঃখজনক। সবকটা মানুষ অপরাধ না করেও অপরাধী।
অবশ্য ধ্বংসাত্মক জীবনে অপরাধ তারও কিছু কম কিংবা বেশি ছিল না। তবুও সে বলি হয়েছিল সেদিন। বলি হয়েছিল তার ছোট্ট সুন্দর পরিবারটা। নোংরা পলিটিক্সের যাঁতাকলে পিষে অঙ্কুরে বিনাশ ঘটেছিল একটি নিষ্পাপ প্রাণের, যার সম্পর্কে এই পৃথিবীর কেউই অবগত ছিল না; দু’জন ব্যক্তি ছাড়া। আসমা এবং তার মা। অঙ্কুরটাকে নিজ হাতে বিনাশের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল যে নাটকের সূচনা, তার সমাপ্তি হবে পুরো বংশকে নির্বংশ করার পর।
এরপর সেও ছেড়ে দেবে এই পৃথিবীর মোহ। শরীরসর্বস্ব জীবনটার ভার টানার ক্ষমতা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে। ভীষণ ক্লান্ত লাগে ইদানীং।
আচ্ছা কি আছে এই পলিটিক্সে? একটা ধ্বংসাত্মক খেলা ছাড়া অন্যকিছু নয়।শাসক গোত্র সবসময় জনসাধারণের কাছে বিষফোঁড়ার মতো। ব্যথা দেয়, যন্ত্রণা দেয়, দাগ দেয়। কিন্তু পাকাপাকিভাবে অপসারণ করা যায় না। তাদের একচেটিয়া শোষণ যেন নিরীহ মানুষগুলোর ওপরেই শুধু। নিরীহ মানুষ কাতারে পড়ে গেছিল বলেই কি কঠিন খেসারতটা দিতে হলো তাকে?
প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে স্থির হয়ে বসল আসমা। মৃদু শব্দে উপমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল,
— আমি এইদিকে।
ফিরে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলো উপমা। চপল পায়ে এগিয়ে এসে চেয়ারের হাতলে বসল। ভাবীর কাঁধে হাত রেখে বলল,
— একা একা কি করছিলে ভাবী?
— ভাবছিলাম।
— কি ভাবছিলে?
— উমম ভাবছিলাম…
একটু সময় নিলো আসমা। বলল,
— ভাবছিলাম আজ সকালে নাশতায় কি বানানো যায়৷
বলে ননদ-ভাবী দুজনেই হেসে ফেলল। হাসির মধ্যে উপমাকে শুধল,
— আবদার করো তো দেখি ননদীনি। বলে ফেলো তুমি কি খেতে চাও?
— আমি ভাবছিলাম.. আসলে…
একটু যেন দ্বিধান্বিত উপমা। তা দেখে আসমার ভ্রু জোড়ায় কুঞ্চন লাগল।
— কি ব্যাপার বলো তো? এত দ্বিধা কিসের।
— ইয়ে মানে ভাবী আজ পায়েস করলে কেমন হয়?
— ভালো হয়, খুব ভালো হয়। তো এতটুকু কথা এত দ্বিধা নিয়ে বলছো যেন.. এই এক মিনিট এক মিনিট, পায়েসটা কি কোনো উপলক্ষকে কেন্দ্র করে বানাতে বলছো?

ধরা পড়ে যাওয়ায় লাজুক হাসলো উপমা। চোখ নামিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
— আজ তাঁর জন্মদিন ভাবী। আর জন্মদিনে তো..
লজ্জায় কথা সম্পূর্ণ করতে পারল না উপমা। তা দেখে সশব্দে হেসে উঠল আসমা।
— বুঝতে পেরেছি। আমার ননদীনি প্রিয়তমকে পায়েস খাইয়ে চমকে দিতে চায়।
— ধ্যাত কি যে বলো না ভাবী। বিষয়টা মোটেই তেমন নয়। বিষয়টা হলো.. হলো।
— হুমম। বুঝেছি বিষয়টা কি। চলো আজ তবে তোমায় পায়েস রাঁধতে শেখাই। মিষ্টি খেলে প্রেম বাড়ে জানো তো?
আদর করে উপমার গালটা টিপে দিয়ে হাঁটা ধরল আসমা৷ আঁচল ধরে ওর পিছু পিছু যেতে যেতে উপমা একা একাই বিড়বিড় করল,
“আমাদের প্রেম তো এমনিতেই অন্তরীক্ষ ছুঁয়ে ফেলেছে। মিষ্টি খাওয়াতে চাইছি এজন্য যে, নিষ্ঠুর মানুষটার ভেতর একটু মিষ্টতা যেন আসে। এই যে দিনের পর দিন যোগাযোগবিহীন থাকে, আমার কতখানি কষ্ট হয় তা তো বোঝে না। খাওয়ার সাথে অভিযোগগুলো মিশিয়ে দিলে নিষ্ঠুরতা কমাবে কি না ভাবছি ”
— তুমি কি কিছু বললে?
পুনরায় আসমার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। তড়িৎ দু’দিকে মাথা নেড়ে অবুঝ বনে গেল উপমা। তা দেখে মুখ ফিরিয়ে মিটিমিটি হাসলো আসমা তবে উপমাকে বুঝতে দিলো না। কি দরকার বেচারিকে লজ্জা দেয়ার! থাকুক সে নিজের মতো প্রেমে আচ্ছন্ন হয়ে। সময় তো তার হাতেও বেশি নেই। যতটাদিন আছে হেসে-খেলে কাটাক।

এই এতদিনে নিজাম চৌধুরীর সাথে মিটিংটা ফিক্সড হয়েছে অতনুর। লোকটা যা উড়েছে না! রংপুরে আসার পর শুধু একদিন দেখাসাক্ষাৎ করলো এরপর সব কাজকর্ম বন্ধ করে রেস্ট। একটু বেশিই ফ্যামিলিম্যান হয়ে যাচ্ছে না ইদানীং? এতই যখন ফ্যামিলিম্যান হবি তাহলে এতদিনের সাম্রাজ্যটায় আধিপত্য জমালি কেন? ছিমছাম একটা বাড়ি বানিয়ে পরিবার নিয়ে সুখে থাকতি৷ অযথাই জায়গা দখল। বিতৃষ্ণায় মুখ তেঁতো হয়ে উঠল অতনুর। অপেক্ষায় যে এত বিরক্তি এই ক’দিনে ভালোমতো উপলব্ধি করেছে অতনু। রীতিমতো রাগ চড়ে যাচ্ছে তার। রওনককে দলে যুক্ত না করলে কবেই একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়ত সে।

ভাবনার এ পর্যায়ে জোর ব্রেকে ধ্যানভঙ্গ হলো অতনুর। হঠাৎ ব্রেকে সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। একরাশ বিরক্তি নিয়ে লিখনের দিকে তাকাল সে। তা দেখে ভয়ে ভয়ে লিখন বলল,
— সামনে হুট করি মোটরসাইকেল আসি গেছে ভাই। আমার কোনো দোষ নাই।

এবারে চোখ তুলে সামনে তাকালে অতনু দেখতে পেলো একটা খয়েরী রঙের ডায়াঙ মোটরসাইকেল এঁকেবেঁকে উড়ে যাওয়ার মতো কিছুটা গিয়ে আড়ালে মিলিয়ে গেল। বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে স্বগতোক্তি করল,
“বয়সের তেজ। প্রথম মোটরসাইকেল হাতে পাইছে বোধহয়। তাই মানুষ না নিজেরে ঝড়ো হাওয়া ভাবতেছে। উঁহ বিরক্তিকর”
এরপর গলা ঝাড়া দিয়ে বলল,
— তুই তা থেমে আছিস কেন? টান দে। সময় খুব কম। নিজাম সাহেব বসে আছে আমার জন্য। লেইট করা যাবে না।
— জ..জ্বী ভাই।
মাথা নেড়ে পুনরায় জীপে স্টার্ট দিলো লিখন। এরপর আর পৌঁছুতে বেশি সময় লাগল না। চৌধুরী ভিলা পৌঁছে জীপ রেখে লিখনকে বিদায় করে দিলো অতনু। মিটিং শেষে আজ উর্বশীর ওখানে যেতে হবে। বহুদিন যাবৎ ঐ চৌকাঠটা মাড়ানো হয় না। শরীরের গিটে গিটে যে অশান্তি কাঁটার মতো বিঁধে আছে। সব সরিয়ে একটু নির্ভার হওয়া চাই। এ নির্ভারটা উর্বশী ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না তাকে। উর্বশী মেয়েটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঐশ্বরিক প্রেমের ছড়াছড়ি। সংস্পর্শে এলে যেন পাগল হয়ে ওঠে অতনু। আজ বুঝি তেমনই এক পাগলামির দিন৷
_________

জন্মদিন রওনকের পছন্দ নয়। এই একটা দিন যেন চিৎকার করে তাকে স্মরণ করায় একজন কলুষিত মানুষের নোংরা রক্ত তার শরীরে বইছে। যার জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ঘৃণা ছাড়া আর কিচ্ছু অবশিষ্ট থাকবে না এই মনে।
উদযাপন তো করেই না পারলে নিভৃতে নিরালা বসে সমস্ত দিনটা পার করে দেয় রওনক। হয়তোবা সকলের থেকে পালিয়ে বেড়ায়। নিজেকে দেখলে ভীষণ লজ্জা হয় রওনকের। ভেতরে ভেতরে একটা আতঙ্ক কাজ করে। মনে হয় সমস্ত পৃথিবীটা তাকে ধিক্কার জানাবে। উপহাস করে বলবে, “কার গর্ভজ তুই জানিস তো। একজন ঠক-জোচ্চোর, চরিত্রহীন মহিলার। যে রাতের আঁধারে নিজের স্বামী-সন্তান রেখে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিল। একবারও চিন্তা করেনি যাদের ফেলে যাচ্ছে সে বিয়োগে এই সমাজটাতে তারা সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারবে কি না! স্বার্থপরের মতো পালিয়ে যাওয়ার পরে পরিবারটার ওপর কলঙ্কের ছায়া নেমে আসবে কি না।
তুই ভারী নির্লজ্জ রে। যে দেহে হরদম একজন স্বার্থপরের রক্ত বইছে সে দেহটা বাঁচিয়ে রেখেছিস কোন লজ্জায়? নিজেকে দেখলে ঘৃণা হয় না?”
এমন উপহাসের বিপরীতে কি বলবে রওনক? হ্যাঁ আমার নিজেকে দেখলে ঘৃণা হয়। ইচ্ছে করে কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তলের ছয় ছয়টা শেল নির্দ্বিধায় নিজের মাথায় ঢুকিয়ে দিই। মুছে যাক নোংরা রক্তের ছাপ, বন্ধ হোক সব উপহাস।

মধ্যাহ্নের সূর্য তার সমস্ত উত্তাপ যেন মাথার ওপর ঢেলে দিচ্ছে। নদীর পাড়ে বসে সমস্ত উত্তাপকে মাথা পেতে গ্রহণ করছে রওনক। তাদের অঞ্চলের এই একটাই নদী। মূল শহর ছেড়ে অনেকটা বাইরের দিকে। সরকারের সুদৃষ্টি পড়েছে মাত্র। নদী সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। শান বাঁধানো ঘাট পাওয়া যায়নি। ফলে এখনও প্রকৃতির নিজস্ব রূপটাই ধারণ করে আছে নদীটা। চারিদিকে পাহাড়ের ঢালের মতো গাছ-পালায় আচ্ছাদিত ঘন জঙ্গল। পাড়ে বসলে জঙ্গলের কারণে মানুষের উপস্থিতি বোঝা যায় না। এই ভর দুপুরবেলা নিরাক পড়া প্রকৃতি। নেই কোনো জনমানসের দেখা, আর না কোনো পশুপাখি। থেকে থেকে কেবল উত্তরী হাওয়ায় গাছের পাতার ঝিরিঝিরি শব্দ আর নদীর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ প্রকৃতির নিস্তব্ধতা ভঙ্গের চেষ্টা করছে। একা একা খারাপ লাগছে না রওনকের। বাতাসে মন খারাপের বাষ্প মিশিয়ে নিজেকে হালকা করার চেষ্টা করছে ও। বিষাদময় এই জগতটা একটা আলাদা জগৎ। এর সাথে পরিচিত জগতের কোনো মিল নেই।
বিষাদপূর্ণ ভাবনাসকল নিয়ে বিষাদপুত্র যখন ভীষণ ব্যস্ত, ঠিক তখুনি তার অবগুণ্ঠিত জগতের সমস্ত নিস্তব্ধতায় চিড় ধরিয়ে এক মোটরসাইকেল আরোহী এসে উপস্থিত হলো নদীর পাড়ে। সে একা আসেনি সাথে নিয়ে এসেছে বিষাদপুত্রের জীবনের একমাত্র উচ্ছলতাকে। রওনক ধারণা করেছিল উপমার সাথে ফের আজ দেখা হবে তার। কিন্তু এই অবস্থায় এই স্থানে সেটা ধারণা করেনি। অবাকের চাইতে অপ্রস্তুত হলো বেশি। ক্ষণিক পূর্বে চোখজোড়ায় ভারী বর্ষণ হয়েছে। মুখমণ্ডলে তার ছাপ ভেসে উঠেছে কি? তড়িৎ ঝুঁকে আঁজলা ভরে পানি নিয়ে চোখেমুখে ছিটিয়ে দিলো রওনক। উঠে দাঁড়িয়ে হাসার চেষ্টা করে মিজানের উদ্দেশ্যে বলল,
— ওকে এখানে নিতে গেলি কেন খামোখা? কারোর দ্বারা খবর পাঠালেই তো হতো।

ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টানার চেষ্টা করলেও দৃষ্টিজোড়া ওর রোষপূর্ণ উপমা কিংবা মিজান কারোরই বুঝতে অসুবিধে হলো না। ভয়ে ঢোক গিলে আমতা আমতা করে কিছু বলবে মিজান, তার পূর্বে উপমা এগিয়ে গেল রওনকের দিকে। ওড়নার একপ্রান্ত দিয়ে সযত্নে রওনকের মুখচোখ মুছে দিতে দিতে বলল,
— ওদিকে চোখ রাঙানি দিয়ে কোনো লাভ নেই আমিই জোর করেছি এখানে নিয়ে আসার জন্য। বার্থডে বয়ের নাকি বার্থডে পছন্দ নয়। তো অপছন্দ হওয়ার কারণটা তো শুনি। আমি যে কতখানি প্রিপারেশন নিয়ে রাখলাম।

বন্ধুর সামনে প্রিয়তমার এমন আদর-যত্নে খানিক লজ্জা পেয়ে গেল রওনক। মিজান অবশ্য খুশিই হলো। রওনকের অপ্রস্তুত মুখভঙ্গি দেখে আনন্দ আছে। ব্যাটাকে ক্ষ্যাপানো যাবে বেশ।
— মিজান ভাই ব্যাগটা নিয়ে আসুন তো। দেখান আপনার বন্ধুকে কত সুন্দর কেক কিনেছি তাঁর জন্য আমরা।
— হ্যাঁ হ্যাঁ।
হ্যান্ডেলে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগটা রীতিমতো দৌড় দিয়ে নিয়ে এলো মিজান। এদিকে রওনকের হাত ধরে টেনে তাকে ঘাসের ওপর বসালো উপমা। এরপর ব্যাগ থেকে একে একে বেরিয়ে এলো মাঝারি সাইজের সুন্দর ডিজাইনের একটা চকলেট কেক, কেক কাটার ছুরি সাথে রঙ্গিন কয়েকটা মোমবাতি আর একটা ক্যামেরা। ক্যামেরাটা অবশ্য উপমার। গত সপ্তাহে ছোটো চাচা বিদেশ থেকে পাঠিয়েছেন। উপমা তো ভেবেছিল কস্মিনকালেও এই জিনিস ছুঁয়ে দেখবে না। তবে আজ আসার সময় কি মনে করে সাথে নিয়ে এসেছে। ভেবেছে এই বাহানায় মানুষটার সাথে ছবি থাকবে তার। ছবিগুলো বাঁধিয়ে এনে কিছু ছবি তাকে দেবে কিছু নিজের ড্রয়ারে লুকিয়ে রাখবে। যখনই মনে পড়বে বের করে দেখে নেবে। কি দারুণ আইডিয়া!

এতখানি আয়োজন দেখে বিস্ময়াভিভূত হলো রওনক। মিজানকে দ্বিতীয়দফা চোখ রাঙানি দিয়ে বলল,
— এতকিছুর প্রয়োজন ছিল! বার্থডে আমার মোটেই পছন্দ না।
— সব সময় সব কাজে এত না না করেন কেন? মন রক্ষার্থে একবার অপছন্দের কাজ করতে দোষ নেই।

কেকটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে সুন্দর করে মোমবাতিগুলো সাজিয়ে দিলো উপমা ওর ওপর। মিজানকে ইশারা করতেই পকেট থেকে দেশলাই বের করে মোমগুলো জ্বালাতে শুরু করল। নদীর পাড়ে হাওয়ার বেগ বেশি। বারবার নিভে যেতে চাইছিল মোমগুলো। কোনোরকমে একবার সব কখানা জ্বালানো হলে রওনককে তাড়া দিলো মোমে ফু দেয়ার জন্য। অগত্যা তাড়া খেয়ে অপছন্দের কাজটাকে সহাস্যে করতে হলো রওনককে। মোম সরিয়ে বাচ্চাদের মতো “হ্যাপি বার্থডে” গান গেয়ে হাতে ধরে কেকও কাটালো উপমা। বিস্ময়, বিরক্তি সবকিছুর উর্ধ্বে একটা ভালো লাগার অনুভূতি সর্বটাক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখল রওনককে। কেক কাটিংয়ের পর কিছুটা খেয়ে বাকি কেক প্যাকেটবন্দী করে মিজানের হাতে দিয়ে দিলো উপমা ছেলেপেলেদের এর ভাগ দিতে। কিন্তু এতটুকুতে রাক্ষসসেনাদের পেট তো ভরবে না। চিন্তা করে পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে মিজানের হাতে ধরিয়ে দিলো রওনক। টাকা এবং কেক হাতে রওনক-উপমাকে বিদায় জানিয়ে ফিরতি পথ ধরল মিজান। যাওয়ার আগে নতুন ক্যামেরায় স্মৃতিটুকুকে বন্দী করতে ভুলল না।
মিজান যাওয়ার পর ক্যামেরা হাতে ছবিগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছিল রওনক। তন্মধ্যে ব্যাগ থেকে পায়েসের বাটিটা বের করে রওনকের দিকে এগিয়ে দিলো উপমা। হালকা কেশে বলল,
— আমি বানিয়েছি।
বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে বাটিটা টেনে নিলো রওনক। নাকের কাছে ঘ্রাণ নিয়ে এক চামচ মুখে পুরতেই স্বাদে চোখ বন্ধ হয়ে এলো তার। টপাটপ আরও কয়েক চামচ মুখে পুরে মুগ্ধতার সাথে বলল,
— চমৎকার হয়েছে।

ভাবী ইন্সট্রাকশন দিলেও বানিয়েছে তো উপমা। এই প্রথম রান্নার মতো বিশাল শখের জিনিসে তার হাত পড়েছে। কেমন হবে, না হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল। তবে রওনকের মুখভঙ্গি বলে দিচ্ছে খাবারটা বেশ সুস্বাদু হয়েছে। সাগ্রহে রওনকের হাত চেপে ধরে বলল,
— দেখি আমাকেও এক চামচ খাইয়ে দিন তো। সর্বপ্রথম আপনাকে টেস্ট করাব বলে নিজে খাইনি। রান্নার সময়ও চেখে দেখিনি।
— দাঁড়াও আর কিছুটা খেয়ে নিই।
জলদি হাতে চামচের পর চামচ মুখে দিয়ে অর্ধেক বাটি সাবাড় করার পর ভ্রু কুঁচকে গেল উপমার৷ বিরোধ করে বলল,
— শেষ হয়ে যাবে তো। এক চামচ অন্তত দিন আমাকে।
— আরেহ এত মজা শেয়ার করতে ইচ্ছেই করছে না বুঝলে।
খাবার মুখে অস্পষ্ট স্বরে বলল রওনক। উপমার একটু সন্দেহ হলো। জোর করে রওনকের হাত থেকে চামচ ছিনিয়ে নিয়ে মুখে দেয়ার পর ফ্যাকাশে হয়ে উঠল তার মুখমণ্ডল। বহু কষ্টে খাবারটা গলাধঃকরণ করে মন খারাপের সুরে বলল,
— মিথ্যুক৷ একদম মজা হয়নি। চিনিই তো দেইনি ওতে। নাটক করে বাজে খাবার এতটা খেলেন।
উপমাকে মন খারাপ করতে দেখে বাটি নামিয়ে রেখে একহাতে ওকে টেনে নিলো নিজের কাছে। চিবুকে হাত রেখে নরম গলায় বলল,
— এত যত্ন করে বানালে আমার জন্য। কমতিটা তো আমার নজরে এলো না, নজরে এলো কতখানি ভালোবাসা মিশে আছে এই খাবারে।
— তাই বলে এমন বিস্বাদ, বাজে খাবার মুখে দিয়ে আপনি চমৎকার চমৎকার করবেন?
— আহা নইলে তোমার মন খারাপ হয়ে যেত না? নিশ্চয়ই শখ করে করেছ আমার জন্য। শখটা মাটি হয়ে যেতে দিতাম কি করে।
— সে তো মন খারাপ আমার এখনও হলো।
— বোকা মেয়ে তুমি। রাগারাগি আর মন খারাপই করতে পারো শুধু। তুমি তো জানো না তোমার হাতের গরলও অমৃত মেনে চোখ বুঁজে খেয়ে নিতে পারব আমি।
— ইশশ হয়েছে আর লজ্জা দেবেন না। খেতে হবে না এই খাবার।
বাটি পুনরায় ব্যাগে ভরতে চাইল উপমা৷ তৎক্ষনাৎ রওনক বাঁধ সাধলো। নিজের কাছে টেনে নিয়ে চোখের পলকে সবটা সাবাড় করে বলল,
— কেন খেতে হবে না? আমার উপমা এই প্রথম কিছু বানিয়ে এনেছে আমার জন্য। স্বাদ হোক,বিস্বাদ হোক সবটা খেয়ে শেষ করব আমি।
উপমা বুঝল এর সাথে কথায় পারবে না। মাথা নেড়ে প্রলম্বিত শ্বাস ছেড়ে পানির বোতল এগিয়ে দিলো। রওনক যতক্ষণে পানির বোতলে চুমুক দিয়েছে ততক্ষণে ওর জন্য নিয়ে আসা র‍্যাপিংয়ে মোড়ানো গিফটটা বের করে হাতের তালুতে রাখল উপমা। এই উপহারটা কেনার জন্য কি পরিশ্রম যে তাকে করতে হয়েছে! সাজুকে কমিশন দিয়ে হাজারটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে কিনিয়েছে। এরপর এতটাদিন সতর্কতার সাথে ড্রয়ারে লুকিয়ে রাখতে হয়েছে। এমন একটা জিনিস ঘুণাক্ষরে কেউ দেখে ফেললে নিশ্চিত ওকে বাড়ি ছাড়া করত।
অর্ধেক বোতল পানি শেষ করে বোতলের ছিপি আটকাতে আটকাতে গিফট দেখে রওনক হেসে উঠল। বলল,
— রূপকথার গল্পের রাজকুমারীর সাথে প্রেম করছি বোধহয়। গরীব প্রেমিকের জন্য উপহারের ওপর উপহার কিনে যাচ্ছে সে।
— হুমম হয়েছে এতটা বাড়িয়ে চাড়িয়ে কিছু বলতে হবে না। চুপচাপ গিফট খুলে দেখুন পছন্দ হয় কি না।

ছোট্ট চতুষ্কোণ বক্সটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল রওনক। শুধল,
— কি আছে এতে?
— নিজেই খুলে দেখুন।
উপমার দিকে এক পলক তাকিয়ে আলতো হেসে র‍্যাপিং পেপারটা খুলতে শুরু করল রওনক। মিনিটখানেক বাদে কালো বক্সের ভেতর থেকে মেটালের একটা লাইটার বেরিয়ে এলো যার ওপরে সুন্দর প্রজ্বলিত আগুনের শিখার ডিজাইন করা। লাইটার দেখে ভারী অবাক হলো রওনক। হতবিস্ময়ে বলল,
— এটা কি এনেছ তুমি?
— কেন পছন্দ হয়নি? আমার তো ভারী পছন্দ হয়েছে। সেজো ভাইয়ের হাতে দেখেছিলাম একটা গোল্ডেন রঙের লাইটার। তখনই ভেবেছিলাম আপনাকে কিনে দেব একটা। অবশ্য আমি নিজে কিনিনি, বন্ধুর দ্বারা কিনিয়েছি।
— তুমি তো আমাকে অবাকের চূড়ান্ত সীমানায় পৌঁছে দিচ্ছ। আমি শুনেছি মেয়েরা সিগারেট খাওয়া ছেলে একদমই পছন্দ করে না। সেখানে আমার প্রিয়তমা নিজে থেকে আমাকে লাইটার গিফট করছে। আশ্চর্য!
— আপনার সিগারেট খাওয়া আসলে আমারও পছন্দ নয়। তবে মাঝেমধ্যে খেলে দোষ নেই। আর লাইটারের বিষয়টা তো। আমি জানি পিস্তল, লাইটার আর সিগারেটের প্যাকেট আপনার নিত্য সঙ্গী। এখন থেকে পুরনো লাইটার ফেলে দিয়ে আমারটা রেখে দেবেন পকেটে। সবসময় তাহলে আমার কথা মনে পড়বে।
— কেন আমার কি এমনি সময় তোমার কথা মনে পড়ে না?
প্রশ্নটা করতে গিয়ে হেসে ফেলল রওনক। তা দেখে চাপা শ্বাস ছেড়ে উপমা বলল,
— পড়লে তো ফোনটোন দিতেন। সেদিনের পর সপ্তাহখানেক হয়ে গেল খোঁজ নেই। আপনি তো জানেন না আপনার কথা ভেবে ভেবে আমার ভেতর কি ঝড় বয়ে যায়।
— আমার কথা এত মনে পড়ে তোমার?
উপমাকে বুকে টেনে নিলো রওনক।
— তো মনে পড়বে না আবার? দশটা নয়, পাঁচটা নয় আমার একটাই প্রেমিক।
— দারুণ বলেছ তো।
— হাসবেন না এভাবে। সবসময় আমাকে নিয়ে মজা নেন আপনি।
ত্রস্তে সরে গেল উপমা। রওনক বুঝল প্রিয়তমার মান হয়েছে। লাইটারটা পকেটে ঢুকিয়ে কিছু খোঁজার মতো করে আশেপাশে তাকাল৷ অদূরে ছোট্ট জায়গা জুড়ে কয়েকটা ভৃঙ্গরাজের গাছ গজিয়েছে। মূলত ওগুলোই খুঁজছিল রওনক। আজ ভৃঙ্গরাজ দিয়ে প্রিয়তমার মান ভাঙাবে। ঈষৎ হেসে উঠে গিয়ে পটাপট কয়েকটা ভৃঙ্গরাজ পাতাসমেত ছিঁড়ে দুহাত ভরে নিয়ে এলো রওনক। উপমা তখনও অভিমানে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। ময়াল সাপের মতো ওর বিশাল বেনিটা মাটিতে বিছিয়ে রয়েছে। ফুল হাতে উপমার ঠিক পেছনে বসে বেনিটা নিজের হাতে টেনে নিলো রওনক। চমকে উঠে পিছু ঘুরে উপমা দেখল বেনিজুড়ে একটা একটা করে ভৃঙ্গরাজ সযত্নে গুঁজে দিচ্ছে রওনক। চোখাচোখি হলে মিষ্টি করে হাসলো। সময় নিয়ে হলুদ ফুলে বেনি জড়ানো হলে অবশিষ্ট বেচে যাওয়া একটা ফুল প্রিয়তমার কানে গুঁজে মুখোমুখি বসল। সমস্ত মুখমণ্ডলে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘোরগ্রস্তের মতো বলে উঠল,
— ফুল কানে গোঁজা আমার প্রিয়তমার সৌন্দর্যের সামনে পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য আজ ম্লান হয়ে গেল।
বিনিময়ে রওনকের দিকে নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল উপমা। কিছু বলল না। রওনকই পুনরায় কথা বলল,
— তোমার আমার এক হওয়ার পথটা অনেক কঠিন উপমা। উপলব্ধি করতে পারো? আঁততায়ী ছায়ার মতো তাড়া করে ফেরে আমাদের। অস্ত্র ধরা শিখেছি থেকে কোনোকিছুতে আমার ভয় করে না। আমি সৃষ্টিছাড়া, পিছুটানে বিশ্বাসী নই। কিন্তু এলেবেলে এই জীবনটাতে তোমাকে জড়িয়ে নেয়ার পর থেকে পিছুটান তৈরি হচ্ছে। আমার পরিবার আমাকে নিষ্ঠুর জানে। তাদের বলে রাখা আছে ভালো খারাপ সব পরিস্থিতির জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে। একই কথা তোমাকেও বলেছিলাম। তুমি বোধহয় কথাটার গভীরতা এখনও পরিমাপ করতে পারোনি।

এ পর্যায়ে কিছু বলার জন্য উপমার ঠোঁটজোড়া ঈষৎ ফাঁক হলো। তবে কণ্ঠনালী থেকে একটা শব্দও উঠে আসতে চাইল না। ছোট্ট শ্বাস ফেলে উপমার একটা হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে রওনক বলল,
— আর পাঁচটা প্রেমিক-প্রেমিকার মতো নিয়ম মেনে আমাদের দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা বলা সম্ভব নয়। অনেক বাঁধা আছে। বাঁধাগুলো ডিঙতে গেলে যা করা প্রয়োজন সবকিছুর চেষ্টাই আমি করছি উপমা। একটুখানি সময় দাও আমাকে। শুধু ভরসা রাখো আর ভুল বুঝো না।

রওনকের বলতে ইচ্ছে করল ওদের এক হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাঁধার নাম অতনু হাওলাদার। কিন্তু বলতে পারল না। তার পূর্বেই উপমার মায়াভরা চোখজোড়া নোনা অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে চিকন ধারা আকারে গড়াতে শুরু করল।
পূর্ণ দৃষ্টিতে ক্রন্দনরত প্রিয়তমার দিকে চোখ রাখল রওনক। গাছের ফাঁক গলিয়ে সোনাঝরা রোদ্দুর স্বানন্দে উপমার সমস্ত মুখমণ্ডলে মেখে যাচ্ছে। অবারিত অশ্রুগুলোকে দেখলে মনে হচ্ছে একেকটা যেন হীরকচূর্ণ। তৃষ্ণার্তের মতো গহন চুমুতে নোনা হীরকচূর্ণগুলোকে একে একে শুষে নিতে ইচ্ছে করছে রওনকের। প্রিয়তমার সমস্ত বিষাদ এক লহমায় টেনে নিতে ইচ্ছে করছে নিজের ভেতরে। অবুঝ প্রিয়তমা। বুঝতে চায় না তার চোখ থেকে ঝরা এক এক বিন্দু বিষাদ ঠিক যেন বর্শা হয়ে রওনকের হৃদয়ের জমিনে গেঁথে গেঁথে যায়।

ভাবনার ভেতর দৈবাৎ একটা উপলব্ধি খুব করে নাড়া দিয়ে গেল রওনকের ভেতরটাকে। এই কাটাছেঁড়া জীবনে মেয়েটাকে জড়ানো ঠিক হলো না বোধহয়। বিষাদ ছাড়া আর কিইবা দিতে পারবে সে মেয়েটাকে? দেবার মতো আদৌ কিছু অবশিষ্ট আছে তার কাছে?

চলবে,
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here