চিঠি দিও ২৫

চিঠি দিও
২৫
_____

“মিন্টুকে সরাতে তোর হেল্প লাগবে অতনু। আমার কাছে আপাতত কোনো প্ল্যান নাই। তোর কাছে থাকলে বল”
সাধের পার্শিয়ান হুঁকায় ঘনঘন বার দুয়েক টান দিয়ে নাকে-মুখে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কথাটা বললেন নিজাম চৌধুরী।
কথায় সায় দিয়ে নড়চড়ে বসল অতনু। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
— আমার কাছে একটা প্ল্যানই রেডি থাকে বস দুনিয়া থেকে খালাস করে দেয়া।
চোখ সরু করে অতনুর দিকে তাকিয়ে হা হা করে হেসে উঠলেন নিজাম। বললেন,
— তা যা বলেছিস। কাজটা করবে কে, তুই? দেখ কোনো প্রমাণ কিন্তু রাখা যাবে না।
— আরেহ বস। সেসব আবার বলে দিতে হয়? এমন একজন মানুষ আমার কাছে আছে, যে কাজ শেষ করবে ছায়ার খোঁজও কেউ পাবে না।
— বেশ বেশ। তাহলে যা ভালো বুঝিস কর। আইনি ব্যাপারস্যাপারে জড়াতে যাস না। অবশ্য সেসব নিয়েও কোনো ঝামেলা নেই। আমার ব্যাকাপ সবখানে রেডি।
দ্বিতীয় দফা হা হা করে হাসলেন নিজাম। হাসি শেষে বললেন,
— কিন্তু এমনভাবে পরিকল্পনা করবি, খুনটাকে যেন খুন না দুর্ঘটনা মনে হয়।
— অবশ্যই। সেটা নিয়ে আপনাকে চিন্তা করা লাগবে না।
হুঁকা হাতে মাথা ঝাঁকালেন নিজাম। ভ্রু জোড়া সংকুচিত করে চত্বরে আরেকবার চোখ বুলিয়ে অতনু বলল,
— মিন্টুরে বহিষ্কারের গুঞ্জন আপাতত স্টপ করে দেয়ার ব্যবস্থা করেন বস।
— গুঞ্জন কি রে! এই নিউজ তো কনফিডেনসিয়াল। তুই, আমি আর আনিস ছাড়া কেউ জানে না। নাকি জানে? ব্যাপার কি বল তো।
— হ্যাঁ ইয়ে.. তেমন কিছু না। গুঞ্জন উঠার পরপরই খুন টুন হলে কেস খায়ে যাব।
— আমারে কি তোর পাগল মনে হয়? সরায় দেয়ার পরিকল্পনা করলে বহিষ্কারের বিষয়টা প্রচার করব কেন? আর বহিষ্কারের কথাটা তো রাগের মাথায় বলছিলাম। মিন্টু যে অপরাধটা করছে তার সাজা শুধু এতটুকু হইতে পারে না।

— বস মিন্টুর পর ঐ পদটা কিন্তু আমার।

বালকসুলভ আবদার করল যেন অতনু। বিনিময়ে নিজাম পুনরায় ডাকাতিয়া হাসি হেসে পিঠ চাপড়ে বললেন,
— অবশ্যই অবশ্যই। এবারের কমিটি নির্বাচন উন্মুক্ত করে দিলাম। যে যা পদে দাঁড়াতে চাস দাঁড়াবি।
— উঁহু উন্মুক্ত না, কমিটি নির্বাচন স্টপ করে দিতে হবে আপনার। মিন্টুর মৃত্যুটাকে এখানে পাশার দানের মতো কাজে লাগাতে হবে। এতদিন ও আমাদের সভাপতি ছিল। ওর মৃত্যুর শোকে, ওকে সম্মান জানায়ে এ বছর আমরা নির্বাচন করব না৷ বরং বিশৃঙ্খলাটাকে কাজে লাগায়ে ঐ ফাঁকে কমিটি সাজায় ফেলব।
— তুই তো আমাকে চিপায় ফেললি রে অতনু।

চিন্তার রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠল নিজাম চৌধুরীর কপালে। এমনিতেই পার্টিতে তার জোর কমে গেছে। এই আসনটা পাওয়ার জন্য অনেক সাংসদ মুখিয়ে আছেন। তার মধ্যে বিশৃঙ্খলা করতে গেলে ছেলেকে আর এমপি বানাতে হবে না। বেশ কিছুক্ষণ আকাশ-পাতাল চিন্তায় মগ্ন থেকে মাথা নেড়ে নিজাম চৌধুরী বলে উঠলেন,
— এইভাবে হবে না অতনু। সভাপতি আর সাধারণ সম্পাদক দুই পদের জন্য নির্বাচন অনিবার্য। ভোট ছাড়া দল গঠন করলে সমস্যা।

কাজে ব্যর্থ হয়ে সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অতনু। হাল ছেড়ে দিয়ে বলল,
— সমস্যা হইলে আর কি করার! ঠিকাছে নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচনই হোক।
— তুই একটু জুনিয়র পোলাপানদের হাত করার চেষ্টা কর।
অতনুর মুখভঙ্গি দেখে উপযাচক হয়ে সাজেশন দিলেন নিজাম। যতই হোক ছেলেটা তার বাঁধা গোলামের মতো। প্রত্যেকটা কথাকে বজ্রসত্যি মেনে কাজ করে। এমন ছেলেকে হাতছাড়া করা সমীচীন নয়। বিশ্বস্ত লোক পাশে পেলে শওকতের এমপি হওয়া সহজ।
— ডাক্তার সাহেবকে দেখতিছি না। ঠিকমতো আলাপচারিতাই হইলো না ওনার সাথে।

অতনু যে শওকতকে খুঁজছে বুঝতে বেগ পেতে হলো না নিজাম সাহেবের। প্রতুত্তরে বললেন,
— ও তো হসপিটালে। গতকাল থেকে চেম্বারে বসছে। আমাদের শহরের মানুষ কিন্তু বেশ হেল্পফুল। সহযোগিদের মানসিকতায় ছেলে আমার সন্তুষ্ট।

“হবে না আবার। মন্ত্রীর ছেলের সাথে যেমন তেমন ব্যবহার করবে কার অত বুকের পাটা?”
মনে মনে বাক্যটা আওড়ালেও কণ্ঠে ফোটাতে পারল না অতনু। মৃদু হেসে সায় জানিয়ে জিপের চাবি হাতে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
— আজ তবে আসি বস। আপনি রেস্ট নিন। কাজ শেষে দেখা করে যাব আপনার সাথে৷
— এত জলদি উঠবি? ঠান্ডা-গরম কিছু নিবি না?
— ইংলিশ খাওয়া মুখ আমার, ঠান্ডা-গরমে পোষায় না।
সৌজন্যের হাসির সাথে প্রতুত্তর করল। হুঁকায় টান দিয়ে শ্লেষের সাথে নিজাম প্রশ্ন করলেন,
— তা যাচ্ছিসটা কোথায়?
প্রশ্নের জবাবে লাজুক হেসে মাথা চুলকোল অতনু। এতেই যা বোঝার বুঝে গেলেন নিজাম। লোভাতুর দৃষ্টিযোগে অশ্লীল ভঙ্গিমায় বললেন,
— বসকে একটু চাখতে দিবি না?
— আপনি চাইলেই দিব। বলেন কবে চান?
উদ্দেশ্য সফল হওয়ায় অহম ফুটে উঠল নিজামের চেহারায়। বিস্তর হাসির সাথে উত্তর করল,
— সুযোগ বুঝে ডেকে পাঠাব। রেডি রাখিস।
— সে তো কবে থেকে রেডি।
— বাহ্ বাহ্। তা মালটা কেমন?
— একদম কড়া।
বুড়ো আঙুল আর তর্জনী মিলিয়ে মুখে অদ্ভুত শব্দ করে বলল অতনু। শুনে লোভী চোখজোড়া চকচক করে উঠল নিজাম চৌধুরীর। ছেলে আসার পর থেকে বহুদিন যাবৎ অভুক্ত রয়েছেন। শরীরটা আর নিয়ন্ত্রণে থাকতে চাইছে না। নাহ্ এবার সুযোগ বুঝে সুখের রাজ্যে অবগাহনের পথটা খুঁজে বের করতে হবে। জৈবিক চাহিদার ভারে ভেতরটা ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে। সংযম ভেঙে গেলে সমস্যা।

ধ্যানমগ্ন নিজামের অশ্লীল হাসির রেখা দেখে তাচ্ছিল্যসূচক শব্দ আলোড়িত হলো অতনুর ভেতরে। শয়তানকে যতই ধর্মের পাঠ পড়ানো হোক শয়তান শয়তানই থাকে। কয়েকদিন সুফি সাজার নাটক করে ঠিক,কিন্তু সুযোগ পেলে রঙ পাল্টাতে সময় নেয় না। নিজামও তেমনই এক নারী মাংসলোভী শয়তান।
উঁহ্ মালের নাম শুনেই দেখো কেমন জীভ দিয়ে লালা ঝরছে বদমাশটার। সে নাকি আবার আদর্শ পিতা হওয়ার ভং ধরেছে।
নাকমুখ কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করে অতনু বলল,
— চললাম বস।
আসন্ন রঙ্গিন রাতের চিন্তায় মগ্ন নিজাম অতনুর কথায় কর্ণপাত করলেন কি না, হাত নেড়ে বোঝালেন “ঠিকাছে।”
এরপর আর বিলম্ব করল না অতনু। গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা উর্বশীর ঠিকানায়।

কয়েকদিন যাবৎ উর্বশীর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। সময়-অসময়ে পিঠ আর মেরুদণ্ডে ব্যথা ওঠে। ক্লান্ত লাগে ভীষণ। খাওয়ার রুচি মাত্রাতিরিক্ত কমে গেছে। আজ আবার গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। এতবড় বাড়িটায় সে ছাড়া আর কেউ থাকে না। কাজের মাসি এসেছিল সকালবেলা। ওকে বলেনি শরীরের এমন অবস্থা। শারীরিক যন্ত্রণার চাইতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে বেশি। কবে ঘুচবে এই একাকিত্ব? দুচোখ বেয়ে সরসর করে পানি গড়ায় উর্বশীর। কান ছাড়িয়ে বিন্দু বিন্দু জল বালিশ ভিজিয়ে ফেলে। প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে উর্বশী। স্বগতোক্তিতে প্রশ্নসূচক বাক্য বেরিয়ে আসে,
“কবে আসবে তুমি? আসবে না আমার কাছে?”

শারীরিক দুর্বলতায় কাবু হয়ে অচীরেই ঘুমের দেশে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেয় উর্বশী। সময়ের কাঁটা ঘুরলে তন্দ্রাঘোরে কলিংবেলের আওয়াজ শোনে। জীর্ণ ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে মলিন হাসি। কম্ফোটার সরিয়ে ফট করে উঠে দাঁড়ায়। হঠাৎ ওঠায় মাথাটা একটু ঘুরে ওঠে। বাধ্য হয়ে মাথা ধরে এক মিনিট বসতে হয়। কিছুটা ধাতস্থ হলে ধীরপায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ওদিকে স্বভাবমত দু’বার কলিংবেলে প্রেস করে দাঁড়িয়ে আছে অতনু। শিঁস বাজাচ্ছে। দরজা ভেদ করে আবছা আওয়াজ এদিক থেকে শোনা যাচ্ছে।
দুর্বল হাতখানা বহুকষ্টে ছিটকিনি অবধি পৌঁছিয়ে দরজা খোলে উর্বশী। অসুস্থতার রেশ সারা শরীরে দৃশ্যমান। এই এত বছরে প্রথম হাসিমুখের পরিবর্তে জীর্ণশীর্ণ উর্বশীকে দেখে কপালে ভাঁজ পড়ে অতনুর। সন্দিগ্ধ চোখে ওকে পুরোটা অবলোকন করে এগিয়ে এসে কপালে হাত রাখে৷ তপ্ত দেহে শীতল স্পর্শে খানিক কেঁপে ওঠে উর্বশী। মলিন হাসিটা ঠোঁটের কোণে লেপ্টে এখনও। হতবিস্ময়ে অতনু প্রায় আঁতকে উঠে বলে,
— সারা শরীর তো তোমার জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। ঔষধ-টৌষধ কিছু নিয়েছ?
কপালে রাখা অতনুর হাতটা দু’হাতে চেপে ধরে আলতো করে চুমু খেয়ে উর্বশী না বোধক মাথা নাড়ে।
— করেছটা কি! আচ্ছা চলো তো ভেতরে চলো ঔষধ খাবে। খাওয়াদাওয়া কিছু হয়েছে?
— জানি না।
দরজার পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো উর্বশী। দরজা আটকে চ’কারান্ত শব্দযোগে অতনু বলল,
— হেয়ালি করবে না তো।
এ কথার বিপরীতে খিলখিল হেসে উঠল মেয়েটা।
— তুমি আমায় নিয়ে এত ভাবো? ইশশ কি আনন্দটাই না লাগছে আমার!
— কেন ভাবলে দোষ?
চোখ সরু করে বলল অতনু।
— নাহ্ দোষ নয়। বিশ্বাসই হচ্ছে না।
বিনিময়ে শিশুসুলভ মাথা দোলালো উর্বশী। অতনু বুঝল জ্বরের ঘোরে চলে গেছে মেয়েটা। কি বলছে কি করছে বুঝতে পারছে না। চাপা শ্বাস ছেড়ে ওর বাহু ধরে বলল,
— চলো ঘরে যাবে।
— উঁহু অ্যায়সে নেহি। কোলে করে নিয়ে যাও আমাকে। কতদিন কোলে উঠিনি তোমার।
— কেন তুমি কি বাচ্চা মেয়ে?
হাসি চেপে মাথা ওপর-নীচ করল উর্বশী। বিরক্ত হতে গিয়েও বিরক্তিভাব আনতে পারল না অতনু। আসলে ও অবাক হয়েছে ভীষণ। উর্বশী মেয়েটার দিকে সবসময় কামনা, আকাঙ্ক্ষা তথা শারিরীক আকর্ষণ থেকে তাকানো হয়েছে। মেয়েটাও নিজেকে উদ্ভিন্নযৌবনা, আবেদনময়ী রূপেই নিজেকে উপস্থাপন করে এসেছে সর্বদা। আজ জ্বরের ঘোরে ওর শিশুসুলভ আচরণ বিস্মিত করছে অতনুকে।

সাগ্রহে নিজের দু-হাত বাড়িয়ে রেখেছে উর্বশী অতনুর পানে। সময়ক্ষেপণ না করে চট করে উর্বশীকে কোলে চাপিয়ে শোবার ঘরের দিকে পা বাড়াল অতনু। ওর গলা জড়িয়ে ধরে কানের ওপর ঠোঁট ছুঁয়ে বিড়বিড় করে উর্বশী বলতে শুরু করল,
“আজ জ্বরতপ্ত ঠোঁটে মেঘ হয়ে চুম্বন বৃষ্টি না ঝরালে কি করে শীতল হবো বলো?”

— জ্বরের ঘোরে সাহিত্যানুরাগী হয়ে উঠেছ বড়। ইদানীং ভালো বাংলাও বলো তুমি। ঘটনা কি? শিখছ কোথায় এসব।
শ্লেষের সাথে কথাটা বললে পুনরায় খিলখিল হাসিতে পরিবেশ মাতিয়ে তুলল উর্বশী। প্রশ্নটাকে এড়িয়ে অতনুর গলায় হাত বুলতে বুলতে বলল,
— আজ আমায় একটু চুমু খাবে? কামনার চুম্বন নয়;ভালোবাসার চুম্বন। একটু সোহাগ করে। জানো তো মুঠোবার্তা মুছে যায় বাইনারি পিক্সেলও, শুধু চুম্বনের দাগ মুছে না৷
— তাই নাকি? ঠিকাছে তবে খাব। সোহাগ করেই চুমু খাব। কিন্তু সোহাগ করার জন্য যে তোমায় সুস্থ হতে হবে সিস্টার। আগে ঔষধ খেয়ে সুস্থ হও এরপর আদর-সোহাগ সব হবে।
— উঁহু তখন যেটা হবে সেটা তো…
কথা সম্পূর্ণ করল না উর্বশী। মিনিটখানেক পর একটু ঝিমিয়ে গিয়ে বলল,
— স্রেফ এএকবার মন ছুঁয়ে ভালোবাসলে কি হয় বাংগালী বাবু? আমার সবরকম অসুখের অওষধি তোমার ভালোবাসা এটা জানো?

দ্বিতীয়বার শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অতনু। উর্বশীকে বিছানায় শুইয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
— কি রেঁধেছে আজ কাজের মেয়েটা? ব্রেকফাস্টে কি নিয়েছ?
— জানি না। পাকঘরে গিয়ে দেখে এসো।

অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিলো মেয়েটা। ভাবল অনুরাগে বাঁধবে অতনুকে। কিন্তু ওর ধারণাটা যে ভুল।
সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল অতনু। সত্যি সত্যি বোধহয় পাকঘরের দিকে গেল।
ওর গমনপথে তাকিয়ে অশ্রুসজল উর্বশী স্বগতোক্তিতে বিড়বিড় করল,
“একটাবার ভালোবেসে কাছে এলে কি ক্ষতি হয়ে যায় বাংগালী বাবু? দূরেই যদি সরিয়ে রাখবে তাহলে একদিন কাছে টেনেছিলে কেন? আচ্ছাই তো ছিলাম ঐ জীবনটাতে। শুধু শুধু আমায় নিজের সাথে জড়িয়ে আকেলা করে দিলে। একাকিত্ব আর সইতে পারি না। কোন আপরাধের সাজা দিচ্ছ কে জানে!”

একদা রবী ঠাকুর বলেছিলেন,
“শরীরের সবচাইতে দামী অংশ হলো হৃদয়, যেখানে থাকার যোগ্যতা সবার থাকে না।”

উর্বশী নামক এই ভিনদেশী মেয়েটা কি এতদিনে উপলব্ধি করতে পারল, কে তার মনে থাকার যোগ্য আর কে নয়? নাকি এখনও মিছে ভালোবাসার মোহমায়া তার চেতনার দৃষ্টিকে তমসাচ্ছন্ন পর্দায় ঢেকে রাখল!
____________

মানুষ কি তার মৃত্যু বুঝতে পারে? মিন্টু বলে লোকটা গত একমাসে খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরুতো না। লোকে বলে না জীবন-মরণ সমস্যা। সেরকম না হলে তার ছায়ার খোঁজও কেউ পায়নি এতদিন। টুপ করে কাজ সেরে কোথায় গিয়ে যে লুকত কে জানে! ওর পরিবারেরও তো কোনো খবর নেই। গোটা পরিবার নিয়ে আত্মগোপনে গিয়েছিল নাকি লোকটা,কে জানে!
বহুদিন যাবৎ লোকটার ওপর নজর রাখছিল রওনক। নাহ্ অতনুর নির্দেশনায় নয়। নিজে থেকেই খোঁজ-খবর নিচ্ছিল। কেন যেন মনে হচ্ছিল শীঘ্রই এই লোকটার যমদূত হিসেবে প্রকট হতে হবে তাকে। ধারণা মিথ্যে নয়। আজ বিকেলেই টেলিফোন যোগে অতনুর নির্দেশনা এসেছে মিন্টুকে পথ থেকে সরিয়ে দিতে হবে। তবে রওনক ঠিক করেছে, সে নয় এবারের কাজটা অন্য কাউকে দিয়ে করাতে হবে। র’ক্তেটক্তে আর হাত ডোবাতে ইচ্ছে করে না তার। নির্ঘুম রাত কাটানোর মুডও নেই। তাছাড়া খুনটাকে নাকি দুর্ঘটনা দেখাতে হবে? গাড়ি, ট্রাক এসবে চাপা দেয়া অনেক ব্যাকডেটেড কাজকারবার। এবার খুনটা হবে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে। খুনের পর টাকাপয়সা, দামী যা কিছু থাকবে সব ছিনতাই হয়ে যাবে। বাহ্ আইডিয়া মন্দ নয়। ফুলপ্রুফ মার্ডার প্ল্যান একেবারে।
বাঁকা হেসে শার্টের পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে গুঁজল রওনক। লাইটার হাতে নিলে উপমার কথা মনে পড়ল। মেয়েটা অভিমান করেছে ভীষণ। তখন কত করে বলল রওনক বাড়ি পৌঁছে দেবে, রাজিই হলো না। রাগ করে একা একা রিকশা করে বাড়ি চলে গেল। আজ বহুদিন পর ফোনও করেছিল রওনক। রিসিভ তো করেইনি উল্টো আননোউন নম্বর বলে ভাবীকে ধরিয়ে দিয়েছিল। ঝাড়ি খেয়ে পুরো বোকা বনে গিয়েছিল রওনক। কথা বেরুচ্ছিল না মুখ থেকে। বিনিময়ে সতর্কবাণী এসেছে। দ্বিতীয়বার ঐ নম্বরে ফোন করলে ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেবে। বাব্বাহ! পুরো পরিবার ডাকাত পরিবার। আর তার ডাকু সর্দারনী। সে তো একেকসময় একেক রূপ দেখিয়ে রীতিমতো চমকে দিচ্ছে রওনককে।

ক্লাবের দেউড়িতে বসে সময় নিয়ে পুরো সিগারেট শেষ করল রওনক। তন্মধ্যে ভেতর থেকে বার কয়েক তাস পেটানোর আহ্বান এলো ছেলেদের তরফ থেকে। ও গেল না। মিজানের অপেক্ষা করছে। মিজান গেছে আজকের মূল চরিত্র মানে কুখ্যাত সেই ছিনতাইকারীদের খোঁজে। কি অদ্ভুত! পলিটিক্সের লাইনটা এমন একটা লাইন, এখানে থাকতে হলে সুফী-সাধক, শয়তান সকলের সাথে একটা গুড রিলেশন বজায় রেখে চলতে হয়। কখন কোন কাজে কার প্রয়োজন পড়ে!

মিজান এসে পৌঁছলো বেশ কিছুসময় পর। রওনক তখনও বহির্দ্বারে বসা। মোটরসাইকেল একপাশে স্ট্যান্ড করে হেলেদুলে ওর পাশে এসেই বসল মিজান। তর্জনী দিয়ে কপাল থেকে ঘাম টেনে ছিঁটিয়ে দিলো চোখেমুখে। বিরক্তিতে উঁহ শব্দ করে ধাক্কা দিয়ে ওকে ফেলে দিলো রওনক। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলল,
— ভর সন্ধ্যায় ভাং খাইছিস কেন বে?
মাটিতে উবু হয়ে পড়ে হাসতে হাসতে মিজান হাত নাড়ল। বলল,
— চেংড়াগুলা ছাড়ল না।
— যে কাজের জন্য গিয়েছিলি সে কাজ কমপ্লিট হয়েছে? নাকি তার আগেই নেশায় টাল!
— উহু। অল কমপ্লিট ব্রাদার, অল কমপ্লিট। নাথিং লেফট। ফিফটি পার্সেন্ট টাকা অলরেডি পে করে দিয়েছি। বাকিটা কাজ শেষে।

গা ঝাড়া দিয়ে ফের রওনকের পাশে এসে বসল মিজান। নেশাগ্রস্ত ওর পা থেকে মাথা অবধি একবার চোখ বুলিয়ে ছোট্ট করে রওনক বলল,
— ভেরি গুড।
— ইয়েস। গুড গুড ভেরি গুড।
অপ্রকৃতিস্থের ন্যায় বার কয়েক মাথা দোলালো মিজান।
ওদিকে আর বিশেষ নজর দিলো না রওনক। ও জানে প্রথম প্রেমে ব্যর্থ হয়েছে বলে বন্ধু এমন মাতাল-বেতাল ঘুরছে ফিরছে। যদিও বন্ধু নিজ মুখে স্বীকার করেনি। তবে বোঝা তো যায়৷ এছাড়া একপ্রকার সন্দেহ থেকে খোঁজও নিয়েছিল রওনক। জানতে পেরেছে অতিসম্প্রতি ছোটো বোন বকুলের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে তার প্রাণপ্রিয় বন্ধুটি। মুখের ওপর না করেছে মেয়েটা।
আহারে! সহানুভূতি প্রকাশ ছাড়া কিছু করারও নেই রওনকের হাতে।
ভালোবাসা হলো একটা অনুভূতির নাম। মানুষের মন থেকে আসে। আর মনের ওপর কি কারোর জোর চলে? চলে না তো। জোর করলে বরং তিক্ততা বাড়ে।
এ সম্পর্ক হওয়ার হলে একা একাই হবে, তাকে কিছু করতে হবে না। করা উচিৎও না। হাজার হোক মেয়েটা তার বোন।

“কইলজা পোড়া গন্ধ কতটা তীব্র হয় বন্ধু। আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়ায় কি?এই যে এই মুহুর্তে তুই আমার পাশে বসি আছিস। তুই কি পাইতেছিস আমার পোড়া কইলজার গন্ধ?অ্যাঁহ?”
টলতে টলতে রওনকের গায়ে ঢলে পড়ল মিজান।
–আরেহ্ ব্যাটা সামলা নিজেকে।
বলে এক হাতে ঠেলে ধরল রওনক মিজানকে। অল্প হেসে রওনকের হাতে ভর দিয়ে মিজান বিড়বিড় করতে লাগল,
— ভালোবাসা কি জানিস? ভালোবাসা জিনিসটা হইলো শবের চিতা। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আমরা পতঙ্গ হয়ে জ্বলন্ত আগুনটাতে ঝাঁপায় পড়তে পছন্দ করি। এই স্বেচ্ছামৃত্যুটা আমাদের ভীষণ পছন্দের;ভীষণ।

নিগুঢ় আঁধারে মিজানের হতাশামিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস কুণ্ডলী পাকিয়ে অন্তরীক্ষে মিশে যেতে লাগল।
পাশেই পুরো নিশ্চুপ হয়ে বন্ধুর কথাটা কর্ণগোচর করল রওনক। বিপরীতে কি বলবে ও? আদৌ কিছু বলার আছে! বলতে গেলে নিজেও তো এই মুহুর্তে শবের চিতায়ই দণ্ডায়মান। আগুন তাকেও ভস্ম করে দেবার বাসনায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তবে সে দুর্বল পতঙ্গ নয়। আগুনের মুখ থেকে বেঁচে ফেরার লড়াই ঠিক তার জানা।

চলবে,
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here