চিঠি দিও ২৬

চিঠি দিও
২৬
_________

নিয়ম করে দিনগুলো গত হচ্ছে। একেকটা দিন কেটে যাবার পর পুরনো কথা আমাদের স্মৃতিকে ততটা আঁকড়ে ধরে থাকে না। ভালো স্মৃতি ধোঁয়াশা হয়ে যায় আর ক্ষতের ওপর একটা প্রলেপ পড়ে। তেমনি করে অভিমানীনি উপমার প্রিয়তমের ওপর অভিমান অনেকটা কমে গেছে। যেটুকু আছে সেটুকুও পলকা মেঘের মতন এদিক সেদিক উড়ে বেড়ায়। কখনো মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠতে চাইলে ওঠে, খানিক পর আবার ভুলেও যায়।
এতসবের মাঝে একটা ভালো ব্যাপার ঘটেছে। মন-মানসিকতায় বেশ পরিবর্তন এসেছে উপমার৷ কীভাবে যেন নিজেকে সামলে নেয়ার প্রবণতা এসেছে ওর মধ্যে। প্রথম প্রেমে মাত্রাছাড়া আবেগের রশিটা দু’হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছে গেছে ও। হয়তোবা দিনকে দিন ওর চিন্তাভাবনার পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে একারণেই। তবে কারণ যা-ই হোক এতে ও এবং রওনক দু’জনেই খুশি।
নিয়ম করে দুটির মধ্যে আবারও যোগাযোগ শুরু হয়েছে। দেখাসাক্ষাৎ তো হয়না বহুদিন। হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সংগঠনের নির্বাচন নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত মানুষটা। প্রথমবারের মতো প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এ মিটিং, সে মিটিংয়ে কখন সকাল হচ্ছে আর কখন রাত, নিজেরই খেয়াল থাকছে না। তবে দিনশেষে একটা নির্দিষ্ট সময়ে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে ফোন হাতে উপমা অপেক্ষা করে প্রিয়তমের কণ্ঠস্বর শোনার জন্য। সে বিনা উপমা যতখানি ব্যাকুল, প্রিয়তমের মধ্যেও তেমন ব্যাকুলতা আছে কি না খুব করে জানতে ইচ্ছে করে উপমার। মানুষটা অবশ্য নিরাশ করে না তাকে। ঠিক সন্ধ্যে নামার আগে মেঘের কোল ঘেঁষে শঙ্খচিলগুলো যেমন নীড়ে ফিরে আসে তেমনই তার প্রিয়তম বেলাশেষে তার ঠিকানায় ফিরে আসে। সমস্ত ব্যস্ততার অবসান ঘটিয়ে জানান দেয় সে আছে, সহচররূপে সর্বদা পাশে আছে।
কথা হয়তোবা কম হয় দুজনের। যতটুকু হয় ঘোরের মধ্যে থেকে শোনে উপমা। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মানুষটা আধোঘুম-আধো জাগরণে জড়িয়ে আসা গলায় অবাক হয়ে যখন বলে,
“বোকা মেয়েটা তুমি এখনও আমার কলের জন্য অপেক্ষা করছিলে!”
চোখ বন্ধ করে তখন মৃদু হেসে উপমার বলতে ইচ্ছে করে,
“আপনার জন্য তো আমি অনন্তটাকাল অপেক্ষা করতে পারব রওনক। এতটুকুতে বিস্ময় কেন?”
অন্তরালের কথাটুকু মুখ ফুটে বলা হয়ে ওঠে না। পরিবর্তে মেকি অহম নিয়ে বলে,
— আপনি তো আমার কণ্ঠস্বর না শুনলে ঘুমোতে পারেন না। তাই অপেক্ষা করি কখন দু’টো কথা বলে আপনার কানজোড়াকে ধন্য করে দেব।
প্রিয়তমার বাঁকা কথায় রওনক হাসে। ওর হাসির শব্দ ক্ষীণ হয়ে কানে বাজে উপমার। ফোনের এপাশে তারও ঠোঁটজোড়া প্রসারিত হয়। তর্কে সময় ব্যয় করে না রওনক। রিসিভারটা ঠোঁটের ওপর আলতো করে চেপে রেখে কথা বলে। জানতে চায় উপমার বেহিসেবী দিনগুলো কেমন করে কেটে যাচ্ছে, রওনককে তার কতখানি মনে পড়ে। কখনোবা বিড়বিড় করে গান শোনার আবদার করে। নিঝুম রাতে জোরে গান গাইতে পারে না উপমা। বালিশের নীচে মুখ ডুবিয়ে কণ্ঠে যতটুকু সুর ফোটানো যায় ফুটিয়ে গান শোনায়৷ কিন্তু একটাদিনেও রওনক পুরো গান শুনতে পারে না। দেখা যায় দু লাইন গেয়েছে কি না ওপাশ থেকে ভারী নিঃশ্বাস পড়ার শব্দ ভেসে আসে। গান বন্ধ করে রিসিভারটা বুকে চেপে ধরে রাখে উপমা।
দুচোখে তার অথৈ সাগর। কোনোরূপ সতর্কবাণী না দিয়েই আকুলিবিকুলি ঢেউ ওঠে; অবাধ্য অগোছালো ঢেউ। বিনা অনুমতিতে দুকূল ছাপিয়ে গড়িয়ে পড়তে চায়। যতই দৃঢ়চিত্তে সামলানোর চেষ্টা করুক কখনো আগল ছাড়া হয়ে তা শব্দ বিহীন ক্রন্দনে রূপ নেয়। তবে এ কান্না কোনোরূপ আফসোসের নয় বরং মিষ্টি বিরহ যাতনার। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম অপেক্ষার৷ আপনারা বলবেন বিরহ যাতনা আবার মিষ্টি কি করে হয়? আমি বলব হয়। মিলনের অপেক্ষারত দুই মানব-মানবির এক হওয়ার প্রহর আকুতিটুকু ভীষণ প্রেমময়, ভীষণ স্মৃতিবহ। এই আকুতিতে যেমন দূরত্বের কষ্ট আছে, তেমনই এক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে;দু-চোখ ভরা স্বপ্ন আছে। স্মৃতিগুলোকে স্মৃতির পাতায় ধরে রাখার তাড়না আছে। এই বিরহে অসীম প্রেম আছে; আর প্রেমে মিষ্টতা আছে।
কলেজে ইদানীং বখাটেদের উৎপাত মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে। যেমনি কলেজে সংস্কার করে নতুন নতুন সিটিং প্লেস তৈরি করা হচ্ছে। আড়ালে থাকা বদমশাগুলো সেই সুযোগে মুখোশ ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে আসছে। অবশ্য ক্লাস টাইমে হলে এরা এত সাহস পেতো না। বিকেলবেলা তো! কলেজ তেমন ফাঁকাই থাকে।
বদমাশগুলো কলেজেরই স্টুডেন্ট নাকি বহির্ভূত ধরতে পারে না উপমা৷ ওর আবার হায়ার ম্যাথ প্রাইভেটটা কলেজের ভেতরে পড়তে হয়, কলেজের স্যারের কাছে। তখনই যাওয়া-আসার পথে বার কয়েক বদমাশগুলোর সাথে সামনা-সামনি হয়। বিরক্ত লাগে ভীষণ।
ও অবশ্য ধৈর্য ধারণ করে আছে। গতবারের ঘটনাটা এখনও ভুলতে পারেনি। মাত্র একটা থাপ্পড়ের বিনিময়ে কীভাবে জান নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গিয়েছিল। এরপর সেজো ভাইয়ের কড়া নির্দেশ এসব ঝামেলায় আর জড়ানো যাবে না। হাত তো উপমার এখনও চুলকোয় দু চারটে চড়-থাপ্পড় মারার জন্য। কিন্তু সেজো ভাইয়ের সতর্কবাণী উপেক্ষা করা দায়। শেষে দেখা যাবে সদ্য পাওয়া যতটুকু স্বাধীনতা আছে সব ফুসস করে গায়েব হয়ে যাবে। মাঝেমধ্যে রাগই হয় উপমার। এ কেমন ভাই তার? এত সাহসী একটা বোন পেয়েছে কোনো কদরই নেই। মনোকষ্টটা ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস আকারে বেরিয়ে আসে।
আজ কলেজ গেটে রিকশাটা ছেড়ে দিয়েছে। ভেতরে এলে নাকি আলাদা চার্জ। কি দরকার? তারচেয়ে পায়ে হেঁটে এগোনো ভালো।

যাওয়ার পথে রোজকার নিয়মে ক্যান্টিনের সামনে কাঠের বেঞ্চে বদমাশগুলোর একটাকে বসে থাকতে দেখা গেল। বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেলল উপমা। ওদিকে ওকে দেখে বদমাশটার অতি উৎসাহে শিঁষ বাজানো শুরু হয়েছে। রীতিমতো পায়ের ওপর পা তুলে পা নেড়ে নেড়ে শিঁষ বাজাচ্ছে ছেলেটা। উপমা ভাবল ইগনোর করবে। দমবন্ধ করে হাওয়ার বেগে বেরিয়ে যাবে।
আঁড়চোখে একবার পা ঝাঁকানোটা লক্ষ করে দ্রুত ক্যান্টিন চত্বরটা ছাড়ার জন্য পা বাড়াল। কিছুটা পথ যাওয়ার পর হঠাৎ মনে হলো ছেলেটা তো এখানে একা;সাঙ্গপাঙ্গবিহীন। কেন না একটু সুযোগ নিয়ে দেখে। মাত্র একটা চপেটাঘাত তাতেই হাতের চুলকানি থেমে যাবে। ওদিকে বদমাশটারও একটা শিক্ষা হবে, নিজের মনেরও শান্তি।
হাঁটার গতি থামিয়ে কোমরে হাত রেখে আশেপাশে চোখ বোলালো উপমা। মানুষজন কিছু আছে ক্যাম্পাসে। থাপ্পড়টা মারার পর কোনো সমস্যা হলে চিৎকারে লোক জড়ো করা যাবে। সরু চোখে চারিদিক ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করা হলে এবার বখাটেটার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল উপমা। তা দেখে শিঁষ বাজানো থামিয়ে ভ্রু নাচালো বখাটেটাও। চোখ টিপ দিয়ে জীভ আর ঠোঁটের অশ্লীল শব্দ তুলে আঙুলে ইশারা করল। যেন ও ডাকছে উপমাকে। বাজে ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ পায়ের রক্ত চিড়চিড় করে মাথায় উঠে গেল উপমার। চরম রাগের বহিঃপ্রকাশে লম্বা শ্বাস টেনে বক্র হেসে ধপাধপ্ পা ফেলে ফিরে এলো ক্যান্টিনের সামনে।
উপমা কিংবা বখাটে ছেলেটার মধ্যে কেউই কিন্তু খেয়াল করেনি ওদের ঠিক বিপরীতে বাংলা মঞ্চের কাছে জলপাই রঙা একটা হোন্ডার উপস্থিতি। হোন্ডাটা আর অন্য কারোর নয় দু’জনেরই পরিচিত মুখ রওনকের। শান্তভাবে হাত ভাঁজ করে হোন্ডায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রওনক। এতটুকু সময়ে যা যা হয়েছে আগাগোড়া সবটাই তার চোখের সামনে ঘটেছে। যদিও দৈবাৎ ঘটনাটার সাক্ষী হয়েছে সে। আজ এই সময়ে তার এখানে থাকার কথাই ছিল না। কথা ছিল কাউনিয়ায় আনিস শেখের বাড়িতে থাকার। কিন্তু দুপুরের দিকে দাদাবাড়ির এলাকার এক ছেলে ক্লাবে এসে তার খোঁজ করল। সাহায্যের আর্জি নিয়ে এসেছে সেই ছেলে। জানা গেল অতিসম্প্রতি তার বাবা মারা গেছে৷ বাবার মৃত্যুর পর যৎসামান্য যে সম্পত্তিগুলো ছিলো ধোঁকার মাধ্যমে চাচারা আত্মসাৎ করে নিয়েছে। এখন ছেলেটার কাছে মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই নেই। কারমাইকেলে অনার্সে ভর্তি ছিল ছেলেটা। পারিবারিক ঝামেলায় না ক্লাস করতে পেরেছে আর না পরীক্ষা দিতে পেরেছে ঠিক মতো। এখন বুঝতে পারছে না তার ছাত্রত্ব আছে কি না। থাকলেই বা শূন্য হাতে কীভাবে কি করবে। বাধ্য হয়ে বেচারা এখন রওনকের শরণাপন্ন হয়েছে। দাদাবাড়ীর এলাকার ছেলে শুনে রওনকের বুঝতে অসুবিধে হয়নি বাবাই ছেলেটাকে পাঠিয়েছে। এই ভেবে রওনকের আনন্দ হয়েছে তার বাবা তাকে যৎসামান্য হলেও ভরসা করে। জানে ছেলের কাছে এই ধরনের সমস্যাগুলোর কিছু না কিছু সমাধান আছে। আজ এত বছরে বাবা তাকে ভরসা করে কাজ দিয়েছে, রওনক ফেলতে পারেনি। চাইলেই সে অসৎ উপায় অবলম্বন করে ছেলেটাকে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে পারে, এমনকি আত্মসাৎ হয়ে যাওয়া সম্পত্তিও ফিরিয়ে এনে দিতে পারে। কিন্তু এখানে তার বাবা জড়িত আছে। বাবার ছায়ার পরে অসৎ কাজে একটা কুণ্ঠাবোধ জেগেছে।
চিন্তাভাবনা করে রওনকের মনে হয়েছে এই সমস্যার একমাত্র সমাধান দিতে পারেন একজনই, তার প্রিয় শিক্ষক। সময় নষ্ট না করে ছেলেটাকে ক্লাবে বসিয়ে রেখে তাই প্রফেসরের সাথে দেখা করবে বলে এসেছিল। কিন্তু এখানে এসে তাকে নিরাশ হতে হলো। প্রফেসর আউট অফ টাউন। ফিরবেন দু’দিন পরে।
এই দুটো দিন ছেলেটাকে অন্য কোনো ব্যবস্থা করে দিতে হবে ভেবে ফিরতি পথ ধরছিল। তখনই হঠাৎ দেখা মিলল ক্যান্টিনের সামনে বসে মেয়েদের উত্যক্ত করা এক মহাপুরুষের। উপমার আগে আরও দুটো মেয়েকে ও টিজ করেছে। রওনক কিছু বলেনি। ও মূলত দেখতে চাচ্ছিল মহাপুরুষের দৌড় কতদূর। কোন চূড়া পর্যন্ত সে উঠতে পারে। এরপর সুযোগ বুঝে তাকে নামানোর দায়িত্ব রওনকের।
কিন্তু এর মাঝে যে উপমা এসে উপস্থিত হবে ভাবনায়ও আসেনি। উপমাকে এগোতে দেখে ক্ষীণ হেসে নাক চুলকোল রওনক। ঠিক হাতে পড়েছে এবার মহাপুরুষ। আগেই এগবে না। দেখা যাক মেয়েটা কতদূর কি অ্যাকশন নেয়। এরপর প্রয়োজন হলে না-হয় এগবে।

এদিকে সরাসরি ছেলেটার সামনে উপস্থিত হয়ে তর্জনী উঁচু করে উপমা সরোষে মৃদু হুংকার ছাড়ল,
— এ্যাই ছেলে উঠে দাঁড়াও। তোমার সাহস কি করে হয় আমাকে টিজ করার। খুব সাহস না? চেনো আমাকে!
— চিনিনা চিনাবা। ঐ ঝোঁপে যাবা? চলো পাখি একদম ভালো মতো চিনে নেব তোমাকে।
খপ করে উঁচিয়ে রাখা উপমার তর্জনী হাতের মুঠোয় চেপে ধরল ছেলেটা। এবং বাজে ভাবে তালুতে মোড়াতে লাগল।
ওর এতবড় দুঃসাহসে উপমা রীতিমতো বিস্মিত। বুঝল চপেটাঘাত ছাড়া ছেলেটাও দম নেবে না৷ দ্বিতীয় কোনো বাক্য ব্যয় করার প্রয়োজন বোধ করল না উপমা । সোজা ওর হাত উঠে গেল। তবে ছেলেটাও তো কম যায় না। তড়িৎ উপমার অপর হাতটা ধরে ফেলে ঝটকা মেরে কাছে টানার চেষ্টা করল। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলল,
— জংলী বিড়াল আমার বহুত পছন্দ। সহজে এরা পোষ মানে না। পোষ মানাইতে গেলে ধারালো নখের আঁচড় খাইতে হয়। উফফ সুন্দর নখগুলা দিয়া যখন আঁচড় কাটে না..
জীভের অশ্লীল শব্দটা দ্বিতীয়বার করল ছেলেটা। অর্ধেকে ফেলে রাখা কথাটুকু সম্পূর্ণ করার আগে অনতিদূরের একজোড়া জ্বলন্ত চোখ অচীরে ওর কণ্ঠরোধ করে দিলো। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ঝট করে উপমার হাত ছেড়ে দিয়ে দু’কদম পিছিয়ে গেল ও। উপমা নিজেও বুঝতে পারল না কি হচ্ছে৷ তবে যা-ই হোক সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভুলল না। এগিয়ে গিয়ে খাবলে ধরল শার্টের কলার। চিৎকার করার প্রস্তুতি নেবে নেবে ভাব তখুনি মৃগী রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে ছেলেটা কোনোরকমে হাতজোড় করে মিনমিন করল,
“আপা মাফ, মাফ করেন।”
এরপর উপমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কোনোরকমে শার্টের কলার ছাড়িয়ে ভোঁ দৌড়।
দৌড়তে গিয়ে একবার পড়েও গেল, পড়িমড়ি করে উঠে তারপর আবার দৌড়। ছেলেটার এমন অস্বাভাবিক ব্যবহার কিছুতেই বোধগম্য হলো না উপমার। ভ্রু কুঁচকে নিজের হাতজোড়ার দিকে একবার তাকাল, আরেকবার সামনে। জ্বীনগ্রস্ত নাকি বদমাশটা? ক্ষণিকের চিন্তাভাবনার পর এই প্রশ্নটাই উদয় হলো মাথায়।
উপমা যখন এসব আকাশ-পাতাল প্রশ্নোত্তরে মশগুল ঠিক তখন পেছন থেকে এসে টুপ করে ওর খোঁপার কাঁটা টান দিয়ে খুলে নিলো রওনক। বলল,
— বেনিমাধবীর আজ বেনি নেই কেন?

এভাবে হুট করে এসে চুল খুলে দেয়ায় যারপরনাই বিরক্ত হলো উপমা। কতখানি সময় ব্যয় করে খোঁপাটা করেছিল ও। নাহ্ এক নিমেষে সব কষ্ট গেল জলাঞ্জলি। কোমরে হাত রেখে চেহারায় বিরক্তিভাব ফুটিয়ে পিছু ঘুরে বলল,
— আহহা রওনক। কি করলেন এটা? কত কষ্ট করে খোঁপাটা বেঁধেছিলাম আমি।
বিনিময়ে সহানুভূতি তো লেশমাত্র মিলল না উল্টো দাঁত বের করে গা জ্বালানো হাসি দিয়ে রওনক বলল,
— বাঁধবে কেন? খোঁপার চেয়ে বেনি ভালো। বেনিতে তোমায় বেশি মানায়।
— কিন্তু সবকিছুই তো একবার করে ট্রাই করতে হয়।
অর্ধ খোলা চুল গুলো দুহাতে মুঠ পাকাতে পাকাতে উপমা পুনরায় বলল,
— দিন কাঁটাটা দিন আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।

কাঁটা সরিয়ে রওনক দুপাশে মাথা নাড়ল।
— উঁহু কাঁটা তো তুমি পাবে না। করলে এমনিই করো নইলে ছেড়ে রাখো। সুন্দর লাগবে।
— এটা কোন ধরনের ছেলেমানুষী!
— ছেলেমানুষী নয় সত্যিই।
কাঁটাটা এবার নিজের পকেটে পুরে নিলো রওনক। তা দেখে ফস করে শ্বাস ফেলে হাতখোঁপা করে উপমা বলল,
— আমাকে জ্বালাতন করে খুব আনন্দ পান?
— ভীষণ। যা বলার মতো নয়।
— আপনার স্বীকারোক্তিতে আমি আপ্লুত।
দাঁতে দাঁত চেপে বিরক্তির সাথে বলল উপমা। বিনিময়ে আলতো করে ওর গালটা টেনে দিয়ে রওনক বলল,
— সো সুইট অফ ইউ। তো এই বিকেলবেলা কলেজে কেন?
— বলিনি আমার প্রাইভেট এই টাইমে।
— বলেছিলে। কিন্তু তোমার ক্লাসরুম তো এখানে নয়।
— জানি এখানে নয়। যাচ্ছিলাম এই পথ দিয়ে তখনই একটা বদমাশ…
কথা সম্পূর্ণ করল না উপমা। হঠাৎ চোখ সরু করে সন্দিগ্ধ চেখে রওনকের দিকে তাকিয়ে বলল,
— এক মিনিট। আপনি এখানে কোত্থেকে এলেন? একটু আগে কোথায় ছিলেন?
— আমি আবার কোথায় থাকব। ছিলাম এক জায়গায়।
— সত্যি করে বলুন কোথায় ছিলেন আপনি। একটু আগে যে বদমাশটা হঠাৎ ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। আপনাকে দেখেই তাই না?
— না তো। কোন বদমাশ, কার কথা বলছ তুমি?
অবুঝ হওয়ার ভাণ করল রওনক। কিন্তু ওর হাসি সবটা গড়গড় করে বলে দিলো উপমাকে। ভ্রু কুঁচকে মিনিট কতক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে উপমা বলল,
— যাইহোক ভালই করেছেন। আমার আর চড়-থাপ্পড়ে সময় ব্যয় করতে হলো না। বদমাশগুলোর যা উৎপাত বেড়েছে কলেজে। একটু চোখ রাঙানি দিয়ে সিধে করে দেবেন তো।
— ম্যাডাম কি আমাকে কাজ দিচ্ছেন? বিনা পারিশ্রমিকে কিন্তু কাজ করি না আমি।

উপমার মুখের দিকে ঝুঁকে বলল রওনক। একহাতে ওকে ঠেলে সরিয়ে আশপাশটায় তাকিয়ে উপমা বলল,
— কি পারিশ্রমিক চাই আপনার শুনি।
— বেশি কিছু নয়। আপনার ব্যস্ত শিডিউল থেকে এই অধমের নামে একটি বিকেল লিখে দিলেই হবে।
— একজন আগাগোড়া ব্যস্ত মানুষ আমার ব্যস্ততা পরিমাপ করছে। হাস্যকর।
তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো উপমা। তা দেখে আরেকটু ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে উপমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে রওনক বলল,
— আর অল্প কয়েকদিনের অপেক্ষা। যে পদটার জন্য আমার এত এত ত্যাগ-তিতিক্ষা সেই পদটা পেয়ে গেলেই ব্যস্ততা কমে যাবে। তারপর আমার সারাবেলা আমি তোমার নামে করে দেব কেমন?
— বিকেলও তাহলে তখনই পাবেন।
হাত সরিয়ে একটু সরে দাঁড়াল উপমা। রওনক বলল,
— চলো পৌঁছে দিই? একদিনও তো ওঠা হলো না তোমার হোন্ডায়৷
— আজ থাক। আপনার জন্য বরাদ্দকৃত বিকেলটাতেই প্রথম উঠব ওটাতে।
প্রস্থানের নিমিত্তে পা বাড়াতে নিলে চট করে ওর হাত টেনে ধরল রওনক। চুপচাপ একদৃষ্টিতে ক্ষণকতক তাকিয়ে থাকার পর আলতো করে চিবুক ছুঁয়ে বলল,
— সাবধানে যেও। মন খারাপ করো না। রাতে কথা হবে কেমন?
জবাবে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল উপমা। বলল,
— আপনিও সাবধানে থাকবেন।

মৃদু হেসে মাথা নেড়ে চিবুক থেকে হাত সরিয়ে নিলো রওনক। অল্প ঠোঁট প্রসারিত করে ওকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল উপমা।
প্রস্থানের পর রওনকের মনে হলো বহুদিন হলো মেয়েটাকে নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখা হয় না। আজ রাখা যেত কিন্তু ঐযে বৈধতা-অবৈধতার একটা বাঁধা। এ শহরে প্রকাশ্যে ভালোবাসা অপরাধ বৈ অন্যকিছু নয়। স্বীকৃত সম্পর্কগুলোতেই কত বাঁধার বেড়াজাল। সেখানে তাদেরটা তো…
তবে স্বীকৃত সম্পর্কে যাওয়ার পর পরাধীনতার শেকলে আটকে থাকবে না রওনক। বৈধ সম্পর্কে বাঁধা কিসের? স্থান, কাল-পাত্রের চিন্তা না করে মন চাইলেই প্রিয়তমাকে জড়িয়ে ধরা যায় এই স্বীকৃতিই তো দেয় বৈধতা।
সম্পর্কের চূড়ান্ত পরিণতিটাকে নিয়ে রওনকের অসীম আগ্রহ৷ নাহ্ আগ্রহের পরিসমাপ্তি ঘটানো অনিবার্য হয়ে উঠছে যে। প্রিয়ার আঁচলে সংসারের চাবি না দেখা পর্যন্ত তার শান্তি নেই।
____________

“ডক্টর শওকতের চেম্বার কি এটাই? আজ কি রোগী দেখবেন উনি?”
আপাদমস্তক বোরখা হিজাবে আবৃত নারীটির দিকে ভ্রু কুঁচকে বার দুয়েক তাকায় কম্পাউন্ডার আবদুল। মাথা নেড়ে বিরক্তিভরা গলায় বলে,
— সিরিয়াল দিয়া আসছেন? দেখি নাম বলেন খাতায় দেখি কয় নাম্বার সিরিয়াল।

সিরিয়ালের কথা শুনে একটু থতমত খেয়ে যায় বোরকার আড়ালে থাকা উর্বশী। সিরিয়াল তো দিয়ে আসা হয়নি। কাজের মাসির কাছে নাম আর চেম্বারের ঠিকানা শুনে সরাসরি এসে পড়েছে। এখানে আসতে হলে যে সিরিয়াল দিয়ে আসতে হয় তা তার জানা ছিল না।
আমতাআমতা করতে দেখে কম্পাউন্ডারই পুনরায় বলে ওঠে,
— তারমানে সিরিয়াল দিয়া আসেন নাই। দেখি পঞ্চাইশ ট্যাকা দেন সিরিয়াল করি দেই।
— ভ..ভাই সিরিয়াল করলে কতক্ষণ লাগবে?

জিজ্ঞেস করে উর্বশী। ওর পেছনে ওয়েটিং জোনে বসে থাকা রোগীদের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে কম্পাউন্ডার জবাব দেয়,
— মেলা রুগী তো। রাইত আটটা-নয়টা বাজবে।
— একটু আগে করা যায় না? আসলে আমার একটু তাড়া আছে তো।
ক্ষীণ অনুনয়ের সুরে বলে মেয়েটা। বিনিময়ে কড়াভাবে মাথা নাড়ে আবদুল।
— এইখানে সব রকমের নিয়ম ভঙ্গ বারণ। নিয়ম ভাঙলেই চাকরি নট। আপনার তাড়া থাকলে বাড়িত ফেরত যান ডাক্তার দেখাইতে হবে না।

কম্পাউন্ডারের কড়া কথায় খানিক দমে যায় উর্বশী। বোরকা চেপে ধরে অস্থিরচিত্তে চারিদিকে তাকায়। পেট আর মেরুদণ্ডে যে পরিমাণ ব্যথা উঠেছে। অপেক্ষা করা অসম্ভব তার পক্ষে। ওখানে দাঁড়িয়েই ভাবতে থাকে কীভাবে চেম্বারে প্রবেশ করা যায়। তন্মধ্যে একজন রোগী দেখা শেষে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেলের শব্দ ভেসে আসে। খাতা ফেলে দ্রুত পদে ওদিকে রওয়ানা হয় কম্পাউন্ডার। উর্বশীর মাথায়ও চট করে একটা বুদ্ধি খেলে যায়। কোনোকিছু না ভেবে কম্পাউন্ডারের পিছু পিছু চেম্বারে ঢুকতে নেয় সে। কিন্তু দরজার কাছাকাছি আসামাত্র তাকে দেখে ফেলে আবদুল। বাঁধা দিয়ে বলে,
— আরে আরে এভাবে তো ঢোকা যাবানায় এ্যাটে। আপনি তো হেভি ঘাউড়া মানুষ। তখন থেকি ঝামেলা করতেছেন।
— প্লিজ ভাই আমার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেন। খুব খারাপ অবস্থায় আছি।
— আপনার অবস্থা তো বুঝিয়া আমার লাভ নাই। আপনি আমার চাকরি খাবেন বুঝছি।

দুজনের তর্ক-বিতর্কের মধ্যে ভেতর থেকে গম্ভীর গলা ভেসে আসতে শোনা যায়,
— ব্যাপার কি আবদুল? কি হয়েছে ওনাকে ভেতরে আসতে দিচ্ছ না কেন?

ডাক্তারের কথায় দরজা থেকে হাত ছুটে যায় আবদুলের। সেই সুযোগ রীতিমতো ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ে উর্বশী। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
— ডাক্তার সাহেব প্লিজ আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করুন। সিরিয়াল দেওয়ার মতো পরিস্থিতিতে নেই আমি। এই দার্দ আর সহ্য হচ্ছে না আমার।

কথার মধ্যে পুনরায় আবদুল এসে বাঁধ সাধতে গেলে হাত উঁচিয়ে তাকে বারণ করে দেয় শওকত। চোখের ইশারায় চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে উর্বশীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
— আপনি বসুন চেয়ারটায় বসুন।

ডাক্তারের ইশারায় সুবোধের মতো বেরিয়ে গেলেও বোরকাবৃত মেয়েটাকে মনে মনে গালি দিতে ভোলে না আবদুল।

এদিকে ডাক্তার যে তার সমস্যাটা বুঝতে পেরেছে ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উর্বশী। নিকাব সরিয়ে হড়বড় করে সমস্যার কথা বলতে চায়। কিন্তু মাঝপথে তাকে থামিয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় শওকত। বলে,
— পানিটা খেয়ে ধীরেসুস্থে বলুন।

মাথা নেড়ে পানি খেয়ে একটু স্থির হলে শওকত নিজে থেকেই জানতে চায় সমস্যার কথা। কয়েকদিন যাবৎ যা যা ফেস করছে উর্বশী সবটাই একে একে খুলে বলে ডাক্তারকে৷ ভীষণ মনোযোগ দিয়ে তার সব কথা শোনে ডাক্তার শওকত। পালস চেক করার পর প্রেশার মাপতে গেলে তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে দেখা যায়। এক ফাঁকে সে প্রশ্ন করে উর্বশীর সাথে বাড়ির লোক কেউ এসেছে কি না। দীর্ঘশ্বাস চেপে উর্বশী মাথা নেড়ে জানায়, এই পৃথিবীতে তার আপন বলতে কেউ নেই। সে একা।
শুনে চিন্তার পাশাপাশি একটা সহানুভূতির ছাপ পরিলক্ষিত হয় শওকতের চেহারায়। সে কিছু টেস্ট লিখে দেয় উর্বশীকে।
মুখে শুনে আর সিম্পটমস মিলিয়ে তার যা মনে হচ্ছে মেয়েটার ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড টাইপ কিছু একটা হয়েছে। তবে রিপোর্ট না দেখে বলা যাচ্ছে না ফাইব্রয়েডটা ঠিক কোন পজিশনে আছে। কোনোভাবে তা ক্যান্সারের রূপ নিয়েছে কি না!
একটা মেয়ের জন্য এই রোগটা কতখানি জটিল ও ভয়াবহ ডাক্তার হিসেবে অজানা নয় শওকতের। এতবড় দুঃসংবাদ শোনার পর মেয়েটার প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই স্বাভাবিক হবে না। ভেবে ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে শওকত।

চলবে,
Sinin Tasnim Sara
★রিভাইজ ছাড়া পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here