চিঠি দিও
২৮
______________
আজ মিতালী এবং সাজুর বিয়ে। তিনদিন আগে থেকে বন্ধুরা সব এসে উঠেছে মিতালীদের বাড়িতে। খালাম্মার আদেশ, পাশে থেকে দায়িত্ব নিয়ে বান্ধবীকে পার করতে হবে। যদিও মিতালীকে এখনই তুলে নেয়ার ব্যাপারে কিছু ভাবেনি দুই পরিবার। আপাতত আকদ করে রাখা হবে। পড়াশোনা শেষ হলে মায়ের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে পদার্পণ করবে। তবে উপমার মনে হচ্ছে অতদিন অপেক্ষা করবে না বাঁদর দুটো। চোখে হারায় যে একজন আরেকজনকে। দূরে থাকতে পারবে না বলে লাজ-ভয় দূর করে পরিবারকে জানিয়েছিল। ওদের দুজনের কথা ভাবলে মাঝেমধ্যে ভীষণ অবাক হয় উপমা। কতখানি সৌভাগ্যের অধিকারী তার বন্ধু-বান্ধব দুটো, ভালোবাসাকে আপন করে পাওয়ার আশীর্বাদ আছে তাদের ওপর। এমন সৌভাগ্য সবার হোক।
গতকাল স্বল্প পরিসরে হলুদের আয়োজন করা হয়েছিল। পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে হলুদ শাড়ি আর ফুলের গহনায় লাজুক, হাস্যোজ্জ্বল মিতালীর জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে লজ্জায়-আনন্দে শিহরিত হয়েছে উপমা বার-বার। একদিন সেও সাজবে এমন ফুলেল গহনায় হলুদ সাজে রওনকের বধূ বেশে। তার প্রনয়েরও নিশ্চয়ই পরিণতি হবে। হতেই হবে। ভালোবাসায় কোনো খুঁত নেই তাদের।
স্বপ্নীল চোখজোড়া মেলে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবিতে চোখ বোলায় উপমা। সাজলে ওকে সুন্দর লাগে। এই যে জামার সাথে মিলিয়ে খয়েরী রঙের লিপস্টিক লাগিয়েছে, চোখ ভর্তি কাজল, ছোট্ট কপালে ছোট্ট একটা টিপ। প্রসাধনীর ছোঁয়ায় মেদুর গালদুটোতে পিচ ফলের মতো ঈষৎ গোলাপি আভা, আভা চিবুকেও। রওনক দেখলে তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে যেত। আলতো হাতে প্রতিচ্ছবিটার চিবুক ছুঁয়ে মুচকি হাসল উপমা। ও জানে মানুষটা ওর চিবুক বড্ড পছন্দ করে। সামনে থাকলে নিশ্চিত ছুঁয়ে দেখত। উষ্ণ ছোঁয়া দেয়ার সম্ভবনাও ছিল।
রওনকের কথা মনে পড়লে বিষণ্ণ লাগে উপমার। এত করে বলার পরও মানুষটা এলো না। জোর করলে বলেছিল,
“আমি তো তাঁদের আত্মীয় নই;আত্মীয় নই তোমারও। কি বলে পরিচয় করাবে?”
তখনই উপমার মনে পড়েছিল নির্বুদ্ধিতার কাজ করে ফেলেছে সে। বয়সের একটা পার্থক্য আছে না? দাওয়াত ছাড়া কীভাবে আসবে মানুষটা। পরে অবশ্য ভেবেছিল মিতালীর দ্বারা বলাবে। কিন্তু তাকে আর পাওয়াই গেল না। সে রাতের পর আবারও ডুব দিয়েছে। ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিসন্ধ্যা বাড়ির কথা বলে মিতালীদের ল্যান্ডফোন থেকে রওনকের নম্বর ডায়াল করে দেখেছে উপমা। কল বেঁজে বেঁজে কেটে যায়, কোনো সাঁড়া নেই। মিজান ভাই যদিও একবার রিসিভ করলেন, তেমন কিছু বলতে পারলেন না। ছোট্ট বাক্যে শুধু এতটুকু বললেন, রওনক আউট অফ টাউন।
ছোট্ট করে হতাশামূলক শ্বাস ছাড়ল উপমা। মানুষটার নাম রওনক না হয়ে অনিকেত হওয়া উচিৎ ছিল। অনিকেত অর্থ হলো গৃহত্যাগী। সেও তো গৃহত্যাগী একটা মানুষ। কাজের সাথে মিলিয়ে নাম রাখতে হতো।
কমিটি নির্বাচন হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। যার যা পদ প্রত্যাশিত ছিল পেয়ে গেছে। নির্বাচনের দিন রওনক উপস্থিত ছিল না। জরুরি কাজের কথা বলে বেরিয়েছে। সত্যিকার অর্থেই সে আউট অফ টাউন। গুরুত্বপূর্ণ সময়টাতে যদিও তার উপস্থিতি অনিবার্য ছিল, তবুও কথা ওঠেনি কারণ ওর ওপর এখন অতনুর ছায়া আছে। কীভাবে যেন ওর অনুপস্থিতির বিষয়টাকে অতনু ম্যানেজ করে ফেলেছে। অতনু এবং রওনকের হুট করে মিলে যাওয়া যদিও অনেকের চোখে কাঁটার মতো বিঁধে যাচ্ছে তবে কেউ রা করার সাহস পাচ্ছে না। আড়ালে সমালোচক ঠিক তৈরি হয়েছে। কিন্তু সমালোচনা কে গায়ে মাখে? আপাতত সাধারণ সম্পাদক হওয়ার খুশি উদযাপনে সব ব্যস্ত। রওনকের প্রাপ্তিতে ওর চাইতে দলের ছেলেপেলেরা বেশি খুশি। দুটো দিন সময় নেই অসময় নেই বিজয় মিছিল পথে নামিয়েছে, হয়েছে প্রীতিভোজের আয়োজন। প্রিয় বড়ভাইয়ের পদপ্রাপ্তিতে তাদেরই যেন সম্মান হাজার গুণ বেড়ে গেছে। লোকজন তাদের সমঝে চলছে। ছেলেরাও বাড়তি বিনয়ে বিগলিত।
এতকিছুর মধ্যে খুশি হয়েও খুশি হতে পারছে না একজন, মিজান৷ তার বন্ধুটি যে উদ্দেশ্যে শহর ছেড়েছে এবং যেদিন শহর ছেড়েছে সেদিন ভয়ানক কতগুলো কাজকারবার করে গেছে;দিয়ে গেছে বিশাল কতগুলো দায়িত্ব।
সর্বপ্রথম বকুলের বাবার দ্বিতীয় পরিবার সম্পর্কে সকল খোঁজখবর নেয়ার দায়িত্ব পড়েছে মিজানের ওপর এবং বকুলকে সব জানানোরও দায়িত্ব তার ওপরেই ন্যাস্ত করেছে।
দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে ভয়ানক যে কাজটা করেছে তা হলো, ক্ষু’ধার্ত বাঘের সামনে থেকে শিকারকে ছিনিয়ে নেয়ার মতো দুঃসাহস দেখিয়ে ফেলেছে। হ্যাঁ কাউনিয়ায় মিন্টুর বোনের ঐ দুরবস্থা দেখার পর সইতে পারেনি রওনক। আত্মদহনে দ”গ্ধ হয়ে বহুদিন পর ন্যায়ের পক্ষে কথা বলেছে। দলের মানুষকে নাখোশ করে খেয়ালি কাজ করে ফেলেছে একটা। আনিসের সাথে মিটিং শেষে আনিসের সামনে দিয়ে মিন্টুর বোনকে তুলে নিয়ে এসেছে সে। বজ্র নিনাদে বিরোধ করে বলেছে, এই মেয়ে তার দায়িত্ব। তার হাত যেখানে আছে অন্য কারোর অধিকার নেই সেখানে আঁচড় কাটার।
আনিস শেখ ঠান্ডা মাথার মানুষ। সেই মুহুর্তে হয়তো এতবড় দুঃসাহসিক কাজটার প্রতিদান দেয়নি, তবে সময় হলে দেবে। এর ফল যে বিশেষ ভালো হওয়ার নয় রওনক নিজেও জানে। কিন্তু চোখের সামনে অত ছোট একটা মেয়ের জীবন ধ্বংস হতে দেখা ওর চেতনাকে নাড়া দিয়ে গেছে। মেয়েটাকে একলা রেখে যাওয়ার সাহস কিংবা ইচ্ছে কোনোটাই অনুভব করেনি। নিজের ওপর ধিক্কার এসেছে এই প্রথমবার৷
মিজান উপলব্ধি করতে পারে ওর বন্ধুটি সময়ের সাথে একটু একটু করে পাল্টে যাচ্ছে। নৃশংস রওনকের অলিন্দের ভেতরটা আগে ছিল রিক্ত শুষ্ক মরুভূমির মতো। সেই মরুভূমিকে মায়া-মমতা-ভালোবাসা দিয়ে পুনর্জীবন দান করেছে একটি মেয়ে। রুক্ষ-শুষ্ক মরুভূমিটি ক্রমশ রূপ পাল্টে হয়ে উঠছে অমরাবতী উদ্যানের মতো স্নিগ্ধ, কোমল। ইতিবাচক পরিবর্তন ভালো, তবে যে ক্ষেত্রটাতে তারা আছে এখানে পরিবর্তনটা ঠিক কতটা কার্যকরী,কতটুকু সুফল বয়ে আনবে;আদৌ আনবে কি না সন্দেহ।
ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়েটার নামখানাও ফুলের নামের সাথে মিলিয়ে রাখা,”বেলি” বাগানের সবচেয়ে সুগন্ধি ফুল।
অদৃষ্টের কি পরিহাস! জটিল সমীকরণের মারপ্যাঁচে পড়ে সুগন্ধি ফুলটা আজ পায়ের নীচে পিষে দলামোচড়া হয়ে নষ্ট হওয়ার পথে। রওনক জানে না ধ্বংসের কতখানি কাছে থেকে মেয়েটাকে সে ফিরিয়ে আনতে পেরেছে, তবে এর রেশ মেয়েটার মস্তিষ্কে গেঁথে থাকবে অনেক-অনেকটা কাল৷ দুঃসহ স্মৃতিটা হয়তো দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করবে ওকে, কখনও ভীত-আতঙ্কিত করে তুলবে। যদি এই ভয়টাকে আতঙ্কটাকে কঠোর হাতে দমন করতে পারে তবেই ও জীবনের বাজিতে জিতে যাবে।
রওনকের কাছে জীবনটা ঠিক ঘোড়ার রেসের মতো। এখানে প্রতিযোগি আছে, প্রতিযোগিতা আছে, ভয়-ভীতি, উদ্বেগ-আতঙ্ক, রোমাঞ্চ সব আছে। তেজীয়ান ঘোড়ার মতো সবকিছুকে পেছনে ফেলে যে এগিয়ে যেতে পারে জয়ের হাসি দিনশেষে তার ঝুলিতে জমা হয়ে যায়।
রওনক জানে না বেলি কতখানি শক্ত মনের মেয়ে তবে ওকে এমন এক জায়গায় রেখে এসেছে যেখানে পরিবেশ-পরিস্থিতি ওকে লড়তে শেখাবে। একটি ভালো ভবিষ্যৎ পাইয়ে দিতে সাহায্য করবে। যে ভবিষ্যতে তার কিংবা আনিস শেখের মতো নোংরা লোকেদের কালো ছায়ার লেশমাত্র থাকবে না। কেউ পৌঁছতে পারবে না ও অবধি। সেই ব্যবস্থাই করে এসেছে রওনক। এক্ষেত্রে ও নির্দ্বিধায় সাহায্য নিয়েছে ডাক্তার শওকতের। শওকতের শরীরে নিজাম চৌধুরীর রক্ত বইলেও ওই ছেলে যে বাপের স্বভাব বিপরীত তা রওনক প্রথম দেখায়ই উপলব্ধি করতে পেরেছিল। শওকতের সাথে ওর প্রথম পরিচয় হয়েছিল অনেকটা নাটকীয়ভাবে।
নির্বাচনের আগের ব্যস্ত সময়টায় এক সন্ধ্যেবেলা কোত্থেকে ফিরছিল ও। সাথে ছিল দলেরই এক ছেলে। চেকপোস্টের কাছে বিশ্বরোড থেকে যখন মাত্র নেমেছে তখনই কোত্থেকে এক দ্রুতগামী ট্রাকের অকস্মাৎ ধাক্কা। ব্যালেন্স হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল দুজন পথে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন রওনকের কাটাছেঁড়া ব্যতিরেকে ভয়াবহ কোনো ক্ষতি না হলেও ওর পেছনের যে ছেলেটা, ও খুব বাজেভাবে আহত হয়েছিল। বিশ্বরোডে ছিটকে পড়েছিল ছেলেটা। মালবাহী ট্রাক রীতিমতো ওর পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়। হাঁটুর নীচ থেকে পা কে”টে ফেলার মতো ভয়াবহ অবস্থা। লোক ধরাধরি করে হাসপাতালে নিলেও সংখ্যায় কম হওয়ায় ডাক্তারের খোঁজ পাওয়া দায় হয়ে পড়ছিল। ব্যথায় অচেতন ছেলেটাকে নিয়ে বড্ড বিপাকে পড়ে গিয়েছিল রওনক। চিৎ’কার চেঁ’চামেচি করলেও একজন ডাক্তার মিলছিল না যে চিকিৎসা করতে পারবে। শওকতের আবার সেদিন জয়েনিং ডে। সিনিয়র ডাক্তাররাসহ রাউন্ডে বেরিয়েছিল সে। রওনকের হুমকি-ধমকির দরুন কোনো নার্স হয়তোবা খোঁজ দিয়েছিল ওয়ার্ডে। বিলম্ব না করে তৎক্ষনাৎ ছুটে এসেছিল শওকত। দায়িত্বে যতটা, সব করেই ছেলেটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। এমনকি অপারেশনের সুব্যবস্থা না থাকায় হেলিকপ্টারযোগে ওকে ঢাকায় পাঠানোরও ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
এই ঘটনার পরেই শওকতের সাথে একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় রওনকের।
বেলি নামক মেয়েটার ব্যাপারেও সর্বপ্রথম যে নামটা মাথায় এসেছে তা হলো শওকত। কেন যেন মনে হয়েছিল শওকতই একমাত্র যে এ ব্যাপারে উত্তম কোনো পরামর্শ দিতে পারবে। দিয়েছেও।
বেলিকে একটি আবাসিক স্কুল রেকমেন্ড করেছে। সেনাবাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত স্কুল। দু’দিন থেকে খোঁজখবর নিয়ে ভালই মনে হয়েছে রওনকের। ভাগ্যিস বছরের শেষ সময়। ভর্তি শুরু হয়েছে স্কুলগুলোয়। শওকতের একজন কলিগ ভর্তির ব্যাপারে খুব সাহায্য করলেন এ ক’দিন। থাকা-খাওয়া তাঁদের বাসা থেকেই হয়েছে। ভর্তি শেষে বেলিকে হোস্টেলে তুলে দিয়ে তবেই নির্ভার হয়েছে রওনক।
আজ থেকে তার দায়িত্বের পরিমাণ আরেকটু বেড়ে গেল। আইনি প্রক্রিয়ায় অনাথ এই মেয়েটার অভিভাবকত্ব নিজের নামে করিয়ে নেবার পরিকল্পনা করছে সে। যদিও বেলির এতে সায় নেই। অভিভাবক কি, রওনকের ছায়াও নিজের পাশে সহ্য করতে পারে না মেয়েটা। রওনক ওর দৃষ্টিজুড়ে নিজের জন্য ঘৃ”ণা ছাড়া অন্যকিছু দেখেনি। দেখার কথাও নয়। বয়সে মেয়েটা ছোট, কিন্তু এতটাও ছোট নয় জীবনের এই বিপর্যয়ের পেছনে কার হাত জানে না, বোঝে না। ও সব জানে এবং সব বোঝে। হয়তো সকাল-সন্ধ্যা রওনকের নাম মনে পড়লে দীর্ঘশ্বাসের সাথে অভিশাপ বেরিয়ে আসে।
এসবে কিছু যায় আসে না রওনকের। সত্যকে সত্য বলে মেনে নিতে কার্পণ্য নেই। বেলির মনে যত ঘৃ”ণাই থাকুক না কেন, চেতনাটুকু ওকে যা যা নির্দেশ করবে নিঃস্বার্থভাবে তা তা করে যাবে রওনক। এ ওর সংকল্প।
___________
আনিস শেখ নিজেকে রওনকের গড ফাদার বলে অভিমান করতে পছন্দ করে। যখন যে মুহুর্তে লোকটার প্রয়োজন অনুভব করেছে রওনক, জাদুবলে লোকটা গিয়ে উপস্থিত হয়েছে ওর সামনে। শুরু থেকেই রওনককে ভীষণ পছন্দ করে এসেছে আনিস। সৃষ্টিছাড়া ছেলেটার মধ্যে কি যেন একটা ব্যাপার আছে। ওর ন’ডরাই স্বভাবটা মূলত আকর্ষিত করেছে আনিসকে। নিজের পরিবারের সদস্যগুলোর মধ্যে এই বিশেষ গুণটির অনুপস্থিতির কারণে বাইরে যোগ্যতার সন্ধান করতে হয়েছে। নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে আনিস শেখের মধ্যে।
মরা পোকার মতো বিকারহীন একটা ছেলে আর নারীত্বে ঠাঁসা একটা মেয়ে। রূপবতী কিন্তু বোকাসোকা। আনিস পরবর্তী সংসার এবং ব্যবসার হাল ধরবার জন্য উপযুক্ত ওরা কেউই নয়। ওদের ঔদাসিন্য আচরণগুলোই অপারগতার স্বীকারোক্তি। নিজের বিশাল সাম্রাজ্যটা সামলানোর জন্য শক্ত সামর্থ্য সুপুরুষের খোঁজ বহুদিন যাবৎ করে আসছে আনিস শেখ। সৃষ্টিকর্তার বিশেষ দৃষ্টি ছিল বলা যায়, খুঁজে পেতে বিশেষ দেরি হয়নি। সর্বদিক দিয়ে রওনকের চাইতে অধিক যোগ্য তল্লাটে কাউকে খুঁজে পায়নি আনিস। বিজনেসে যুক্ত করা এবং শুরুতেই কঠিন কর্মভার রওনকের জন্য একটা পরীক্ষার মতো ছিল। আনিসকে সন্তুষ্ট করে সে লেটার নম্বর পেয়ে পরীক্ষায় পাশ করেছে। এরপরেই পরিকল্পনা করে ফেলে আনিস, পাণিপ্রার্থী তার একমাত্র কন্যা অহনার সাথে যত দ্রুত সম্ভব রওনককে পাণিবদ্ধ করে ফেলবে। সহায়-সম্পদের অভাব তো তার নেই। এছাড়া আনিস শেখের জামাতা হলে রাজনীতির ক্ষেত্রটাতে বিশেষ সুবিধা রওনক পাবে,অবশ্যই পাবে। সবদিক বিবেচনায় বিয়ের প্রস্তাবটা রওনকের কাছে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো বলেই ধারণা আনিস শেখের।
আনিস ভেবেছিল রওনক সাধারণ সম্পাদক হয়ে গেলে অহনার সাথে ওর এঙ্গেজমেন্টটা করে রাখবে। ব্যবসার অবস্থা এখন রমরমা। রওনকের তত্ত্বাবধানে ফুলেফেঁপে বিশাল আকার ধারণা করছে অল্পদিনে। দায়িত্বের বোঝা কিছুটা ওর কাঁধে স্থানান্তর করে একটু নির্ভার হওয়ার বাসনা আনিস শেখের।
কিন্তু সাজানো গোছানো সকল ইচ্ছে, পরিকল্পনাকে মাটি করে হঠাৎ এ কোন রূপ দেখালো তাকে রওনক?
কাউনিয়ার সেই সন্ধ্যেটা বেশ ভাবাচ্ছে আনিস শেখকে। সেদিনের রওনক যেন একটু বদলে যাওয়া, একটু অন্যরকম। অল্পেই হাতের মুঠো খুলে বেরিয়ে যাওয়ার মতো পরাক্রমশালী। ওর হিং”স্র দু’চোখে কিসের একটা প্রলেপ পড়েছে। হিং”স্রতা কমে গেছে। দৃষ্টির ভাষা ভিন্ন। এতদিন পর অকস্মাৎ এই ভিন্নতার কারণ কি? খুঁজে বের করা অনিবার্য।
ইজি চেয়ারে পেটের ওপর দুহাত জড়ো করে মূর্তিমান বসে এসব চিন্তা করছে আনিস শেখ। চিন্তার একপর্যায়ে হাত উঁচিয়ে বাইরে দাঁড়ানো অনুচর একজনকে ডেকে পাঠালো গম্ভীর কণ্ঠে। উপস্থিত হলে নীচু গলায় আদেশ করল,
“রওনকের প্রত্যেক মিনিটের হিসাব আমার চাই কই যাইতেছে, কি করতেছে, কার লগে মিশতেছে সবকিছু;সবকিছুর খোঁজ আমারে আইনা দিবি। তবে অয় জানি টের না পায়। মনে থাকবে?”
আদেশের বিপরীতে বিনিত ভঙ্গিতে মাথা দোলালে পুনরায় হাত নেড়ে অনুচরকে সরে যাওয়ার ইশারা করল আনিস শেখ।
আনিসের একটা নীতি আছে। কঠিন থেকে কঠিন শত্রুকেও সে তিনটে করে সুযোগ দেয়। তিন সুযোগের মধ্যে শত্রু তার আনুগত্য স্বীকার করলে বেঁচে গেল, আর না করলে…
রওনক সেখানে তার দলের, বন্ধুরূপ। না জেনে হয়তো একটা কাজ করে ফেলেছে। এত ছোটো অপরাধকে আপাতত গোনায় ধরবে না আনিস। তবে এর পর থেকে ওর জন্যেও তিনটে সুযোগ বরাদ্দ থাকবে। সময়ের আগে ফিরে এলে ভালো। নয়তো ওরও সেই অবস্থাই করা হবে যা আনুগত্য স্বীকার না করা শত্রুগুলোর করা হয়। একটি নৃ’শং’স মৃ””ত্যু।
কয়েকদিন যাবৎ শরীরটা ভালো যাচ্ছে না রঞ্জু সাহেবের। অল্প পরিশ্রমেই কেমন দুর্বল হয়ে পড়ছেন। হাঁপানির টানটাও বেড়েছে।
সারাটা জীবন নিয়মতান্ত্রীক জীবন-যাপনের অভ্যেস তাঁর। স্ত্রী বিয়োগের পরও নিয়মের কোনো এদিক-সেদিক হয়নি। পরিবারের লোকগুলোর বিশেষ নজর ছিল এসবের ওপর। এখনও আছে। তবে মাঝখান থেকে তিনি পাল্টে গেছেন। বয়সের ভার পাল্টে দিচ্ছে তাঁকে। রুটিন অনুযায়ী আজ কলেজে ক্লাস আছে দুটো। বেলা করেই ক্লাস। তবুও যেতে ইচ্ছে করছে না। অগ্রহায়ণ যাবে যাবে করছে। প্রকৃতিতে শীতের আমেজ পড়ে গেছে ইতোমধ্যে। না শীত না গরম এই আবহাওয়াটা শরীর খারাপের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন রঞ্জু সাহেব। নাহ্, গরম পানির অভ্যেস করে নিতে হবে বলে মনে হচ্ছে। বউমাকে বলতে হয়। গা থেকে কাঁথা সরিয়ে পাশ ফিরে শুতেই দরজায় টোকা পড়ল দু’টো। ধীরেসুস্থে উঠে বসে চশমা চোখে গলিয়ে তাকাতেই চৌকাঠের কাছে অতনুকে দাঁড়ানো দেখলেন রঞ্জু সাহেব। হাতে ইশারা করে বললেন,
— এসো ভেতরে এসো। কি ব্যাপার?
— ইয়ে বড়বাবা ভালো আছেন?
ইতস্ততভাবে হেসে প্রশ্ন করল অতনু। এক ছাদের নীচে থেকেও সচরাচর বড়বাবার মুখোমুখি হয় না সে। তার সাথে বড়বাবার দূরত্ব ছোটোবেলা থেকেই। অতিরিক্ত নীতিবোধে তার অ্যালার্জি। বিষয়টা অজানা নয় বড় বাবারও। তাই অন্য ভাই-বোনদের নিয়ন্ত্রণে রাখলেও অতনুর বেলায় তেমন প্রচেষ্টা তিনি করেননি। বিষয়টা একদিকে স্বস্তির।
— আছি ভালোই আছি। তো তুমি হঠাৎ? কোনো জরুরি বিষয় নাকি!
শ্লেষের সাথেই কথাটা বললেন রঞ্জু সাহেব। গায়ে মাখল না অতনু। মন-মেজাজ সর্বোচ্চ রকমের ঠান্ডা রেখে কৃত্রিম বিনয় জমিয়ে তবেই সে এই দুয়ারে পা রেখেছে। এত সহজে ধৈর্যচ্যুতি হওয়ার নয়।
দু পা এগিয়ে গিয়ে বিস্তর হাসি হেসে মাথা নাড়ল সে। বলল,
— তেমন জরুরি নয়। তবে একটা আর্জি নিয়ে এসেছি বড় বাবা।
— আর্জি! কিসের আর্জি?
চশমা খুলে টেবিলে রাখতে রাখতে শুধলেন রঞ্জু সাহেব।
বিনিময়ে উত্তরটা দেবেই অতনু তার পূর্বে মাঝারি সাইজের বোল ভরে ধোঁয়া ওঠা গরম পানি নিয়ে উপস্থিত আসমা। বড় একটা সালাম দিয়ে সহাস্যে পানির পাত্র হাতে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে সে বলল,
— কথাবার্তা সব পরে হবে। আগে বড়বাবাকে একটু ভাপ নিতে দাও তো। দু’দিন থেকে দেখছি ওনার হাঁপানির টানটা বেড়েছে। আম্মাকে জানাতেই বললেন জলদি করে গরম পানি করে দিতে। ভাপ নিলে উপকার হবে। বড়বাবা একটু আসুন তো ইজি চেয়ারটা বসুন। পানি, টাওয়াল সব নিয়ে এসেছি আমি।
— আহহা খামোখা তুমি কষ্ট করতে গেলে কেন বউমা? ঔষধেই কাজ হয়ে যেত।
— কিচ্ছু কষ্ট নয়। ঔষধের পাশাপাশি এটা নিলে দ্রুত সুস্থ হবেন। আসুন তো।
পানির পাত্র একদিকে নামিয়ে রেখে চেয়ার-টেবিল সেট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল আসমা। তা দেখে মৃদু হেসে বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে অতনুর উদ্দেশ্যে রঞ্জু সাহেব বললেন,
— আর্জিটা বলে ফেলো অতনু। আমি শুনছি।
জরুরি কথার মধ্যে হুট করে আসমার আগমন খানিক বিরক্তির উদ্রেক সৃষ্টি করেছিল অতনুর মধ্যে। তথাপি বাইরে তা প্রকাশ করল না। পূর্বের ন্যায় বিনীত ভঙ্গিতে বলল,
— আপনি বোধহয় জানেন আমাদের সংগঠনে সদ্য কমিটি নির্বাচন হয়ে গেল। এবং বিপুল ভোটে জয়লাভ করে আমি সভাপতির আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছি।
— শুনেছি। তোমাকে অভিনন্দন সে জন্য।
— ধন্যবাদ বড়বাবা।
হাত পিছুমুড়ে ক্ষীণ হাসলো অতনু। বলল,
— প্রাপ্তির পর তো ছেলেপেলেরা ছাড়ছে না। তাদের আবদারের বিষয়টা মাথায় রেখে ছোট্ট আয়োজনে একটু খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে চাচ্ছি বাড়িতে।
— করবে। আমার পারমিশন নিতে হবে কেন? এর পূর্বেও এমন অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছ তুমি বাড়িতে। নিষেধাজ্ঞা তো নেই আমার।
— জ্বী নেই। তবে এবারের অনুষ্ঠানটায় আপনার উপস্থিতি কাম্য বড়বাবা। আসলে এমপি নিজাম চৌধুরী এবার শহরে আছেন। আমরা যেহেতু তারই আন্ডারে কাজ করছি তাই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে তাকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। আপনি যদি থাকতেন..
কথা সম্পূর্ণ করল না অতনু। ওর বিপরীতে কিছু বলবেন রঞ্জু সাহেব তন্মধ্যে হুট করে গরম পানির বোল টেবিলে রাখতে গিয়ে অসাবধানতাবশত পুরো বোল উল্টে গরম পানি সব নিজের দু পায়ে ফেলে দিলো আসমা। সাথে সাথে ব্যথায় মুখ কুঁচকে গেল ওর। পা চেপে ধরে নীচে বসতে বসতে অজান্তে মৃদু চিৎকার বেরিয়ে এলো গলা ছেড়ে।
তা দেখে নিজের জায়গা থেকে তৎক্ষণাৎ ছুটে এসে ওর বাহু ধরলো অতনু। এবং রঞ্জু সাহেবও ব্যতিব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এসে ওকে বিছানায় বসানোর নির্দেশ দিলেন৷
আসমার ত্বক ভীষণ ভীষণ সেনসিটিভ। পানি ফুটন্ত গরম না হলেও যে তাপ সেটুকুই ওর শরীরের পক্ষে অসহনশীল। পরিমাণে বেশি হওয়ায় নিমেষে সাদা ধবধবে পা আঁচে লাল টুকটুকে হয়ে গেল। অসহনীয় যার দহন।
না চাইতেও দু-চোখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি নামতে লাগল আসমার। গা কাঁপতে লাগল থরথর করে। কম্পমান ওকে একহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে একাধারে ধমক লাগাচ্ছে অতনু। অন্যদিকে রঞ্জু সাহেব ব্যতিব্যস্ত ছুটে ডাক্তারের নম্বর ডায়াল করেছেন। আসমার খেয়াল কিন্তু এসবের কোনোদিকে নেই। লেশমাত্র পায়ের ব্যথা অনুভব করতে পারছে না সে। তার দুচোখের অথৈ জল এবং ভয়ে কম্পিত হওয়ার মূল কারণ ব্যথা নয় বরং “নিজাম চৌধুরী” এই নামটা।
সকলের অলক্ষ্যে অস্থিতিশীল ওর মস্তিষ্কে এই মুহুর্তে পুরনো এক স্মৃতির আনাগোনা শুরু হয়েছে। যা ও জ্ঞানত কিংবা দুঃস্বপ্নে কভু স্মরণ করতে চায় না। ও স্মরণ করতে চায় না জীবন পাল্টে দেয়া ঝড়-বাদলার ঐ বিকেলটাকে; যে বিকেলে প্রকৃতির তাণ্ডবলীলার সাথে সাথে ওর হাসিখুশী জীবনে নেমে এসেছিল এক মহাপ্রলয়। প্রলয়ে ভেসে যাওয়ার পরের অভিশপ্ত একটা রাত; বদ্ধ প্রকোষ্ঠের তমসা ফুঁড়ে নিরীহ একটা মেয়ের আর্তচিৎকার, সম্ভ্রম রক্ষার সর্বান্তকরণ চেষ্টা এবং দুটো নরপশুর পশুত্বের কাছে চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার দুঃসহ স্মৃতিটাকে ও কিছুতেই মনে করতে চায় না৷ কিছুতেই না।
স্মৃতির ঝাপটা প্রবল হলে ভয়ে আতঙ্কে জমে গিয়ে ঠিক সেদিনের মতো করে বাঁচার অভিপ্রায়ে গলা ফাটানো আর্তচিৎকারযোগে হাতের মুঠোয় শক্ত করে অতনুর শার্ট চেপে ধরে আসমা বিড়বিড় করে উঠল,
“ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে ভীষণ। প্লিজ বাঁচাও আমাকে, প্লিজ”
বহুকষ্টে এই একটা লাইন উচ্চারণ করতে না করতেই চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখতে লাগল মেয়েটা। তথাপি অস্পষ্টভাবে একবার ঠোঁট নাড়িয়ে অকস্মাৎ ঢলে পড়ল অতনুর গায়ে।
একরাশ দুশ্চিন্তা এবং আতঙ্কগ্রস্ত হতবুদ্ধি অতনু সহসা দু’হাতে জড়িয়ে নিলো অর্ধাঙ্গীকে নিজের বুকে। বিচ্ছিন্ন কিছু স্মৃতি ওর মানসপটকেও নাড়া দিয়ে গেল পলকাভাবে। কেন যেন মনে হলো একইরকম দৃশ্য এর আগেও ঘটেছে ওর সামনে, ভয়মিশ্রিত একই লাইন পূর্বেও একবার শুনেছিল ও অবচেতন কিংবা অর্ধচেতনে। কিন্তু কার কাছে? কোথায়ই বা দেখেছিল সে এমন দৃশ্য?
মস্তিষ্কে জোর প্রয়োগ করলেও তড়িৎ কিছু স্মরণে এলো না অতনুর। বৃথা চেষ্টা বাদ দিয়ে আসমাকে কোলে তুলে নিয়ে সে ছুটল জিপের কাছে। অতিসত্বর মেয়েটাকে হাসপাতালে নিতে হবে। এতটুকু সময়ের মধ্যে কি থেকে কি হয়ে গেল কিছুই যে বুঝতে পারছে না অতনু।
চলবে,
Sinin Tasnim Sara
★unedited