চিঠি দিও ৩১(২)

চিঠি দিও
৩১(২)
_____________

ওপর মহলের নির্দেশ খাবারে বাঙালিয়ানা রাখা চাই। ভোজন রসিক বাঙালি নামে-গুনে যতবড় সম্মানের চাদর গায়ে জড়াক না কেন দিন শেষে এক থালা ভাত ছাড়া পেট পূজোটা ঠিক সম্পূর্ণ হয় না। খালি খালি লাগে। এছাড়া পলিটিক্যাল ব্যক্তিবর্গের খাদ্যাভাসেও বোধহয় রাজনৈতিক কুটিলতা থাকা অনিবার্য। কথাটা খানিক হাস্যকর শোনালেও মিথ্যে নয়। বীর বাঙালি অ’স্ত্র ধরেছিল দেশ স্বাধীন করবার জন্য। স্বাধীন দেশের বাঙালিদের তো মাছে-ভাতে বাঙালি বলে চেনে লোকে। তাই রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের আতিথেয়তায় বাঙালিয়ানার ছোঁয়া থাকাটা অনেকটা নিয়মের কাতারে পড়ে। আজ মেইন কোর্সে পোলাও, সাদাভাত, পাতলা ঝোলের মাংসসহ পরিচিত আইটেমের পাশাপাশি ডেজার্টেও ট্রেডিশনাল খাবারের সব আইটেম রেখেছে আসমা। শীতকালে খাদ্যপদের বৈচিত্র্য নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তা করতে হয় না। শীতের সিজন পিঠেপুলি, পায়েসের সিজন। পৌষ সংক্রান্তির পর থেকে আতপ কিংবা বিন্নি চালের পিঠে-পায়েসের ঘ্রাণে ম-ম করে প্রায় বাড়িগুলোর হেঁশেল।
আজ রাঁধুনি যাকে ডাকা হয়েছে তিনি এসব রান্নাবান্নায় সিদ্ধহস্ত। একটুখানি খাবার মুখে তুলেই বুঝতে পেরেছে আসমা।

ডাইনিং টেবিলের ওপর সুসজ্জিত সিরামিকের বাটিতে এইমাত্র ধোঁয়াওঠা পায়েস নামিয়ে রাখা হলো। ঘন দুধ আর সেদ্ধ চালের সাথে দারুচিনি, এলাচ এবং তেজপাতার অবর্ণনীয় ঘ্রাণ মিলি মিশে একাকার হয়ে পুরো চত্বর মাতিয়ে তুলেছে।
বাটি ভরা পায়েসগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আসমা ভাবছে এত চমৎকার স্বাদের একটা খাবার। বেশি নয় মাত্র এক ভায়াল স্ট্রিকনিন ওতে মিশিয়ে দিলে স্বাদের কোনো পরিবর্তন হবে না; না খাবারের রঙে কোনো তারতম্য দেখা দেবে। শুধু, যে খাবে পৃথিবীতে এইটেই তার শেষ খাবার ধরে নিতে হবে। কারণ এর পর তো…
স্ট্রিকনিন আসলে তেমন কষ্টদায়ক কোনো গরল নয়। আহামরি কিছুই হবে না, বড়জোর দম বন্ধ মনে হবে আর পেশীয় সংকোচন তীব্র হবে। সর্বোচ্চ আধঘন্টা, এরপরেই ব্যক্তি চিরকালের তরে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমাবে। এই সংসারে অনুপ্রবেশ ঘটেছিল আসমার গরল হাতে। পরিকল্পনানুযায়ী এতদিনে ওর কার্যসিদ্ধি হয়ে যাওয়ার কথা। তবে কোনো এক কারণবশত পরিকল্পনা অনুযায়ী ও এগোতে পারেনি। আজ অবধি একটা স্ট্রিকনিনের শিশিরও সিল খোলা হয়নি। বহুবার ওগুলো ব্যবহারের সুযোগ এসেছে, কিন্তু সুযোগটাকে আসমা কাজে লাগায়নি। তবে কি ওর এই সংসারের লোকগুলোর প্রতি কোনোরূপ মায়া জন্মে গেছে?

— কি শরীর খারাপ লাগছে? এত ঘেমে গেছ কেন?
গলায় ঠান্ডা হাতের স্পর্শে ঈষৎ কেঁপে উঠে ভাবনা সকলে ইস্তফা টানল আসমা। মাথা নেড়ে হাসার চেষ্টা করে বলল,
— কই?
— এই যে গলায়, কপালে, নাকে।
কথার ফাঁকে তর্জনীটি ক্রমশ আসমার সমস্ত মুখমণ্ডলে বুলিয়ে গেল অতনু। তীব্র অস্বস্তি এবং বিরক্তিভাব টের পেলেও তা উপেক্ষা করে ক্র্যাচ শক্ত হাতে চেপে ধরে স্বাভাবিক রইল আসমা। বরং চেহারায় অতিরিক্ত লজ্জাভাব ফুটিয়ে অতনুর সামনে সন্দেহের কোনো অবকাশ রাখল না।
স্ত্রীর আরক্তিম মুখমণ্ডলে চোখ বুলিয়ে মনে মনে হাসলো অতনু। স্বীয় ভাগ্যের ওপর নিজেরই অহম হলো তার। অকল্মষ শ্রী, সৌষ্ঠব কলেবরের অপ্রতিম সৌন্দর্যের অধিকারীনি অঙ্গনাটি তার অর্ধাঙ্গী ভাবলেই প্রফুল্লতায় দেহ-মন ভরে ওঠে সর্বটাক্ষণ। জীবনের থেকে এতটাও আশা সে করেনি।
আলতো চেপে রাখা তর্জনীটি কপাল, কপোল, চিবুক ছুঁয়ে যখনই নাকের ডগায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো তখনই চট করে ওর হাত ধরে ফেলল আসমা। ভ্রু সংকুচিত করে বলল,
— নাকের ঘাম মুছে দিতে হয় না জানো না? লোকে বলে যে মেয়ের নাক ঘামে সে নাকি বর সোহাগি হয়।
বাঁধা প্রাপ্ত হলেও কিন্তু দমে গেল না অতনু। মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শ্রবণ করার পর ঈষৎ ঝুঁকে চট করে নাকে নাক ঘষে স্বেদটুকু মুছে দিয়ে বলল,
— আমাকে কখনও আটকানোর চেষ্টা করবে না আসমা। এটা আমার পছন্দ না।

অতনুর কথায় মুখ ভার হয়ে গেল আসমার। হাত ছেড়ে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো সাথেসাথে। তা দেখে ছোট্ট করে শ্বাস ফেলল অতনু। এক কদম এগিয়ে আরেকটু নিকটে গিয়ে কনুই ধরে নিজের দিকে ফেরালো অভিমানী অর্ধাঙ্গীকে। এরপর নিজের দুই বাহুতে গলা জড়িয়ে ঠোঁটের ওপর শুষ্ক চুমু এঁকে বলল,
— তোমার জন্য আমার ভালোবাসা কিংবা আদর-সোহাগ এসব কান কথা মানা না মানার সাথে বিন্দুমাত্র কম-বেশি হবে না। একজন স্ত্রী হিসেবে তোমার যা অধিকার এবং তোমার সমস্ত সত্তা দিয়ে তুমি যা অর্জন করে নিয়েছ সবটাই তোমার একার হয়ে থাকবে। বুঝতে পেরেছ?

এ পর্যায়ে আসমার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। মাথা ওপর নীচে করে বোঝালো সে বুঝতে পেরেছে। বিপরীতে অতনুও হাসল অল্প করে। পুনর্বার আসমার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে তাকে জড়িয়ে নিলো বুকের মাঝে পরম ভালোবাসায়।
ওদিকে বক্ষপিঞ্জরে মুখ লুকিয়ে বিরক্তিতে চোখ কোঁচকাল আসমা। অন্দরটা স্বগতোক্তি করল,
“আমার অধিকার তো বহু আগেই নিলাম করে দিয়েছ তুমি অতনু হাওলাদার। তোমার ওপর আমার কোনো আগ্রহ নেই, কখনও ছিলোও না; আশাকরি জন্মাবেও না। তোমায় তো ঐ বারাঙ্গনার সাথেই মানায়। কি যেন নাম ওর? উর্বশী, হ্যাঁ উর্বশী। নেহাৎ তোমায় ঘৃণা করি। তুমি আমার একান্ত মানুষ হলে তোমায় ছুঁতে চাওয়া হাতগুলোকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার করে দিতাম”
মুহুর্তের এ ঘৃণা এবং ছলনার অদ্ভুত মেলবন্ধন বাইরে থেকে কিন্তু বোঝার উপায় নেই। একমুহূর্ত তাকালে যে-কেউ এই আলিঙ্গনকে বৈবাহিক সম্পর্কের পবিত্র আলিঙ্গন বলেই মনে করবে।
ব্যতিক্রম হলো না উপমার ক্ষেত্রেও। সে এসেছিল ড্রইং রুম থেকে টেলিফোন নিয়ে যেতে। সিঁড়ির মুখে ভাই-ভাবীর এক ঝলক মধুর প্রেম দেখে সে ভারী লজ্জা পেয়ে গেল। কোনোরকমে টেলিফোন হাতে নিয়ে ছুটল নিজের ঘরের দিকে। দোর এঁটে টেলিফোন দু’হাতে জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে শ্বাস ফেলল। তার সেজো ভাইটা যে কি না! বাড়ি ভরা বাইরের মানুষ। খেয়াল নেই এসবে।
আবার মনে হলো অপরাধ তো তারা করছে না। চক্ষুলজ্জার ভয়টাকে এড়িয়ে গেলে মধুর কথোপকথনটুকু ভারী সুন্দর। ভালোবাসা দু-চোখ ভরে দেখতে ভালো লাগে। অস্বীকার করার অবকাশ নেই রওনকের বুকে মাথা রাখলে ওর বড্ড আনন্দ হয়। তখন উপলব্ধি করে দয়িতের বাহু বন্ধনে জড়িয়ে থাকার মতো সুখ বুঝি আর হয় না।

লাজুক হেসে ফোন হাতে নিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসন পেতে বসে বিছানার মধ্যিখানে। কোলের ওপর ফোনটা রেখে রিসিভার তুলে ডায়াল করে রওনকের নম্বর। বলা বাহুল্য রওনক ঐ সময় ফোনের কাছেই ছিল। ক্লাবের টেলিফোনটা একমাত্র ওর জন্যই বাজে। কেউ অনবগত নয় কার তরফ থেকে ফোন আসে রওনকের কাছে। তাই ফোনটা বাজলেই মুখ টিপে হেসে নেয় উপস্থিত সকলে। রওনক ছাড়া ঐ কল রিসিভ করার অধিকার কারোর নেই। অবশ্য অযাচিত সমস্যা দেখা দিলে সেক্ষেত্রে মিজান উপযাচক হয়ে দু-একবার ফোনে হাত দেয়। নয়তো অন্যকেউ দেয় না। রওনকের বারণ নেই, ছেলেরা নিজেরাই নিয়মটা তৈরি করেছে।
আজও কল রিসিভ করার পর ছেলেপেলেদের সমস্বরের গুঞ্জন শুনতে পায় উপমা। লাজুক হাসি গাঢ় হয় তার ঠোঁটের কোণে। রওনক ঠোঁট কামড়ে ধমক লাগায় ছেলেগুলোকে। বিনিময়ে দাঁত বের করে হেসে সিঁটি বাজিয়ে বেরিয়ে যায় তারা। ফোনের এপাশে সবটাই বোঝে উপমা, কিছু বলে না। এই ছেলেগুলো যখন ওকে ভাবী বলে ডাকে লজ্জা মিশ্রিত এক অদ্ভুত আনন্দ হয় উপমার। রওনককে যদিও কথাটা বলা হয়নি। বলবেও না। মানুষটা যা দুষ্টু! ক্ষেপিয়ে ক্ষেপিয়ে মাথা খারাপ করে দেবে।
ওদিকে ছেলেরা বেরিয়ে যেতেই রওনক গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
— হ্যাঁ উপমা বলো?
হাসি ধরে রেখে উপমা পাল্টা প্রশ্ন করে,
— রওনক আপনি কি আজ আসছেন আমাদের বাড়িতে?
— কি উপলক্ষে? তুমি ডেকেছিলে আমায়? কই কোনো চিঠি তো আসেনি।

উপমা তো ভেবেছিল অন্যান্যদের সাথে রওনকও দাওয়াত পেয়েছিল, কিন্তু রওনকের সাবলীল কণ্ঠস্বর ওর ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে সব আগ্রহ-উৎকণ্ঠা নিভিয়ে দিলো চোখের পলকে। দমে যাওয়া স্বরে বলল,
— আপনার আসার কথা ছিল না!

অবুঝের মতো ডানে বাঁয়ে মাথা দোলালো রওনক।
— না তো। তবে তুমি বললে আসি। কোথায় দাঁড়াব পেছন গেইটে?
— নাহ্ থাক আজ আর আসতে হবে না। একদম কলেজে গিয়ে দেখা হবে নাহয়।
— আরে আসতে বললে আসছি। তুমি..
— উঁহু দরকার নেই তো। আচ্ছা আমি এখন রাখি কেমন?
— আর কিছুটা কথা বলো।
ফোন রাখার কথা শুনে ভারী অবাক হলো রওনক। ছোট্ট শ্বাস ফেলে উপমা বলল,
— এখন নয় রাতে বলব।
এ পর্যায়ে ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে আসতে শোনা গেল। জবাবে ক্ষীণস্বরে রওনক বলল,
— ঠিকাছে রাতে কথা হবে।

ডিসকানেক্ট হয়েছে বুঝতে পেরে রিসিভার নামিয়ে মুখ ভার করে বসে রইল উপমা। সেজো ভাই সবাইকে ডেকেছে অথচ রওনককে ডাকেনি। তবে কি তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক বিশেষ ভালো নয়? ভাইয়ের সাথে রওনকের নিয়মিত যোগাযোগ আছে জানতে পেরে উপমার মনের মধ্যে একটা আশার আলো জেগেছিল। ভেবেছিল যোগাযোগ ভালো থাকলে ওদের সম্পর্কের বিষয়টা মানতে বিশেষ সমস্যা হবে না। রওনকের পারিবারিক অবস্থা তো ওদের মতই বলা যায়, আবার রাজনীতিতেও রওনকের অনুপ্রবেশ প্রশংসনীয়। কোনোদিক দিয়ে রওনক অযোগ্য নয়। কিন্তু আজকের এই ঘটনা উপমার সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা নিমেষে মাটি করে দিলো। শিয়রে টেলিফোন নামিয়ে রেখে বালিশ টেনে শুয়ে পড়ল উপমা। সময়ের সাথে ওর বিষণ্নতা গাঢ় হবে। বিষণ্নতাকে দূর করতে হয় কান্না চাই, নয়তো ঘুম। দেখা যাক কোনটায় ও সফল হয়।
বোকা উপমা তো জানে না রওনকের সাথে অতনুর দ্বন্দ্বটা ঠিক কোথায়! বাইরেটা দেখে কখনও ভেতরের খবর জানতে পারা যায়? উপমার ভাবনার চাইতে হাজারগুণ বেশি জটিলতা মিশে আছে এ সম্পর্কে। না আছে এর কোনো সুন্দর ভবিষ্যৎ আর না ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা। এজন্যই রওনক ভবিষ্যৎ ভাবতে বারণ করে। কারণ ভবিষ্যৎ ভাবতে গেলে আজকের সব নিরর্থক মনে হতে পারে।

___________

সাঁঝ পড়ে গেছে অনেকক্ষণ। খাবার-দাবার তৈরি করে দিয়ে বাইরের মানুষ সব বাড়ি ফিরে গেছে। অতনুর পার্টির লোকজনও এসে উপস্থিত হয়েছে বসার ঘরে। অতিথিদের সাথে জম্পেশ আড্ডায় মেতেছে অতনু, সাথে মতের বিরুদ্ধে বসে আছেন রঞ্জু সাহেব। তার মুখভঙ্গি কিংবা গল্পের ধরন দেখে যদিও বিরক্তিভাব একদমই টের পাওয়া যাচ্ছে না! তবে সত্যিকার অর্থেই সে বিরক্ত এবং নাখোশ।
অন্যদিকে চাচাশ্বশুর বসে আছে বলে কিছুটা মনোবল জোটাতে পারছে আসমা। ভেতরে ভেতরে তো সেও শতটুকরোয় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। নিজাম চৌধুরী লোকটার চেহারা যতবার দেখছে, কন্ঠস্বর যতবার কানে আসছে ততবার অতীত মনে পড়ছে আসমার। হিম শীতল পরিবেশেও ও ঘামছে কুলকুল করে। হাত-পা শরীর সব যেন কাঁপছে অবিরত ঠকঠক করে। কাঁপুনি থামাতে বারবার হাত মুষ্টিবদ্ধ করতে হচ্ছে নয়তোবা কাপড় কিংবা ক্র্যাচ চেপে ধরে রাখতে হচ্ছে। পাক্কা অভিনেত্রী হয়ে গেছে বলা যায়। ভেতরের ভাঙন এত তীব্র, তবুও বাইরে লেশমাত্র বোঝার জো নেই। কি সুন্দর স্ন্যাক্স এগিয়ে দিচ্ছে অতিথিদের, টুকটাক কথাবার্তায়ও যুক্ত হচ্ছে। তবে সুক্ষ্ণভাবে খেয়াল করলে বোঝা যায় নিজাম চৌধুরীর সাথে চোখাচোখি তেমন করছে না। ওর কেন যেন মনে হচ্ছে লোকটা ওকে চিনতে পেরেছে। এবং লোকটার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ওর দিকেই নিবন্ধ। এসব ভাবতে গেলে অস্বস্তি দ্বিগুণ-তিনগুণ বেড়ে যাচ্ছে আসমার। ভয় হচ্ছে না চাইতেও কোনো রিঅ্যাকশন না দেখিয়ে ফেলে। মস্ত ঝামেলা হয়ে যাবে তাহলে।

ওদিকে অন্য কারোর নজর এড়িয়ে গেলেও পরিবেশের অস্বাভাবিকতা রওনকের নজর এড়াতে পারছে না। ও খুব ভালো মতই বুঝতে পারছে অতনুর স্ত্রী আসমার মধ্যে কোনো সমস্যা রয়েছে। প্রথম ঝলকে তাকে দেখামাত্র নিজাম চৌধুরীর চমকিত দৃষ্টি কিংবা বক্র হাসি, বিপরীতে আসমার বাহ্যিক অস্থিতিশীলতা কিছুই ওর সজাগ চোখজোড়া এড়িয়ে যেতে পারেনি। ভেতর থেকে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি উঠে এসেছে। মাঝেমধ্যে মনে হয় কোনো নিগুঢ় দুর্ভেদ্য রহস্য কুয়োয় বসবাস করে সে। আশেপাশের মানুষগুলো সব মুখোশ পরে চলাচল করে। কার ভেতরে কোন রহস্যের জাল বুনে রাখা বোঝাই দায়!

কয়েক মুহুর্ত দু’জনের দিকে তাকিয়ে থাকার পর একসময় মনোযোগ ঘুরিয়ে নিলো রওনক।বরং আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কাঙ্ক্ষিত মুখটাকে খোঁজার চেষ্টা করল। সবাই আছে শুধু তার জল ফড়িংটা নেই কেন? তার তো সবকিছুতেই দাপিয়ে বেড়ানো শখ। নাকি বাড়ি থেকে নিষেধাজ্ঞা! এ-ই ভালো। এসব কুটিল আলাপে ওর না থাকাই ভালো। কে বলতে পারে কার মনে কি লুকিয়ে আছে! রাজনীতি তো পুরোটাই গিভ অ্যান্ড টেইক এর খেলা। এছাড়া অতনু যেমন মানুষ! ওকে বিশ্বাস নেই। স্বার্থ হাসিলের জন্য যেকোনো স্তরেই ও নেমে যেতে পারে।
নাহ্ সুযোগ বুঝে রওনককেই দেখা করে আসতে হবে প্রেয়সীর সাথে। গতরাতের লেখা চিঠিটাও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে ও। মেয়েটার হাতে দিলে নিশ্চিত চমকে যাবে। সাথে আনন্দিতও হবে নিশ্চয়ই!
বুক পকেটের ওপর আলতো করে হাত রেখে মৃদু হেসে উঠল রওনক। মিথ্যে বলেছিল ও উপমাকে। আজকের এই প্রোগ্রামে ওকেও নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। রওনক জানতো উপমা ওকে কল করবে। মেয়েটাকে সারপ্রাইজ দেবে বলেই তো দুপুরে অমন মিথ্যে বলল। আসবে না শুনে সে কি মন খারাপ করে বসে আছে? শেষের দিকে তার কণ্ঠে বিষণ্ণতা স্পষ্টই টের পাওয়া যাচ্ছিল। সমস্যা নেই। বিশাল আনন্দের আগে একটুখানি বিষণ্নতায় দোষ নেই।

কুটিল ব্যক্তিরা বোধহয় প্রতিপক্ষের সমস্ত পদক্ষেপ চোখের সামনে দেখলে টের পেয়ে যায়। অতনুও কিছুটা পাচ্ছে। ওর প্রতিপক্ষ সর্বদাই রওনক। রওনকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে কিন্তু বিশ্বাস তো একফোঁটা করে না। রওনকের পেছনে ওর শাণিত দৃষ্টি বহু আগে থেকেই নিবন্ধ আছে। আজকাল রওনককে ভারী সন্দেহজনক লাগে। ওর বদ্ধমূল ধারণা প্রতিশোধের স্পৃহায় অন্ধ রওনক কোনোভাবে অতনুর পরিবারকে টার্গেট করার চেষ্টা করছে। ওর সহজ টার্গেটে যেহেতু উপমার পড়ার সম্ভাবনা তীব্র তাই অতনুর ধারণা রওনক উপমাকেই ওর বিপরীতে অস্ত্র বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও ও শতভাগ নিশ্চিত নয়, তবে কোনোভাবে সন্দেহটা যদি সত্যি প্রমাণিত হয় তাহলে অতনু ওকে সহজে ছেড়ে দেবে না। প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছিল বলে প্রিয় বন্ধুর হাত ছিনিয়ে নিতে ওর সময় লাগেনি, পরিবারের দিকে হাত বাড়ানোর মতো দুঃসাহস দেখালে সমূলে উচ্ছেদ করে দিতেও দ্বিতীয়বার ভাববে না।

চলবে,
Sara

ছোট্ট জিজ্ঞাসাঃ অবুঝ বালিকা উপমাকে আপনাদের ভালো লাগে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here