চিঠি দিও
৬
_________
“তোরে আমাদের ব্যবসায় ঢুকাব রওনক। আমার বিশ্বাস তুই আমার ব্যবসাটারে বহুদূর নিয়া যাইতে পারবি।”
হাসি মুখে রওনককে উদ্দেশ্য করে বলে আনিস শেখ। বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে আনিসের দিকে ঘুরে তাকায় রওনকও। বিরক্তি জাগে ভেতরে ভেতরে। বাইরে অবশ্য সে স্বাভাবিক। বিরক্তি,রাগ এসব চুনোপুঁটিদের সামনে তড়িৎ দেখানো যায়। আনিস হলো রাঘববোয়াল। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এই মুহুর্তে রওনকের ভবিষ্যৎ পুরোটা আনিসের ওপরই নির্ভরশীল। আনিসই তার আর নিজাম চৌধুরীর মধ্যস্থতাকারী। তাই তার সাথে উল্টোপাল্টা কিছু নয়।
চেয়ারে হেলান দিয়ে রওনক উত্তর দেয়,
— ঐসব আলাপ এখন ক্যান আনিস ভাই? ইলেকশনটা যাক তারপর নাহয় ঐসব বিষয়ে আলোচনা হবে।
— আলোচনা তো হবে। আলোচনার অনেক কিছুই আছে। শর্টকাটে তো শেষ করা সম্ভব না তুইও জানস আমিও জানি। ভাসায় রাখলাম কথাটা। মনে রাখবি খালি।
আনিসদের ব্যবসাটা সম্পর্কে অজানা নয় রওনক। অস্ত্র চোরাচালান ও মাদক কারবারের। ব্যবসায় তার সমস্যা নেই। এসবে যুক্ত হলে বরং নিজাম সাহেবের আরও কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব, বিশ্বস্ত হয়ে ওঠা সম্ভব। কিন্তু যতদূর জানে, এই শহরে এতদিন যাবৎ এসবের দেখাশোনা করে আসছে অতনু। এবং অতনুর আন্ডারে কাজ করতেই রওনকের যত আপত্তি। আপত্তির বিষয়টা আপাতত চেপে যায় রওনক। কতক নিশ্চুপ থেকে শুধয়,
— নিজাম সাব কই?
— উনি তো চলি গেছেন।
— চলি গেছে মানে! আমাক দেখা করতে কয়া উনি চলি গেল?
অবাকই হয় রওনক। আনিস বোঝানোর চেষ্টা করে ওকে,
— আরে উনি সরাসরিই দেখা করতে চাইছিলেন তোগোর সাথে। কিন্তু হুট করি ঢাকা থেকি আসলো টেলিফোন। পড়িমড়ি করে ছুটা লাগল বেচারাক। তবে যা বোঝানোর আমাক বোঝায় দিয়া গেছেন উনি। আলাপ আলোচনা আপাতত আমার সাথেই হবে তোর।
— আচ্ছা ঠিকাছে। সমস্যা নাই।
এবার আপনাদের পরিকল্পনা গুলা বলেন তো শুনি। আজকে থেকিয়ায় তো কাজে পড়ি যাওয়া লাগবে।
— হ্যাঁ। মিজানকে ডাক। একসাথে বুঝায় দেই।
অতঃপর মিজান এলে সামনের দিনগুলোর সমস্ত সভা, মিছিল-মিটিংয়ের একটা খসড়া পরিকল্পনা করে ফেলে ওরা তিনজন বসে। সবগুলোতে পরিচিত মুখ হিসেবে থাকবে অতনুই। রওনকের কাজ সব আড়ালে। মেনে নিয়েছে রওনক। নেপথ্যে কাজ করতে করতেই একদিন এই ক্ষমতা হাতে চলে আসবে তার। সে জানে। কেবল ধৈর্য ধরে আছে দিনটার অপেক্ষায়।
পরিকল্পনা শেষে আনিস হাসতে হাসতেই বলে,
— তুই ছাড়া ইদানিং অচল হয়ে পড়তেছি রওনক। তুই হইলি আমাদের শহরের সবচেয়ে পাওয়ারফুল মানুষ। তুই পাশে আছস ভাবলেই মনে হয় সব ঠিক আছে।
আনিসের বিপরীতে রওনকও কৌতুকের স্বরে বলে ওঠে,
— এখন পর্যন্ত ক্ষমতা দিয়া রাখছেন অতনুরে আর বলেন আমি এই শহরের পাওয়ারফুল মানুষ!
নরম হয় আনিস।
— আরে বোকা বুঝস না অয় বহুদিন থেকে আছে দলে। শুরুতে তো অয়ও কামলাই খাটছে। খেটে স্থান শক্ত করছে নিজের। এত সহজে ওকে সরানো সম্ভব? তবে নিরাশ হবি না। জানবি আনিস ভাই সবসময় তোর সাথে ছায়ার মতো আছে। আর আমি আছি মানে একদিন না একদিন ক্ষমতা ট্রান্সফার হবেই তোর কাছে৷ সে দিনটাও বেশি দূরে না।
— এই কথা তো বহুদিন থেকি বলতেছেন ভাই। গতবারও বললেন।
— আমি গতবারে তোক একটা গতি করি দিতাম রওনক তুইও জানস। কিন্তু, গতবার গুঞ্জন উঠল তুই বিরোধী দলের। নিজাম সাব তো ঐজন্যই শতভাগ বিশ্বাসটা করতে পারতেছেন না তোকে। তার উপর তুই বদির ভাই। বুঝোসই তো।
রওনক এবারে একটু কঠিন হয়। দৃঢ় চিত্তে বলে,
— আমি কোনো দলেরই না আনিস ভাই। ভাইয়ার সাথে আমাক মিলাইলে তো হবে না।
— আরে পাগল সেইটা তো আমিও জানি। বদি আর তোর মধ্যে বিশাল ফারাক। আর তুই আমাদের এইখানেই ঢুকতে চাস। কিন্তু নিজাম সাব তো বুঝতেছেন না।
— অতনু যে ঠুলি পরায় রাখছে ওনার চোখে।
রওনকের কথায় ক্রোধের ছাপ। আনিস শেখের মনে হয় নিজেকে রওনকের সামনে আরেকটু মেলে দেয়া উচিৎ। এগিয়ে এসে রওনকের কাঁধে হাত রেখে সে তরল গলায় বলে,
— ঠুলি ফুলি বুঝি না। শোন রওনক আর যাই হোক আমি পাশে আছি তোর। ভরসা রাখ। নিজেও চেষ্টা কর। তোর স্থানটা কি একলা হাতে ছিনায় আনি দিতে পারব আমি? তোকও সাহায্য করা লাগবে। আমাকে, নিজেকে। আমি পাশে থেকে চেষ্টা করতে পারব, তোকে পথ দেখায় দিতে পারব; বলে দিতে পারব কোনটা তোর স্থান। কিন্তু স্থানটাকে নিজের করার জন্য চেষ্টা তোকেই করা লাগবে। এইবারের কাজ দিয়া নিজাম সাবের বিশ্বাস অর্জন কর। তাহলেই সহজ হবে সবকিছু। বুঝলি?
প্রলম্বিত শ্বাস টেনে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো রওনক। ওদের কথা চুপচাপ শুনছিল মিজান। এতক্ষণ পর ও হঠাৎ বলে উঠল,
— সবই ঠিক আছে আনিস ভাই কিন্তু একটা বিষয় খুঁতখুঁত করতেছে মনে। অভয় দিলে বলি?
— বল রে ব্যাট্যা অভয় দিলাম।
মিজানের দিকে ঘুরে তাকায় আনিস এবং রওনক।
— আপনের কি মনে হয় নিজাম সাব এবার.. মানে বুঝতেছেন তো কি বলতে চাইতেছি?
কাচুমাচু মুখ করে বলে মিজান। বিপরীতে ভ্রু কুঁচকে কতক পর হা হা করে হেসে ওঠে আনিস শেখ।
রওনকের পাশ থেকে উঠে রাজকীয় কায়দায় বানানো তার আরাম কেদারায় বসতে বসতে বেশ দম্ভের সাথেই বলে,
— শোন এই দ্যাশত ক্ষমতা হইলো এক কেন্দ্রিক। রাজত্ব যখন যার নামে, তখন সে একমাত্র রাজা আর বাকি সব গোলাম। কোনোকালেই গোলামদের হাতে অত ক্ষমতা দেয়া হয় না, তারা রাজার বিরুদ্ধে টু শব্দ করবে।
নিজাম সাবকে এই অঞ্চলের একপ্রকার রাজা ভাবতে পারিস। তারে বাইর করা অত সোজা না৷ ভেতরের ঘটনা অনেক আছে বুঝলি? সব তো বলা যায় না, খালি মনে রাখবি যতদিন পার্টি আছে ততদিন নিজাম সাবও আছে।
— হুম বুঝলাম।
মাথা নেড়ে বলল মিজান।
— গুড। তবে মিজান তোর ওপর কিন্তু আমি বহুত খুশি। রফিক আমার ভাইয়ের মতো আছিল। ওর খুনিরে তুই নিজ হাতে শাস্তি দিছিস আমার দিল খুশ হয়া গেছে। খবর শুনিয়ায় আমি সিদ্ধান্ত নিছি তোক ইনাম দেব। এর বিপরীতে তুই যা চাইবি তাই পাবি আমি ওয়াদা করতেছি।
আচম্বিত নিজের প্রশংসা শুনে লাজুক ভঙ্গিতে হাসলো মিজান। বলল,
— ধন্যবাদ ভাই। আমার এই মুহুর্তে চাওয়া-পাওয়ার কিছু নাই। খালি আপনাদের পাশে থাকতে দিয়েন তাইলেই হবে।
— তা তো অবশ্যই। কিন্তু অতবড় কাজের এট্টুক ইনাম না। আরও কিছু চা।
এবার যেন বিপাকে পড়ে গেল মিজান। কি চাইবে ও? সবই তো আছে। চাওয়ার তো তেমন কিছু নেই। বোকার মতো তাই রওনকের দিকে তাকাল। সহাস্যে রওনক ওর পিঠ চাপড়ে বলল,
— মোক্ষম সুযোগ বন্ধু। কি চাবা চায়ে ফেলো।
মাথা চুলকালো মিজান। বহু চিন্তাভাবনার পর বলল,
— এখন কিছু চাওয়ার নাই আনিস ভাই। চাওয়া-পাওয়া সব তুলে রাখলাম। অন্য কোনো সময় খুব দরকার পড়লে স্মরণ করব আপনাকে।
— ঠিকাছে। আমি আনিস শেখ তোক ওয়াদা করলাম তোর সব প্রয়োজনে আমারে পাশে পাবি তুই। কি রওনক ঠিক করলাম তো?
পুনরায় হা হা করে হেসে উঠল আনিস শেখ । রওনকও স্মিতহাস্যে সহমত জানাল। ওদিকে খুশি হয়ে মিজান আনিসের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে দোয়া নিলো আনিসের থেকে৷
এরপর আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো ওরা দুই বন্ধু৷ তখন বোধহয় রাতের আটটা বেজে গেছে।
এত জলদি বাড়ির পথ ওরা ধরে না। যাবে ক্লাবঘরে। কিন্তু তার পূর্বে মাথা ঠান্ডা করা চাই। হালকা পাতলা চা-সিগারেট খেলে মন্দ হয় না। সার্কিট হাউজ থেকে বেরিয়ে অল্প কিছুটা গেলেই রাস্তার দু ধারে চায়ের দোকানে ভরা। হোন্ডায় টান দিয়ে কাছাকাছি যেটা ছিল ওখানেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো রওনক।
ও জানে আনিস শেখ মানুষটা ওর সাথে শতভাগ বিশ্বস্ত না। অন্তত পক্ষে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে তো না ই। তবে একটা কথা সত্য, দলে থাকতে থাকতে এতবছরে নিজের একটা শক্ত স্থান তৈরি করে নিয়েছে অতনু। ওকে সরানো সহজ কর্ম নয়। অতনু ভীষণ চালাক একটা মানুষ। আনিসের হাতে তো নয়ই ওকে সরানো। কাঙ্ক্ষিত স্থানটা পেতে হলে খোদ রওনককেই চেষ্টা করতে হবে। হয় অতনুকে একধাপ ওপরে উঠিয়ে আরো বড় স্থানে পাঠাতে হবে, নয়তো পূর্ব পথ অনুসরণ করে নিজের স্থান বানাতে স্থান দখল করে রাখা মানুষটাকে অপসারণ করতে হবে।
রওনক অবশ্য দ্বিতীয় পন্থাতেই বেশি আগ্রহী।
— দোস্ত দেখ দেখ অতনুর গাড়ি যায়।
মিজানের কথা শুনে ভ্রু জোড়ায় কুঞ্চন লাগে রওনকের। চা রেখে ছাউনির বাইরে বেরিয়ে আসে সে। কোমরে হাত রেখে চোখ সরু করে দেখে ঠিক মোড় ঘুরে সার্কিট হাউজের দিকে এগোচ্ছে অতনুর জিপটা। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে অতনুর পাশে সহাস্যে বসে আছে নিজাম চৌধুরী। আনিস না বলল নিজাম সাহেব চলে গেছে ঢাকায়? তারমানে তাকে মিথ্যে বলা হয়েছে।
মিজান পাশে থেকে গালি দিয়ে ওঠে অতনুর নাম ধরে। রওনক অবশ্য কিছু বলে না। বরাবরের মতো ধৈর্য ধারণ করে চুপচাপ আছে সে।
সার্কিট হাউজের সামনে গিয়ে এক মুহুর্ত দাঁড়ায় অতনুর জিপটা। রওনকের মনে হলো অতনু তার দিকে বক্র হাসি ফিরিয়ে দিয়েছে। তড়িৎ শক্ত হয়ে যায় রওনকের চোয়ালদ্বয়। হৃদয়ে উত্থিত প্রতিশোধের অনল দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। সময়, সুযোগ দুটোই তো অঢেল পড়ে আছে সামনে। আগুন যত বাড়তে চায় বাড়ুক। এই আগুনে একদিন দাহ করবে ও অতনুকে;পুরো নি’শ্চি’হ্ন করে দেবে। এ ওর প্রতিজ্ঞা।
________
অতনুর সাথে শত্রুতা মূলত রওনকের ভাই বদিউজ্জামানের সময় থেকে। একসময় বদি আর অতনু একই দলের হয়ে কাজ করত। বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও ছিল দুজনের মধ্যে। বদি ছিল ওখানকার লিডার। চিন্তায়, কাজে সকলের থেকে অনেক ওপরে ছিল সে। ছিল তার অনেক যোগ্যতাও। এই ক্ষেত্রেটাতে অনেক নামও করতে পারত তারা। কিন্তু একটা ট্রাজেডি.. আর সবকিছু ওলটপালট।
বড় বড় আসনে দণ্ডায়মান মানুষগুলোর অভ্যন্তরীণ লড়াই, কূটচাল আর ষড়যন্ত্রের কালো থাবা। অকারণ দা’ঙ্গা বেঁধে রাতরাতি ক্ষমতার হাত বদল হলো। ঐসবের প্রভাবে ছোট ছোট শহর গুলোতে বদিউজ্জামানদের মতো মানুষরা হয়ে পড়ল মূল্যহীন। এত অস্থিরতা ছড়িয়ে গেল গোটা দেশে! প্রভাবিত করতে লাগল বদিদের। কোত্থেকে কি করবে বুঝে উঠতে পারল না ওরা৷ তারই মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে কিছু মিথ্যে মামলায় ফেঁসে গেল বদি, অতনুসহ সবাই। এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল সবকিছু পালানোর সময় অবধি পেলো না ওরা। এরপর আর কি, জেলে। সেই সময় তাদের সাহায্য করারও কেউ ছিল না। কয়েকদিন পড়ে রইলো ওভাবেই। কান কথায় শুনল কোর্টে চালান করে দেয়া হবে ওদের। ভাবনার কোনো কূলই খুঁজে পাচ্ছিল না বদি। কি করবে!
কোর্টে চালান করার দিন দুয়েক আগে এক সকালে হঠাৎ এক ক্ষমতাধর ব্যক্তির আগমন ঘটল জেলে। সে আর অন্য কেউ নয় নিজাম চৌধুরী। এসেই সে বদি এবং অতনুর সামনে প্রস্তাব রাখল যদি তারা এই মুহুর্ত থেকে দল পাল্টে নিজাম চৌধুরীর দলে চলে আসে তাহলে ওদের দুজনের সকল দায়িত্ব নিজাম স্বেচ্ছায় নিজ কাঁধে তুলে নেবে। এমন কু প্রস্তাব শুনে বদি ফুঁসে উঠলেও অতনু এক কথাতেই রাজি হয়ে গিয়েছিল। সম্ভবনাময় ভবিষ্যৎ ছেড়ে সে এই কাল কুঠুরি পঁচে মরতে মোটেও রাজি ছিল না। হোক না নৈতকতার অবক্ষয়। এই পথে সৎ থেকে কে কতটা অর্জন করতে পেরেছে?
নিজামের সেদিনের ডাকে সাঁড়া না দেয়ায় বদিকে আরও মাস ছয়েক জেল খাটতে হয়েছিল। পরে অনেক লোক ধরাধরি করে বের করা হলো তাকে। এদিকে অতনুর জীবন পুরোটাই পাল্টে গেছে। নিজামের ডাকে সাঁড়া দিয়ে বহুদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছে সে। হয়ে উঠেছে শহরের অন্যতম পরিচিত মুখ।
বদি তখনও দীর্ঘশ্বাস চেপে পড়ে আছে ফেলে যাওয়া সবকিছুকে আবারও নতুন করে সাজাতে। পুরনো প্রায় সব মানুষই ছেড়ে দিয়েছিল দল। ওদের কোনো হদিসই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। যে দু একজন ছিল তারা সহ নতুন কিছু মুখ নিয়ে শুরু হলো কাজ। নতুন ছেলেগুলো আবার প্রথম থেকেই মারমুখী ছিল। নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক কষ্ট হয়ে যেত বদির। তেমনই একদিন মিছিলে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেল ছেলেগুলো। অপর পক্ষের সাথে লেগে গেল ভয়াবহ ঝামেলা। তখন চলছে জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতি। কথায় কথায় অস্ত্র-শস্ত্রের ঝনঝন শব্দ। সেদিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বিশৃঙ্খলার কথা ফলাও করে ছড়িয়ে গেলে মাঠে নেমে এলো অতনু খোদ। বহু মাস পর দুই বন্ধু সামনা-সামনি। কিন্তু ঘটনা ভিন্ন, প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
ঐ সময়টাতে কারোর চোখে বিন্দুমাত্র মায়া-দয়া অবশিষ্ট ছিল না। লড়েছিল দু’জন প্রতিপক্ষ হয়ে। বদির চলছিল দুঃসময়, অন্যদিকে অতনুর দল ছিল ভারি। ফলাফল পরাজয়ের খাতায় বদিরই নাম উঠে গেল। যে নামখানা লেখা হলো উষ্ণ লাল কালিতে। লড়াইটাতে অতনুর নির্দয় আঘাতে হারাতে হয়েছিল বদিকে তার ডানহাত; বরণ করতে হয়েছিল আজীবনের পঙ্গুত্ব।
এবং সেদিনের ঘটনাটা সম্পূর্ণটাই ঘটেছিল রওনকের চোখের সামনে। যা মানসপট থেকে মুছে ফেলা অসম্ভব প্রায় রওনকের জন্য। প্রতি মুহুর্ত কাজের ফাঁকে কিংবা নিরালা নিভৃতে বসে থাকলেও ঐ দুঃসহ স্মৃতিটা চোখের পর্দায় ভেসে উঠতে দেখে রওনক। শুনতে পায় তার বড় ভাই, পরম প্রিয় বন্ধুসম লোকটার আর্ত্মচিৎকার। দেখতে পায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে সেকেন্ডের মাথায় কাঁধ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া ভাইয়ের ডান হাতটাকে। হাত হারিয়ে কাটা মুরগীর মতো ছটফট করতে থাকা বদিকে। প্রত্যেক সেকেন্ড ঐ দৃশ্যটা তাড়া করে ফেরে রওনককে, প্রত্যেক সেকেন্ড।
শরীরে রক্ত ফুটতে শুরু করে। ভাইয়ের রক্তে হাত রাঙানো অতনুকে পিষে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে ওর। পৃথিবীতে এতখানি ঘৃণা কেউ কাউকে করে না যতখানি রওনক করে অতনুকে।
কে জানে এই ঘৃণা একদিন কোন প্রলয় নামিয়ে আনবে ধরণীতে!
এতকিছুর পর একটা কথা না বললেই নয়। বদির সাথে রওনকের সত্যিকার অর্থেই কাজের কোনো মিল নেই। বদির মতো সৎ সেও নয়। একসময় অতনুর ওপর প্রতিশোধস্পৃহা থেকে দলে যুক্ত হলেও রাজনীতির প্রতি প্রীতি আছে তার। কাজ করতে করতে দলের প্রতি ভালো লাগাও সৃষ্টি হয়েছে। সে মনে করে এখানে লেগে থাকতে পারলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল; পাশাপাশি অতনুর সাথে বোঝাপড়াটাও সহজ।
এখানে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো অতনু আর রওনকের কাজ একই দলের সাথে। কিন্তু অতীতের জের ধরে দুটি একে অপরকে অপজিশন বলে সম্বোধন করে। না অতনুকে রওনক মানতে পারে আর না রওনককে অতনু মানে। এজন্য দুজনের সাঙ্গপাঙ্গও আলাদা করে দিয়েছে আনিস।
বিষয়টা এরকম, একই ডাঙ্গায় বসে দুই কুমিরের লড়াই।
দেখবার বিষয় লড়াইয়ে জয়ের হাসি কে হাসে আর পরাজয় কার ঝুলিতে পড়ে!
পুরনো কথা মনে পড়লেই মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয় রওনকের। যেমন এখন হচ্ছে। সইতে না পেরে দাঁতে দাঁত চেপে নিজের মাথার পেছনটা চেপে ধরে রওনক। প্রেশার বেড়ে গেছে ওর। চোখ দু’খানা হয়ে উঠেছে রাঙা জবার মতো রক্তিম। মিজানকে ডেকে চায়ের বিল মিটিয়ে গাড়িতে উঠতে বলে রওনক। এই প্রেশার কমানোর টোটকা ক্লাবঘরে আছে। সিল করা স্বচ্ছ বোতলের ঘোলাটে তরলগুলি শান্তিমতো গলায় ঢালতে পারলেই কষ্ট, যন্ত্রণা সব হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। এভাবেই তো সবসময় নিজের যন্ত্রণাগুলোর উপশম করে এসেছে রওনক।
চলবে,
Sinin Tasnim Sara
★Unedited