চিঠি দিও ৮

চিঠি দিও

______________

উপমার আজ মন ভালো নেই। মন ভালো না হওয়ার একমাত্র কারণ আজ তার মায়ের জন্মদিন। সব ঠিকঠাক থাকলে আজ মায়ের আটত্রিশতম জন্মদিন পালন করা হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কিচ্ছু ঠিক নেই। জন্মদিনের মতো চমৎকার একটা দিনকে শোকের সাথে মনে করতে হয় ওদের। মামা বলেন ভাগ্যকে মেনে নিতে শিখতে হয়। কিন্তু উপমার এই ভাগ্যকে মেনে নিতে ইচ্ছে করে না। কোনোকিছু করে যদি ভাগ্য পরিবর্তন করা যেত তাহলে বোধহয় ভালো হতো৷ সেটা যেহেতু সম্ভব না তাই উপমা সিদ্ধান্ত নিয়েছে হৃদয়ের অপূর্ণ এক ইচ্ছে সে পূর্ণ করবে। এভাবে মেটাবে শূন্য হৃদয়ের হাহাকার। সে যখন আরও বড় হবে, হবে অনেক টাকাপয়সার অধিকারীণি;তখন সে ঘটা করে মায়ের জন্মদিন পালন করবে। বড় ভাইয়ের হাতে টাকা দিয়ে বলবে ঢাকা থেকে বিরাট বড় কেক নিয়ে আসতে। তারপর আয়োজন করে মায়ের শাড়ি পরে মা সেজে সে কেক কাটবে। সে তো মায়েরই অংশ। মায়ের অংশ হিসেবে এতটুকু গেটিস দেয়াই যায়; তাই না?

মন খারাপ লাগলে গান গেয়ে তা দূর করার চেষ্টা করে উপমা। আবেগ মিশিয়ে দুঃখী দুঃখী গান করে সে। গানের লাইনগুলো অনেক বেশি হৃদয়স্পর্শী হলে গান থামিয়ে একা একাই কান্না করে। মনে হয় গানগুলো ওর জীবনের আদলে লেখা। আগে এরকম অভ্যেস ওর ছিল না। বড় হওয়ার সাথে সাথে নতুন অনেক অভ্যেস যোগ হচ্ছে জীবনের সাথে। অভ্যেসগুলো ভালো নাকি খারাপ?

আজ শোবার আগে নিজে হাতে মামাকে ঔষধ পানি এগিয়ে দিয়েছে উপমা। সচরাচর সে এমন করে না। মামার পাশে বসে গানও শোনাতে চেয়েছে। কিন্তু মামার আগামীকাল অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে। রাত জাগা সম্ভব না তাই গান শোনাও সম্ভব না। মামার ঘর থেকে বেরিয়ে টর্চ লাইট নিয়ে তরতর করে ছাদে উঠে এসেছে উপমা। অভ্র তার ঘরে ঘুম। ও জাগনা থাকলে আসতে চাইতো। ভাগ্যিস আসেনি। একটু আগেও সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে গান গাইতে ইচ্ছে করছিল। এখন নিভৃতে নিরালা বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। সেজো ভাবী আসার পর পুনরায় ছাদে গাছের টব নিয়ে আসা হয়েছে। ভাবীর পছন্দ সাদা গোলাপ। তাই গোলাপ গাছের সংখ্যাই বেশি দেখা যাচ্ছে। ধীরপায়ে একটা গোলাপের টবের পাশে এসে বসল উপমা, কাঠের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে। ওর পাশে যে গাছটা সেই গাছে ফুলের সংখ্যা অনেক বেশি। মুখ ঘুরিয়ে গাছটার দিকে তাকাল উপমা। নীচু হয়ে সুগন্ধ নেয়ার চেষ্টা করল। ফুলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল। বড় মামি থাকলে এই ফুলগাছ দেখে ভয়ে ফেলে দিয়ে আসতেন। উপমা জানে মেজো মামি দেখলেও তাই করবে। ওদের ধারণা বাড়িতে যখন অনিষ্ট কিছু ঘটতে যায় তখন গাছগুলি ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। আগে তো বিশ্বাস করত না উপমা। কয়েকটা দুর্ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী হলো, এরপর থেকে করে। প্রথম দুর্ঘটনা তার সাপে কাটার ঘটনাটা, দ্বিতীয় তার নানী মরে যাওয়া। নানী মরে যাওয়া আগে বাগানের গোলাপ গাছে এমন ফুল ফুটেছিল। আবার বড় মামি মারা যাওয়ার আগেও ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল। উপমার বড় মামি মারা গেছেন অ্যাক্সিডেন্ট করে। অ্যাক্সিডেন্টটাও হয়েছিল তাদের এই বাড়িতে।
দুপুরবেলা রান্না করছিলেন মামি। কীভাবে অসতর্কতাবশত গায়ের কাপড়ে আগুন লেগে গেল তার। শাড়ি পরতে খুব পছন্দ করতেন মামি, সাটিনের শাড়ি। মৃত্যুর আগে তার শরীরে সাটিনের শাড়িই জড়ানো ছিল। এসব কাপড়ে আগুন ছড়ায় দ্রুত। মামির বেলায়ও এমন হলো। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে আগুন ভয়ানক রূপ ধারণ করে ফেলল। পরে হসপিটালে নিয়ে যেতে যেতেই..

মামি মরে যাওয়ার পর সমস্ত ঘটনাগুলোর যোগসূত্র মেলানোর চেষ্টা করেছিল উপমা। ঠিক তখুনি খেয়াল করেছিল সব ঘটনার সাথে এই সাদা গোলাপের অদ্ভুত সংযোগ। দুর্ঘটনার আগে যেমন ফুলে ফুলে ভরে যায় পুরো গাছ, তেমনই ঘটে যাওয়ার পরপরই দু তিনদিনের মাথায় ফুলগুলো একসাথে ঝরে পড়ে। একটাও অবশিষ্ট থাকে না ডালে। এটা কি কোনো সংকেত নাকি অন্যকিছু! জানে না উপমা। কেউই জানে না। কিন্তু এরপর থেকে আর কখনোই সাদা গোলাপের চারা নিয়ে আসা হয়নি। আজ বহুদিন পর বোধহয় আনা হলো। এখন কি তবে নতুন কোনো দু*র্ঘটনার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে উপমারা?

রাতে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত রওনক বাড়ি ফিরেছে। ফিরেই গা দিয়েছে বিছানায়। একটানা পরিশ্রমের পর শরীরটা আর চলতে চাইছে না। আজ বিকেলে মাথা ঘুরে উঠছিল বারবার। না পেরে মিজানকে বলে চলে এসেছে। সেদিনের পর এই আজ তার বাড়ি ফেরা;একসপ্তাহ কাটিয়ে। এই সপ্তাহটা ভালো-মন্দ মিলিয়ে কেটেছে। মন্দর চাইতে ভালো কেটেছে বেশি। এর একমাত্র কারণ উপমা। মেয়েটাকে যা জব্দ করা গেছে এই ক’দিন। ওদের অনুপস্থিতিতে ক্লাবে উঁকিঝুঁকি দেয়ার শাস্তি আরকি! চুপচাপ মেনে নেয়ার মেয়ে না ও। কত যুক্তি দিয়ে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল! পরে যখন ওর মামাকে বলে দেয়ার ভ”য় দেখালো তখন সুরসুর করে রাজি হয়ে গেল৷ ওকে ভালো কাজেই লাগিয়েছে রওনক। সভা হবে। ছেলেমেয়েদের প্রয়োজন, প্রয়োজন কিছু হাতে লেখা পোষ্টারের। এই কাজগুলো ও উপমা এবং উপমার বন্ধুদের দ্বারা করিয়েছে। ডেকোরেশনেও টুকটাক সাহায্য নিয়েছে মেয়েটার। মেয়েটা ভীষণ বুদ্ধিমতি। চাপা রাগ পুষে রেখেছে ঠিক রওনকের প্রতি, কিন্তু রওনক জানে কাজে হাত লাগানোর পর এক মুহুর্ত খারাপ লাগেনি মেয়েটার। খুব আগ্রহভরে সব দেখাশোনা করেছে ও। রওনকের থেকে শুনে তো বটেই নিজেও নতুন নতুন আইডিয়া উপস্থাপন করে প্রশংসিত হয়েছে। ছেলেগুলো তো ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাস কিংবা ক্যারম, এমনি আড্ডা বসলেও উপমার নামখানা লেগে থাকে ওদের মুখে৷ মেয়েমানুষ করে গোছানো কাজ। বিন্দুমাত্র অস্থির না হয়ে বড় বড় ঝামেলা নিজ কাঁধে টেনে নেয়। গুছিয়ে সামলে দেয় সবকিছু। তাঁরা প্রশংসা পাবে না তো কে পাবে? উপকার স্বীকার করবে রওনক। এর পাশাপাশি বেশ জ্বালিয়েছেও ও উপমাকে। নিয়ম বেঁধে দেয়া ছিল। প্রত্যেকদিন সকালে কলেজ যাওয়ার আগে রওনকের সাথে দেখা করে সালাম দিয়ে কাজ বুঝে নিতে হবে। ক্লাস শেষে তা কমপ্লিট করে রওনকের কাছে আবার বুঝিয়ে দিয়ে চলে যেতে হবে। প্রতিবেলা ওর সাথে দেখা করার সময় মেয়েটা যেমন কঠিন মুখ করে থাকতো! সুযোগ পেলেই কটমট করে চাইতো রওনকের দিকে।এই দৃষ্টিগুলোই আনন্দ দিতো রওনককে। মেয়েটাকে জ্বা”লাতে ওর কেন যে এত ভালো লাগে কে জানে! স্মৃতিগুলো রোমন্থন করতে গিয়ে এক চিলতে হাসি খেলে গেল রওনকের ঠোঁটের কোনে। সোজা হয়ে শুয়ে চোখ বুজল ও। অতনুকে ধ্বংস করার একটা মাধ্যম বানাতে চেয়েছিল ও উপমাকে। ইদানীং সে ইচ্ছেটাতে ভাটা পড়তে দেখছে। কেন কে জানে!

— ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছো কেন রুনু। শরীর খারাপ?

ভাবীর স্নেহময়ী গলা শুনে চট করে চোখ খুলে ফেলল রওনক। উঠে বসে মাথা ওপর নীচ করে বলল,
— একটু খারাপ ভাবী। মনে হয় জ্বর এসেছে।
চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ছিল হাসনা। জ্বর শুনে ভেতরে ঢুকল। সুইচ বোর্ড খুঁজে লাইট জ্বালিয়ে বিছানায় বসা রওনকের দিকে এগলো। কপালে হাত দিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে বলল,
— তাপ তো আছে। এত অনিয়ম করে চলো। বিনা সিজনে জ্বর বাঁধায় ফেললা।

ভাবীর কথায় হাসলো রওনক।
— জ্বরেরও আবার সিজন হয় ভাবী?
— হয় না! অসুখ-বিসুখেরও নিয়ম কানুন আছে। আমার আম্মা বলতো ঋতুর সাথে সাথে অসুখ বদলায়। একেক ঋতুতে একেক অসুখের প্রকোপ।
মায়ের কথা বলতে বলতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল হাসনার চোখ-মুখ। তা দেখে স্মিতহাস্যে রওনক শুধল,
— সবসময় বাড়ির কথা তোমার মনে পড়ে তাই না ভাবী?

নিশ্চুপ রইলো খানিক হাসনা। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল,
— সবসময় না। কিছু কিছু সময়। হুট করে জীবনটা পাল্টে গেল তো৷ এক কূল আঁকড়ে ধরতে গিয়ে আরেক কূল ছেড়ে এলাম। ও কূলও পথ গুটিয়ে নিলো।
— তোমার কি আফসোস হয় ভাবী?
— আফসোস! আফসোস কিসের? এত ভালো স্বামী, এত ভালো সংসার যার থাকে তার আফসোস কিসের?
— তোমার চোখে জল ভাবী।
হাসবার চেষ্টা করল হাসনা। শাড়ির আঁচল চোখে চেপে ধরে বলল,
— এটাকে আফসোস বলে না রওনক। এর অন্য নাম আছে।
— কি সেই নাম?
— আজ থাকুক সে আলাপ। যেজন্য আসছিলাম। তোমার ভাইয়ার ব্যথাটা আবার বাড়ছে রুনু। একটা হাত তো নাই ই মানুষটার। যেটা আছে সেখানেও কিসের এত ব্যথা! কালকে একটু ডাক্তারের কাছে নিতে পারবা?
— আগে তো সিরিয়াল দেয়া প্রয়োজন। দেখি কয়টা বাজে।
টেবিল ঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে রওনক দেখলো রাতের সাড়ে এগারোটা।
— এই সময় ডাক্তারের চেম্বার খোলা থাকার কথা না। তবুও আমি বের হয়ে দেখি। যদি খোলা পাওয়া যায়৷

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল রওনক।
— খোলা না থাকলে দরকার নাই। কালকেই সিরিয়াল দিয়ে আসিও। এমনিতেই তোমার জ্বর।
— চেষ্টাটা করে দেখি ভাবী। আর পুরুষ মানুষের জ্বর হলো ভাল্লুক জ্বর। এই ঝাঁপায় আসে, এই নেমে যায়। চিন্তার কিছু নাই। ঔষধ তো খাইছি সমস্যা হবে না।
— তবুও..
— বললাম না দুশ্চিন্তার কিছু নাই।
অল্প হেসে আশ্বস্ত করল রওনক। চাপা শ্বাস ছেড়ে “সাবধানে যাইও” বলে প্রস্থান করল হাসনা৷

এক মুহুর্ত আর দেরি না করে ঝটপট তৈরি হয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হাতে রওনকও বেরিয়ে পড়ল। সরকারি হাসপাতালে যাবে আগে। নতুন যিনি এসেছেন,ডাক্তার। শুনেছিল উনি অনেক রাত পর্যন্ত রোগী দেখেন। কে জানে আজ আছেন কি না! রওনক ঠিক করল ওখানেই আগে যাবে। গিয়ে দেখা যাক কি হয়!
____________

সৌভাগ্যবশত হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন ডাক্তার। আরও দু’জন রোগী দেখা বাকি। ভাগ্যিস রওনক এসেছিল! তাই তো পরদিনের সিরিয়াল দেয়া সম্ভব হলো।
হাসপাতালের কাজ মিটে যাওয়ার পর আরও কিছুক্ষণ বাইরে থাকতে মন চাইলো রওনকের। কোথায় যাবে, কোথায় যাবে ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেল কোন এক রাতে ডিসি বাংলোর ওদিকে একটা অপরিচিত বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গান শুনেছিল ও। এতই ভালো লেগেছিল সে গান! অনেক রাত পর্যন্ত বসেছিল ওখানে। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রতিদিন যাবে। কি আশ্চর্য! এতদিন মনেই ছিল না তার। আজ যখন মনে পড়ল তখন তো যাওয়াই যায়! সময়টাও সুন্দরভাবে কেটে যাবে। গান শুনতে না পেলেও ওখানে বসে থাকবে রওনক। এটা তার ইচ্ছে! মুচকি হেসে চট করে গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো রওনক। গন্তব্য অপরিচিত ঐ বাড়ি।
সেদিনের মতো ডিসি বাংলো পেরিয়ে পাড়াটায় তো ঢুকে গেল রওনক। কিন্তু চার মাথার মোড়ে এসে পথ এলোমেলো হয়ে গেল তার। নেশার ঘোরে ঘুরে বেড়ানো গলি এই মুহুর্তে ঝাপসা হয়ে ধরা দিলো। ঠোঁট কামড়ে সে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে খুঁজতে লাগল এমনকিছু যা ওই গলিটার পরিচয় বহন করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য অনেক সময় লাগিয়ে খোঁজার পরও ব্যর্থ হতে হলো তাকে। শেষে সিদ্ধান্ত নিলো প্রত্যেকটা গলিতে একবার ঢু মেরে দেখবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। হোন্ডায় টান দিয়ে একে একে তিনটে গলি ঘুরে দেখা শেষ করল সে। দোতলা বাড়ি অনেক চোখ পড়ল কিন্তু গঠন পরিচিত লাগল না। রইলো বাকি একটা। তার মনে হলো এই গলিতে গেলে অবশ্যই সে তার কাঙ্ক্ষিত বাড়িটা দেখতে পারবে। গতি কমিয়ে মনোযোগ দিয়ে চারিদিক পর্যবেক্ষণ করতে করতে এগোতে লাগল রওনক। এগোতে এগোতেই তার মনে পড়ে গেল বাড়িটার ঠিক অপজিটে একটা শা”টার নামানো দোকান পাওয়া যাবে। ঐ দোকানটাই একমাত্র পরিচয় বহন করছে। বাড়ির চাইতেও দোকান খোঁজা এবার মুখ্য হয়ে গেল রওনকের। বেশিক্ষণ অবশ্য লাগল না সেটা খুঁজে পেতে। মিনিট পাঁচেক হবে। তন্মধ্যেই সে তার কাঙ্ক্ষিত জায়গায় উপস্থিত হতে পারল। ঠিক সেদিনের মতো দোকানের সামনে হোন্ডা রেখে তৃপ্তির সাথে হেসে উঠল রওনক। আজ এগোলো না ঠিক। হোন্ডাতেই হেলান দিয়ে বাড়িটার দিকে দৃষ্টি দিলো। সেদিন বাড়ির সামনে কোনো লাইট ছিল না। আজ আছে। ক্ষীণ আলোয় বাড়ির গেটটা পরিচিত মনে হলো রওনকের। ভ্রু কুঁচকে সে মনে করার চেষ্টা করল এর আগেও কি এসেছিল বাড়িটাতে? আসলেও তা কোন উদ্দেশ্যে? নাহ্ মনে হচ্ছে দিনের আলোয় ঢু মেরে যেতে হবে একবার। স্রেফ গেট দেখে বোঝা যাচ্ছে না কিছু । গেটের ওপাশে তো নিগূঢ় অন্ধকার। সন্ধিৎসু চোখে বাড়িটাকেই দেখে যাচ্ছিল রওনক। গানের কথা আর মাথায় নেই। কিন্তু তা হলে কি হয়? গান শুনতেই তো এসেছিল সে। তা না শুনে অন্য চিন্তায় নিজেকে ডো’বালে তো হবে না৷ মনে করিয়ে দিতেই মিনিটখানেক বাদে সেদিনের মিষ্টভাষিণী সুরের ঝাঁপি খুলে করুণ সুরে আকাশ-বাতাস ভারী করতে গান ধরল,

“যখন বেলা-শেষের ছায়ায়
পাখিরা যায় আপন কুলায়-মাঝে,
সন্ধ্যাপূজার ঘণ্টা যখন বাজে,
তখন আপন শেষ শিখাটি জ্বালবে এ জীবন—
আমার ব্যথার পূজা হবে সমাপন”

গানের কথাগুলি ক্ষীণ হয়ে কানে লাগল রওনকের। সুরটা এত বেদনাবিধুর! চমকিত হয়ে সে চাইল সোজা ছাদপানে। কিন্তু তিমিরের করাল গ্রাস সমস্তটাকে আঁকড়ে ধরে আছে দৃঢ়ভাবে। ওর দৃঢ়তা কাটাতে ব্যর্থ হলো রওনকের চঞ্চল চোখজোড়া। সুরের অধিকারীণির রহস্যময়ী ছায়া আজ আর দৃষ্টিগোচর হলো না। কিসের শূন্যতায় খাঁ খাঁ করে উঠল রওনকের বুক। হোন্ডার সিটে জোর চাপড় মেরে শূন্যতাকে ক্রোধরূপে প্রকাশ করে দিলো রওনক। আজকের রাত যেন অদ্ভুত রাত হয়ে ধরা দিলো তার কাছে।

চলবে,
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here