১🌸
গরম ভাতের মাড় হাতে পড়ে সাথে সাথে ফোস্কা পড়ে যায়। অসহ্য যন্ত্রণায় হাত থেকে ভাতের পাতিলটাও পড়ে যায়। বিকট শব্দের সাথে পুরো মেঝেতে ভাত ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। কিছু ভাত কথার পায়ের উপরও পড়েছে। জ্বালাপোড়া সহ্য করতে না পেরে মা’কে ডাকতে ডাকতে মেঝেতেই বসে পড়ল কথা। তার চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। ঠোঁট কামড়ে ব্যথা সহ্য করতে গিয়ে ঠোঁট কেটে ফেলছে। ঝলসে যাওয়া জায়গা আগুনের মত জ্বালা করছে। রান্নাঘর থেকে শব্দ পেয়ে আশা ছুটে এলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মেঝেতে ভাত ছড়িয়ে থাকতে দেখে তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে উঠল।
-হায় হায়! এটা কী করেছিস তুই? অলক্ষ্মীর ঘরের অলক্ষ্মী! অপয়া মেয়েছেলে। সব ভাত ফেলে দিয়েছিস! এখন গিলবি কী হ্যাঁ?’
আশার কোন কথাই কথার কানে ঢুকছে না। সে হাতে ফুঁ দিয়ে জ্বালা কমানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কথার দিকে আশার চোখ যাচ্ছে না। সে কথার যন্ত্রণা দেখছে না। কথাকে উদেশ্য করে বিলাপ বকে যাচ্ছে সে।
-এতগুলো ভাত! সব ফেলে দিল! কাজের বেলা মহারাণীকে দিয়ে কোন কাজ হবে না। খাওয়ার বেলা কম খাবে না। সব অপয়া আমার ঘাড়ে এসে জুটেছে। আমি কেন মরি না? আল্লাহ আমাকে চোখে দেখে না! আমাকে তুলে নেয় না কেন?’
শিমুল মা’র পেছনে ছুটে এসেছে। মা’র কথা তার কানে যাচ্ছে। কথাকে নিচে বসে কাঁদতে দেখে ওর কাছে ছুটে গেল। বোনের হাতের দিকে নজর পড়তে আঁতকে উঠল শিমুল।
-আপু হাত পুড়ে গেছে তোমার! কখন হলো? আমাকে ডাকলে না কেন?’
শিমুল বোনকে ধরে তুলে বেসিনের সামনে নিয়ে দাঁড় করালো। কল ছেড়ে দিয়ে কথার হাত পানির নিচে ধরে রাখল। কথা ফুঁপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। আশার গালাগালি এখনও থামছে না। শিমুল রেগে মা’র দিকে তাকালো। তারপরও দমে যাওয়ার ব্যক্তি আশা না। সে ছেলেকে ভয় পায় নাকি? তার এত বড় ক্ষতি করেছে মেয়েটা। এমনি এমনি ছেড়ে দিবে অলক্ষ্মীটাকে!
-তোদের ভাইবোনের সোহাগ দেখে আমার চোখ কানা হোক। কীভাবে আমার সংসার ভাসিয়ে দিতে পারবি দুইটা মিলে ওই ফন্দিই করিস সারাক্ষণ।’
শিমুল রাগান্বিত মুখ তিনটা ডিম বের করে আনলো। সে শুনেছে ডিম লাগালে জ্বালা কমে। তা দেখে আশা হায় হায় করতে লাগল।
-কী করছিস তুই? তিনটা ডিম! ডিমগুলো নষ্ট করছিস কেন? হাত পুড়েছে পুড়ুক না। আমার ক্ষতি কেন করছিস?’
শিমুল লবণের বয়াম এনে কথার হাতের পুড়ে যাওয়া জায়গা লবণ লাগিয়ে আস্তে ধীরে ফুঁ দিয়ে দিচ্ছে।
-এখনও জ্বলছে? আমি ফার্মেসি থেকে আলম ভাইকে বলে ঔষধ নিয়ে আসছি। তুমি ঘরে আসো।’
-ঔষধ যে আনবি টাকা পাবি কোথায়? আমি একটা টাকাও দিব না। আমার হাত খালি। তোদের নাটক দেখে আমার সংসার চলবে না।’
শিমুল খেঁকিয়ে উঠল,
-মা তুমি চুপ করবে! আর একটা কথা বললে খারাপ হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি।’
-তুই আমাকে চোখ রাঙাচ্ছিস! আমাকে! আমি তোর মা…
-মা বলেই এখনও কিছু বলিনি। তোমার সামনে কোন মানুষ মরে গেলেও তোমার খারাপ লাগবে না। নাহলে এই সময় এসব কথা তুমি কীভাবে বলতে পারছো!’
শিমুল বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে আশা কথাকে নানান কথা শোনাতে লাগল।
-আমার ছেলের মাথা তো খেয়েছিসই। আর কী করবি? ওকে লেলিয়ে দিয়ে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবি? এটাই তো চাস তুই। তোকে আমি চিনি না! তোর বাপ মরে উদ্ধার হয়েছে। আমার ঘাড়ে আপদ চাপিয়ে দিয়ে গেছে।’
————
শিমুল হাঁপাতে হাঁপাতে ফার্মেসির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রোদে ছেলেটার মুখ লাল হয়ে গেছে। ঘনঘন দম নিয়ে শ্বাস নিয়মিত করছে। আলম ওকে দেখে খানিকটা চিন্তিত হলো। কী হয়েছে শিমুলের?
-কী হয়েছে শিমুল?’
-আলম ভাই, আপুর হাত পুড়ে গেছে। অনেকটা পুড়েছে। ফোসকা পড়ে গেছে।’
-এ বাবা! কীভাবে পুড়ল?’
-ভাতের ফেন হাতে পড়েছে।’
-ওকে রাঁধতে কে বললো বল তো! কথাটা যে কী করে।’
আলম ঔষধ দিতে দিতেই সোহান এসে দোকানের সামনে বেঞ্চে বসল। শিমুলের দিকে দেখে বলল,
-কী হয়েছে রে শিমুল?’
-আপুর হাত পুড়ে গেছে। ঔষধ নিয়ে যাচ্ছি।’
সোহান বসা থেকে দাঁড়িয়ে উঠল। চিন্তিত ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো।
-অনেকটা পুড়েছে?’
-হু।’
-কী লাগিয়েছিস?’
-ডিম, লবণ লাগিয়েছি। ফ্রিজ নষ্ট বরফ দিতে পারিনি।’
আলম ঔষধ দিতে দিতে বলল,
-উঁহু, পোড়া জায়গায় এসব লাগালে লাভের থেকে ক্ষতিই বেশি হয়। এসব না লাগিয়ে শুধু ঠান্ডা পানি দিলেই হবে।’
সোহান আলম ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-তুমি ঔষধের টাকাটা লিখে রাখো তো আলম ভাই। আমি এসে দিচ্ছি। চল শিমুল।’
————–
নাহিদ চৌধুরী সকালের শেষ কাপ চা শেষ করে ঘর থেকে বেরুলেন। আজ অফিসে যাবেন না তিনি। আজ তিনি ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে যাবেন। মেয়েটার ছবি দেখেছেন উনি। ছবি দেখেই ভালো লেগে গেছে। আজ সরাসরি দেখতে যাবেন। এই মেয়ের খোঁজ তাকে যে ঘটক এনে দিয়েছেন তার কাছ থেকে জানা গেছে, মেয়ের বাবা বেঁচে নেই। নিজের মা-ও ছোট বেলায় মারা গেছে। এখন সৎমা আর দুই ভাইয়ের সাথে আছে। মেয়েটার নাম সম্ভবত কথা। নাহিদ চৌধুরী কাঁচা কাজ করেন না। তিনি তার ম্যানেজারকে দিয়ে সমস্ত খোঁজ খবর নিয়ে রেখেছেন। ছেলের ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে আসার সময় লক্ষ করলেন এখনও দরজা বন্ধ। ক’টা বাজে? ঘড়ি দেখলেন তিনি। এগারোটা পঁচিশ। এখনও ঘুমাচ্ছে ও! কপাল কুঁচকে উঠলো উনার। রোজ রোজ বাড়িতে থাকেন না বলে দেখেন না। আজ চোখের সামনে দেখেও কিছু করার নেই।
হলরুমে সোফায় এসে বসলেন তিনি।
-রমিজা।’
-কিছু লাগব স্যার?’
-উঁহু। নীড় এখনও উঠেনি?’
-না। ছোড স্যার এই সময় উডে না।’
-কখন উঠে? কয়টা বাজে এখন?’
রমিজা চুপ করে রইল। নাহিদ চৌধুরীর তিরতির করে রাগ উঠে যাচ্ছে।
-যাও ওকে ডেকে তুলো।’
-বারোটা বাজার আগে ছোড স্যাররে ডাকা নিষেধ।’
-কে নিষেধ করেছে?’
-ছোড স্যার।’
নাহিদ চৌধুরীর কপাল কুঁচকে গেল। বাড়ির কাজের লোক গুলোকেও হাতে নিয়ে রেখেছে!
-আমি বলছি তুমি ডাকো ওকে।’
-মাফ করবেন স্যার। তয় এই কাজ আমি পারমু না।’
-পারবে না! কেন?’
-তাইলে ছোড স্যার আজই আমার চাকরি খাইব।’
হতবিহ্বল চিত্রে নাহিদ চৌধুরী কাজের লোকের দিকে চেয়ে রইল।
-এই বাড়ির মালিক কে?’
-আপনি।’
-তোমাকে কাজে কে রেখেছে?’
-আপনি।’
-তোমার বেতন কে দেয়?’
-আপনি।’
-কার হুকুম সবার আগে মানবে তুমি? আমার নাকি আমার ছেলের?’
-আপনার।’
-তাহলে! এখন তুমি কার হুকুম মানছো? তোমাকে কাজ থেকে শুধু আমি বের করতে পারব। অন্য কেউ না। এখন যাও। ডাকো ওকে। নবাবজাদা বেলা বারোটা পর্যন্ত ঘুমোবে! তার আগে কেউ ডাকলে চাকরি খাবে! আমার বাড়িতে কত বিশাল রাজ ওর!’
রমিজা চুপসে যাওয়া মুখে নিজের ইচ্ছে আর ছোড স্যারের কথার বিরুদ্ধে গিয়ে বড় স্যারের কথা মত দোতলার দিকে পা বাড়াল। বুক ধড়ফড় করছে ওর। বড় স্যার না জানুক সে তো জানে, এখন ছোড স্যারের ঘুম ভাঙানো মানে যমরে খুঁচানো একই কথা। ঘুম ভেঙে সবার আগে তার চাকরিটা খাবে। বড় স্যার যতই বলুক, এই বাড়িতে ছোড স্যারের রাজত্বই চলে। দোয়া দুরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে রমিজা নীড়ের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। দরজায় শব্দ করতে বুক কাঁপছে। ঠুকঠুক করে দরজায় শব্দ করে ডাকছে রমিজা।
-ছোড স্যার! ও ছোড স্যার!’
এর থেকে বেশি জোরে ডাকার সাহস হচ্ছে না। রমিজা আবার ডাকল,
-ও ছোড…
ভেতর থেকে বাজখাঁই গলায় নীড় ধমক দিয়ে বলল,
-রমিজা আজই তোমার চাকরির শেষ দিন।’
রমিজা নিজের চাকরি বাঁচানোর জন্য তাড়াহুড়ো করে ধরা গলা বলতে লাগল,
-আমার কোন দোষ নাই। বড় সাহেব…আপনার বাবা আপনারে ডাকতে কইছে। ছোড স্যার!’
-এখনও কথা বলছো তুমি! গেলে না এখান থেকে।’
রমিজা ফিরতি পথ ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় নিজেই বলছে,
-হাজার টাকা বেশি দিলেও এই বাড়িতে আর কাজ করমু না। বাপে ধমকায়, ছেলে ধমকায়। আমার হইছে ধমক খাওয়ার কপাল। বাপে কয় না ডাকলে চাকরি খাইব, পোলা কয় ডাকলে চাকরি খাইব। কই যামু আমি?’
নাহিদ চৌধুরীর ম্যানেজার এসে বিনীত ভঙ্গিতে উনার সামনে দাঁড়াল। উনি কপালের ভাঁজ মুছে ম্যানেজারের দিকে দৃষ্টি দিলেন।
-কী ম্যানেজার! সব ঠিকঠাক?’
-জি স্যার।’
-কখন যাব আমরা?’
-আপনি যখন বলবেন। ঘটকের সাথে আমার কথা হয়েছে। আগে থেকে ওদের কিছু জানাবে না। আমরা হুট করে গিয়ে উঠব।’
-হুম। আমি দেখতে চাই… বলতে বলতে কোন ভাবনায় ডুবে গেলেন তিনি।
———-
শিমুলের সাথে সোহানকে দেখে আশা তেতে উঠল। এই ছেলেটার কথার জন্য এত দরদ কেন? দরদ একেবারে উথলে পড়ছে। সামান্য একটু পুড়ে গেছে কি না গেছে এতেই একেবারে ডাক্তার নিয়ে টানাটানি লেগে গেছে। শিমুল এসে কথার পাশে বসল। কথা এখন আর কাঁদছে না। যন্ত্রণা সয়ে এসেছে। সোহান কথার দিকে তাকিয়ে কোমল সহানুভূতি মাখা গলায় বলল,
-অনেকখানি পুড়েছে কথা? কষ্ট হচ্ছে তোর?’
-এখন আর কষ্ট হচ্ছে না সোহান ভাই।’
-কই দেখি। আমাকে দেখতে দে একটু।’
কথা হাত বাড়িয়ে দিল। ফোসকা পড়া লাল জায়গাটার দিকে তাকিয়ে সোহানের মনটা কেঁদে উঠল। এতটা পুড়ে যাওয়ার পরও কথা বলছে এখন আর কষ্ট হচ্ছে না! মেয়েটা কি পাথর!
-তুই কেন ভাত রাঁধতে গেলি! রান্নাবান্না কি তোর কাজ?’
আশা প্রতিবাদী করে বলে উঠল,
-ও রাঁধবে না, তোমার বউ এসে রেঁধে দিয়ে যাবে? বিয়েও তো করোনি। বাদাইম্মা হয়ে এ বাড়ি,ওর বাড়ির ব্যাপারে নাক গলাও। তোমাকে তো এখানে কেউ আসতে বলেনি।’
এই মহিলার কথায় সোহান কিছুই মনে করল না। মানুষ মরে গেলেও স্বভাব পালটায় না। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। এই মহিলাও কিছুটা তেমন। কথাটা এত করে তবুও মন পায় না।
শিমুল সোহানের অপমান সহ্য করতে পারলো না। তার নজরে সোহান ভাইয়ের সম্মান অন্যরকম।
-মা তুমি সোহান ভাইয়ের সাথে এভাবে কথা বলতে পারো না।’
আশা শিমুলের উপর চটে গিয়ে সোহানকে আরও অপমান করার আগে কথা বলল,
-সোহান ভাই, তুমি চলে যাও। আমি এখন ভালো আছি। জ্বালাপোড়া কমে গেছে। শিমুল তো ঔষধ নিয়ে এসেছে। ওটাই লাগিয়ে নিব।’
-এখনই লাগিয়ে নে। হেলাফেলা করিস না কথা।’
-হুম।’
চলবে🌸
#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব-১|
আসসালামু আলাইকুম
নতুন গল্পের প্রথম পর্ব। যাদের কাছে পৌঁছুবে রেসপন্স করার চেষ্টা করবেন।
নয়নতারা গল্পটাও লিখব। কাল পরশু ওটার নতুন পর্ব পেয়ে যাবেন। আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশা করছি।
আমার গ্রুপ জয়েন হবেন।
‘
https://facebook.com/groups/928548141001685/