#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ১০|
-শুনলাম বিয়ে করেছিস!’
নীড় অবহেলিত দৃষ্টিতে একবার সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকাল। কিছু বলল না। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে হাতে থাকা গ্লাসে এক চুমুক দিল। এটা এখানে এসেছে কেন? আগুনে ঘি ঢালতে এসেছে? সৌভিক নীড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
তাচ্ছিল্য ভরা গলায় নীড় বলল,
-কী চাই?’
-বিয়ের দাওয়াত নাহয় না-ই দিলি। এখন কি ভালো করে দু’টা কথাও বলবি না?’
হাসল নীড়। ভ্রু কুঁচকে সৌভিকের দিকে দেখল।
-আমার সাথে তোর কী কথা থাকতে পারে।’
সৌভিক টুল টেনে এনে নীড়ের সামনে বসলো। কাউন্টারে নিজের জন্য বিয়ার অর্ডার দিয়ে নীড়ের দিকে ধ্যান দিল।
-কত কথাই তো থাকতে পারে। এককালে তোর এমন কোন কথা ছিল না যেটা আমার অজানা ছিল। তোর সবই আমি জানতাম।’
-ফালতু বকার জন্য এসেছিস এখানে!’
সৌভিক এমন ভাবে হাসল তাতে নীড়ের গা জ্বলে গেল।
-আরে না, না। বিয়ের শুভকামনা দিতে এসেছি। বউদিকে আমার তরফ থেকে ভালোবাসা ও শুভকামনা জানাবি।’
-হু।’
-তা বউদিকে আমাদের দেখাবি না। আমরাও একটু দেখি শেষমেশ কোন মেয়ের কপাল পুড়লো। মেয়েটার কথা ভেবে বড্ড আফসোস হচ্ছে রে। জীবটাই নষ্ট হলো ওর।’
নীড়ের মাথায় তিরতির করে রাগ উঠে যাচ্ছে। সৌভিকের খোঁচা দেওয়া কথা ওর সহ্য হয় না।
তারপরও নীড় মুখে হাসি রেখে বলল,
-আমার বউয়ের জন্য তোর দেখছি ভীষণ দরদ।’
-দরদ থাকবে না! বলছিস কী তুই? আমি তো জানি, তুই যে মেয়েকেই ছুঁয়ে দিবি সেই মেয়েই কয়লা হয়ে যাবে। জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হবে। তোর সাথে থাকলে আগুনে পুড়তে হবে সারাজীবন।’
নীড় নিজেকে আর সামলে রাখতে পারল না। নিজের বসার জায়গা করে উঠে সৌভিকের কলার ধরে ওকেও দাঁড় করিয়ে ফেলল।
-আর একটা বাজে কথা বললে আমি তোর জিব ছিড়ে ফেলব।’
সৌভিক হাসছে। নীড়কে তড়পাতে দেখলে ওর মনটা শান্তি পায়। হাসতে হাসতেই বলল সে।
-সত্য কথা ভীষণ তেতো হয়। হজম করা যায় না। তোরও হজম হচ্ছে না, তাই না! তুই এত সহজে সবকিছু ভুলে যাস কীভাবে? ওই মেয়েটার জীবনটাও নষ্ট করিস না যেন। মেয়েদের জীবন নিয়ে খেলা করা তোর পুরোনো অভ্যাস।’
নীড় মুঠো পাকিয়ে সৌভিকের চোয়ালে এক ঘা বসিয়ে দিল। সৌভিক দূরে গিয়ে মেঝেতে ছিটে পড়ল। নীড় নিজের উপর থেকে সম্পূর্ণ কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছে। ক্ষেপে গিয়ে সৌভিকের দিকে এগোচ্ছে সে।
সৌভিকের ঠোঁট কেটে গেছে। বাঁ হাত দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে সে বলল,
-এর আগেও তোর জন্য একজন আগুনে পুড়েছে। তা হয়তো তুই ভুলে গিয়েছিস। কিন্তু আমি ভুলিনি। আর না কখনও ভুলব। আমি নিজেও ভুলব না। তোকেও ভুলতে দিব না। তুই একটা খুনি। নিজেকে কতদিন লুকিয়ে রাখবি তুই? বিবেকের কাঠগড়ায় একদিন তোকে দাঁড়াতেই হবে। সেদিন বাপের টাকার জোরে বেঁচে যেতে পারবি না। আমার সাধ্য থাকলে আমি নিজের হাতে তোকে খুন করতাম।’
—————
আশা আম আর পেয়ারা কেটে এনে কথার হাতে দু’টা প্লেট ধরিয়ে দিল। কথা চোখ বড় বড় করে একবার প্লেটের দিকে একবার আশার দিকে দেখল। বিশ্বাস হচ্ছে না তার। মা আজ তার এত খাতিরযত্ন করছে! বাবা! আগে তো কথা দু’দিন না খেয়ে থাকলেও বলত না যে, খেয়ে নে। আজ আসার পর থেকে পকোড়া বানিয়ে দিল। শিমুলকে দোকানে পাঠিয়ে আইসক্রিম আনিয়ে দিল। কথা একাই তিনটা আইসক্রিম খেতে চাইলে ওর জন্য দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে বলল,
‘একেবারে তিনটা খাস না। ঠান্ডা লেগে গলা ব্যাথা হবে। ফ্রিজে রেখে রেখে খা।’
মা আজ এটা বলল না,
‘রাক্ষস মেয়ে। তুই একা তিনটা খাবি কেন? আমাদের কারো পেট নেই? একটা নিয়ে বাকি দু’টা রাখ। নইলে আজ তোর রাতের খাবার বন্ধ।’
এখন আবার আম, পেয়ারা কেটে ঘরে এসে দিয়ে গেল। বিয়ের পর তার সম্মান এতটা বেড়ে যাবে জানলে কথা আরো আগে বিয়ে করে নিত। অন্তত মা’র ক্যাচ ক্যাচ থেকে বাঁচার জন্য হলেও সে বিয়ে করত। কথাকে হাঁ করে চেয়ে থাকতে দেখে আশা বলল,
‘হাঁ করে আমার মুখের দিকে কী দেখিস? আম খা। শিমুল রান্নাঘর থেকে একটু মরিচের গুঁড়া আর লবণ এনে দে। আগে অনুদের গাছ থেকে পেয়ারা এনে যেভাবে মাখিয়ে খেতি, ওভাবে খা।’
‘আজ তোমার কী হলো বলো তো?’
বিরক্ত হয়ে আশা বলল,
‘আমার আবার কী হবে?’
‘আমার অত খেয়াল রাখছ। অত যত্ন করে খাওয়াচ্ছ। ফল কেটে এনে হাতে দিচ্ছ। আগে তো এসব কিছুই করতে না।’
‘করব না? শ্বশুরবাড়ির মেয়ের খেয়াল রাখতে হবে না?’
‘আমি শ্বশুরবাড়ির মেয়ে না। এই বাড়ির মেয়ে।’
‘কিন্তু এখন তো শ্বশুরের আদরের বৌমা। আদরের না হলে কি বিয়াই এতকিছু পাঠাত! মাছ,মাংস,চাল,ডাল বাজার সদাই থেকে ধরে রান্নাবান্নার প্রতিটা জিনিস কম করে হলেও এক মাসের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমাদের সবার জন্য দামী দামী জামাকাপড়, জুতা, তুই বাড়িতে না থাকলে আমার তো আর মেয়ে নেই। তবু মেয়েদের সাজগোজের জিনিস দিতেও ভোলেননি।’ মুখ লাল হলো আশার, ‘নিশ্চয় বিয়াই আমার জন্যই পাঠিয়েছেন। বাজারের এমন কোন ফল বাদ রাখেননি। যেসব ফলের এখন সিজন না ওসবও পাঠিয়েছেন। বিয়াই আমার বোঝেন কীভাবে বাপের বাড়িতে ছেলের বউয়ের মান রাখতে হবে। তোর কপালটা কত ভালো রে কথা। আমার মত পোড়া কপাল না। পোড়া কপাল না হলে কী তোর বাপের কাছে এসে পড়তাম। লোকটা না পারল আমাকে ভালো কিছু খাওয়াতে আর না পারল পরাতে। সারাজীবন কষ্টই করে গেলাম। এখন তোকে দিয়ে যদি একটু সুখ করতে পারি। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে আমাদের ভুলে যাস না কথা। মা ভাইদের কথাও একটু মনে রাখিস। কষ্ট করে পেলে তোকে বড় করেছি। এতটুকু প্রতিদান তো দিতেই পারিস।’
কথা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘শিমুল কই? আসার পর থেকে ওকে দেখলাম না? বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছ নাকি?’
‘ওই হারামজাদাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারলেও তো আমার শান্তি হতো। শয়তানটা তো মরেও না। আমাকে জ্বালানোর জন্য আল্লাহ ওকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছে। অত সহজে ওইটার হাত থেকে নিস্তার পাব না। দেখ গিয়ে সাথের বদমাইশ গুলোর সাথে বসে কোথাও মোবাইল টিপছে।’
পলাশ বলল,
‘ভাই মোবাইলে গেম খেলে মা। ফ্রি ফায়ার গেম।’
‘ওর ওই মোবাইল আমি যতদিন চুলায় না ফেলি ততদিন আমার শান্তি হবে না।’
————
কথার এখনও পেয়ারা খাওয়া শেষ হয়নি। প্লেটে বেশি অর্ধেক পড়ে আছে। হঠাৎ কী মনে পড়ে গেলে খেতে খেতে কথা দাঁড়িয়ে গেল। পলাশ এখনো তৃপ্তি করে আম খাচ্ছে। তার হাত গড়িয়ে আমের রস কনুই পর্যন্ত গিয়ে পৌচেছে। মুখের আশেপাশেও আম দিয়ে লেপ্টে লুপ্টে নাজেহাল অবস্থা। ওকে দেখে কথা ফিক করে হেসে ফেলল। কথাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে শিমুল ওর দিকে চেয়ে বলল,
‘কোথায় যাও আপু?’
‘অনু শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে?’
‘না।’
‘চল অনুর সাথে দেখা করে আসি। কাল সকালে চলে গেলে তো আর দেখা করতে পারব না।’
‘আমি এখন আম খাচ্ছি। তুমি যাও।’
‘আচ্ছা তোর যেতে হবে না। খা তুই। মা ডাকলে বলবি আমি ঘরেই আছি।’
‘হুম।’
কথা আশার চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল। এখন মা’র সামনে পড়া মানেই হাজারটা প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার। ওসব প্রশ্নের উত্তর তার নিজের কাছেও নেই। দেখা গেল শেষ পর্যন্ত মা তাকে যেতেই দিল না। তাহলে আর বেচারি অনুর পা ঠিক হলো কিনা জানা হবে না। ওর বুড়ো ষাঁড় শ্বশুরটা বেচারির পা-টাই ভেঙে দিয়েছে। কোন শব্দ না করে, চুপিচুপি রান্নাঘরের সামনে দিয়ে পা টিপে যাওয়ার সময় আশা ডেকে উঠল,
‘কথা, কই যাস তুই?’
‘এইরে…
শক্ত করে চোখ বুজে জিভ কামড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল কথা। রান্নাঘরের ভেতর থেকে আশার গলা আবার শোনা গেল।
‘কিরে কথা বলছিস না কেন? এই সময় কই যাস হ্যাঁ?’
‘কাকীদের বাড়ি। অনুকে দেখতে। এক্ষুনি চলে…
ওর কথা শেষ হওয়ায় আগেই আশা বলল,
‘আচ্ছা যা। তাড়াতাড়ি চলে আসিস। দেরী করিস না বুঝলি।’
‘হুম। যাব আর আসব।’
মা তাকে রাতে কাকীদের বাড়ি যাবার জন্য অনুমতি দিয়েছে! আজকে সব আশ্চর্য কারবার ঘটছে। মা’কে ভূতে ধরেছে নাকি? তার কোন কিছুতেই বাধা দিচ্ছে না! আজ মারবে তো দূর বকছেও না। মুখ কালো করে একটা কথা বলছে না! তাকে কোন কাজ করতে দিচ্ছে না! মা তো সুস্থ নেই। কী হলো মা’র?
নিচের ঠোঁট কামড়ে ভাবতে ভাবতে কথা উঠান পেরিয়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল।
অনুদের উঠানে পা দিয়েই কথা অনুর মা’র সামনে পড়ল। মহিলা কথাকে দেখে খুশি-খুশি গলায় বললেন,
‘কিরে কথা, তুই কখন এলি?’
‘বিকেলে।’
‘জামাই কই?’
‘বাড়িতে।’ কথা নীড়ের নিজের বাড়ির কথা বললেও কাকী ভেবে নিয়েছে কথাদের বাড়িতে। তাই তিনি আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।
‘কাকী অনু কই?’
‘ঘরেই তো৷ যা দেখা কর গিয়ে। তোকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর অনুর কান্না থামায় কে? ওর সে কী কান্না!’
হাসতে হাসতে কাকী বললেন, ‘মনে হচ্ছিল তোর না ওরই যেন বিদায় হচ্ছে। নিজের বিয়েতেও এতটা কাঁদেনি যতটা তোর বিয়েতে কেঁদেছে।’
দরজার সামনে কথাকে দেখে অনু খুশিতে চিৎকার করে উঠল,
‘কথা তুই কখন এলি?’
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে কথা বলল,
‘এক প্রশ্নের উত্তর আর কয়বার দেব? বিকেলে এসেছি।’
‘তোর বর এসেছে? ভেতরে নিয়ে আয়।’
কথা হেসে ফেলল।
‘ব্যস্ত হোস না৷ মাথায় ঘোমটা দিয়ে তোকে নতুন বউ সাজতে হবে না। উনি আসেননি।’
‘তুই কিরে! তোর বরের উপর আমি নজর দেব নাকি? নিয়ে এলি না কেন? বেচারাকে একা বাড়িতে বসিয়ে রেখে এসেছিস।’
কথা শব্দ করে হাসতে লাগল৷ অনু বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বলল,
‘পাগলের মত হাসছিস কেন? শ্বশুরবাড়ি গিয়ে পাগল টাগল হয়ে গেলি নাকি?’
‘বেচারা কাকে বলছিস তুই? উনি বেচারা হলে সত্যিকারের বেচারাদের কী বলবি?’
‘মানে?’
‘মানে কচু। উনি আমার সাথে আসেনি। আমি একা বাড়ি এসেছি।’
চলবে🌸
বিঃদ্রঃ সবার গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।