#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ২|
কথা ফোসকা পড়া হাত নিয়েই ঘরের সব কাজ করেছে। মলম লাগিয়ে নেওয়ায় জ্বালা পোড়া কম হলেও কোনকিছুর সাথে ঘষা লাগলেই আত্মা বেরিয়ে যাচ্ছে। এক হাতেই কোনোরকমে কাপড় গুলো কেঁচে রোদে শুকাতে দিল। হাতটা টনটন করছে। কথার মাঝে মাঝে সত্যিই আফসোস হয়।
-ছোটবেলায় তুমি মারা না গিয়ে আমি মরলেই বেঁচে যেতাম। শিশুদের তো কোন পাপ থাকে না। বেহেশতেই যেতাম। বেঁচে থেকে এখন কী করছি দেখো? তার থেকে ভালো ছিল না মরে গিয়ে সুখে থাকা!’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল কথা। সে মাঝে মাঝে কল্পনা করে, তার নিজের মা বেঁচে থাকলে জীবনটা হয়তো অন্যরকম হতো। মা নিশ্চয় তাকে খুব ভালোবাসতো৷ সবার মা’ই তো বাসে। বাবার কথা মনে পড়লেও কথার কষ্ট হয়। মা’কে নাহয় আল্লাহ নিয়ে গেছে বাবাকে কেন তার কাছে রাখল না। বাবাকেও নিয়ে গেল। যখন বাবা ছিল তখন তার এত কষ্ট ছিল না।
-ও নবাবের বেডি! দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কোন ধ্যান ধরছো? এক কাপড় ধুয়েই সারাদিন পার করবা! আর কাম নাই ঘরে? কাম চোর মেয়েছেলে।’
কথাকে উঠানের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আশা বারান্দা থেকে গলা ছাড়ল। এইরকম ফাঁকিবাজ মেয়ে আশা কমই দেখেছে। একটা কাজে হাত দিয়ে দিন পর করে ফেলে। বসে বসে গিলা শুধু। কাজের বেলা ঠনঠন।
-আমি যাওয়ার পর খালি বাড়ি ফেলে তুইও সফরে বেরুস না। আমি এসে বাড়ি ফাঁকা পেলে ঠ্যাং ভেঙে ফেলব তোর।’
-হু। কই যাও তুমি?’
-তোরে বলে যেতে হবে?’
-ফিরতে দেরি হবে? রাতের জন্য কী রাঁধব?’
-আমি একটু পরেই এসে পড়ব।’
-আচ্ছা।’
-পলাশটা আবার কই গেল! একটা কাজের সময় ছেলেটাকে কাছে পাই না। ভাই বোন তিনটাই একরকম হয়েছে। কাম চোর। আমার হয়েছে যত জ্বালা। বাইরে ঘরে একসাথে সামলাতে হবে। আল্লাহ আমাকে কেন চোখে দেখে না।’
বকবক করতে করতে আশা গেট পেরিয়ে বেরিয়ে গেল। আশা চোখের আড়াল হতেই কথা মুখ মুচড়ে উঠল। ভেঙ্গচি দিয়ে বলতে লাগল,
-ভাই বোন তিনটাই কাম চোর! নিজে যে কাজের মানুষ, উহম ঢঙ! আল্লাহ তোমাকে কীভাবে দেখবে হ্যাঁ? খারাপ মানুষকে আল্লার সহজে তুলে নেয় না। অনেক বছর বাঁচিয়ে রেখে তারপর নেয়।’
কথা গুনগুন করতে করতে ঘরে চলে গেল। মেয়েটার যত কষ্টই থাকুক বাইরে থেকে তাকে দেখে কেউ বলতে পারবে না। ও নিজের সাথে তার আশেপাশের মানুষদেরকেও ভালো রাখতে পারে। আশা ওকে যতই বকুক,কথা শোনাক, কথা ওসব মনেই রাখে না। এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়। জীবনের মানেটা ওর কাছে ভীষণ সুন্দর। হ্যাঁ মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়। তবে সেটা ক্ষণিকের জন্য। তার মন খারাপ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। একটাই তো জীবন, কী হবে কষ্ট পেয়ে?
ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদু বায়,
তটিণী-র হিল্লোল তুলে কল্লোলে চলিয়া যায়,
পিক কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে কুউহু কুউহু কুউহু গায়,
কি জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায় হায়….
হুম-হুহুহু-হুহুমহু… না-নানা… ফুলে ফুলে…হায়!
——————–
সাওয়ার সেরে কোমরে তোয়ালে পেঁচিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো নীড়। মাথা মুছতে মুছতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বেডের উপর তোয়ালে ছুঁড়ে রেখে দু-হাত কোমরে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তীক্ষ্ণ চোখে আয়নার নিজেকে দেখছে। ধীরে ধীরে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। এক মাস হবে জিম ছেড়ে। তবুও বডি ফিড আছে। কত কসরত করে এই বডি বানানো! তারপরও এভাবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলে তৃপ্তি পাওয়া যায়। রেডি হয়ে ফোন হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো নীড়। সিঁড়ি বেয়ে নামার ফাঁকে ফোনের স্ক্রিনে টাইম দেখে নিল। দু’টা বাজে! আজ একটু দেরি হয়ে গেছে। ব্রেকফাস্টের সময় পেরিয়ে লাঞ্চের সময়ও পেরিয়ে যাচ্ছে। ডাইনিং সাজানো থাকলেও নীড় ওদিকে গেল না। দরজার দিকে যাচ্ছে ও। ওকে চলে যেতে দেখে মতিন চাচা পেছনে ডাকল।
-নীড় বাবা, খাইবা না?’
নীড় দাঁড়াল। চাচার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
-না। বাইরে খেয়ে নিব। তোমাদের খাওয়া হয়েছে?’
-হুম। খাইয়া যাও। বাইরের খাওন ভাল না। তোমার শরীর খারাপ করব।’
নীড় কিছু ভাবল। ফোন পকেটে রেখে হাসল। বলল,
-জলদি জলদি দাও। আমার তাড়া আছে।’
এই মানুষটার কথা কখনও ফেলতে পারে না নীড়। মতিন চাচা তার মা’র দিকের লোক। মা’র বিয়ের পর থেকেই এখানে আছে। ছোটবেলা থেকে তাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। মা’র অভাব বুঝতে দেয়নি। বাবার ভালোবাসা এই মানুষটাই তাকে দিয়েছে। এখন সে বড় হয়েছে। মানুষটার জন্য তারও কিছু দায়িত্ব আছে। মতিন চাচা নীড়ের পাশের চেয়ারটায় বসে ওকে খেতে দেখছে। ছেলেটার সব কিছুই উনার কাছে ভালো লাগে। এইযে এখন খাচ্ছে, মতিন চাচার কাছে এর থেকে সুন্দর সুখময় দৃশ্য পৃথিবীতে আর নেই। খেতে খেতে ছেলেটা যখন কথা বলছে, মনটা তৃপ্তিতে ভরে যাচ্ছে। পুরুষ মানুষের হাসি এত সুন্দর হয় এই ছেলেকে না দেখলে মতিন চাচা জানতো না। বড় সাহেব যে কেন ছেলেটার সাথে অকারণে রাগারাগি করে! নীড় যখন ‘মতিন চাচা’ বলে ডাকে তখন মনে হয় এই পৃথিবীতে এই ডাকের থেকে মধুর ডাক আর নেই। মতিন বিয়ে করেনি। এক সময় একজনকে ভালোবেসেছিল সে। তাকে হারিয়ে অন্য কাউকে নিয়ে সংসার বাঁধার ইচ্ছে হয়নি। তবে এখন তার ইচ্ছে হয়, নীড়ের মত একটা ছেলে যদি তার থাকতো। তাকে বাবা ডাকত।
খেতে খেতে নীড় মতিন চাচাকে দেখল। সহজ গলায় বলল,
-তোমার বড় সাহেব আজ অফিসে যায়নি?’
-না। বাড়িতেই আছে। এখন মনে হয় ঘরে।’
-তাইতো সকালে রমিজা আমাকে ডাকার সাহস করেছে।’
-অত বেলা করে কেউ ঘুমায়! শরীর খারাপ করব।’
-রাতে একদম ঘুম হয়নি।’
রাতের কথা মনে পড়ে মতিন চাচার মুখ শক্ত হয়ে গেল। কাল রাতে সে-ই দরজা খুলে দিয়েছিল। নীড়কে ওই অবস্থায় সে-ই ঘরে দিয়ে এসেছিল। ছেলেটার হুস ছিল না তখন। বদ্ধ মাতাল হয়ে ফিরেছিস। বড় সাহেব কাল রাতের ব্যাপারে এখনও কিছু জানে না। জানলে আজ এই বাড়ির সকাল কীভাবে ঘটতো তা কেউ জানে না। মতিন চাচার চেহারার পরিবর্তন হতে দেখল নীড়। কিছু বলল না সে। মাথা নিচু করে খেয়ে নিল।
-ওসব ক্যান খাও?’
-কষ্ট কমাতে। আমার অনেক কষ্ট। তুমি তো সবই জানো।’
-ওসব খেলে কষ্ট কমে?’
-উঁহু, কষ্ট কী অত সহজে কমে? তবে সাময়িক সময়ের জন্য কষ্ট ভুলে থাকা যায়।’
-আমার একটা কথা রাখবা? ওইসব জিনিস আর খাইও না।’
-তোমার কথা রাখার চেষ্টা করব। কতটুকু রাখতে পারব তার গ্যারান্টি দিতে পারছি না।’
-ওসব ভালো মাইনসে খায় না।’
-আমি তো ভালো না। ভীষণ বাজে আমি। ভয়ংকর খারাপ মানুষ।’
-আমি তোমারে পালছি। তোমার এই হাত-পা এমনি এমনি এত বড় হয় নাই। গাগতরে বড় হইয়া আমার কথা শুনবা না!’
-তা হঠাৎ তোমার বড় সাহেব অফিস কামাই করে বাড়িতে বসে আছে কেন? রিটায়ার করেছেন নাকি?’
মতিন চাচা থম হয়ে বসে রইল। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। এই ছেলে এখন আর তার কথা শুনবে না। কেমন কথার মাঝে এক কথা কাটিয়ে অন্য কথায় চলে গেল!
-কী হলো, কথা বলবে না?’
হাসল নীড়। তার খাওয়া শেষ। উঠতে উঠতে বলল সে,
-আমি জানি তুমি আমার উপর রাগ করে বেশিক্ষণ থাকতে পারো না। ছোট থেকে দেখছি তোমায়।’
-আজও ওসব খাইয়া বাড়ি ফিরলে তোমার বাড়ি আসাই লাগব না। আর আসলেও আমি দরজা খুলমু না।’
-আজ খাব না। আজ মনটা ফুরফুরা লাগছে।’
-আমি বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করমু। তারপর শুইয়া পড়মু।’
নীড় ভ্রু কোঁচকালো।
-বারোটা তো সন্ধ্যা রাত। অত সকাল সকাল তুমি আমাকে বাড়ি ফিরতে বলছো!’
-হ। তোমার জন্য বড় সাহেবের কাছে জীবনে অনেক মিছা কথা কইছি আমি। বয়স হইতাছে। মরার আগে আর পাপ করতে চাই না।’
নীড় কিছু না বলে চুপ করে কতক্ষণ মতিন চাচাকে দেখল। চাচার বয়স হয়েছে এটা আগে কেন চোখে পড়েনি তার? চাচা মারা যাবে! ভাবতেই বুকটা কেমন করে উঠল। ক্ষীণ গলায় সে বলল,
-আচ্ছা চলে আসব।’
———-
-ও কথার মা, দাঁড়াও। শুইনা যাও।’
আশা গেট দিয়ে ঢোকার সময় পেছন থেকে সাদেক ঘটক ওকে ডাকল। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে দাঁড়ালেন তিনি। ঘটক শয়তান তাকে ডাকে কেন? মতলব কী? সাদেক ঘটক আশার কাছে এসে হাসি হাসি মুখে বলল,
-তোমার কপাল খুইলা গেছে কথার মা। তোমার মেয়েরে দিয়া তোমার ভাগ্যও খুলছে।’
-বুঝলাম না। খুইলা কন।’
-তোমার কথার তো চাঁন কপাল। এই শহরের সবথেকে বড়লোক ব্যবসায়ী নাহিদ চৌধুরীর ঘরের বউ হইতে কপাল লাগে, কপাল। সবার কপালে এমন ঘর মিলে না। তোমার কথার মিলছে। তোমার কিছুই করতে হয় নাই।’
আশার কপালে ভাঁজ এখনও কমছে না। সে তো কাউকে কথার বিয়ের কথা বলেনি। তাহলে?
-আমি কথার বিয়ে দিমু তা আপনাকে কে কইল?’
-দিবা না? কও কী হ্যাঁ! এইরকম একটা ঘর হাতছাড়া করবা! নাহিদ চৌধুরীরে তুমি চিনছো? তোমাগো এলাকার অর্ধেক মানুষ উনার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ করে। শহরে উনার কতগুলা ফ্যাক্টরী আছে জানো? নিজেদের বাড়ি, গাড়ি কোনকিছুর অভাব নাই। এত বড় একজন মানুষ তোমার বাড়ি আত্মীয়তা করতে চায়, তুই তারে না করবা!’
আশার এখনও পুরো ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছে না। বার কয়েক ঢোঁক গিলল সে।
-কথারে ওরা কই দেখছে?’
-সামনাসামনি দেখে নাই। আমার কাছে কথার ছবি ছিল। অনেকগুলা ছবির মাঝে তোমার কথারেই উনার পছন্দ হইছে। আজ ওরে দেখতে আসব।’
আশা হায় হায় করে উঠল। আজ! তার কোন আয়োজন নেই।
-আজ! না,না আজ না। এত বড় মানুষের আপ্যায়ন করারও তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে।’
-ওসব নিয়া ভাইব না তো। তোমার কিছুই করতে হইব না। তুমি শুধু কথারে ভালো কাপড়চোপড় পরাইয়া রেডি কইরা রাইখো।’
-কিন্তু…
-কোন কিন্তু না। আয়োজন করে ওদের বুঝতে দিও না তুমি আগে থেকেই ওদের আসার কথা জানো। আমারে বলতে নিষেধ করছিল। তুমি কাছের মানুষ বইলাই বলা। আচ্ছা যাই আমি।’
আশা দ্রুত বাড়ির ভেতরে পা রাখল। কথাটা কই? ওর ভালো কাপড়চোপড় আছে নাকি তাও জানা নেই। আজ সকালে আবার হাত পুড়িয়ে ফেলছে। এই মেয়ে মরলেও তাকে শান্তি দিবে না।
-কথা! আরে এই কথা…
চলবে_
আসসালামু আলাইকুম।
সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন।
আমার গ্রুপ
.
https://facebook.com/groups/928548141001685/