চুপকথারা বিষন্ন পর্ব-৩

0
4281

#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ৩|

আশা কথার ঘরে এসে আলমারি খুলে তার সব কাপড় বের করতে লাগল। কথা ভেবে পাচ্ছে না মা’র হঠাৎ কী হলো? তার আলমারিতে কী খুঁজছে এভাবে! কথা আশার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। আশাকে বাধা দিয়ে বলতে লাগল,

-কী খুঁজছ তুমি? কী হয়েছে? এসব কেন বের করছো? কিছু লাগবে? কী খুঁজছ আমাকে বলো, আমি বের করে দিচ্ছি।’

-আহ! এত কথা বলিস কেন তুই? একটু চুপ থাকতে পারিস না!’

-তুমি আমার আলমারি এলোমেলো করছ আমি চুপ করে থাকব।’

-হ্যাঁ থাকবি। আমার দরকারেই আমি এলোমেলো করছি। আবার গুছিয়েও রাখব।’

কথাটা শুনে কথা টাস্কি খেয়ে গেল। চোখ বড় বড় করে অবিশ্বাস্য গলায় বলল,

-তুমি গুছিয়ে রাখবে!’

-হু। তুই এখান থেকে যা তো। রান্নাঘরে গিয়ে ডাল বাট। মধু আছে ঘরে? ডাল,মধু,হলুদ মুখে লাগা। যা।’

আজ মা’র কথাগুলো কথার মাথার উপর দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। মা’কে ভূতে ফূতে ধরল নাকি! তাকে হঠাৎ রূপচর্চা করতে বলছে! কেন? কথা এখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখে আশা খেঁকিয়ে উঠল।

-আমার মাথার উপর দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যেটা করতে বলেছি কর গিয়ে, যা।’

আশা কথার নীল রঙের একটা গোলজামা বের করল। সবগুলো থেকে এটাই তার পছন্দ হয়েছে। কথার যে ভালো কোন কাপড় নেই তা আশা জানতো না। ভাগ্যিস এটা ছিল। কথা মা’কে বুঝতে পারছে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে হলো। মা তাকে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কেন?

-আমি যা ভাবছি তা হলে ভালোই হবে। আল্লাহ তুমি তো জানো তোমার কাছে আমি কী চাই। টাকাপয়সা বাড়ি-গাড়ি কিচ্ছু লাগবে না আমার। তুমি শুধু আমাকে টাকলা, বুড়া, পেটুক বর দিও না। সুন্দর হ্যান্ডসাম একটা বর দিও আমাকে। যাকে দেখে আমি আমার সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যাব। যার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আমার ছোট জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারব। আর হ্যাঁ, আরেকটা জিনিসও খুব করে চাই তোমার কাছে। মানুষটা যেন আমাকে অনেক অনেক ভালোবাসে। তার ভালোবাসার নমুনা দেখে আমি যেন পাগল হয়ে যাই।’

কথার কতটা খুশি লাগছে তা সে কাউকে বুঝাতে পারবে না। রান্নাঘরের সামনে কয়েকটা পাক খেল। নাচতে ইচ্ছে করছে তার। গাইতে ইচ্ছে করছে। সে এখন থেকেই সেই মানুষটাকে কল্পনা করছে। তার মনের রংতুলি দিয়ে তার মুখখানা আঁকতে চেষ্টা করছে।

-ইশ! আপনার কিন্তু আমাকে অন্নেক ভালোবাসতে হবে। আমার প্রতি আপনার ভালোবাসায় একটুও কমতি থাকতে পারবে না। আর কিছুই তো চাই না। শুধু ভালোবাসা চাই। ভালোবাসা, ভালোবাসা আর ভালোবাসা।’
———-
নাহিদ চৌধুরী ম্যানেজারের সাথে কথাকে দেখতে এলেন। বাড়ির সামনে এত বড় গাড়ি দাঁড়ানো দেখেই পাড়াপ্রতিবেশি ভীড় জমাতে শুরু করে দিল। অনেকে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে কিছু বলছে। আশা আগেই কথাকে নতুন কাপড় পরে বসে থাকতে বলেছে। মেয়েটা এমনিতেই নজরকাড়া সুন্দরী। তার উপর আজ আবার নিজের সৌন্দর্যের বাড়তি যত্ন নিয়েছে। ওর থেকে চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়েছে।
আশার আপ্যায়নে যে কেউই সন্তুষ্ট হতে বাধ্য। মুখে রস আছে উনার। কথা নাহিদ চৌধুরীর সামনে চা নিয়ে এলো। মেয়েটাকে ছবির থেকে বাস্তবেই বেশি ভালো দেখায়। যেন সদ্য ফোটা এক তাজা গোলাপ। যার সুভাস চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।

-আসসালামু আলাইকুম।’

-ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছো মা?’

-জি আমি ভালো। আপনি?’

নাহিদ চৌধুরী হাসলেন। মনে মনে বললেন,

-আগে শুধু ভালো ছিলাম। তোমাকে দেখে ভালো থাকাটা তিনগুণ বেড়ে গেল।’

মুখে বললেন, ‘আমিও ভালো।’
কথা চায়ের কাপ এগিয়ে দিচ্ছে। কাপ গুলো নিতান্তই সস্তা। চা দেওয়ার সময় কথার হাতের পুড়ে যাওয়া জায়গা নাহিদ চৌধুরীর চোখ এড়ালো না। চোখ মুখ শক্ত হয়ে উঠল উনার। সাদা ফর্সা হাতটা আগুনের মত লাল হয়ে আছে।
কথা এ ঘর থেকে চলে গেলে তিনি আশার সাথে বাকি কথাবার্তা সেরে নিলেন। আশা সবার চোখের আড়ালে নিজের হাতে তিনবার চিমটি কেটেছে। তিন বারই প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে। তার এখনও বিশ্বাসই হচ্ছে না এত বড় একজন মানুষের সাথে তার আত্মীয়তা হতে যাচ্ছে। এই মেয়ের কপাল এত ভালো আগে যদি জানত! সোনার ডিম পারা হাঁসকে কেউ অবহেলা করে? একে হেলাফেলা করে মোটেও ঠিক করেননি তিনি।
এখানে বসেই নাহিদ চৌধুরী বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে গেলেন। আর দেরি করতে চান না তিনি। আশা একটিবারও ছেলে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেনি। ছেলে দিয়ে তার কাজ নেই। কথাকে ওদের পছন্দ হয়েছে। এখন ছেলে করুক আর বাপ, ঘর তো একটাই থাকবে। মেয়েটা টাকার উপর শুয়ে সারাজীবন কাটাবে! ভাবতেই নিজের কপালের উপর দুঃখ হচ্ছে।

শিমুল পাড়ায় খবর পেয়ে ছুটে বাড়ি আসে। ছেলেটা মাত্র সেভেনে উঠেছে। তবুও হাতে পায়ে কথাকেও ছাড়িয়ে গেছে। ওকে দেখে বয়স আন্দাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এখনই এত লম্বা, না জানি আরও কয়েক বছর পর কী অবস্থা হবে।
বাড়িতে পা দিয়েই শিমুল রাগ দেখাতে লাগল।

-মা! মা, আপুকে নাকি কারা দেখতে এসেছিল।’

-হু। কিছুক্ষণ আগে গেল। তুই কোথায় ছিলি? একটা কাজের সময় পাওয়া যেত যদি।’

-আপুকে তুমি যার তার সামনে যেতে দাও কেন? যেকেউ আসবে আর দেখে চলে যাবে?’

আশা ছেলের কথা শুনে ঝাঁঝিয়ে উঠল।

-যার তার কাকে বলছিস তুই! তুই উনাকে চিনিস? ছোট মানুষ, ছোট মানুষের মত থাকবি। তোকে পাকনামি করতে কে বলেছে? বোনকে ঘরে বসিয়ে খাওয়ানো মুরদ আছে তোমার?’

কথা ঘরে বসে সবই শুনছিল। কিন্তু এসবে তার মন নেই। সে তো অন্য চিন্তায় মগ্ন।

-ছেলেকে দেখাবে না! ছেলেকে না নিয়ে এসে একা একাই বিয়ে ঠিক করে ফেলল এটা কেমন কথা! হায় আল্লাহ! ছেলের মাঝে কোন ঘাবলা আছে না তো!’

কথার হাত-পা ছড়িয়ে কান্না করতে মন চাচ্ছে। জীবনে একটাই তো বিয়ে, সেটাও যদি ভুলভাল মানুষের সাথে হয় তাহলে কীভাবে? মা’কে কিছু বলে লাভ নেই। কাকে তার সমস্যার কথা বলবে সে?
———–
আজও নীড় বদ্ধ মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরল। নিজের পায়ে ঠিকমত দাঁড়াতে পারছে না সে। টলছে, পড়ে যেতে চাচ্ছে। চোখ দু’টোও বন্ধ। চেষ্টা করেও খোলা রাখতে পারছে না। মতিন চাচা দরজা খুলে দিয়ে নীড়কে ধরল না। অন্য দিন হলে সাথে সাথে ওকে ধরে নিত। নীড় নেশার ঘোরেও মতিন চাচাকে চিনল। চাচার বুকে পড়ে গিয়ে নির্লজ্জের মতো হাসছে সে। মুখ দিয়ে ভুরভুর করে মদের গন্ধ এসে নাকে লাগছে।

-স-সরি-ই চাচা। ত-তোমাকে দেওয়া ক-কথা রাখতে পারলামমম না…
মতিন চাচা জানতো নীড় ওর কথা রাখতে পারবে না। এত বছরের অভ্যাস একদিনে ছুটে যাবে না। মতিন চাচা নীড়কে ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে।
হঠাৎ নীড় হু হু করে কাঁদতে লাগল।

-তু-তুমি আমার বাবা। বাবার মতন না। তুমিই আমার বাবা হবার যোগ্য। ওই লোক তো শুধু নামে বাবা। জন্ম দিলেই কেউ বাবা হয়ে যায় না। আমিও তো এমন কয়েক ডজন সন্তান জন্ম দিতে পারব। তাতে কি আমি…

-চুপ করো।’

-তুমি অনেক ভালো মানুষ। তোমাকে একটা চুমু খাই?’
অনুমতির দেওয়ার জন্য দেরি করল না নীড় চট করে মতিন চাচার গালে চুমু খেয়ে নিল। মাতালের কাজ কারবার কিছুই বোঝা যায় না। এই হাসে তো এই কাঁদে।

-তোমার বড় সাহেব একটা চোর। ঠকবাজ, জোচ্চর। একটা ভণ্ড।’

-উনি তোমার বাবা।’

-নাহ। নো,নেভার। আমার কানো বাবা নেই।’

নীড় নেশার ঘোরে আরও অনেক কিছু বলে যাচ্ছে। মতিন চাচা ওকে ঘরে এনে নরম তুলতুলে বিছানায় শুইয়ে দিল। নীড়ের কথা বলা এখনও বন্ধ হচ্ছে না। মতিন চাচা ওকে দেখে বলল,

-এত আরাম আয়েশ পাইয়াও বাপেরে গালি দেও। চোর, জোচ্চর, ভণ্ড কও। এই মানুষটা না থাকলে এত সুখ কই পাইতা? এই যে প্রতি রাতে মদ গিলে আসো, সেটাও তো এই মানুষটায় মাথার ঘাম পায়ে ফেলার টাকায়। মানুষটা নিজের রক্ত পানি কইরা এসব বাড়ি-গাড়ি সম্পত্তি করছে। কার জন্য করছে? তুমি ছাড়া উনার আর কে আছে?’

নীড় ঠোঁট নাড়াচ্ছে। ওর কথা এখন বোঝা যাচ্ছে না। মতিন চাচা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিল। নীড়ের চোখের কোণ গড়িয়ে টুপ করে এক ফোঁটা পানি বালিশে পড়ল।

-আমি ওই লোককে ঘৃণা করি।’
—————
-কিরে কথা! কী শুনছি? অত বড় ঘরের বউ হয়ে যাবি। তখন তো আর আমাদের চিনবি না।’

সোহান ভাইয়ের উস্কানিতেও কথা আজ খেপল না। মন ভালো নেই তার। রাতে ঘুম হয়নি। একটা চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মানুষটা কেমন হবে! না দেখেই বিয়ে করা ঠিক হবে! সোহান কথার চিন্তিত মুখ লক্ষ করল। ধ্যান ধরে ওকে দেখল। গলার স্বর নরম করে বলল,

-মন খারাপ কেন? কী হয়েছে?’

-সোহান ভাই, বিয়েটা আমি করব না।’

-ও মা কেন! করবি না কেন?’

-ছেলেকে তো আমি দেখিনি।’

কথার কথা শুনে সোহান হো হো করে হাসতে লাগল। কথা বিরক্ত হলো।

-এই কারণে বিয়ে করবি না! দূর পাগল, কত ভালো ঘর।’

-বিয়ের পর বর পছন্দ না হলে ভালো ঘর ধুয়ে আমি পানি খাব। সাথে তোমাকেও খাওয়াব।’

হাসতে হাসতেই সোহান বলল,

-খাওয়াস। বড় ঘর ধোয়া পানি খেলেও জীবন স্বার্থক।’

-মজা না। সত্যি সত্যিই যদি ছেলেটার মাঝে কোন সমস্যা থেকে থাকে।’

-কী সমস্যা থাকবে?’

-কানা হতে পারে। বা এক হাত পা নেই। আগে আরও কয়েকটা বিয়েও করতে পারে।’

-দূর! এসব কিছুই হবে না।’

-ধরো যদি হয়?’

-তখন আমাদের কথা রাণীকে আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসব।’

-সত্যি সত্যি আনবে তো?’

-আমার উপর তোর বিশ্বাস নেই?’

-আছে। সোহান ভাই, ছেলেটা কি তোমার মত সুন্দর হবে?’

সোহানের হাসি থেমে গেল। কথাকে দেখছে সে।

-আমি সুন্দর?’

-হুম। নুহা আপার অনেক ভাগ্য। ও তোমার মত একজনকে পেয়েছে। আমার বরটা যদি তোমার মত হতো!’

-হলে কী করতি?’

-চোখের তারায় রাখতাম। মাথার মণি করে রাখতাম। কোনোদিন অযত্ন হতে দিতাম না।’

সোহান আবার তার বিখ্যাত হাসি হাসতে লাগল। তার বিশ্বাস কথার মত মেয়ের সাথে কখনও খারাপ কিছু হতেই পারে না। মেয়েটার মনটা যে কী ভীষণ ভালো তা তাকে ছাড়া কে জানে? সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর সব সুখ ওকে দিক।

চলবে_

গ্রুপ—— মায়ামহল (নিপা’র গল্প)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here