#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ৫|
আজ সকাল থেকেই কথাদের বাড়ির পরিবেশে বিয়ে বিয়ে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। পাড়ার সবাই এসে ওদের বাড়িতে ভীড় করছে। কাকী, জেঠি একেক জনের একেক কথা। কেউ কথার ভাগ্যের উপর হিংসা করছে। কেউ কেউ মন থেকেই ওর জন্য খুশি হচ্ছে। রাতে কথার ঘুম হয়নি। আজ মনটাও ভালো নেই। সবকিছুর মাঝেও কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এর আগে কখনও নিজেকে এমন একা লাগেনি। আজ আশেপাশের এত মানুষের ভীড়ের মাঝেও কথার মনে হচ্ছে তার কেউ নেই।
-দেখছো আমাগো কথার কী কপাল! রাজ কপাল! নইলে কি এত বড় ঘরে বিয়া হয়!’
-মাইয়াটা কষ্টও তো কম করে নাই। সৎমা ওরে এক দণ্ড শান্তি দিছে? রান্নাবান্না থেকে শুরু করে একা হাতে ঘরের সব কাজ করছে।’
-আল্লাহ কথাটার কপালে সুখ দেক। বাপ, মা হারা মাইয়া এই বয়সেই অনেক কিছু দেখছে।’
-হ যা কইছো। কথার জন্য আমার কষ্টই হইতো। এহন এইটা ভেবে শান্তি পামু শেষ পর্যন্ত কথার সুখ হইল।’
শিমুল পাশ থেকে পাড়ার কাকীদের কথা শুনছিল। আপু বিয়ে হয়ে যাবে ভাবতেই কান্না পাচ্ছে তার। আপু চলে গেলে এই বাড়িতে সে একা কীভাবে থাকবে? কথাকে দেখা গেলে শিমুল তাড়াহুড়ো করে এখান থেকে চলে গেল। আপুর সামনে কাঁদতে চায় না ও।
-আপু, তুমি ভালো থেকো। আমার মা কোনোদিনও তোমাকে শান্তি দেয়নি। আমি তো ছোট, তোমার সাথে ঘটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করে দিও।’
কথা শিমুলকেই খুঁজছিল। ভাইটার জন্য বুক পুড়ছে তার। সকাল থেকে দেখা নেই। কোথায় গেল এই ছেলে? পলাশ অবশ্য তার কাছ ছাড়ছে না। আপু চলে যাবে এটা কীভাবে বুঝে গেছে সে।
-আরে কথা, এইদিকে আয়।’
-কাকী শিমুলকে দেখেছ?’
-শিমুল! এইখানেই তো ছিল একটু আগে। তুই এখনও এইভাবে ঘুরছিস কেন? হলুদ বাটা কিন্তু শেষ। যা ঘরে গিয়া তৈরি হ।’
-হু। শিমুলকে পেলে আমার কাছে পাঠিয়ে দিও।’
কথার বান্ধবীরা মিলে ওকে হলুদের সাজে সাজিয়ে দিল। উঠানে ছোট্ট করে স্টেজ বেঁধে হলুদ করা হবে। আশার দম নেওয়ার সময় নেই। একা হাতে সব দেখতে হচ্ছে তাকে। তার বিয়াইয়ের হাত কত বড় তা বিয়ের আগেই দেখিয়ে দিয়েছে। একটা টাকাও তাকে খরচ করতে হচ্ছে না। সব কথার শ্বশুরই দিয়েছে। গতকাল হলুদের তত্ত্ব পাঠিয়ে দিল। আজ ম্যানেজার নিজে ডেকোরেশন এর লোকদের নিয়ে এসেছে সব ব্যবস্থা করে গেছে। বিয়েতে ওখানের যারা আসবে তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থাও মেয়ের শ্বশুরই নিয়েছে। ভাবা যায়!
-শিমুল কই রে? ও শিমুল! ছেলেটাকে একটা কাজে পাওয়া যায় না।’
-কাকী কথা কোথায়?’
সোহান এসেছে। আশা সোহানকে দেখে কাজের বাহানা বানিয়ে বলল,
-ঘরেই তো হবে। বিয়ের কনে তো বাইরে থাকবে না। আমাকে বিরক্ত করো না বাবা। অনেক কাজ আমার।’
সোহান নিজেই কথাকে খুঁজে নিল। কথা ওকে দেখে ছুটে এলো। আশেপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে বলল,
-নুহা আপা কই? ও আসেনি? আমি তোমাকে বলেছিলাম ওকে নিয়ে আসতে।’
-আজ আসতে পারেনি রে। কাল আসবে। তুই তো জানিস ওর পরিবার কেমন। তার উপর আজ আবার ওর বাবা বাড়িতে।’
কথার মন খারাপ হয়ে গেল। যা! নুহা আপা সোহান ভাইয়ের প্রেমিকা। ওদের প্রেম দেখে দেখে কলেজের একটা বছর শেষ করেছে কথা। অর্ধেক খবর আনা নেওয়া তো কথাই করেছে। নুহা আপার বাপটা যে হার বজ্জাত। মেয়েকে একা ছাড়তেই চায় না।
-তুই মন খারাপ করিস না। কাল আসবে। ও বলেছে যেভাবেই হোক কাল তোর বিয়েতে আসবে। দেখ তো কথায় কথায় ভুলেই গেছি। তোকে যে আজ কী ভীষণ সুন্দর লাগছে রে কথা। তোর বরটার অনেক ভাগ্য। তোর মত একটা লাল টুকটুকে পুতুল বউ পাচ্ছে সে।’
-সোহান ভাই তোমার ফোনটা দাও তো।’
-কেন? এই তুই অলরেডি দুলার নাম্বার জোগাড় করে ফেলেছিস! ওর সাথে কথা বলিস!’
-আরে দূর! তুমি বললে না আমাকে সুন্দর লাগছে। সেল্ফি তুলব।’
————
নীড় লাপাত্তা। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নাহিদ চৌধুরী চোখে অন্ধকার দেখছেন। বর না নিয়ে গেলে কাল বর ছাড়া বিয়েটা হবে কার সাথে?
মেয়েটার জীবনটা নিয়ে এভাবে খেলা করার অধিকার তার নেই। একেই তো এই অপদার্থটার সাথে বিয়ে দিয়ে মেয়েটার সাথে কম অন্যায় করছেন তিনি?
-সাহেব, তোমার ঔষধ।’
নাহিদ চৌধুরী চোখ মেলে মতিনকে দেখল।
-ছেলেটা আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দিবে না মতিন।’
-তুমি চিন্তা কইরো না।’
-চিন্তা না করে কীভাবে থাকব বলো? কাল বিয়ে। মেয়ের বাড়িতে বিয়ের আয়োজন হচ্ছে। এদিকে আমি আমার ছেলেকেই খুঁজে পাচ্ছি না। আমার সম্মানের কথা আমি ভাবছি না। আমি মেয়েটার কথা ভাবছি। ওর তো কোন দোষ নেই। বিয়ের দিন বর না গেলে সমাজের চোখে মেয়েটা দোষী হয়ে যাবে। ওকে মানুষ শান্তিতে বাঁচতে দিবে না।’
—————
হলুদের দিনটাও পার হয়ে গেল। রাত পোহালে কাল বিয়ে। অথচ যার সাথে কথার বিয়ে হচ্ছে তাকেই এখনও দেখেনি সে। মায়ের মুখে যেটুকু বর্ণনা শুনেছে তাতে মনে মনে মানুষটাকে কল্পনা করেছে সে। তবে কল্পনার সাথে যদি বাস্তব না মিলে। সন্ধ্যার হৈচৈ অনেক আগেই থেমেছে। সবাই এখন ঘুমোচ্ছে। শুধু কথার চোখেই ঘুম নেই। তার ঘুম চুরি করে নিয়েছে ওই লোকটা। ওর কথা ভেবে ভেবে আগের দুই রাতও এক ফোঁটা ঘুম হয়নি। আজকের রাত নিয়ে নির্ঘুম তিন রাত। নিস্তব্ধ এই রাতে কথা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে চাঁদ নেই। কথার মনে নানান চিন্তা ঘুরপাক খেয়ে ওর মনটাকে আরও অশান্ত করে দিচ্ছে।
-আপনার কথা ভেবে ভেবে আমার ঘুম হচ্ছে না। ওদিকে আপনি নিশ্চয় আরাম করে ঘুমোচ্ছেন। না, আপনিও হয়তো আমার মতই জেগে আছেন। নির্ঘুম রাত পার করছেন। আচ্ছা আমাদের বিয়ে ঠিক হবার পরও আপনি কেন একবারও আমার সাথে দেখা করতে এলেন না? আমাকে দেখতে ইচ্ছে হয়নি আপনার? বিয়ের আগে দেখে নিবেন না কেমন মেয়েকে বিয়ে করছেন আপনি? আমি কালো নাকি সুন্দর। আপনার পছন্দের মতন নাকি উল্টো!’
কোথাও নাম না জানা অচেনা কন্ঠে কোন পাখি ডেকে উঠল। হঠাৎ কথা ভয় পেয়ে গেল।
-বজ্জাত পাখি! ভয় পাইয়ে দিয়েছিস। তুই কেন জেগে আসিস হ্যাঁ? জাগব তো আমি। আমার চোখের ঘুম এক ভদ্রলোক চুরি করে নিয়েছে। তোর ঘুম কে চুরি করেছে? ঘুমা তুই।’
বাইরে থেকে শিরশিরে বাতাস আসছে। কথার গায়ে কাটা দিচ্ছে। কাল সে এই বাড়ি থেকে চলে যাবে। কষ্ট হচ্ছে আবার ভালোও লাগছে।
-আপনি আমাদের বাড়িতে না-ই এলেন। কারো থেকে আমাদের ফোন নাম্বার জোগাড় করে আমার সাথে কথা তো বলতেই পারতেন। সেটাও করলেন না আপনি। বিয়েতে কি আপনি খুশি না? বিয়ের আগে থেকেই আমার প্রতি এত অবহেলা কেন আপনার? আমি তো কিচ্ছু চাই না। আমার এই কাঙ্গাল মন শুধু একটু ভালোবাসা চায়। কোনোদিনও কারো কাছ থেকে পায়নি তো। তাই মনে মনে এতদিন নিজেকে এটাই বলে এসেছে, একদিন একান্তই আপন একটা মানুষ হবে তোর। সে তোকে পৃথিবীর সব ভালোবাসা দিয়ে এতদিনের তৃষ্ণা মিটিয়ে দিবে। সেই মানুষটা শুধু তোর হবে। তুই তাকে নিজের বলতে পারবি।’
কথা খেয়াল করছে না। কিন্তু তার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু ঝরছে।
-আল্লাহর কাছে এই একটা জিনিসই চেয়েছি শুধু। আমার চাওয়া খুব কম। পাওয়া তার থেকেও কম।
আমার বিশ্বাস আমার না বলা কথাগুলোও আপনি বুঝে নিবেন।’
—————-
সকাল সকাল ডাক্তার এসে নাহিদ চৌধুরীর চেক-আপ করে গেছে। কাল রাত থেকেই তার শরীর ভালো যাচ্ছে না। তার অসুখ যে কোন মেডিসিন দিয়ে সারবে না তা ডাক্তারকে কে বোঝাবে? তারপরও একগাদা ঔষধ লিখে দিয়ে গেল ডাক্তার ছোকরাটা।
তিন দিন, তিন রাত ধরে ছেলের কোন খবর নেই। সে যে গা ঢাকা দিয়ে আছে তা বুঝতে বাকি নেই উনার। এই ছেলে তাকে শিক্ষা দিচ্ছে। ছেলেকে জন্ম দেওয়ার সাজা।
-সাহেব, কিছু মুখে দেও। না খাইয়া থাকলে কোন সমাধান বাইর হইব?’
-আমাকে খাবার না দিয়ে বিষ এনে দাও মতিন। মেয়েটার মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। ওর সাথে বড্ড অন্যায় করে ফেললাম। কুলাঙ্গার সন্তান জন্ম দেওয়ার শাস্তি ভোগ করছি।’
———–
পার্লারের মেয়েরা এসে কথাকে বউ সাজিয়ে দিয়েছে। দাওয়াতের মেহমানরা সেই কখন খেতে বসে গেছে। যত সময় যাচ্ছে কথার ভয় যেন ততই বাড়ছে। অনিশ্চয়তায় পা দিতে যাচ্ছে সে। না জানি মানুষটা কেমন হবে? তার সাথে কথা মানিয়ে নিতে পারবে কি-না।
-বরযাত্রী কখন আসবে? এখনও বর আসেনি! এটা কেমন কথা!’
-দেখো না কী হয়। নাহলে হঠাৎ এত বড় ঘর থেকে কথার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসবে কেন? ওদের সাথে কথাদের কোন তুলনা আছে?’
-জানি না। আশা তো সারাজীবনই মেয়েটার জীবন নিয়ে জুয়া খেলে যাচ্ছে।’
-শেষ পর্যন্ত বর আসবে কি-না কে জানে?’
-জামাই দেখেছ তোমরা? নির্ঘাত ছেলের মাঝে কোন খুঁত আছে।’
পাড়াপ্রতিবেশিরা নানান কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে। আশার কানে সবার খুসুরফসুরই যাচ্ছে। সে নিজেও মনে মনে এই চিন্তাই করছে। এখনও বরযাত্রী আসছে না কেন? এতক্ষণে তো ছেলের এসে যাওয়ার কথা। কপাল পুড়িটার কপাল পুড়ল কি-না কে জানে! আজ বিয়ে না হলে বাড়ি থেকেই বের করে দিবে এই অপয়াকে।
-ও শিমুল! বাবা বড় রাস্তায় গিয়া দেখ না বরের গাড়ি আসতেছে কি-না। দেখ না বাবা। বিয়াই নিজে আইসা মেয়েটারে পছন্দ করে গেল। এখন ছেলে নিয়া আসতাছে না ক্যান?’
বাইরের হৈচৈ কথার কানেও যাচ্ছে। এই হৈচৈ যে খুশির না তা কথার বুঝতে অসুবিধা হলো না। রাত থেকেই তার মন কু ডাকছিল। কিছু একটা অঘটন ঘটবে। কথার ভয় হচ্ছিল শেষ পর্যন্ত যদি বিয়েটা না হয়! চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কিছু বলছে কথা।
-আল্লাহ তোমার কাছে আমি নিজের জন্য কখনও কিছু চাইনি। আমার ওই একটা চাওয়াও তুমি পূরণ করতে পারবে না! আমার উপর তোমার এতই অবজ্ঞা! আমি জানি সুখের কপাল নিয়ে আমি দুনিয়ায় আসিনি। তাই বলে এভাবে অসম্মানিত হতে দিবে তুমি আমাকে?’
চলবে_
গ্রুপ —- মায়ামহল (নিপা’র গল্প)