#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ১২|
কথা শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাবার আগে একজনের সাথে দেখা করে যেতে চায়। আবার কবে না কবে আসা হয় কে জানে। কাল আলম ভাইয়ের ছেলে দেখার চক্করে আর কোথাও যাওয়া হয়নি। বিয়ের পর একবারও মানুষটার কাছে যায়নি সে। একটু পরেই তাকে নিতে গাড়ি আসবে। তার আগে একফাঁকে মা’কে না বলে চলে গেলেই হবে। মা’কে বললে জীবনেও যেতে দিবে না।
-পলাশ আমার সাথে এক জায়গায় যাবি?’
-কোথায় আপু?’
-যাবি নাকি বল। যাবার পথে তোকে চকলেট কিনে দিব।’
চকলেটের কথা শুনে পলাশ খুশিতে গদগদ করে মাথা দোলাতে দোলাতে বলল,
-যাব যাব।’
-তাহলে চট করে বাইরে গিয়ে দেখে আয় তো মা কোথায়। আশেপাশে কোথাও না থাকলে আমাকে ডাকবি বুঝলি।’
পলাশ সন্দেহজনক ভাবে হাসল। আপু আগেও এভাবে মা’র চোখ ফাঁকি দিয়ে বাড়ি থেকে কতবার পালিয়েছে।
-তুমি আবার পালাবে,তাই না?’
-আরে না পাগল। এখন আর পালানোর প্রয়োজন নেই। তোকে যা করতে বলেছি কর। যা।’
———————
কথা কোনরকমে বাড়ি থেকে বেরুতে পেরেছে। ছোট্ট গলিটা দিয়ে হাঁটার সময় ওড়না দিয়ে নাক মুখ চেপে ধরল কথা। বিশ্রী একটা বোটকা গন্ধ নাকে এসে লাগছে। এই গলিটা এত নোংরা! মানুষ বসবাস করার উপযুক্ত না। তবুও যে এখানে মানুষজন কীভাবে দিব্যি থাকছে। পলাশ মুখ বাঁকিয়ে নিলে কথা ওর ওড়নার একটা কোণা পলাশকে দিল।
-এটা দিয়ে নাক মুখ চেপে ধর। আমার পেছনে তাড়াতাড়ি হেঁটে আয়।’
-এটা কোথায় এসেছি আমরা আপু?’
-কথা বলিস না।’
পলাশ তার ছোট্ট পায়ে রীতিমতো কথার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটার জন্য দৌড়ুচ্ছে। রঙচটা আধভাঙা বাড়িটা ভেতর ঢুকে বুক ভরে দম নিল কথা। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখল না। কারো কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে ডাকল সে।
-পাতানো মা। ও পাতানো মা।’
ঘরের ভেতর থেকে একটা রিনরিনে গলা শোনা গেল।
-কে?’
-আমি কথা।’
মানুষটা তাৎক্ষণাৎ বেরিয়ে এলো। গলার স্বরে খুশি ঝড়ে পড়ছে উনার।
-ও মা! কথা তুই! কখন এলি মা? আয়, আয়।’
-তোমার কী হয়েছে?’
-ঠান্ডা লেগেছে রে। গলা বসে গেছে। জ্বরও আসে মাঝে মাঝে।’
-ডাক্তার দেখাওনি।’
-আর ডাক্তার! আমার জ্বর আপনাতেই সেরে যায়। তুই শ্বশুরবাড়ি থেকে কখন এলি? আজ এসেছিস?’
-না। এসেছি তো কাল। তোমার কাছে আসার সময় পাইনি। আলম ভাইয়ের বউয়ের ছেলে হয়েছে। আমি ফুপু হয়েছি বুঝলে।’
শিউলি স্নেহভরা দৃষ্টিতে কথাকে দেখছে। মেয়েটাকে সেই ছোট্টবেলা থেকে দেখে আসছে সে। ওর অনেক কষ্ট। যাক, এখন আর কথার কোন কষ্ট থাকবে না। কথার জন্য কিছু করতে পেরেছে তিনি এটা ভাবলেই মনে শান্তি লাগে। কথার ছবি ঘটককে সে-ই দিয়েছিল। বলেছিল এই ছবিটা যেন নাহিদ চৌধুরীকে দেখায়। শিউলি নীড়ের মুখটা মনে করার চেষ্টা করলো। ছোটবেলার সেই মুখটাই স্মৃতিতে আছে। এখনকার চেহারা তার অজানা। অনেকদিন ধরে দেখেনি ছেলেটাকে। এখন তো নীড় বড় ব্যাটা হয়ে গেছে। বিয়েও করে ফেলেছে।
-তোর সাথে ওটা কে এসেছে? তোর ভাই?’
-হুম। শিমুলের ছোটটা। ওর নাম পলাশ।’
-কবে চলে যাবি? আজই?’
-হ্যাঁ। শ্বশুর আব্বা হয়তো এতক্ষণে আমাকে নেওয়ার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।’
-তোর বরটা সাথে আসেনি?’
-না। উনি যেন কেমন! অদ্ভুত। আমি উনাকে বুঝতে পারি না।’
শিউলি হাসল। নীড়টা তো ছোটবেলা থেকেই পাগলাটে ছিল। এখনও হয়তো তেমনই আছে।
মাঝে মাঝে ছেলেটাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে। ওর জন্য বুক কাঁদে।
-অদ্ভুত হলেও তো ও এখন তোর স্বামী। ওকে তোর বুঝতে হবে। ওর সুখ দুঃখে ওর পাশে থাকতে হবে।’
-হু।’
——————-
পলাশকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ফিরে এলো সে। পলাশ তার ছোট্ট জীবনে এত বড় বাড়ি আর কখনও দেখেনি। যে চোখের সামনে যা দেখছে তাতেই অবাক হচ্ছে। বিস্মিত চোখে চারপাশে দেখছে।
-দেখছিস তো আমার শ্বশুরবাড়ি কত বড়! একদম রাজাদের বাড়ির মত না!’
-হুম।’
কথা ভেবেছিল ঘরে গিয়ে নীড়কে দেখতে পাবে। কিন্তু তার দেখা আর কথা পেলো না। কথা মনে মনে কল্পনা করে রেখেছিল, নীড় তাকে জিজ্ঞেস করবে,
-আমাকে না বলে তুমি বাপের বাড়ি গিয়েছিলে কেন?’
কথা মুখ বাঁকিয়ে উত্তর দিবে,
-গেলে কী হয়?’
নীড় সামান্য রেগে গিয়ে বলবে,
-কী হয় বুঝো না তুমি? আমি তোমাকে মিস করেছি। তুমি জানো এই দুই দিনে তোমার কথা আমি কতবার মনে করেছি। আর কখনও আমাকে না বলে বাপের বাড়ি যাবে না। যেতে হলে আমাকে বলবে। আমি তোমাকে নিয়ে যাব।’
কোথায় কী! বাস্তবতা তার ভাবনার ধারের কাছ দিয়েও গেল না। তার বরটা ভীষণ কাঠখোট্টা লোক।
-কী এক লোকের সাথে যে বিয়ে হলো আমার! বউয়ের কোন পরোয়াই করে না। মনে হয় আমি জোর করে উনার ঘাড়ে চেপে বসেছি।’
—————
কথা বাকিটা দিন ছোট ভাইয়ের সাথে কাটালো। রাতে তার শ্বশুর বাড়ি ফিরে কথাকে দেখে খুশি হলেন। পলাশকে খাইয়ে দিয়েছে কথা। ওকে ঘরে শুইয়ে দিয়ে শ্বশুরের কাছে এলো। নাহিদ চৌধুরী ঘরের পোশাক পরে খাবার টেবিলে এসেছেন।
-বাবা আপনি সারাদিনই অফিস করেন!’
-তোমার কি বাড়িতে একা লাগে?’
-হু। কত বড় বাড়ি। মানুষ মাত্র তিনজন। আমি, রমিজা খালা আর মতিন চাচা।’
নাহিদ চৌধুরী বুঝতে পারল নীড় বাড়ি ফিরেনি। ও এরকম করতে থাকলে মেয়েটার সত্য বুঝতে বেশি সময় লাগবে না।
-তোমার ভাই কি ঘুমিয়ে পড়েছে?’
-হুম। পলাশ বেশিক্ষণ জাগতে পারে না। ওকে শুইয়ে দিয়ে এসেছি।’
-তুমি খেয়েছ মা?’
বাড়ির বউ হয়ে শ্বশুরের আগে খেয়ে ফেলে যেন কথা কোন অপরাধ করে ফেলেছে। মাথা নুইয়ে অপরাধী কন্ঠে সে বলল,
-হ্যাঁ। আমার ক্ষিধে পেয়েছিল।’
নাহিদ চৌধুরী কথাকে দেখে হাসলেন। বললেন,
-ভালো করেছ। যখন ক্ষিধে পাবে খেয়ে নিবে। কারো জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।’
কথা পলাশকে পাশে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। পলাশ ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্তে ঘুমচ্ছে। কথাও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
নীড় তখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনবরত কলিংবেল চেপে যাচ্ছে। কেউ দরজা খুলছে না। নীড় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। পা টলছে তার। জড়ানো গলায় সে বলছে,
-এই বাড়ির সব দরজা আমি ভেঙে ফেলব। কোন বাধা রাখব না। একটা মানুষ দরজা খুলছে না। সব কি মরে ঘুমোচ্ছে।’
নীড় জেদের বশে জোরে জোরে সুইচে চাপ দিচ্ছে। সুইচ টিপে একটানা ধরে রাখছে।
কথার ঘুমটা সামান্য নড়ে গেল। বিকট শব্দটা তার কানেও এসে লাগছে। এখন রাত কয়টা বাজে? এই রাতের বেলা কে কলিংবেল বাজাচ্ছে!
মতিন চাচা দরজা খুলে দিয়ে রক্তচক্ষু করে নীড়ের দিকে দেখল। চাপা গলায় ধমক দিয়ে বলল,
-কী হচ্ছে কি হ্যাঁ! রাতদুপুরে ডাকাতের মত আচরণ করছ কেন? দিনের বেলা তো শান্তি দেওই না। এখন কি আমাদের রাতের ঘুমও হারাম করবে?’
-চ-চা-চা! আই লাভ ইউ। তুমি অনেক ভালো। আমি তোমাকে অ-অনেক ভালোবাসি।’
-মাতলামি করা বন্ধ করো।’
নীড় পড়ে যাচ্ছে দেখে মতিন চাচা ওকে ধরে ফেলল।দরজা লাগিয়ে দিয়ে ওকে ঘরের দিকে নিয়ে আসতে লাগল। এতদিন ওই ঘরে শুধু নীড়ই থাকত। আর কেউ ছিল না। আজ ওখানে আরও একটা মানুষ আছে। এই অবস্থায় ওকে কীভাবে ওই ঘরে নিয়ে যাবে? মেয়েটা ওকে এই অবস্থায় দেখে কী করবে? নীড়ই বা মেয়েটার সাথে কেমন ব্যবহার করবে! মদ খেলে তো ওর হুঁশ থাকে না। এখনও হুঁশ নেই।
সিঁড়ির মাথায় একবার পড়ে গেল নীড়। কপালটা মেঝেতে ঠুকে গেল। কাতর শব্দ করল নীড়।
-আহ! লাগলো বড্ড!’
-লাগবোই তো। লাগব না। মদ খাইয়া মাতলামি করবা। পইড়া যাইবা আর ব্যথা পাইবা না!’
-শক্ত করে একটু ধরো না।’
মতিন চাচা নীড়ের উপর মহা বিরক্ত হচ্ছে। ছেলেটা যে কেন এমন হলো!
-কোন ঘরে যাইবা? আজ তোমার ঘরে যাওয়া চলব না।’
-কে-কেন? আমার ঘরে আমি যেতে পারব না কেন?’
-ঘরে বউ আছে সেই কথা ভুইলা গেছ? বউয়ের সামনে গিয়া মাতলামি করবার চাও!’
-ব-বউ!’ হাসল নীড়। মনেই ছিল না সে বিয়ে করেছে। ঘরে এখন তার বউ আছে। মতিন চাচা বিরবির করছে।
-নতুন বউয়ের সামনে মাতলামি করবা। তুমি মদ খাইয়া আসছো জানলে বৌমা কষ্ট পাইব না!’
-হ্যাঁ! ক-কষ্ট! ক-কেন কষ্ট পাবে? আমি মদ খাই তাতে ওর কী? ওর টাকায় খাই? নাকি ওর বা-পের… আমার মন চাইলে আমি হাজার বার মদ খাব। তোমাদের বৌমা কষ্ট পেলে আমার কি? আমি কি বিয়ে করতে চেয়েছি?’
-চুপ করো। চুপ। এসব কথা…
কথার ঘুম ভেঙে গেলে সে বিছানা থেকে উঠে বসেছিল। বাইরে কারো ফিসফিসে গলায় কথা শুনতে পেয়ে প্রথমে ভয় পেলেও পরে কণ্ঠস্বর চিনে ভয় কেটে গেল। মতিন চাচা এত রাতে চোরের মত ফিসফিস করে তার ঘরের সামনে কার সাথে কথা বলছে? দরজা খুলে দিলে কথা ওদের দেখতে পেল। মতিন চাচা কথাকে দেখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে গেল। নীড় দাঁড়াতে পারছে না। কথা কতক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল। নীড় পড়ে গেলে ছুটে এলো সে।
-কী হয়েছে উনার?’
মতিন চাচা কী বলবে ভেবে পেল না। কথা নীড়কে ধরে তোলার চেষ্টা করছে। আবার জিজ্ঞেস করল,
-কী হয়েছে উনার? উনি এমন করছেন কেন?’
-ওরে একটু ধরো। শরীরটা মনে হয় ভালো না। ঘরে নিয়া শোয়াই দেই।’
-হুম।’
দু’জন নীড়ের দু’হাত নিজেদের কাঁধে নিয়ে ওকে সোজা হয়ে চলতে সাহায্য করছে। ওর গা থেকে সেই বাজে গন্ধটা কথার নাকেও লাগছে। পলাশকে একপাশে টেনে নিয়ে নীড়কে শুইয়ে দিল ওরা। কথা এখনও বুঝতে পারছে না নীড়ের কী হয়েছে। সে নিজে নিজে বিড়বিড় করে যাচ্ছে। তবে কথা ওর সেসব কথা বুঝতে পারছে না।
-আ-আমি বিয়ে ক-করতে চাই-ই…
-উনি কিছু বলছেন। কিন্তু কী বলছেন বুঝতে পারছি না আমি।’
মতিন চাচা মেয়েটাকে দেখল। ফুটফুটে ফুলের মতো মেয়েটার জীবনটা কেন নষ্ট করলো! এই মাতাল ছেলে কখনও কি এই ফুলের মূল্য দিতে শিখবে?
-কিছু বলছে না। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। সকাল হলে ও ঠিক হয়ে যাবে।’
চলবে🌸