#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ২০|
কথা তার অভ্যাস মতো দরজায় নক না করে আজও হুটহাট ঘরে চলে এলো। নীড় মাত্রই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে। তার কোমরে সাদা একটা টাওয়াল ছাড়া আর কিছুই নেই৷ কথাকে দেখে শক খেলেও সামলে নিল নীড়। এই মেয়ে মরে গেলেও এর অভ্যাস ঠিক হবে না। ঘরে আসার আগে অন্তত শব্দ করবে তো! কথা নীড়কে দেখতেই থাকল। চোখ সরাচ্ছে না সে। বা নীড়কে খালি গায়ে দেখে লজ্জাও পাচ্ছে না। এদিকে নীড় নিজে কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেছে। কথাকে ধমক দিয়ে বলে উঠল সে,
-তোমার মধ্যে বিন্দু পরিমাণ কমনসেন্স নেই? যখন যেখানে খুশি চলে এলেই হলো, না! নক করতে শেখায়নি কেউ।’
-না শেখায়নি। নিজের ঘরে এলেও নক করতে হবে নাকি! আশ্চর্য!’
কপাল কুঁচকে নীড় বলল,
-নিজের ঘর!’
-জি হ্যাঁ। এই ঘরটা যতটা আপনার ঠিক ততটা আমারও। বউ হই আপনার। আপনার সব জিনিসে সমান অধিকার আছে আমার। এমনকি আপনার উপরও আমার পুরোপুরি অধিকার খাটবে।’
নীড় বাকরূদ্ধ। তার জিনিসে অধিকার খাটাতে চাচ্ছে মেয়েটা! তাকেও ছাড় দিচ্ছে না! সাহস কত।
-এই মেয়ে এই, তোমার তো সাহস কম না।’
-সাহসের দেখেছেন কি হ্যাঁ? আমার সাহস দেখতে চান। দেখবেন কত সাহস আমার।’
-দেখাও দেখি।’
কথার মনে তখন থেকেই দুষ্টুমি বুদ্ধি কাজ করছে। নীড়ের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে রহস্যময় হাসল।একপা একপা করে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। ওর চোখের ভাষা নীড়ের ঠিক লাগছে না। কী করতে চাইছে ও! কথা নীড়ের সামনে চলে এলে নীড়ও বুঝতে পারল কথা কী করতে চাইছে। কোমরের তোয়ালেটা শক্ত হাত ধরে লাফিয়ে দু’পা পিছনে চলে গেল। ওকে ক্যাঙারুর মত লাফাতে দেখে খিলখিল করে হাসতে লাগল কথা। নীড়ের চোখ কপালে উঠে গেছে। এই মেয়ে এতটা সাঙ্ঘাতিক ভাবতেও পারেনি সে।
-তুমি মেয়ে মানুষ! সত্যিই তুমি মেয়ে মানুষ! আল্লাহ লজ্জা শরম দেয়নি তোমাকে! তোমার তো চরিত্র ঠিক নেই।’
নীড়ের কথা শুনে কথার হাসি আরও বেড়েই যাচ্ছে। পেটে হাত দিয়ে হাসছে সে। নীড় ফ্যালফ্যাল করে ওকে দেখছে।
-তোমাকে আমি উচিত শিক্ষা দিব বেয়াদব মেয়ে। ফাজিলের হাড্ডি। এসব চিন্তাভাবনা তোমার মাথায় আসে কীভাবে? ডিজগাস্টিং!’
কথা নীড়ের কথা আমলে নিল না। সে বলতে এসেছিল সোহান ভাইয়ের সাথে যেন নীড় একটু ভালো করে কথা বলে। সোহান ভাই তার নিজের ভাইয়ের থেকে কম না। কিন্তু নীড়কে দেখতে দেখতে কথা যে কারণে এসেছিল তা ভুলেই গেল। মনের মধ্যে কতশত বদ বুদ্ধি বুদবুদ করতে লাগল। নীড়কে চোখের সামনে দেখলে কথার সবকিছু এমন এলোমেলো হয়ে যায় কেন? মানুষটা কি কোনোদিনও বুঝতে সে মানুষটাকে নিয়ে কী অনুভব করে! মানুষটা সামনে থাকলে তার দুনিয়া রঙিন লাগে। সবকিছুতেই কেমন ভালো লাগা কাজ করে। আর যখন মানুষটা চোখের আড়াল হয়, তখন সবকিছু অসহ্য লাগে। চোখ দু’টো সব জায়গায় তাকেই খুঁজে। তাকে দেখার জন্য মন ব্যাকুল হয়। কখন বাড়ি আসবে, কখন কথা তাকে দেখতে পাবে এসব ভেবেই অস্থির হয়। এখন তো নীড়ের ধমক মাখানো শাসন গুলোও তার ভালো লাগে। নীড় তাকে ধমকালেও শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। কথা যে মানুষটার প্রতি কী ভীষণ দুর্বল তা যদি এই মানুষটা বুঝতো! কখনও বুঝবে কি? কথা পলকহীন চোখে ড্যাবড্যাব করে নীড়কে দেখছে সে। নীড় এই মেয়েকে নিয়ে মহা বিপদে পড়েছে। এর তো চোখে সমস্যা আছে। কীভাবে তাকিয়ে থাকে তার নিজেরই লজ্জা লাগে। একে ভালো কোন চোখের ডাক্তার দেখাতে হবে। মাথার ডাক্তার না দেখালেও চলবে না।
-কথা। কথা!’
কথার হুঁশ ফিরল। নীড়ের ভাবনা থেকে বের হয়ে কাজের কথায় ফিরল।
-শুনুন, সোহান ভাইয়ের সাথে দেখা হলে আপনি ওর সাথে একটু ভালো করে কথা বলবেন। এটা আপনার কাছে আমার অনুরোধ।’
সোহান ছেলেটার নাম শুনলেই নীড়ের আজ রাগ উঠে যাচ্ছে। এই রাগের কারণ তার অজানা। অনেক ভেবেও কূলকিনারা পায়নি।
-ওর সাথে আমার কথা বলার দরকার কী? আমি কারো সাথে কথা বলতে পারব না।’
-এমন করবেন না প্লিজ। সোহান ভাই আমার বাপের বাড়ির লোক। আজ প্রথম আমার শ্বশুরবাড়িতে এসেছে। আপনি যদি কথা না বলেন তাহলে কষ্ট পাবে।’
-পাক কষ্ট। তাতে আমার কি?’
কথার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে গলা ঠিক রাখছে সে।
-আপনার কিছু না। কিন্তু আমার অনেক কিছু।’
নীড়ের রাগ তিরতির করে বাড়ছে। ওই ছেলের জন্য কথার অনেককিছু! কে হয় ওই ছেলে ওর?
– তোমার অনেককিছু! ওই ছেলে তোমার কে হয়?’
-আমার ভাই।’
-হাহ্ ভাই! কেমন ভাই। আমার জানা মতে তোমার ভাই দু’জন। শিমুল, পলাশ। সোহান তোমার কেমন ভাই? খালাত,মামাত,ফুপাতো, লতাপাতার ভাই!’
কথার গলা ধরে এসেছে। কান্না গিলছে সে। কিছুটা সময় নিল কথা। নীড় কখনও তার অনুভূতির কদর করে না। ওর কষ্টে তার কিছু আসে যায় না।
-সোহান ভাই আমার পাড়ার ভাই। তার সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই। এমনকি কোন আত্মীয়তাও নেই।’
-পাড়াতো ভাই! সংখ্যায় তোমার এমন কয়টা ভাই আছে আমাকে জানাও তো। না, সবাই যদি একদিন করেও আমার বাড়িতে আসে তাহলেও তো…
কথা নীড়কে পুরোটা শেষ করতে দিল না। সোহান ভাই উনার বাড়িতে খেতে আসেনি। এখানে থাকতেও আসেনি। এসেছে শুধু ওকে দেখতে। কে জানত এখানে এসে ওকে ছোট হতে হবে। জানলে কথা কোনোদিনও সোহান ভাইকে এই বাড়িতে আসতে বলতো না।
-বিয়ের পর একটা মেয়ে তার সমস্তটা দিয়ে চেষ্টা করে শ্বশুরবাড়ির মানুষ গুলোকে আপন করে নিতে। শ্বশুরবাড়ির মানুষের মন জুগিয়ে চলতে নিজের শখ আহ্লাদ বিসর্জন দেয়। কিন্তু ছেলেরা তা কখনোই করে না। আপনার বাবা, মা, পরিবার সবাইকে আপন করে নিয়েছি আমি। সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে চাই। কিন্তু আপনি তা পারছেন না। সোহান ভাইকে আমি ভাই মনে করি। হোক সে আমার লতাপাতার ভাই। তার সাথে আমার রক্তের কোন সম্পর্ক না-ই থাকুক। তারপরও বোনকে সুখী দেখতে চায় সে। সে যদি দেখে বোনটা ভালো আছে, সুখে আছে তাহলে সে নিজেও ভালো থাকবে। আপনি এই কথাটা বুঝবেন না। কারণ আপনার তো বোনই নেই। সোহান ভাই সবসময় এসে আপনার বাড়িতে পড়ে থাকবে না। একটা দিন কি আপনি মানুষটার সামনে একটু অভিনয়ও করতে পারবেন না! আপনি আসলে কারো ভালো দেখতে পারেন না। আপনি চান না কেউ ভালো থাকুক। ভীষণ স্বার্থপর আপনি। অন্যকে কষ্ট দিয়ে নিজে ভালো থাকতে চান।’
কথার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। নীড়ের মত স্বার্থপর মানুষ কথা খুব কমই দেখেছে। কথা বুঝতে পারে নীড় ভীষণ কঠিন। তারপরও ওকে ঘৃণা করতে পারে না। ছেড়ে যাবার কথাও ভাবতে পারে না। কথা চলে গেলে নীড় স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল। সে তো এটাই চাইছিল কথা তাকে ভুল বুঝুক। তাকে ঘৃণা করুক। তাকে ছেড়ে চলে যাক। নীড়ের চাওয়া মত এমনটাই হচ্ছে। কিন্তু নীড় তাহলে এখন খুশি হতে পারছে না কেন? কথার চোখের পানি ওকে কষ্ট দিচ্ছে। কথার ঘৃণা ওকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
—————–
নাহিদ চৌধুরী ছেলের বউয়ের কথা মত দুপুরে বাড়ি চলে এসেছেন। ফ্রেশ হয়ে কাপড় পাল্টে এসে সোহানের সাথে অনেকক্ষণ বসে কথা বলেছেন। ওদের দু’জনের সব গল্পই কথাকে নিয়ে। সোহান মনে মনে সত্যিই খুশি হলো কথা শ্বশুর না বাবা পেয়েছে। কিন্তু কথার স্বামীর সাথে এখনও তার দেখা হয়নি। এতটা সময় ধরে এসেছে একবারও নীড় ওর কাছে আসেনি। সোহানেরই যাওয়া উচিত ছিল। কথা টেবিলে খাবার সাজিয়ে ওদের ডাকতে এসেছে। খেতে বসে সোহান দেখল নীড় আসেনি। সে কথাকে আস্তে করে বলল,
-তোর বরটা কই রে? আমার সামনে আসতে লজ্জা পাচ্ছে নাকি?’
কথা কী বলবে? সোহান ভাইয়ের হাসিহাসি মুখটা দেখে তার কান্না পাচ্ছে। কথা ভালো থাকুক খুব কম মানুষই এটা চায়। আর সেই কম মানুষদের মধ্যে সোহান ভাই সবার উপরে। কথা কিছু বলল না। নাহিদ চৌধুরীও কথার চেহারা লক্ষ করলেন। নীড়ের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে উনার।
-আমি গিয়ে ওকে ডেকে নিয়ে আসি কী বলিস।’
-না। তোমার যেতে হবে না। তুমি বসে খাও।’
-দুঃখিত আমার একটু লেট হয়ে গেল।’
নীড়ের গলা শুনে কথা আকাশ থেকে পড়ার মত চমকালো। নীড় সবার সাথে খেতে আসবে কল্পনাও করেনি কথা। নাহিদ চৌধুরীও অবাক হলেন। মনে মনে হাসলেন, বৌমা বাছতে ভুল করেননি তিনি। অন্তত নীড়ের পরিবর্তনই তা বলে দিচ্ছে। সোহান হেসে বলল,
-একটু না, অনেকটাই লেট করে ফেলেছ তুমি।’
প্রতি উত্তরে নীড়ও হাসল। সোহানের পাশের চেয়ারটায় বসল সে। কথা কয়েক মুহূর্ত কিছুই ভাবতে পারল না। এতকিছু শুনিয়ে আসার পরও নীড় এসেছে। সোহান ভাইয়ের সাথে হেসে কথাও বলছে!
আজ অনেকগুলো বছর পরে নীড় বাবার সাথে এক টেবিলে বসে খাচ্ছে। প্রথম দিকে খানিকটা অস্বস্তি লাগলেও সোহানের উপস্থিতিতে অল্প সময়েই তা কাটিয়ে নিয়েছে নীড়। কথার রান্নার হাত বরাবরই ভালো ছিল। সোহান ওর রান্নার প্রশংসা করে থামছে না।
-তোর হাত দু’টো বাঁধিয়ে রাখার মত রে কথা! তুই নিজেও জানিস না কত ভালো রান্না করিস তুই।’
-আমার রান্না অখাদ্য কুখাদ্য হলেও তোমার কাছে ভালো লাগবে।’
-মোটেও না। রাস্তা থেকে অচেনা একজন মানুষ ধরে এনে তোর রান্না খাওয়াই, সে-ও প্রশংসা না করে পারবে না।’
নীড় খাচ্ছে আর মৃদু হাসছে। সোহান আর কথার সম্পর্ক সত্যিই স্পেশাল। নীড়ই ভুল ভেবেছিল। ওদের মাঝে কখনও অন্য কিছু হওয়া সম্ভবই না।
-কী নীড়, তুমিই বলো। তোমার বেগমের রান্নার হাত ভালো না?’
-ভালো।’
-শুধু ভালো! না ভাই, তুমি কিন্তু বড্ড কিপ্টেমি করে ফেলছ।’
-খুব বেশিই ভালো।’
কথা টাস্কি খেয়ে নীড়কে দেখছে। এনার আবার কী হলো আজ! মুখ দিয়ে মধু ঝরছে যেন। কথার প্রশংসা করছে! সজ্ঞানে! বাবাহ!
সোহান কথার সুখের সংসার দেখে খুশি মনে বিদায় নিল। কথার মনটাও বিশেষ একটা কারণে ভালো হয়ে গেছে। রাতে শোয়ার সময় নীড়ের সাথে কোন কথা বলল না। কিন্তু গতরাতের কথা মনে পড়লে এক বিছানায় শুতে ইতস্তত করছে কথা। ঘুমের মধ্যে হাত-পা চালানোর অভ্যাস আছে তার। ভুলেও যদি নীড়কে লাথি ঘুসি মারে তাহলেই হলো! কথাকে মেঝেতে বিছানা করতে দেখে নীড় ভাবল, তার উপর রাগ করে হয়তো কথা এমনটা করছে। তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে কলজে কাঁপানো ধমক দিল নীড়।
-নতুন নাটক শুরু করেছ নাকি? এতদিন তো বেডেই শুয়েছ, আজ নিচে কেন? চাদর বালিশ নিয়ে উপরে আসো। এক্ষুনি। টিপিক্যাল স্বামী স্ত্রীর মত একটু ঝগড়া হলেই মান অভিমানের পর্ব শুরু করে দিও না। আমি কাউকে মানাতে পারব না।’
কথা মিনমিন করে বলল,
-আমি ঘুমের মধ্যে লাথি দিই। তাই নিচে শুচ্ছি।’
নীড় হতভম্ব। গবেট মেয়েটার আজ মনে পড়েছে সে ঘুমের মধ্যে হাত-পা চালায়! যেখানে সে অলরেডি কয়েকদিনই লাথি খেয়ে ফেলেছে।
চলবে_