চুপকথারা_বিষন্ন পর্ব-২১

0
3117

#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ২১|

কলেজে এসে কথা সকাল সকাল ভীষণ বাজে একটা খবর শুনলো। কথাটা শোনার পর রীতিমতো তার হাত পা কাঁপছে। মাঠ থেকে কীভাবে বারান্দা পর্যন্ত এসেছে সে নিজেও জানে না। পা দু’টো অবশ হয়ে গেছে। হাঁটার শক্তিটুকু পাচ্ছে না। গতকাল, হ্যাঁ গতকালও তো মেয়েটা ঠিকই ছিল। ওকে দেখে তো মনে হয়নি কোন বিষয়ে চিন্তিত সে। স্যার যখন কাল ক্লাসে তাকে দাঁড় করিয়েছিল তখনও রুনা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছে। কথার অবশ্য তখন মেয়েটার উপর ভীষণ রাগ হয়েছিল। সে নিজেই পারলে ওকে ছাঁদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিত। কিন্তু তাই বলে মেয়েটা সত্যি সত্যিই ছাঁদ থেকে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করবে! কেন? কী কষ্ট ছিল ওর! রুনার মৃত্যু কথা একেবারেই মেনে নিতে পারছে না। রুনা একটু হিংসুটে ছিল। কথাকে তেমন পছন্দও করতো না। সুযোগ পেলেই ওকে অপমান করত। কথাকে ছোট করার কোন সুযোগ মিস দিত না।
কথা গেট দিয়ে ঢোকার সময় নুড়ি আপাও গাড়ি থেকে নামছিল। ওকে দেখতে পেয়ে ডাকল।

-এই কথা, দাঁড়াও।’

নুড়ি আপার বাবার কয়েকটা গাড়ি আছে। প্রতিদিন ড্রাইভার ওকে দিতে আসে৷ নুড়ি আপা এত ধনী ঘরের মেয়ে তবুও সোহান ভাইয়ের মত অনাথ একটা ছেলেকে ভালোবাসে। যেখানে নুড়ি আপা জানে তার পরিবার কোনোদিনও সোহান ভাইকে মেনে নিবে না। তবুও সে সোহান ভাইকে ছাড়বে না। তার এক কথা, শেষ পর্যন্ত দেখিই না কী হয়! ভাগ্যে থাকলে পাব। না থাকলে তো কিছু করার নেই।

-সোহান ভাই কাল আমার শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল। তুমি জানো?’

-হু।’

-তুমি কবে যাবে? তোমাকে কিন্তু যেতেই হবে।’

-অবশ্যই যাব। তুমি আমার একমাত্র ননদিনী। তোমার শ্বশুরবাড়ি আমিই তো যাব।’

কথা খিলখিল করে হেসে ফেলল। নুড়ি আপা এত ভালো কেন? ওরা হাঁটছিল মাঠে অনেকগুলো ছেলেমেয়েদের একসাথে দেখে নুড়ি আপা এগিয়ে গেল। ওখানে ওর বান্ধবীরাও ছিল।

-কী হয়েছে রে! কিসের মিটিং চলছে?’

-তুই জানিস না?’

-কী জানব?’

-আজ তো মনে হয় ক্লাস হবে না। না হবারই সম্ভাবনা বেশি। কলেজে যা হয়ে গেল! আমাদের কলেজের সুনাম ধুলোয় মিশবে এবার।’

-কী হয়েছে খুলে বলবি প্লিজ।’

-ফার্স্ট ইয়ারের একটা মেয়ে, তোমার ক্লাসেরই তো মেয়েটা কথা। কী যেন নাম? হ্যাঁ, রুনা। তুমি চেনো না?’

কথা মাথা নাড়ল। চিনে সে। কী হয়েছে রুনার?

-কাল কলেজ ছুটির, ধর বিশ মিনিট পর। ছাঁদ থেকে লাফ দিয়েছে।’

নুড়ি বিস্ময়ের সাথে চড়া গলায় বলল,

-কী! কেন? ঝাপ দিয়েছে কেন?’

কথা বিশ্বাসই করতে পারল না রুনা মারা গেছে।

-হ্যাঁ রে। সাথে সাথেই মারা গেছে। পুলিশ তো বলছে সুইসাইড কেস। সবাই ধারণা করছে বয়ফ্রেন্ডের সাথে কোনকিছু নিয়ে ঝগড়া লেগেই এই কাজ করেছে। তোরা কোথায় থাকিস হ্যাঁ? টিভি দেখিস না। পুলিশ, সাংবাদিক এসে নিউজ টিউজ করে একাকার করে ফেলেছে। ওর সবগুলো বান্ধবীর ইন্টারভিউ নিয়েছে। কারো সাথেই ওর তেমন কোন শত্রুতা ছিল না যার কারণে ওকে মেরে ফেলতে হবে। মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড নাকি পালিয়েছে। ওকে পেলেই আসল খবর জানা যাবে।’

নুড়ি নিজের ক্লাসে গেল। কথা কোনোরকমে জায়গাটুকু এসেছে। আচ্ছা মানুষ আত্মহত্যা কেন করে? নিজেই নিজের জীবন শেষ করে দেওয়া এতটাই সহজ! ভয় লাগে না। আত্মহত্যাই তো সবকিছুর সমাধান না। কারো ছাদে যাওয়া নিষেধ। তবুও কথার ইচ্ছে করছিল একবার গিয়ে দেখবে। কিন্তু সাহসে কুলালো না।
নুড়ি ড্রাইভারকে কল করে আবার আসতে বলল। আজ আর কলেজে থেকে কাজ নেই। এই ঘটনার পর কয়দিন ঠিক মত ক্লাস হবে না কে জানে। এই ঘটনা চাপা পড়তে সময় লাগবে। কথা ভয় পেয়ে গেছে। ওকে একা ছাড়া ঠিক হবে না ভেবে সে কথাকে বাড়ি পর্যন্ত নামিয়ে দিল। গাড়িতে কথা থেকে থেকেই ভয় পেয়ে উঠছে। নুড়ি ওর হাত ধরে বলল,

-তুমি ভয় পাচ্ছ কেন পাগল! মেয়েটা বোকা ছিল, তাই এরকম একটা কাজ করেছে। সুইসাইড করে কী পেল? কিছুই না। এখন আরও জাহান্নামে গিয়ে শাস্তি পাবে। তুমি ভয় পেয়ো না।’

নুড়ি কথাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। আজ কথার শ্বশুরবাড়িতে উঠল না৷ কথাও জোর করেনি। সে চোখের সামনে থেকে রুনার চেহারা মুছতে পারছে না। কালও মেয়েটা তাকে নিয়ে ক্লাসের সবার সামনে মজা করেছে। আজ নাকি সে নেই!
খুব পুরোনো একটা স্মৃতি বারবার কথার মনের পর্দায় বেসে উঠছে। সে মনে করতে চাইছে না। তবুও মনে পড়ে যাচ্ছে। সেইদিনের কথা মনে পড়লে কথা স্বাভাবিক থাকতে পারে না। ভয় হয় ওর। একটা সময় এরকম একটা সিদ্ধান্ত সে-ও নিয়েছিল। সেই দিনটা কথার জীবনের সবথেকে ভয়ংকর দিন ছিল। সেই দিনটাকে স্মৃতি থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে চায় কথা।
——————-
দুপুরের পরেও ঘর থেকে বেরোয়নি কথা। রমিজা ডাকতে এসেও ফিরে গেল। এই মেয়েকে এখন আর ভালো লাগে না তার। নতুন বউ অনেক মিথ্যা কথা বলে। এটা সেটা ভুলে যাওয়ার নাটক করে। রমিজার প্রায়ই সন্দেহ হয় নতুন বউয়ের জ্বীন ভূতের আছড় আছে।
সারাটা বিকেলও কথা ঘরেই থাকল। সন্ধ্যার পরে এসে মতিন চাচা কয়েকবার ডেকে গেছে। কথার কিছু হয়েছে ভেবে মতিন চাচা নীড়কে জানিয়ে দিল। নীড় সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ি ফিরে এসেছে। ঘরে এসে নীড় কথাকে দেখে হতভম্ব। এই গরমের মাঝেও কেমন চাদর দিয়ে নাকমুখ ঢেকে শুয়ে আছে। নীড় কথাকে ডাকল।

-কথা। কথা, এই সময় শুয়ে আছ কেন? কী হয়েছে?’

নীড়ের কন্ঠ কানে যেতে কথা কেঁপে উঠল। আরও শক্ত করে চাদর টেনে ধরল। কথা কোন সাড়াশব্দ দিচ্ছে না দেখে নীড়ের বিরক্ত লাগছে।

-এ আবার কী নতুন নাটক! নাটক না করলে তোমার পেটের ভাত হজম হয়না। আস্ত একটা ড্রামা কুইন।’

নীড় চাদর ধরে টান দিয়ে ডাকল।

-কথা, কী শুরু করেছ তুমি! আমাকে রাগালে কিন্তু তোমার জন্য ভালো হবে না।’

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল কথা। নীড় বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। ব্যস্ত হয়ে কথার পাশে গিয়ে বসল। আলতো করে ওর গায়ে হাত রেখে কোমল গলায় ডাকল,

-এই কথা…

-না। না প্লিজ। মারবেন না। আমাকে মারবেন না।’

নীড়ের কপাল কুঁচকে উঠল। কে কথাকে মারবে! কী বলছে এসব ও। জোর করে কথাকে টেনে তুললো নীড়। ঘেমে ভিজে গেছে মেয়েটা। কোন কিছু নিয়ে ভীষণ রকমের ভয় পেয়েছে হয়তো। থরথর করে কাঁপছে ও। নীড় যতই কথার ভয় কমাতে চাচ্ছে ততই কথা নীড়ের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

-আমাকে মারবেন না। আমি কাউকে বলব না। মারবেন না। না…’ চোখ বন্ধ করে আবোলতাবোল বলার পাশাপাশি কেঁদেই যাচ্ছে কথা।

-কথা, চোখ খুলো। দেখো এটা আমি। আমি নীড়। কেউ মারবে না তোমাকে। কাকে ভয় পাচ্ছ তুমি? কে মারবে তোমাকে? আমাকে বলো। আমি আছি তো। ভয় নেই কথা, ভয় নেই।’

-আমাকে ছেড়ে দিন। ছেড়ে দিন।’

কথার এখন বাস্তব কল্পনার হুঁশ নেই। সে নিজেকে আরও অনেক বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই অভিশপ্ত রাতটায় ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। সেসব কথা মনে করেই ভয় পাচ্ছে। নীড় কথাকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। কথার এরকম অবস্থা দেখতে পারছে না সে। কাকে ভয় পাচ্ছে কথা? কেন ভয় পাচ্ছে? নিশ্চয় ওর সাথে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা বাজে ভাবে ওর মনে দাগ কেটে গেছে।
কথার অতীত সম্পর্কে কিছুই জানে না নীড়। কথার সম্পর্কেই কী জানে ও! বিশেষ কিছুই তো না। ওর এত ভয় পাওয়ার কারণ কী। এমনি এমনি কেউ এমন ভয় কেন পাবে?

-কথা, এই কথা! ভয় কিসের তোমার? আমাকে তুমি বিশ্বাস করো না। তোমার কিছু হতে দিব না আমি।’

কথা নীড়ের হাতে চিমটি দিচ্ছে। ব্যথা পেলেও সহ্য করে নিচ্ছে নীড়। হাতপা ছুড়ছে কথা। নীড় কথার পা নিজের পায়ের মধ্যে নিয়ে আটকে ধরলো। নীড়কে জানতেই হবে কথার সাথে অতীতে কী এমনই ঘটে গেছে। সর্বক্ষণ হাসিখুশি থাকা এই মেয়েটা কাকে এতটা ভয় পায়।
কথার জোর শেষ হয়ে আসছে। অচেতন হয়ে পড়ছে সে। তবুও বলে চলছে। তার কথাগুলো অস্পষ্ট।

-মা-মামা আমাকে যেতে দিন। আমি কাউকে বলব না। বাবাকেও বলব না। আমার ভয় লাগছে মামা।’

-মামা! কথা কি কোন মামার কথা বলছে! ওর মামা ওর সাথে কিছু করেছে? হয়তো খুব ছোট বোলয়, কথা যখন অবুঝ..

নীড়ের মাথা ফেটে যাচ্ছে। রাগে সবকিছু ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করছে। কথা কোন মামার কথা বলছে নীড় জানে না। সত্যিই যদি তার ভাবনা মত কথার সাথে কিছু ঘটে গিয়ে থাকে তাহলে ওই লোককে ছাড়বে না সে। ওকে খুঁজে বের করে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে।
নীড়ের কোলেই ঢলে পড়ে গেছে কথা। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে নীড়ের বুকের ভেতরটা ভেঙে চুরমার যাচ্ছে। এই বাড়িতে আসার পর থেকে কথাকে সবসময় হাসতে দেখেছে ও। কোন কারণে মন খারাপ করতে দেখেনি। মেয়েটার আজ এই দশা সত্যিই সহ্য করার মত না।
————
অনেক রাত পর্যন্ত নীড় কথার মাথার পাশে বসে রইল। এক দৃষ্টিতে কথার নিষ্পাপ মুখটার দিকে চেয়ে আছে। কিছুতেই চোখ সরাতে পারছে না। ওর মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কথার ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় আছে। এই মুহূর্তে কথার সাথে এতদিন করে আসা প্রতিটা খারাপ ব্যবহারের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কারণে অকারণে ওকে কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করা। নীড় ভুলেই গিয়েছিল এই মেয়েটাও একজন মানুষ। ওরও একটা মন আছে। সেই মনটা সবার মত না। ভীষণ কোমল।

-তোমার সাথে ভারি অন্যায় করে ফেলেছি, তাই না! কী করব বলো। আমি তো এমনই। তোমার অন্যায় ছিল কেন আমাকে বিয়ে করেছ। আরে এই অন্যায়ের অপরাধী তো আমিও। আমি ছেলে হয়েও কেন বিয়েটা ভাঙতে পারলাম না। তুমি মেয়ে হয়ে কীভাবে পারবে? বাবা নেই তোমার। মা যা বলবে সেটাই তো তোমাকে করতে হবে। এই কথাটা এতদিন আমার মাথায় ঢুকেনি। বড্ড অন্যায় করে ফেলেছি।’

ঘুম ভেঙে কথা যেন নতুন কোন কথা রূপে উঠল। নীড়কে পাশে দেখে ঝট করে সরে গেল ও। নীড়ের চোখটা লেগেই এসেছিল। কথাকে জাগতে দেখে মৃদু হাসল। জিজ্ঞেস করল,

-এখন কেমন লাগছে? ঠিক আছো তুমি?’

নীড়কে দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল কথা। ওর হাসিতে বিদ্রূপ।

-হঠাৎ ওকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে! তুই মানুষটা মোটেও সুবিধার না। তোর থেকে ভালোমানুষি আশা করা যায়না। ওকে নিয়ে ভাবিস না তুই। ওর জন্য আমিই যথেষ্ট। পারলে তুই ওর থেকে দূরে থাকিস। সর্তক করে দিচ্ছি বলা যায়। নইলে পরের বার তোর পরিণতির জন্য তুই-ই দায়ী থাকবি। কথা বড্ড বোকা। যার কারণ তোর মত অমানুষকে ভালোবেসেছে। তোর জন্য এটাই ভালো হবে ওকে ছেড়ে দে তুই।’

চলবে_

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here